You dont have javascript enabled! Please enable it! Anjali Lahiri | Friends of Bangladesh 1971 (ভিডিও) - সংগ্রামের নোটবুক

Anjali Lahiri | Friends of Bangladesh 1971 (ভিডিও)

অঞ্জলি লাহিড়ী

কলকাতা বিমান বন্দরে দেখি ঢাকা যাচ্ছে বেশ বড় সড় একটা দল । তাদের অনেকে আমার চেনা কলকাতায় আসা যাওয়ার সূত্রে। জানলাম, তারা ঢাকা যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননা’ আনতে। এই সম্মাননা প্রদান কমিটির আমি একজন সদস্য। এঁদের অনেকের নামই হয় আমি না হয় শাহরিয়ার কবির, মফিদুল হক বা লে কর্নেল সাজ্জাদ বীর প্রতীক দিয়েছেন। সবার সঙ্গে কুশল বিনিময়ের সময় পরিচয় হলাে অঞ্জলি লাহিড়ীর সঙ্গে।

অঞ্জলি লাহিড়ীর নাম অনেক শুনেছি। স্মৃতি ও কথা ১৯৭১ নামে তাঁর একটি বইও প্রকাশিত হয়েছিল । মেঘালয় সীমান্তে ১৯৭১ সালে শরণার্থীদের। তিনি ন’টি মাস সেবা করেছেন। তখন তাঁর বয়স ৪৯। এখন তাঁর বয়স ৯১। আমরা যখন তালিকা প্রণয়ন করে খোজ খবর নিই তখন দেখি অনেকেই পরলােক গমন করেছেন। আমরা সৌভাগ্যবান তখনও তিনি বেঁচে ছিলেন। হুইল চেয়ারে বসা, সঙ্গে তাঁর এক পুরনাে ছাত্রী। ঢাকায় যে কদিন ছিলেন দেখা হয়েছে। সামান্য কথা হয়েছে। মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি পরলােক গমন করেছেন। তাঁকে যে আমরা সম্মানিত করেছি, এটি তিনি জেনে গেছেন এই টুকুই যথেষ্ট। 

১৯২২ সালে কলকাতায় জন্ম অঞ্জলি লাহিড়ীর । দশ মাস বয়সে চলে আসেন শিলং। ক্লাস সিক্স পর্যন্ত পড়াশােনা শিলং-এ। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ীতেও পড়েছিলেন এক বছর । শিলং-এ কলেজে পড়েছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি চলে এলেন সিলেট । তাঁর দিদি কল্যাণী সিলেটে তখন রেডক্রসের ডাক্তার। সেখানেই তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন। আই পাস করার পর পড়াশােনা ছেড়ে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৭ সালের পর অবশ্য বিএ পাস করেন।

তখন আসাম গার্লস স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারি ছিলেন। জেল খেটেছেন। আন্ডার গ্রাউন্ডে ছিলেন। বিয়ে করেছেন আইনজ্ঞ নীরেন। লাহিড়ীকে। ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টি ভাগ হলে রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে সমাজ সেবা শুরু করেন। নীরেন লাহিড়ী ছিলেন মেঘালয়ের অ্যাডভােকেট জেনারেল । তিনিও ১৯৭১ সালে শরণার্থীদের সেবা করেন। আমি আগে। জানতাম না অঞ্জলির পৈত্রিক বাড়ি সিলেটে এবং তিনি বিখ্যাত ডাক্তার সুন্দরী মােহন দাসের পৌত্রী । সুন্দরী মােহন ছিলেন বিপিন পালের স্কুল বন্ধু।

অঞ্জলি লাহিড়ী সেলা, বাঁশতলা, দোয়ারা বাজার, মাইলাম, টেংরিটিলা পালের শরণার্থী শিবির ও ক্যাম্পে কাজ করেছেন। তাঁর বইয়ে সেই সব স্মৃতির কিছু অংশ বিধৃত হয়েছে। 

“লম্বা ব্যারাকের ফাটা বাঁশের ভেতর দিয়ে গ্রীষ্মের কাঠফাটা রােদুর ঘরের ভেতরটা তাতিয়ে তুলেছে। দম যেন বেরিয়ে আসার যােগাড়। মাচার এককোণে গােটা তিন ছােট ছােট শিশু (ওঁদের নাতি, নাতনি) একনাগাড়ে কেঁদে চলেছে। গত এক মাসের ওপর থেকে ওরা আমাশয়ে কাহিল, হাড়ি জিরজিরে শরীর। ক্যাম্পের চতুর্দিকে কলেরা আর আমাশয়। পুরাে ঘরটা মাছিতে হেঁকে ধরেছে। বাচ্চাগুলাের চোখ-মুখ মাছিতে ঢাকা। বেড়ার ওপাশে একপাল ছােট ছােট ছেলেমেয়ে। তারাও তারস্বরে চিৎকার করে বিচিত্র ঐকতানের সৃষ্টি করেছে। সবাই পেটের ব্যথায় ভুগছে। চারদিকে প্রচণ্ড শব্দ, মানুষের কাতরানি আর কান্নার আওয়াজ। এই দুস্থ রােগজীর্ণ মানুষগুলাে যেন একদলা আবর্জনার মতােই অর্থহীন। এরা কি সেই একই মানুষ, যারা কোনােদিন শিল্পকলা সৃষ্টি করতাে, গান গাইতাে, লােকনৃত্যের নানা ভঙ্গিমায় জীবনটাকে সরস করে তুলতাে! কোন অশুভশক্তির পাপ স্পর্শে মানুষ আজ মানুষের অপভ্রংশে পরিণত হয়েছে!

মাসিমার পাশের ব্যারাকের একটিতে থাকে এক মুচি পরিবার, অন্যটিতে এক মেথর পরিবার। তাদের প্রতিটি খুপরিতে দশ বারােটি করে বাচ্চা। সবাই যেন কমপিটিশন দিয়ে চিৎকার করে চলেছে।

ব্রাহ্মণ, চণ্ডাল সবাই আজ মিলেমিশে একাকার। এই বিপর্যয়ের দিনে মানুষে মানুষে যে মিলন ঘটল এটা কি স্থায়ী রূপ নেবে?

মাসিমার সঙ্গে আরেকটি খুপরিতে গিয়ে চমকে উঠলাম । ষােল সতেরাে বছরের একটি মেয়ে প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় বসে আছে । দুতিনটে হেঁড়া গেঞ্জি যােগাড় করে তালি লাগিয়ে একটা আচ্ছাদন তৈরি করার চেষ্টা। আমাকে দেখেই গৌরচন্দ্রিকা ছাড়াই প্রথম কথা, ‘দিদি একটা শাড়ি দেবেন? মাথায় জট পড়ে গেছে, শরীরের রুক্ষ চামড়া যেন ফেটে পড়বে। লজ্জা লজ্জা মুখ। করে বলল, দুসপ্তাহ স্নান করিনি, পরনে শাড়ি নেই, নদীতে যাই কেমন করে, লজ্জা করে ।

হঠাৎ পা দুটো জড়িয়ে ধরে আমার। ঘর গেরস্তালির দিকে তাকানাে যায় না, যেন এক আঁস্তাকুড়।”

শরণার্থী শিবিরে যখন মহামারী দেখা দিয়েছিল তখনও সেবা করে গেছেন অঞ্জলি লাহিড়ী। সে রকম একটা বর্ণনা

“রাকেশ বাবুর দিকে তাকিয়ে দেখি । এখনও শিরদাঁড়া কেমন খাড়া করে রেখেছেন। এ রকম মৃত্যুহীন প্রাণ দু’চারটি না থাকলে কারা মূঢ় মূক। মুখে ভাষা যােগাবে? প্রাপ্য অধিকারের জন্য দাবি জানাবে?

ওঁকে সঙ্গে নিয়ে চললাম ছাউনি থেকে ছাউনিতে । সেদিন সকালের মধ্যে দুশাে লােক কলেরায় মারা গেছে। মহামারী দেখা দিয়েছে মাইলামে। স্যালাইন নেই, রেডক্রস যে ডাক্তার পাঠিয়েছে তা সমুদ্রে বিন্দুবৎ। ওরা হিমশিম খাচ্ছে। একটা ছাউনিতে ঢুকে দেখি এক সৌম্য চেহারার বৃদ্ধ এক। বদনা জল নিয়ে মাটিতে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছেন। জিজ্ঞেস করতে বললেন, আল্লাহ আমারে না লইয়া এইসব কচি ছাওয়ালগুলারে নেয় ক্যান?। কাল বৌ গেছে, বড় পুলা দুটা, নাতি-নাতনি গেছে। আঙুল দিয়ে দেখালেন, ‘ঐ যে বড় নাতনি আমিনা, আজথনে তারও দাস্ত বমি।

দেখি বাঁশের চাঙের উপর শুয়ে আছে এক পরমা সুন্দরী কিশােরী। মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে অজানুলম্বিত একমাথা ঘন কালাে চুল। টিকল নাকে একটা সাদা পাথরের নাকছাবি আলাে পড়ে চকচক করছে। আয়ত ডাগর দুখানি চোখ । আমাকে দেখেই দুহাতে জড়িয়ে ধরলে, মাসিমা আমারে বাঁচান। আমি মরতে চাই না। দুচোখের সেই করুণ আকুতি আমার স্মৃতিপটে চিরদিন অক্ষয় হয়ে থাকবে। কিন্তু না, স্যালাইন ছিল না। তাঁকে বাঁচাতে পারিনি। তার ডাগর দুখানি চোখ বােধ হয় শেষ পর্যন্ত শকুনেই খুবলে খেয়েছিল ।

বাতাসে গন্ধ। মহামারীর গন্ধ। ক্ষুধার গন্ধ, অনিঃশেষ বেদনার জমাট বাধা নােনা চোখের জলের গন্ধ । অজস্র বুকফাটা কান্নার নাগপাশ থেকে কানে আঙুল চেপে পালাতে চাইলাম।

রাকেশ বাবু অনেক হয়েছে আজকের মতাে। আর পারছি না। উনি একটু অনুকম্পার হাসি হাসলেন। ‘দিদি এত রাত্তিরে তাে শিলং ফিরে যেতে পারবেন না। সারাদিন পেটেও কিছু পড়েনি। খালি পেটে কলেরা রােগীর মধ্যে ঘােরা ঠিক না।। ক্যাম্পের সব ছেলেগুলাের চোখ উঠেছে। সমানে জল পড়ে আর অসহ্য ব্যথা। এখানকার লােকেরা এই রােগের নাম দিয়েছে ‘জয় বাংলা’। রাকেশ বাবু হাসলেন।”

Reference: ভিনদেশিদের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসির মামুন, pp. 50-53