বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৭ই ডিসেম্বর, সোমবার, ১লা পৌষ, ১৩৮০
দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম
মহান জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গত শনিবার রাতে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে বলেছেন, এই দিন এক যুদ্ধের শেষ, আরেক যুদ্ধের শুরু। একাত্তরের ১৬ই ডিসেম্বর আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমাপ্তি। এই একই দিনে আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রাম শুরু। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আরো বলেন, প্রায় এক লাখ পরাজিত শত্রু আত্মসমর্পণ করেছে। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে আরো শক্তিশালী শত্রু। এই শত্রু হলো অভাব, দরিদ্র, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা, বেকারত্ব ও দূর্নীতি। এই যুদ্ধে জয়লাভ করা সহজ নয়। অবিরাম এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। এবং একটি সুখী সুন্দর অভাবমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই হবে আপনাদের সংগ্রাম সফল। আপনাদের শেখ মুজিবের স্বপ্ন ও সাধনার সমাপ্তি।
বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে উৎপাদন বৃদ্ধি, চোরাচালান, কালোবাজারী, অসৎ ব্যবসায়ী, দূর্নীতিবাজ ও ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ার সংগ্রামে দেশপ্রেমিক জনসাধারণের করণীয় কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্পর্কে যা বলেছেন, তা বর্তমান অবস্থার আলোকে দেশবাসীকে অবশ্যই অনুধাবন করতে হবে। দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে দু’বছর আগে। এ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে ঘরে ঘরে আমরা দূর্গ গড়ে তুলেছিলাম। সংগ্রামের প্রাথমিক অধ্যায়ে আমরা জয়যুক্ত হয়েছি। তারপর আরম্ভ হয়েছে দ্বিতীয় অধ্যায়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের সংগ্রাম আরো কঠিন। আরো ব্যাপক।
সেদিন শত্রুকে আমরা সহজেই চিনতে পারতাম। আজ আমাদের শত্রু চতুর্দিকে। ঘরের বাইরে শত্রু। ঘরে দারিদ্র্য, অশিক্ষা, রোগ, আর দুর্নীতির শত্রু। বাইরে বিদেশি ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তকারী শত্রু। এ দু,য়ের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুক্ত হবার একমাত্র শর্ত হলো উৎপাদন বৃদ্ধি ও জাতীয় ঐক্য। শত্রু বাহিনীর উৎপাদন ব্যাহত করা, জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরিয়ে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানো। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে- এ সংগ্রাম সহজ সংগ্রাম নয়।
স্মরণ রাখতে হবে, একেবারে শূণ্য থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো। চতুর্দিকে হাহাকার। অভাব অভিযোগ। পুনর্বাসন ও পুনর্গঠনে সমস্যা, খাদ্য সংকট, সব সমস্যাই আমাদের অক্টোপাশের মতো শতবাহু বিস্তার করে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছিলো। কিন্তু সকল দেশ প্রেমিক জনসাধারণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা প্রাথমিক সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছি।
দেখতে দেখতে দুই বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমাদের সম্মুখে রয়েছে অনাগত ভবিষ্যৎ। এ ভবিষ্যৎকে সুখী ও সুন্দর করে গড়ে তুলতে হবে। আমাদের দেশ গড়ার সংগ্রামে আরো গভীরভাবে আত্মনিয়োগ করতে হবে। কল-কারখানায় খেতে-খামারে উৎপাদন বৃদ্ধি, আইনের শাসন কায়েমের সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আর তাহলেই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন সফল হবে। সার্থক হবে। সকলের মুখে হাসি ফুটবে।
বুনো ওলের জন্য চাই বাঘা তেঁতুল
সংবাদটি আতংকিত হবার মতই। আগেও এমনি ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তবে যারা ক্ষেত থেকে রাতের অন্ধকারে ধান তুলে নিয়েছিলো তারা ছিলো ছিচকে চোর। কিন্তু এবারে যারা ধান নিয়েছে তারা রাতের বেলা বিশেষ পার্টির পতাকা উড়িয়ে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিতে দিতে কৃষকের গোলা থেকে ধান লুট করে নিয়েছে।
স্থানীয় একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে যে, গত বুধবার রাতে বেশ কিছু সংখ্যক তরুণীসহ প্রায় এক হাজার সশস্ত্র লোক ঝিনাইদহ থানার ভিতসর, ঘোড়াশাল ও পাকা এই তিনটি গ্রামের মাঠের অধিকাংশ পাকা ধান কেটে নিয়েছে। সশস্ত্র ব্যক্তিরা বিশেষ একটি পার্টির শ্লোগান দিয়ে অস্ত্রের মুখে দুটি গ্রামের কৃষকদের বাড়ি থেকে কয়েক শত মণ ধান লুট করে। ধান ছাড়াও মূল্যবান জিনিসপত্র ওরা নিয়ে যায়।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে এটা কোন ছিচকে চোর বা ডাকাতের কাজ নয়। বিশেষ পার্টির নামে স্লোগান দিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীদের ধন-সম্পত্তি লুট করা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোই হলো এদের লক্ষ্য।
এ ধরনের কাজ-কারবার কয়েক বছর আগে পশ্চিমবঙ্গেও অনুষ্ঠিত হয়েছে। পরলোকগত তথাকথিত বিপ্লবী নেতা চারু মজুমদারের ভাবশিষ্যরাই যে এ কর্মটি করেছেন এতে কোন সন্দেহ নেই। এরা শহরে-বন্দরে সুবিধা করতে না পেরে ধান লুট আর থানা লুটেরই আশ্রয় নিয়েছে। দেশের সাধারণ মানুষের অভাব-অভিযোগের সুযোগ নিয়ে এবং এগুলোকে পুঁজি করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করাই হলো এদের লক্ষ্য। মাটির সঙ্গে এদের কোন যোগাযোগ নেই একথা যেমন সত্য তেমনি সত্য হলো এদের সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে নিরীহ গ্রামবাসীরা বিভ্রান্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে।
তথাকথিত বিপ্লবী চারু মজুমদারের ভাবশিষ্যরা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছে যে, নিয়মতান্ত্রিক পথ নয়- সশস্ত্র বিপ্লবই হলো সঠিক পথ। সুতরাং এরা যে চুপ করে বসে নেই তা স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের উচিত বুনো ওলের জন্য বাঘা তেঁতুলের ব্যবস্থা করা। আর এটা করতে হবে দেশের ও দশের বৃহত্তর স্বার্থেই।
বুদ্ধিজীবীরা যেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন না হন
বুদ্ধিজীবীরা সমাজ সংসার বহির্ভূত কোন জীব নন। বুদ্ধিজীবীরা আমাদের সমাজ, দেশ এবং জাতিরই প্রতিভূ। বুদ্ধিজীবীরা দেশ ও জাতির গৌরব। আমাদের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে বুদ্ধিজীবীরা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করে নিজেদের জীবন অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। একটা আদর্শকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়েছেন। পরাধীন আমলে বুদ্ধিজীবীরাই দেশের সাধারণ মানুষের আশা-আকাংখা, কামনা-বাসনা এবং হতাশা-বেদনার অংশীদার হয়েছেন। স্বৈরশাসকদের অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে আমাদের বুদ্ধিজীবীরাই আন্দোলনের পথে ঝাপিয়ে পড়ে আলোকের সন্ধান দিয়েছেন। অর্থাৎ আপামর সাধারণ মানুষের সঙ্গে সব সময়ই বুদ্ধিজীবীরা একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। বুদ্ধিজীবীরা যেহেতু জাতির বিবেক, সেহেতু শহীর বুদ্ধিজীবীদের আদর্শ এখনো আমাদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। সম্প্রতি সারা দেশব্যাপী শহীর বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়েছে। এবং আমরা শহীদ বুদ্ধিজীবীদের প্রতি আমাদের অন্ততের শ্রদ্ধাঞ্জলি যথারীতি নিবেদন করেছি। কারণ, বুদ্ধিজীবীদের ত্যাগ ও তিতিক্ষাকে আমাদের কোনদিন উপেক্ষা করা উচিত নয়। শহীদ বুদ্ধিজীবীরা মুক্তি সংগ্রামে যে আত্মদান করে গেছেন, তার কোন তুলনা নেই। কিন্তু তবুও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় নানা সময়ে জনমনে নানা সন্দেহ ও বিভ্রান্তির জন্ম হয়। বুদ্ধিজীবীরা জনগণ থেকে যদি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন, তাহলে তা সীমাহীন দূর্ভাগ্যের কারণ না হয়ে পারে না। বুদ্ধিজীবীরা দেশের সম্পদ সন্দেহ নেই, কিন্তু তারা যদি জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খা বাস্তবায়নের ব্যাপারে শতহাত দূরে অবস্থান করেন, কিংবা জনসাধারণের স্বার্থ বিরোধী কাজ-কারবার করেন তা হলে কি তারা সত্যিকার জনজীবনের প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন? বুদ্ধির বেসাতি যদি বিলাসিতার পর্যায়ে না পড়ে জনগণের কল্যাণে ব্যয়িত হয়, তাহলে বুদ্ধিজীবী নামের সার্থকতা সপ্রমাণিত হবে। নইলে বুদ্ধিজীবীরা তাদের কৃতকর্মের জন্য ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে বাধ্য। যে সব বুদ্ধিজীবীরা স্বাধীনতা সংগ্রামকালে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রতি আমাদের আন্তরিক শ্রদ্ধা রেখেই নিবেদন করছি, বর্তমান বুদ্ধিজীবীরা যেনো তাদের পূর্বসূরীদের ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হন। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোকে আমরা এই কথাটি উচ্চারণ না করে পারলাম না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক