You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.07.27 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | মৎস্যচাষ অভিযান | বন্যার ভয়াবহ রূপ | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ২৭শে জুলাই, শনিবার, ১০ই শ্রাবণ, ১৩৮১

মৎস্যচাষ অভিযান

মৎস বিভাগের উদ্যোগে আগামী ১লা আগস্ট থেকে ৭ই আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশের মৎস্য চাষ অভিযান সপ্তাহ উদযাপিত হবে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আনুষ্ঠানিকভাবে এই অভিযান সপ্তাহের উদ্বোধন করবেন বলে সংবাদে প্রকাশ। মৎস্য চাষ অভিযান সপ্তাহের প্রধান লক্ষ্য সম্বন্ধে বলা হয়েছে যে, এই উদ্যোগের মাধ্যমে দেশের অসংখ্য নদ-নদী, পুকুরে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউস জাতীয় মাছ এবং পরিত্যক্ত ধানক্ষেতে তেলাপিয়া মাছের চাষ করে খাদ্যাভাব দূরীকরণের চেষ্টা নেয়া হবে।
মৎস্য চাষ অভিযানকে সাফল্যমন্ডিত করার ব্যাপারে প্রতিটি জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের কাছে বিভিন্ন অনুষ্ঠান সূচি প্রণয়ন করার জন্য নির্দেশও দেয়া হয়েছে। ঢাকায় ইতিমধ্যেই মৎস্যচাষ অভিযান সপ্তাহের অনুষ্ঠানসূচী প্রণয়ন করা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পহেলা আগস্ট শেরেবাংলানগরে, দোসরা আগস্ট বঙ্গভবনে, ৩রা আগস্ট ধানমন্ডি লেকে, ৫ই আগস্ট ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাস্তার পাশে এবং জুরাইনে, ৬ই আগস্ট গুলশানে এবং ৭ই আগস্ট মৎস্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন পুকুরগুলোতে মাছের পোনা ছাড়া হবে এবং প্রতিটি জেলার অসংখ্য পরিত্যক্ত এবং জলমগ্ন ধানক্ষেতে তেলাপিয়া মাছ বিনামূল্যে ছাড়া হবে।
আমরা জানি, মাছে-ভাতে পুষ্ট বাঙালির ঐতিহ্য বহু পুরাতন। নদ-নদী, খাল-বিল-ঝিল পরিবৃত বাংলার জনপদ ছিল সমৃদ্ধ। বৈজ্ঞানিক উপায়ে মৎস্য চাষ পদ্ধতি তাদের জানা না থাকলেও সাধারণ দূরদর্শিতার সৌজন্যেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা মাছের চাষ করতেন। রুই-কাতলা, গজার মাছ লালন করে বড় করতেন। উৎসব-অনুষ্ঠানে বড় মাছের সমারোহে আভিজাত্য ও প্রাচুর্য প্রদর্শন করে গৌরববোধে উদীপ্ত হতেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় সেসব প্রবণতা আমাদের মধ্যে সংক্রমিত হয়নি বা অবস্থান চাপে সংক্রমিত হবার সুযোগ পাচ্ছে না। ফলে একদিকে যখন দেশে আতঙ্কজনক হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে তখন মাছের চাষ দারুণভাবে হ্রাস পাচ্ছে। সেদিকে দৃষ্টি রেখেই সরকারি উদ্যোগে মৎস্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণে মৎস্যচাষ উদযাপন সপ্তাহের পরিকল্পনা সমালোচিত হয়েছে বলে আমরা মনে করি।
একথা অনস্বীকার্য যে জলে নাব্য বঙ্গভূমিতে মাছের চাষ অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ ও লাভজনক। বর্ষা সূচনায় নদীতে যখন নতুন পানি আসে তখন যে ডিমগুলো পুকুরে বা জলাশয়ে ছাড়া হয় তা মাত্র ২-১ মাসের মধ্যে খাওয়ার উপযোগী পোনা মাছের রূপান্তরিত হয়। ওই পোনা মাছ গুলোকে যদি আবার লালন করা হয়–তাহলে মাত্র ৩ থেকে ৫ মাসের মধ্যেই তাঁর প্রতিটির ওজন দাঁড়ায় এক থেকে দেড় পোয়া। এবং একটি পরিবার যদি শুধুমাত্র একটি প্রমাণ সাইজের পুকুরে পরিকল্পিত উপায়ে জীবিকা নির্বাহের উদ্দেশ্যে মৎস্য চাষ করেন তাহলে অনায়াসে নিজস্ব চাহিদা মিটিয়ে ও তার সেই উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। অভিজ্ঞ লোকের অন্ততঃ তাই বলে থাকেন। এমন কি বিদেশের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশকে মৎস্য চাষের মোক্ষম স্থান বলে উল্লেখ করে বলেছেন যে, শুধুমাত্র মাছেই বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে পারেন। আশ্বিন মাসের শেষ বর্ষণে সাধারণত একবার ব্যাপক প্লাবন হয়। সেই সময়ে খাল-বিল, পুকুর উপচে মাছসহ পানি ছড়িয়ে পড়ে মাঠে-ঘাটে ধানক্ষেতে এবং নদীর মোহনায়। যদিও সেই সময় বাইরে থেকেও প্রচুর নানা জাতের মাছ পুকুর ও খাল-বিল, ঝিলে আসে তবু পরিকল্পিত উপায়ে চাষ করা মাছের অধিকাংশ যায় ভেসে। অতএব মৎস্য চাষ উন্নয়ন কর্মসূচিতে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে এবং চাষ করা মাছকে লালন ও রক্ষণাবেক্ষণের কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে। নইলে মাছের পোনা ছাড়া নিরর্থক।
আবার দেখা যায় বর্ষার মৌসুমে চাষকৃত পোনা মাছে বাজার ভরে যায়। আমরা জানি, বহু কাল থেকেই পোনা মাছ ধরা নিষিদ্ধ। তা সত্বেও ব্যাপক পোনা মাছ ধরার প্রকাশ্য কর্ম আজও চলে। মৎস্য চাষ উন্নয়ন প্রকল্পে তাই পোনা মাছ ধরা আইনগত ভাবে নিষিদ্ধ করতে এবং পোনা মাছ শিকারীকে দণ্ড দেয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে। না হলে ফুটো কলসির মত অবস্থা হবে। একদিকে মাছের চাষ করার উদ্যোগ নিলে এবং একদিকে পোনা গুলিকে খেয়ে সাবাড় করে দিলেও উদ্ধৃত কিছুই থাকবে না।
জেলা ভিত্তিতে তেলাপিয়া মাছ ছাড়ার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে–তা প্রশংসার্হ। তবে সাধারণের মধ্যে একটা ভীতি আছে যে–তেলাপিয়া মাছ অন্য পোনা খেয়ে ফেলে। যদি এই ভীতি অমূলক না হয়–তাহলে তেলাপিয়া মাছের চাষের জন্য নির্দিষ্ট পুকুর বা জলাশয় বেছে নেয়াই সমীচীন। তেলাপিয়া মাছ বছরে চার থেকে পাঁচবার ডিম ছাড়ে বলে এই মাছের চাষ খুবই লাভজনক। মাছটি খাদ্যগুণ সম্পন্ন এবং সুস্বাদু । তেলাপিয়া মাছের চাষ পদ্ধতি ও সহজ। ছোট একটি জলাশয়েও মাছ উৎপাদন করা যায়। সে ক্ষেত্রে জেলাগুলিতে বিশেষ সংরক্ষিত জলাশয়ে বা মৎস্য বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন পুকুরে তেলাপিয়া মাছের চাষ বাস্তবায়িত হলে দেশবাসী উপকৃত হবে।
মৎস্য চাষের উদযাপন সপ্তাহের পরিকল্পনার লক্ষ্যে খাদ্যাভাব দূরীকরণের কথা বলা হয়েছে। একথা সত্য যে, দেশে আজ ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি রয়েছে। সে ক্ষেত্রে বিশেষ প্রোটিন যুক্ত খাদ্য হিসেবে মাছের চাষ বাড়াতে পারলে তা দিয়ে আমরা নিজেদের পুষ্টি সরবরাহ ছাড়াও প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারি। অতএব সার্বিক দিক দিয়েই মৎস্য চাষ উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে তা যে শুধু পরিকল্পনা ভিত্তিক বা উদযাপনী অনুষ্ঠান সর্বস্ব না হয়। বাঁচার তাগিদে আজ আমাদেরকে মুখের আহার জোগাড় করে তারই মাধ্যমে সমৃদ্ধিকে ছিনিয়ে আনতে হবে। মৎস্য চাষ অভিযান সপ্তাহের সুদূরপ্রসারী প্রভাবে বাংলাদেশ আবার মাছ সম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে উঠুক, তবেই এই পরিকল্পনার সার্থকতা।

বন্যার ভয়াবহ রূপ

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশুদিন বন্যাকবলিত চাঁদপুর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। চাঁদপুর শহর এখন ভাঙ্গনের মুখে। গত বছর থেকেই এ ভাঙ্গন প্রকট হয়ে উঠেছে। সন্দেহ করা হচ্ছে যেকোন মুহুর্তে চাঁদপুর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যেতে পারে। বঙ্গবন্ধু সরেজমিনে চাঁদপুর থেকে এসে নির্দেশ দিয়েছেন, যে কোনো মূল্যে চাঁদপুর রক্ষা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। চাঁদপুর শহরকে রক্ষার জন্য একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠিত হয়েছে। তারা সম্ভাব্য প্রতিরোধমূলক কর্মপন্থা বের করবেন শহরটি রক্ষার জন্য। এদিকে নদীর ভাঙ্গন এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে প্রতিরোধের ব্যবস্থা করেও শেষ রক্ষা হবে কিনা জোর দিয়ে বলা যায়না। পুরান বাজার ও রেলস্টেশন সম্পূর্ণ বিপদের মুখে। ভাঙ্গনের দরুন বেশ কয়েকটা অংশ ইতিমধ্যেই নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে। এবারের বন্যা বেশ ভয়াল রূপ ধারণ করেছে ইতিমধ্যেই। দেশের অধিকাংশ জেলাই বন্যার কবলে পতিত। ফলে বড় বড় নদীর পার্শ্ববর্তী শহর ও জনপদ ভাঙ্গনের মুখে অনিশ্চিত অবস্থায় রয়েছে। চট্টগ্রাম, ফেনী, ভোলা, পাবনা ও রাজশাহীতে নদী ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। চট্টগ্রামের ওয়াপদার বাধ ভেঙ্গে কুতুবদিয়া দ্বীপের এক বিরাট অংশ পানিতে তলিয়ে গেছে। কুতুবদিয়ায় বানের প্রখরতায় বারো জন মানুষ ভেসে গেছে বলে সংবাদ প্রকাশ। চট্টগ্রামের শঙ্খ নদীর ভাঙনে দোহাজারী ও বৌলতলী ইউনিয়নের আরো একশটি বাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। ফেনী মহাকুমার শুভপুর মুহুরী নদীর ভাঙ্গনে প্রায় অর্ধ মাইল এলাকা ডুবে গেছে। পাবনা জেলায় মোট দুইশত পয়ত্রিশ মাইল বাধ পদ্মা নদীর ভাঙ্গনে ভেঙেছে। পঁয়তাল্লিশটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীর ভাঙ্গনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার ভয়াবহতা শুধু চট্টগ্রামে প্রায় পাঁচশত লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন বন্যা কবলিত এলাকা থেকে শত শত প্রাণহানির খবর আসছে। গতকালের এক খবরে প্রকাশ, বন্যায় এ পর্যন্ত ৬৪ জেলায় দুই কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্থ বন্যা কবলিত জেলাগুলো হচ্ছে রংপুর, পাবনা, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, নোয়াখালী-কুমিল্লা, বগুড়া, ময়মনসিং, টাঙ্গাইল, বরিশাল ও ঢাকা। এর মধ্যে ১২ টি জেলার ক্ষতিগ্রস্থ রিপোর্টে জানা গেছে যে, এ পর্যন্ত ১৩২ কোটি টাকার ফসলই বিনষ্ট হয়েছে। এ ফসল প্রায় দশ লাখ একর জমির। সরকারের কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী জানা গেছে–প্রায় দুই লাখ একর জমির ফসল সম্পূর্ন এবং ছ’লাখ একর জমির ফসল আংশিক ভাবে নষ্ট হয়েছে। এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ফসল নষ্ট হয়েছে সিলেট ও চট্টগ্রামে। শুধু সিলেটের ১৭০ হাজার একর জমির ফসল বিনষ্ট হয়ে গেছে। বন্যার কারণে দেশের প্রায় দেড় কোটি লোক গৃহহারা হয়ে গাছের নিচে বাস করছে। ক্ষতির তুলনায় সাহায্যের পরিমাণ অত্যন্ত কম। সরকার এ পর্যন্ত ৩১ লাখ ৯০ হাজার দুইশত টাকা নগদ অর্থ, ঊনিশ হাজার দু’শত ত্রিশখানা শাড়ি, ১ লাখ ২০ হাজার সাতশ ঊননব্বইটি শিশু পোশাক বরাদ্দ করেছেন। বন্যা কবলিত এলাকায় খাদ্যাভাব ছাড়াও বর্তমানে অসুখ-বিসুখ দেখা দিয়েছে। ত্রাণমন্ত্রীর ভাষায়, ‘এমন বন্যা কোনদিন দেখিনি।’ বস্তুতঃ বন্যার কবলে আজ দেশের কোটি কোটি লোক পতিত হয়ে জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গন বহু পুরনো। পাকিস্তান আমল থেকেই এর সংস্কারের চেষ্টা নেয়া হয়েছিল, কিন্তু আজও তা সফল হয়নি। সিরাজগঞ্জ শহরের ভবিষ্যৎ ও চাঁদপুরের ন্যায় অনিশ্চিত। শুধু চাঁদপুর নয় দেশের যে সকল এলাকায় নদীর ভয়াবহ ভাঙ্গনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে তাকে যেকোন মূল্যেই হোক রোধ করতে হবে। সরকার চাঁদপুরের ন্যায় অন্যান্য স্থানের ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে আমরা আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন