বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৩ই ডিসেম্বর, বৃহস্পতিবার, ২৭শে অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
ইউনিয়ন কাউন্সিল নির্বাচন প্রসংগে
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই স্বাধীন বাংলাদেশের প্রায় সব এলাকাতেই ইউনিয়ন পঞ্চায়েত ও পৌরসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই চারদিকেই শুধু সাজ সাজ রব। গ্রামে-গঞ্জে, পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে এখন শুধু স্লোগান আর মিছিলের প্রাণ জোয়ার। ছেলে-বুড়ো, ছাত্র-শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী জনতা সবার মুখেই শুধু ওই একই কথা, একই ভাবনা-নির্বাচন, নির্বাচন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আমাদের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের লোকেরা যাতে তাদের স্থানীয় প্রশাসন ক্ষেত্রে নিজেরাই তাদের নিজস্ব ভোটের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশের সামগ্রিক শাসন ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ গ্রহণ করতে পারে, সেজন্য দেশব্যাপী সেই বিগত ১৯৫৬ সন থেকে সর্বাত্মক গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টা চালিয়ে এসেছে, কিন্তু সরকারের নানান ঔপনিবেশিক ও শোষণমূলক চক্রান্তের ফলে আমাদের দেশের জনসাধারণ কখনোই সে অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের সুফল লাভ করতে সক্ষম হয়নি। এই এবারই প্রথম আমাদের দেশের মানুষ তাদের সরাসরি গণতান্ত্রিক ভোটের মাধ্যমে তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করতে যাচ্ছে।
ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে মোট ১ লাখ ৭৫ হাজার ২৪৯টি মনোনয়নপত্র দাখিল করা হয়েছে। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রার্থী হলেন ২২ হাজার ২৭২ জন, ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য প্রার্থী হলেন ২১ হাজার ৩৩৫ জন এবং সদস্য পদের জন্য প্রার্থী হলেন ১ লাখ ৩১ হাজার ৬৬২ জন।
৬৮টি পৌরসভার নির্বাচনে মোট ৪ হাজার ১১৯ জন প্রার্থী মনোনয়ন পত্র দাখিল করেছেন। তার মধ্যে ৪১১ জন চেয়ারম্যান পদের জন্য, ৪২৫ জন ভাইস চেয়ারম্যান পদের জন্য, এবং ৩ হাজার ২৮৩ জন কমিশনার পদের জন্য দাখিল করেছেন।
এ নির্বাচনে কোনো দলই দলীয় ভিত্তিতে কোন প্রার্থী দাঁড় করাবেন না বলে পূর্ব ঘোষণা দেয়া সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীরা কোনো না কোনো দলীয় ভিত্তিতে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে একই দলের একাধিক লোক একই পদের জন্যে প্রার্থী হয়েছেন বলে জানা গেছে। প্রার্থীদের প্রায় শতকরা ৭০-৭৫ জনই তরুণ এবং সম্পূর্ন নতুন মুখ। এদের সবারই বয়স প্রায় ২০ থেকে ৩০ এর মধ্যে। অবশ্য, কিছু কিছু পুরনো বয়স্ক ব্যক্তিরাও আছেন, তবে তাদের অনেকেই প্রার্থীপদ প্রত্যাহারের কথা ভাবছেন বলে জানা গেছে। যাহোক, আগে আমাদের দেশের যে অবস্থাই থেকে থাকুক না কেন, বর্তমানে দেশের পরিবর্তিত অবস্থায় আমাদের দেশের মানুষ তার মূল্যবান ভোটেত সত্যিকারের সদ্ব্যবহার করে এক স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের সুযোগ্য নাগরিক হিসেবে নিজেদের পরিভয় রাখতে সক্ষম হবে বলে আমরা দৃঢ় বিশ্বাস রাখি। বিশেষ করে, তারা পুরনো প্রতারণা ও ছল-চাতুরীর কথা স্মরণ রেখে কোনো রকমের অসৎ প্রলোভনের বশবর্তী হয়ে নিজের ও দেশের ধ্বংস সাধন করবে না এটা স্বভাবতঃই আশা করা যাচ্ছে।
আবার যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বা যারা নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকেও জাতির এই অমোঘ মূল্যবান মুহূর্তে অনেক আশা-ভরসাও আছে। নিজস্ব ব্যক্তিগত কুটিল স্বার্থ সিদ্ধির জন্য নয়, সম্পূর্ণ দেশপ্রেম ও জাতীয় উন্নয়নের প্রকৃত মহানব্রতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা নির্বাচন শেষে জাতির সেবায় এগিয়ে আসবে, এটাই স্বভাবতঃ দেশের মানুষ এককভাবে সবার কাছ থেকে প্রত্যাশা করছে। এরপর আছে নির্বাচন প্রাক্কালে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রশ্ন। কোনো দেশেই কখনো উশৃঙ্খলাতা বা বিশৃঙ্খলার মাঝে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারেনি বা পারেনা, কিংবা বিশৃঙ্খলার মাঝে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা করাও এক অসম্ভব ব্যাপার। এ জন্য প্রথমেই প্রয়োজন যাতে নির্বাচনের সময়ে কোন রকম বিশৃঙ্খলা দেখা না দেয় বা শান্তি ভঙ্গ না হয় সেদিকে বিশেষ নজর দেয়া।
আবার শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার একটি প্রধান পূর্ব শর্ত পারস্পরিক সহনশীলতা। এই পারস্পরিক সহনশীলতা না থাকলে শান্তি ভঙ্গ হলে নির্বাচন ব্যাহত ও দূষিত হতে বাধ্য। আবার নির্বাচন ব্যাহত হলে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক অধিকারও ব্যাহত হতে বাধ্য। এবং পরিণামে দেশের দূর্যোগ ও দূর্গতি আসতে বাধ্য।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, নির্বাচনে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার প্রশ্নের সঙ্গে দেশের অপরাপর স্বার্থসমূহ অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। নির্বাচনে পছন্দ অপছন্দ একটি ব্যক্তিগত অধিকার এবং সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নীতি মানলে এর ওপর কারোই হস্তক্ষেপ করা মোটেই উচিত নয়। কারণ বাহ্যিক পরিচাপ সৃষ্টি করে বা ভীতি প্রদর্শন করে কখনোই প্রকৃত গণতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব নয়। সুতরাং, প্রত্যেকেই যাতে আপন আপন পছন্দ মতো যে যার গণতান্ত্রিক অধিকারের সদ্ব্যবহার করতে পারে, সেজন্য প্রত্যেকেরই পরস্পরের সঙ্গে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করা উচিত। আসন্ন নির্বাচন সম্পূর্ণ সুশৃঙ্খলভাবে অনুষ্ঠিত হয়ে দেশের প্রকৃত দেশপ্রেমিকরা দেশ গঠনে এগিয়ে আসুক এবং আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা আরো স্থিতিশীল হোক একান্তভাবেই তা’ কামনা করি।
সমবায় বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক গঠন নিয়ে বিভ্রান্তি
সম্প্রতি আমাদের সমবায় মন্ত্রী ‘সমবায় বাণিজ্যিক ব্যাংক’ নামে একটি ব্যাংকের উদ্বোধন করেছেন। সমবায় ব্যাংক উদ্বোধনের এই বিষয়টি নিয়ে একটা প্রতিক্রিয়া জনগণের মনে দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন জন বিভিন্ন প্রকার প্রশ্ন তুলেছেন। দেশের সকল ব্যাংক জাতীয় করণ করার পর হঠাৎ করে সমবায় ব্যাংক গঠনের সুযোগ কোন ব্যাংক নীতির উপর ভিত্তি করে সরকার দিচ্ছেন সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। আমরাও জানতাম সরকার সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনের জন্যে দেশের সকল ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করে তাকে পুনর্গঠন ও পূর্ণোদ্দমে চালু করার জন্যে আত্মনিয়োগ করেছেন। দেশের অর্থ উপার্জনের বৃহৎ সেক্টরগুলো যেমন মিল, কারখানা, আমদানি, রপ্তানি বাণিজ্যের বড় অংশ, ব্যাংক-বীমা প্রভৃতি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া হয়েছে গৃহীত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পথ সুগম করার জন্যে।
সরকার, সংগঠন ও দেশের জনগণ আজ জাতীয়করণ নীতিকে বাস্তবায়িত করার জন্যে একে অন্যের প্রতি সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রহণ করেছে। সরকার জাতীয়করণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্যে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যদিকে জাতীয়করণ কর্মসূচি যারা বানচাল করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক ছাত্র-যুব দলগুলো ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার সংকল্প গ্রহণ করেছে। ঠিক এমনি সময়- সবার বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠনের অনুমতি প্রদানে জনমনে স্বাভাবিক ভাবেই নানা প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। আমরা সমবায় আন্দোলনকে স্বাগত জানাই। দেশের কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্প উন্নয়নের ও বিকাশের জন্যে সমবায়ের গুরুত্ব অপরিসীম বলে আমরা মনে করি। কিন্তু বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠনের বিষয়টি নিঃসন্দেহে ভিন্নতর। ব্যাঙ্কিং নীতির আওতায় এ ধরনের সমবায় ব্যাংক গঠন করা যায় কিনা সেটা জনগণের জানবার কৌতূহল রয়েছে।
দেশের যে সকল ব্যাংক জাতীয়করণ করা হয়েছে তার প্রায় সবই ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংক। এগুলোর মালিক ছিল এক বা একাধিক ব্যক্তি। এদের অধিকাংশেরই স্থানে বাস ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বাংলাদেশ শোষণ করার অন্যতম হাতিয়ার ছিল এ সকল ব্যাংক। স্বাধীনতার পর এগুলোর মালিকানা খর্ব করে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় নেওয়া হয়েছে। এখন এ সকল ব্যাংকের মূল মালিক হলো দেশের জনগণ। নতুন কোন বাণিজ্যিক ব্যাংক গঠনের সুযোগ দেশে আর থাকবেনা এটাই ছিল সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। সমবায়ের নিয়ম অনুযায়ী একজন বা দু’জন একটি ব্যাংক করতে না পারলেও বহু নামের বা অংশীদারের ঘাপলা তৈরি করে গুটিকয়েক লোক সমবায়ের নাম ভাঙ্গিয়ে এ ধরনের বাণিজ্যিক ব্যাংক যে গঠন করতে সক্ষম- এ কথা সবাই জানে। পূর্বের দিনেও আমরা বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংকের অংশীদার বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। এখানে সমবায়ের নিয়মেও গুটিকয়েক মানুষ অংশ ক্রয়ের মাধ্যমে ব্যাংকের মালিকানা লাভ করতে পারবে।
এ ধরনের সমবায় ব্যাংক গঠনের ব্যাপারে সরকারি নীতি আমাদের কাছে আজও অস্পষ্ট। বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিও এ ব্যাপারে আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। অতএব সঙ্গত কারণেই জনগনের মনে আজ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সমাজের কোন শ্রেণীর স্বার্থে এ ধরনের ব্যাংক ব্যবহৃত হবে- সেটা একবার ভেবে দেখা প্রয়োজন। দেশের জাতীয়করণকৃত ব্যাংকের নীতির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের সমবায় ব্যাংক কতটুকু জনকল্যাণকর তা বিবেচ্য বিষয়। সমবায় বাণিজ্যিক ব্যাংক উদ্বোধনের পর জনসাধারণের মাঝে উদ্ভূত বিভ্রান্তি দূর করার জন্যে আমরা সরকারের সমবায় মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক