You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ২৯শে জুলাই, সোমবার, ১২ই শ্রাবণ, ১৩৮১

পাকিস্তানের বিভ্রান্তিকর প্রচার

জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী পর্যবেক্ষক জনাব এস,এ, করিম গত ২৭শে জুলাই এক অভিমতে উল্লেখ করেছেন যে, পাকিস্তানের একগুঁয়েমির জন্যেই বাংলাদেশ-পাকিস্তান আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। সম্প্রতি আনীত পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব আজিজ আহমেদের অভিযোগের উত্তরে তিনি এ কথা বলেন। আজিজ আহমেদের অভিযোগ ছিল -বাংলাদেশ নিজেদের কয়েকটি প্রস্তাবের ব্যাপারে খুব বেশি প্রত্যাশা করে এবং কতিপয় বিষয়সম্পত্তি অবিলম্বে স্থানান্তরের দাবি জানায়। জনাব এস,এ, করিম বলেন–কিছুদিন আগে প্রকাশিত এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জনাব আজিজ আহমেদ এক মুখে দুই কথা বলেছেন। একদিকে তিনি দু’দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত ঢাকা বৈঠক সফল হয়েছে বলেন অন্যদিকে তিনি দ্বিপাক্ষিক প্রশ্নে বাংলাদেশের ভূমিকা সম্পর্কে দোষারোপ করেন। জনাব করিম এ ধরনের মন্তব্যকে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। তার মত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জনাব ভুট্টো বাংলাদেশ সফর দু’দেশের অমীমাংসিত সমস্যা সমাধানের এক বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছিল কিন্তু পাকিস্তানের একগুয়েমির জন্যেই সে সুযোগ নষ্ট হয়ে যায়।
নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে পাকিস্তানি এই মর্মে আশ্বাস আশ্বাস দিয়েছিল যে, দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের সময় বাংলাদেশ-পাকিস্তানের অমীমাংসিত প্রশ্নের সুরাহা করা হবে। জনাব করিম এ কথা উল্লেখ করে বলেছেন–এ কারণে বাংলাদেশ আশা করেছিল যে জনাব ভুট্টোর সফরের সময় দু’টি দেশের প্রধান প্রধান অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান হবে। বিশেষ করে বিষয় সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা ও পাকিস্তানীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নের সমাধান হওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। ঢাকা বৈঠকের সময় পাকিস্তান নীতিগতভাবে ‘সাবেক পাকিস্তানের’ বিষয় সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা মেনে নেবে বলে বাংলাদেশ আশা করেছিল কিন্তু তা হয়নি। যদি পাকিস্তান নীতিগতভাবে ভাগবাটোয়ারার ব্যাপারটি মেনে নিত তাহলে এ ব্যাপারে একটি যৌথ কমিটি গঠন করে বিস্তারিত বিষয় খুঁজে বের করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেত। এবং যে সমস্ত সম্পত্তির পরিমাপ করা যায় না যেমন-বৈদেশিক মুদ্রা, পুরাতন রিজার্ভ, জাতীয় শিপিং কর্পোরেশনের জাহাজ ও বাণিজ্যিক বিমান প্রভৃতির ব্যাপারে একটা মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হলে বিষয়টির দ্রুত বাস্তবায়ন সম্ভব হতো। অথচ এক্ষেত্রে পাকিস্তানের নীতি ছিল-‘আদৌ যদি কোনো ভাগ বাটোয়ারা হয় তাহলে বিষয়টি একটি যৌথ কমিটি বিবেচনা করে দেখবে।’ পাকিস্তানিদের দেশে ফেরার প্রশ্নেও পাকিস্তান নেতিবাচক ভূমিকা নিয়েছিল। সাতষট্টি হাজার পরিবারভুক্ত তিন লাখ লোকের এক্ষেত্রে পাকিস্তান বাস্তব প্রস্তাব পেশ করবে বলে বাংলাদেশে যে আশা পোষণ করেছিল তাও পাকিস্তান করেনি। এতদ্বসত্ত্বেও বাংলাদেশ একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পূর্ব ঘোষিত নীতিতে অটল রয়েছে বলে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক জনাব এস, এ করিম তার অভিমতে উল্লেখ করেছেন।
সম্প্রতি পাকিস্তানের বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাও গত বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বৈঠকের উপর উদ্ভট মনগড়া নিবন্ধ প্রকাশ করে চলেছে। ‘পাকিস্তান টাইমস’ সরকারি মুখপত্র। কয়েকদিন পূর্বে পত্রিকাটিতে আপত্তিকর একটি সংবাদ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে-বাংলাদেশ নাকি পাকিস্তানের কাছে সম্পত্তি দাবি করেছিল–পত্রিকার মতে এটা উদ্ভট একটি দাবি। জনসংখ্যার ভিত্তিতে দাবীর পরিমাণ নির্ধারণ আরও হাস্যকর। নিবন্ধে আরো বলা হয়েছে–‘বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছ থেকে খেসারত নিয়ে তার পতনোন্মুখ অর্থনীতিকে কুলে ভিড়াবার স্বপ্ন দেখছে।’ এধরনের আরো আপত্তিকর মন্তব্য ফেঁদে নিবন্ধে দু’দেশের সম্পর্ক তিক্ত করার ইন্ধন দেয়া হয়েছে। ঘোষিত পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের যে সকল বিরাজমান সমস্যা রয়েছে তার শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়ত সমাধান আমরা আশা করি। উভয় দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এটা আবশ্যক। পাকিস্তান যদি একগুঁয়েমি করে সমস্যা সমাধানের সুযোগ বন্ধ করে দেয় তাহলে তা উপমহাদেশের শান্তি ও প্রগতির পথে অন্তরায় হবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বাংলাদেশ সফরে এসে জনাব ভুট্টো যে সুযোগ সৃষ্টি করতে পারতেন তা তিনি করেননি। একটা মীমাংসার পথ খুঁজে বের করতে তিনি আগ্রহী হননি। কেন আগ্রহী হননি আমরা জানি না। তবে অতীতের পাকিস্থানে আমরা দেখেছি পাকিস্তান বা তার নেতারা নিজের ইচ্ছায় চলেন না, তাদের মুরুব্বিদের ইঙ্গিতে তারা উঠেন এবং বসেন। হয়তো তাদেরই কারো ইঙ্গিতে জনাব ভুট্টো বাংলাদেশের সঙ্গে আপোষে রাজি হননি। অথচ আমরা আজও আগ্রহী একটা সুষ্ঠু মীমাংসার জন্য। উপমহাদেশের শান্তি, সহযোগিতা ও মৈত্রীর বন্ধন সুদৃঢ় করার জন্য। ভবিষ্যতে জনাব ভুট্টো বিভ্রান্তিকর প্রচার ছেড়ে সেটা বুঝতে সক্ষম হবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।

পর্তুগিজ উপনিবেশ সমূহের স্বাধীনতা

পর্তুগালের নিজের রয়েছে বহু দিনের অমীমাংসিত নানা সমস্যা। দীর্ঘদিন সামরিক শাসনের ধকল কাটিয়ে উঠতে তাদের খুব কম কাঠ-খড় পোড়াতে হবেনা। নয়া সরকার তা বোঝেন আর তাই আফ্রিকায় পর্তুগালের উপনিবেশ গুলোর ব্যাপারে তারা যে নূতন করে সমস্যা সৃষ্টিতে খুব একটা আগ্রহী হবেন না তা মোটামুটি গত এপ্রিলে অভ্যুত্থানের পর আঁচ করা গিয়েছিল। ক্ষমতা দখলের অব্যবহিত পর তাই অভ্যুত্থানের নায়ক স্পিনোলা ঘোষণা করেছিলেন অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক এবং গিনি-বিসাউ এর মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রদানের কথা। অবশ্যই এটা একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে এগোবে। সেখানকার প্রতিনিধিত্বশীল নেতৃত্তের সাথে এ ব্যাপারে সমঝোতায় আসার পদক্ষেপও স্পিনোলার তরফ থেকে নেয়া হবে। পর্তুগালের সমাজতন্ত্রী নেতা সোরেস অ্যাঙ্গোলা, গিনি-বিসাউ এবং মোজাম্বিকের গেরিলা নেতৃবৃন্দের সঙ্গে স্পিনোলারর ইচ্ছা অনুসারেই কয়েক দফা আলোচনায় মিলিত হন। প্রথম দিকে পর্তুগাল সরকারের সাথে কোন কোন প্রশ্নে তাদের মতানৈক্য হলেও এবং সম্পূর্ন স্বাধীনতার ব্যাপারে স্পিনোলার কিছু বক্তব্য তাদের সন্দেহ সংশয়ের উদ্রেক হলেও পরবর্তীকালে তার একটা সমঝোতায় উপনীত হতে পেরেছেন বলে অনুমান করা চলে।
উপনিবেশগুলোতে বসবাসকারী শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা ‘কালোদের’ শাসন ক্ষমতা লাভের সম্ভাবনাকে স্বাভাবিকভাবেই খুব একটা ভালো চোখে দেখছিলেন না। সেখানে পর্তুগালের স্বার্থরক্ষার নামেই বস্তুতঃ পূর্ববর্তী শাসকদের দ্বারা অনুপ্রাণিত এবং সাহায্যপুষ্ট হয়ে তারা উপনিবেশগুলোতে ঘর বেঁধেছিলেন। বিগত দিনে পর্তুগালের সামরিক বাহিনীর অত্যাচার এবং নির্যাতন পরিচালনায় এদের অবদান কিছু কম ছিলনা। বিশেষ করে সেখানকার জনসাধারণকে অর্থনৈতিক শোষণের রজ্জুতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার ব্যাপারে এরাই পর্তুগালের ফ্যাসিস্ট সরকারের সবচাইতে বিশ্বস্ততার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করেছে। উপনিবেশ গুলির স্বাধীনতা প্রদানের প্রশ্নে তাই তাদের বক্তব্য অত্যন্ত নেতিবাচক।
ইতিমধ্যেই পর্তুগালের চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের ইঙ্গিতে এবং সম্ভবতঃ উপনিবেশগুলির পার্শ্ববর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণ বৈষম্যবাদী সরকারের মদদ পেয়ে শ্বেতাঙ্গরা বিভিন্ন স্থানে দাঙ্গা ঘটাবার প্রচেষ্টা চালায়। এমনকি এই উপনিবেশগুলোতে শ্বেতাঙ্গরা রোডেশিয়া রায়ান স্মিথের মত একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণার পরিকল্পনা করছে বলেও আফ্রিকান গেরিলারা অভিযোগ করেছে।
এমতাবস্থায় জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট অ্যান্টোনিও স্পিনোলা আফ্রিকার উপনিবেশগুলোর পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদানের যে অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন তা আফ্রিকা কেন সারা দুনিয়ার স্বাধীনতাকামী মানুষকে আশ্বস্ত করবে। গত ২৭শে জুলাই-এর বেতার ভাষণে তিনি বলেছেন আফ্রিকান ভূখণ্ডের জনসাধারণ এখন আপন ভবিষ্যত নির্ধারণে সম্পূর্ণ সক্ষম। তার সরকার মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা ও গিনি-বিসাউ-এই তিনটি আফ্রিকান উপনিবেশকে স্বাধীনতা প্রদানের প্রস্তুতি গ্রহণ করছে।
আমরা দীর্ঘদিন সংগ্রামরত এ তিনটি দেশের স্বাধীনতাকামী মানুষকে তাদের স্বাধীনতা লাভের ঊষালগ্নে অভিনন্দন জানাই। একই সঙ্গে তাদের একটি ব্যাপারে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি; আর তা হলো সেখানে বসবাসরত প্রতিক্রিয়াশীল শ্বেতাঙ্গ অধিবাসী ও তাদের আন্তর্জাতিক মুরুব্বীদের সম্ভাব্য ষড়যন্ত্র। কোন প্রকার হঠকারী পদক্ষেপ এই মুহূর্তে সেখানকার সাধারণ মানুষের চরমতম ক্ষতি করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সাধারণতঃ জনসাধারণের একটি অংশকে অন্য অংশের বিরুদ্ধে ধর্ম-কর্ম ইত্যাদির ভিত্তিতে প্ররোচিত করার নীতি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র কারীরা গ্রহণ করে অর্থাৎ সংগ্রামী নেতৃত্বকে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণের দিকে ঠেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। আমরা বিশ্বাস করি মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা এবং গিনি-বিসাউ এর সংগ্রামী নেতৃত্ব তাদের অভিজ্ঞতা থেকেই এসবের দিকে অত্যন্ত সতর্ক দৃষ্টি দেখে অগ্রসর হবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!