বাংলার বাণী
ঢাকা : ১লা জানুয়ারী, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ১৬ই পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
গত বছরের অভিজ্ঞতায় এ বছরে নতুন প্রত্যয়ে এগোতে হবে
আজ ঊনিশশ’ চুয়াত্তর সালের প্রথম দিবস। ঊনিশ শ’ তিয়াত্তর পেরিয়ে এসে আমরা আজ চুয়াত্তর পদার্পণের এই মুহূর্তে অতীতের সকল ঘটনাপ্রবাহের কথা স্মরণ করছি। সঙ্গে সঙ্গে নতুন ইংরেজী বছরের শাশ্বত বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেবার মনোবল আমাদেরকে অর্জন করতে হবে। অভিজ্ঞতা থেকে ভবিষ্যতকে আমাদের নতুন প্রত্যয়ে গ্রহণ করতে হবে। একটি বৎসর আমাদের জাতীয় জীবনে অনেক শিক্ষা দিয়েছে। সেই শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা আমাদের নতুন বছরের চলার পথের পাথেয়। ১৯৭৩ সাল শুধু আমাদেরই নয়, বিশ্বের সকল দেশের জন্যেই একটি উল্লেখযোগ্য বছর ছিল। বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামাজিক পটপরিবর্তনের একটা উল্লেখযোগ্য বছর ছিল ১৯৭৩। আন্তর্জাতিক শান্তি আন্দোলনের একটা চূড়ান্ত রূপরেখাও নির্নিত হয়েছে গত বছর। সেই সঙ্গে গত বছরে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলনেরও একটা বিশ্বব্যাপী সাড়া পাওয়া গেছে। ১৯৭৩ সালের সেই সকল অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের উপর প্রভাব বিস্তার করেছে তা আজ নতুন বছরের নতুন দিনে অবশ্যই পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
গত বছরের নানা ভুল-ক্রুটিই আমাদের এই নতুন বছরের সঠিক পদক্ষেপে নতুন দীক্ষা দেবে। গত বছরের বিভিন্ন ক্রুটি-বিচ্যুতি এ বছরে শুধরিয়ে নিবে আমাদেরকে নতুন উদ্যমে সামনের দিকে এগোতে হবে। গত বছর যে কাজটি করতে গিয়ে আমরা ব্যর্থতা প্রদর্শন করেছি এই নতুন বছরে তাকে সার্থক করে তোলার শপথ নিতে হবে। এই নতুন বছরে অবশ্যই আমাদেরকে নতুন শপথ গ্রহণ করতে হবে এগোতে হবে সামনের দিকে। জাতীয় অগ্রগতির কাজের যে সকল ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের যথার্থ পারদর্শিতা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছি সে সকল ক্ষেত্রে অবশ্যই আমাদেরকে যোগ্যতা প্রদর্শন করতে হবে। শিল্প ও কৃষি ক্ষেত্রে যে সকল অগ্রগতি সামনে আমরা পিছপা হয়েছি, এ বছরে আরো নতুন প্রত্যয় নিয়ে তার অগ্রগতির জন্যে কাজ করে যেতে হবে। তাছাড়া প্রশাসন যন্ত্রের বিভিন্ন কদর্যতা যা গত বছর আমরা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছি তাকে পুনর্বিন্যাস করে এ বছর নতুন করে সাজাবার কর্মসূচী নিতে হবে।
বঙ্গবন্ধু দেশের মানুষের কাছে তিনটি বছর কিছু দিতে পারবেননা বলে ঘোষণা করেছিলেন। ১৯৭৪ সাল সেই তিন বছরের শেষতম বছর। এ বছরে অবশ্যই তাই আমাদেরকে আরো দূরদৃষ্টি ও প্রজ্ঞা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। গত দু’বছরের অভাব ও দৈন্য এ বছরে পূরণ করার মনোবল নিয়ে কাজ করে যেতে হবে। সরকারের প্রত্যেক বিভাগে যে সকল অসংলগ্নতা রয়েছে তা দুর করে ভিত্তি মজবুত করার কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে হবে। আমরা সরকারকে আরো দূরদর্শী ও সুনিশ্চিত আত্মপ্রত্যয় নিয়ে এই নতুন বছরের প্রতিটি দিন অতিবাহিত করার জন্যে আহ্বান জানাবো। নতুন বছরের আজকের প্রথম দিনে আমরা শুভেচ্ছা জানাই আমাদের সকল শুভার্থী, শুভানুধ্যায়ী ও প্রিয় পাঠক-পাঠিকাদেরকে।
পাটের ভবিষ্যত ও লাল ফিতার কালো হাত
আমাদের জাতীয় অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সৌভাগ্য বস্তু ‘পাট’ এর ভবিষ্যত উজ্জ্বলতা সম্পর্কে গতকাল একটি স্থানীয় দৈনিকে যে সংবাদ ছাপা হয়েছে তাতে দেশের আপামর জনসাধারণের পাটের অনাগত ভবিষ্যত সম্পর্কে আশাব্যঞ্জক হবারই কথা।
এবারও বিগত দেশে দেশ কয়েক দিন ধরে এ রাজ্যের নানা নৈরাজ্য, দুর্নীতি, অব্যবস্থা, অভাব, অযোগ্যতা, দুর্বলতা, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে সরকার ও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এসেছি এবং যথা সম্ভব স্থান বিশেষে করণীয় ব্যবস্থা সম্পর্কের বক্তব্য রাখতে চেষ্টা করছি।
তবুও স্বীকার করতেই হয় যে, যেভাবে আমরা আমাদের এমন মহামূল্যবান সম্পদের উৎপাদন, ব্যবহার বা রপ্তানী ইত্যাদি সম্পর্কে বিভিন্ন সূত্রে যে খবরাখবর পেয়ে আসছিলাম, তাতে যে কেউই এর অন্ধকার ভবিষ্যত সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়েই পারেনা। ঠিক এরই পাশাপাশি গতকালের সংবাদ আমাদের সমস্ত জাতির জন্যেই এক ‘গসপেলের’ সমান।
এ জন্য ধন্যবাদ দিতে হয় বিশ্বের বর্তমান ব্যাপক তেল সংকটকে। এ কথা অবিশ্যি ঠিকই যে, বিশ্বের বর্তমান তেল সংকটে আমরাও কম দুর্ভোগ পোহাচ্ছিনা, তবুও অন্য দিক থেকে এ আমাদের সৌভাগ্যের পথও খুলে দিয়েছে বলে অভিজ্ঞদের অভিমত। আর সেটা হচ্ছে আমাদের একান্ত প্রয়োজনীয় সম্পদ পাট বা সোনালী আঁশ। জানা গেছে, বিশ্বে যতই এই তেল সংকট দেখা দিচ্ছে বা দেবে, ততই আমাদের পাটের ভবিষ্যত আরো উজ্জ্বল হচ্ছে বা হবে।
এতদিন আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পাটের একচেটিয়া কর্তৃত্বের একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ও অন্তরায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরী কৃত্রিম তন্তুজাত দ্রব্য। আমাদের মতো পাট সৌভাগ্য মার্কিনীদের নেই বলে এবং আমাদের উপর পাটের জন্য ওদের অমন সম্পূর্ণভাবে যাতে নির্ভর করতে না হয়, একমাত্র সেজন্যই ওরা ওদের বিজ্ঞানী হাতিয়ার বলে এই ফন্দি ফিকির তৈরী করেছিল।
শুধু তৈরী নয়, রীতিমতো হুঁ হুঁ করে আমাদের অতিক্রম করতেও উচ্চাভিলাষী হয়ে উঠেছিল। ভারতে উৎপন্ন পাটজাত দ্রব্য হেসিয়ানকে তারা বেশ কিছুদিন আগেই প্রতিযোগিতায় ধরে ফেলেছিল এবং উভয়ের দ্রব্যমূল্য প্রায় সমপর্যায়ের উন্নীত হয়েছিল। ওদের পরবর্তী টার্গেট ছিলাম আমরা। ওদের ঐ প্রচন্ড বিজ্ঞান শক্তি বলে ওরা আমাদেরও ধরে ফেলতে পারতো কিনা সেটা বিতর্ক-সাপেক্ষ।
১৯৬৭ সালের পর থেকেই ভারত সহ আমাদের পাটজাত দ্রব্য বিদেশী কৃত্রিম তন্তুজাত পণ্যের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বাজারে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এসেছে এবং এখনো করছে। ওদের ঐ ফন্দিতে আমাদের রপ্তানীর যে কিছুটা আঘাত পেয়ে এসেছে তা’ অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে, সম্প্রতি চিত্রপট একটু পরিবর্তিত হচ্ছে বলে অনুমিত হয়। তন্তুজাত দ্রব্য তৈরীর কাঁচামালের দাম দিন দিন বেড়েই চলেছে এবং এজন্যে প্রয়োজনীয় তেলের সংকটও ব্যাপক হয়ে চলেছে বলে এখন আর অল্প খরচে এই দ্রব্য তৈরী সম্ভব হচ্ছে না। তাই বাজারে এর খুব চড়া দাম হাঁকা হয়েছে। যে জন্যে বাজারের আগ্রহ আবার পাটজাত দ্রব্যের দিকে ঘুরে যাচ্ছে। যার ফলে, বাংলাদেশে বর্তমানে পাটের ভবিষ্যতও যথেষ্ট উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।
বিভিন্ন কারণে গত বছরের এপ্রিল-আগস্ট মাসের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিল-আগস্ট মাসে আমাদের বিদেশে পাট রপ্তা্নী পরিমাণের দিক থেকে প্রায় শতকরা ৮ ভাগ এবং মূল্যের দিক থেকে প্রায় শতকরা ১২ ভাগ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
খবরে প্রকাশ, গত জুলাই থেকে ৭ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২ লাখ ২৭ হাজার টন পাটজাত দ্রব্য বিক্রির চুক্তি সম্ভব হলেও বস্তুতঃ ও সময়ে আমাদের কাঁচাপাটের পরিমাণ ছিল মাত্র এক লাখ ৪ হাজার টন। অর্থাৎ, অর্ধেকের কম। অনুরূপভাবে, ১লা জুলাই থেকে ২১শে নভেম্বর পর্যন্ত ১২ লাখ ৯ হাজার বেল কাঁচাপাট রপ্তানীর চুক্তি হলেও বাস্তবে রপ্তানী হয়েছিল মাত্র ৫ লাখ ২৮ হাজার বেল। কিন্তু আমাদের এ অবস্থার তাৎক্ষণিক অবসান ঘটতে হবে এবং সেজন্য মোক্ষম সুযোগও আমাদের প্রায় দ্বারপ্রান্তে।
এ প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে আমাদের পাটের ব্যবসার সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করা উচিত্।
সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক বাজারে যে দামে পাট বিক্রি করছে সেই দামে ভারত চলতি মৌসুমে বাংলাদেশ থেকে কাঁচাপাট কিনতে রাজী হয়েছে। আমাদের পাটমন্ত্রী ও ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রীর মধ্যে এক যুক্ত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
নিঃসন্দেহে এও আমাদের জন্যে একটি সুসংবাদ। কারণ, বৃহৎ শিল্পরাষ্ট্র ভারতের যথেষ্ট উন্নতমানের পাটের প্রয়োজন এবং আমরাও অনায়াসে দূরের রাষ্ট্রের দিকে না তাকিয়ে আমাদের বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে পাট বিক্রি করে আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারি। এতে অনেক শিপমেন্ট খরচও বেঁচে যাবে।
অথচ একদল দুষ্কৃতিকারী ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তধারী আমাদের ও ভারতের মধ্যে একটা স্থায়ী বিরোধ সৃষ্টির এক অপচেষ্টায় সংঘবদ্ধভাবে নিয়োজিত আছে। কিন্তু আমাদের তাদের প্ররোচণার শিকার হওয়া কখনোই উচিত নয়।
প্রথমেই আমাদের যে বিষয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে তা’ হচ্ছে এই যে, ভারত আমাদের বন্ধু—শত্রু নয়। তার সাথে আমাদের পাট বাণিজ্য সহযোগিতা ও পরিপূরকতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক নয়। ভারতের পাটের প্রয়োজন, আমরা তার সম্পূর্ণ প্রয়োজনই মেটাবো। দরকার পড়লে তার বেশী দেবো। আবার আমাদের কয়লার প্রয়োজন মেটাতে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা ভারতকে আমাদের যে কোনো প্রয়োজনীয় বস্তুর জন্যে আন্তর্জাতিক মূল্য দেবো, এবং ভারতকে আমাদের থেকে নেওয়া যে কোনো দ্রব্যের জন্যে আন্তর্জাতিক মূল্য দিতে হবে—এটাই হওয়া উচিত নীতি-এরই নাম প্রকৃত বন্ধুত্ব। বাকী সব অবান্তর। আমরা পাট সম্পদের উন্নয়নে ভারতের সাথে যৌথ সহযোগিতা, গবেষণা ও পরিপূরকতার নীতিতে বিশ্বাসী।
তাই বর্তমানে সম্পাদিত ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্য চুক্তি সফল হোক, কামনা করে আমরা কর্তৃপক্ষের কাছে অনুরোধ রাখতে চাই-যাতে বাংলাদেশ তার চুক্তি মোতাবেক নির্ধারিত মান বজায় রাখতে পারে এবং যথাসময়ে পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করতে পারে সেজন্যে যেন কঠোরতম দৃষ্টি রাখা হয়। এক্ষেত্রে চিরন্তন লাল ফিতার কালো হাত ও আমলা চক্রান্তের দারুণ অভিশাপ হাতে এ উদ্যোগ নস্যাৎ করতে না পারে সেদিকেও যথেষ্ট সতর্ক হতে হবে। কারণ আমাদের পাট সম্পদের ভবিষ্যত উজ্জ্বলকরণের মোক্ষম সময় এসে গেছে, এখন এক সদ্ব্যবহারের উপরই আমাদের ভবিষ্যত।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক