বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১লা ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার, ১৮ই মাঘ, ১৩৮০
জোট নিরপেক্ষ নীতির বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ
বাংলাদেশে পাঁচ দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছেন মহামান্য যুগোস্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল ব্রোজ টিটো। মার্শাল টিটোর এই বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। তিনি বাংলাদেশ আসবার পূর্বে ভারত সফর করেছেন। ভারত-বাংলাদেশ মিলিয়ে মার্শাল টিটোর এই উপমহাদেশ সফর অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব বহন করছে বলে আমাদের ধারণা।
আমাদের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান গত পরশু সন্ধ্যায় মার্শাল টিটোকে এক ভোজ সভায় আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ভোজ সভায় তিনি যে ভাষণ দান করেছেন তা আমাদের পররাষ্ট্রনীতির প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত অর্থবহ। মার্শাল টিটো আহ্বান জানিয়েছেন জোট-নিরপেক্ষ রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে সমঝোতা বৃদ্ধির জন্য। তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। জোসেফ টিটো আরও উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের পর যুগোস্লাভিয়ার জনগণ একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের সে সকল প্রতিবন্ধকতাও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে। প্রেসিডেন্ট টিটো বিশ্বশান্তির স্বার্থে এই অঞ্চলের স্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রয়োজন রয়েছে সে কথাও জোর দিয়ে উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের সঙ্গে যুগোস্লাভিয়ার সম্পর্ক বন্ধুত্ব, পারস্পরিক সমঝোতা, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ, সাম্য ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর প্রতিষ্ঠিত।
জোট নিরপেক্ষ নীতির কথা বলতে গিয়ে মিঃ টিটোর আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ দেশ সমূহের সম্মেলনের কথা স্মরণ করেছেন। তিনি আন্তর্জাতিক উত্তেজনার অবসান, বিশ্বের অনিশ্চয়তা এবং সংকটের উৎসগুলোকে দূর করে উত্তেজনা প্রশমনে একজন শান্তিকামী ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহের সহযোগিতায় জোট নিরপেক্ষ দেশ গুলোকে আরো সম্মিলিত ও সক্রিয়ভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। বাংলাদেশের সকল যুগোস্লাভিয়ার সম্পর্ক আরো দৃঢ় ও মজবুত হোক আন্তরিকভাবে তিনি তা কামনা করেছেন।
পূর্বাহ্নেই আমরা উল্লেখ করেছি- মার্শাল টিটোর এই ভারত উপমহাদেশ সফররত গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ। জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির প্রথম সারির উদগাতা মার্শাল ব্রোজ টিটো। তিনিই জোটভুক্ত না হয়েও যে দেশের ও জাতির কল্যাণ সাধন করা যায় তা প্রমাণ করেছেন। বিশ্ব যখন সাম্রাজ্যবাদ ও সমাজবাদের বিশ্বে বিভক্ত হয়ে পড়ছে তখন যুগোস্লাভিয়া জোটভুক্ত না হয়েও সমাজবাদের পথে অগ্রসর হবার চিন্তা করেছিলেন। সিয়াটো- সেন্টো থেকে দূরে থেকে তিনি তার জাতির কল্যাণে ব্রতী হতে পেরেছিলেন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির দাবা খেলার শিকার হোক এটা শান্তিকামী মানুষ অবশ্যই আশা করে না। সর্বোপরি সমাজবাদের পথে অগ্রসর হবার নিমিত্ত কোন ব্যক্তির সঙ্গে আঁতাতবদ্ধ না হবার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। জোসেফ ব্রোজ টিটো জোট নিরপেক্ষতাকে আমাদের সরকার গ্রহণ করেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে বারবার উল্লেখ করেছেন বাংলাদেশে কোন জোটভুক্ত নীতির অনুসারী নয়- বরং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির অনুসারী। আদর্শগতভাবে বাংলাদেশ সমাজবাদী রাষ্ট্রগঠনের প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অতএব যুগোস্লাভিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও মজবুত ও দৃঢ় হতে বাধ্য বলে আমরা মনে করি। আমাদের চলার পথে যুগোস্লাভ নীতি ও পদ্ধতি অন্যতম সহায়ক হতে পারবে বলেও আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
আফ্রিকায় স্বাধীনতার জাগরণ এবং ডঃ ওয়াল্ডহেইম
জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ ওয়াল্ডহেইম বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের ঘূর্ণিপাকে পড়ে আফ্রিকার বৃহত্তম সমস্যা যেন কুয়াশাচ্ছন্ন না হয় পড়ে। আফ্রিকায় উপনিবেশবাদ এবং বর্ণ বৈষম্য বিরোধী সংগ্রাম এক নতুন দিগন্তের উপনীত হয়েছে বলে মহাসচিব মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। ডঃ ওয়াল্ডহেইম ২৪ জাতি কমিটির বিশেষ উপনিবেশবাদ অবসানে প্রথম সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে উচ্চারণ করেছেন যে, আফ্রিকার জাতীয় সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম শতাব্দী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসে ঘটনাবলীর অন্যতম। মহাসচিব আরো বলেছেন, আফ্রিকার স্বাধীনতার জাগরণ এবং মুক্তিসংগ্রামকে কিছুতেই রোধ করা যাবে না। তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক সমঝোতার ভিত্তিতে আফ্রিকায় যদি সত্যিকার শান্তি অগ্রগতি সাধিত না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে রক্তপাত, তিক্ততা ও দুর্দশা থেকে কোনো বাঁচোয়া নেই। ডঃ ওয়াল্ডহেইম আফ্রিকার বর্তমান পরিস্থিতিকে শান্তির পক্ষে এক বিরাট হুমকি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই হুমকি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিকেও নাড়িয়ে দেবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেছেন।
একথা অনস্বীকার্য যে, আফ্রিকার নিপীড়ন, নির্যাতন ও বর্ণবৈষম্যবাদের এক হোলি খেলা শুরু হয়েছে। এই দমন নীতির বিরুদ্ধে আফ্রিকায় যে প্রতিরোধ সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠেছে, তাও আজ এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিবের উদ্বেগ আকুল পরিস্থিতি সম্পর্কে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের আবর্তে আফ্রিকার প্রধান সমস্যা ধামাচাপা দেয়া যাবে না। শান্তির স্বার্থেই আফ্রিকাবাসীর দিকে এবার দিব্যদৃষ্টি মেলে তাকাতে হবে, সমস্যার গ্রন্থি করতে হবে উন্মোচন। আফ্রিকান জনগণের সংগ্রাম বৈদেশিক আধিপত্য থেকে মুক্তির সংগ্রাম। আফ্রিকান জনগণ নিজস্ব স্বাধীন জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে লিপ্ত। অ্যাঙ্গোলা মোজাম্বিকে পর্তুগিজ উপনিবেশবাদীরা আফ্রিকান জনগণের ওপর নানা রকম নির্যাতনের স্টিমরোলার চালাচ্ছে। লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন মূলক ব্যবস্থা আফ্রিকার স্বাধীনতাকামী জনজীবনকে নির্মমভাবে পর্যদুস্ত করে চলেছে। পর্তুগিজ শোষকরা সভ্যতার নামে ঘৃণ্য বর্ণবৈষম্যবাদের হিংস্র নীতি অবলম্বন করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের নিপীড়নকে চাঙ্গা করার জন্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো যোগাচ্ছে প্রভূত ইন্ধন। এ অবস্থায় কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকা বাসীদের জীবনে নিরাপত্তাহীনতা জাগ্রত হয়ে উঠেছে। আফ্রিকাকে প্দানত করে রাখার জন্য বর্ণবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সম্মিলিতভাবে আগ্রাসন চালাচ্ছে। ব্যাপক গণজাগরণ এবং উত্তাল মুক্তিযুদ্ধের জোয়ারে তাই আফ্রিকানরা দিন দিন প্রতিরোধের দুর্গ গড়ে তুলছে। আফ্রিকার মুক্তিকামী জনগণ আজ শত্রুর নৃশংসতাকে নস্যাৎ করার জন্য সহিংস ও সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছে। এ্যাঙ্গলো মোজাম্বিকে তাই মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসের তাৎপর্যময় ঘটনায় রূপান্তরিত হয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ ওয়াল্ডহেইম তাই বর্ণবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়াকু আফ্রিকান মুক্তিকামীদের প্রতি দৃষ্টি দিতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেছেন, আফ্রিকার মহাসমস্যা অন্য কোনো সমস্যার আবর্তে চাপা পড়ে আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হবে না। ডঃ ওয়াল্ডহেইম শান্তির স্বার্থেই এ কথাগুলো বলেছেন। আফ্রিকান সংগ্রামীদের প্রতি তার সহানুভূতি এ বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বর্ণবাদী এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো ডঃ ওয়াল্ডহেইমের বক্তব্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে কিনা এটাই এখন মূল সমস্যা। সমঝোতার মাধ্যমে যদি আফ্রিকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব না হয়, তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়াটাই স্বাভাবিক। ডঃ ওয়াল্ডহেইম আফ্রিকানদের মুক্তিসংগ্রামকে রোধ করা যাবে না বলেও মন্তব্য করেছেন। মুক্তি সংগ্রামের দুর্বার অভিযানকে আজকের বিশ্বে রোধ করাটাও সহজ নয়। বিশ্বের মুক্তিকামী জনতার কোনদিন পরাজয় ঘটেনি। সমগ্র বিশ্বব্যাপী আজ মুক্তি সংগ্রামীদের জয়জয়কার ঘোষিত হয়েছে। মুক্তি সংগ্রামী রা শৃংখল বন্ধনের রজ্জূ থেকে একদিন না একদিন মুক্তির আলোকে স্পর্শে উজ্জীবিত হবেই। আফ্রিকার বুক থেকেও বর্ণবৈষম্যবাদের ঘৃণ্য থাবাকে একদিন হাত গোটাতে হবেই। এবং সেদিন বেশি দূরে নয়। ধর্মের নামে, গোত্র কিংবা বর্ণের নামে মানুষকে আজ আর পদানত করার দিন নেই।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক