বাংলার বাণী
ঢাকা: ৩০শে ডিসেম্বর, রোববার, ১৪ই পৌষ, ১৩৮০
শিল্প শ্রমিক মজুরি কমিশনের সুপারিশ
বাংলাদেশ সরকার শিল্প শ্রমিকদের জন্য মজুরি কমিশনের সুপারিশ সমূহ মেনে নিয়েছেন। এতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প বিভাগের অধীন উৎপাদনশীল বিভিন্ন ইউনিট এবং জুট মিল কর্পোরেশনের কল-কারখানা সমূহে কার্যরত সমস্ত শ্রমিকদের জন্যে বোনাস, বাড়ি ভাড়া, চিকিৎসা ভাতা এবং অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। এসব সুবিধা ১৯৭৩ সালের ১লা জুলাই থেকে কার্যকর হবে। রাষ্ট্রয়ত্ত শিল্প শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরি হার ধার্য করা হয়েছে ১৫৫.৫-২০৫.৬-২৩৫ টাকা। গেজেট বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, সব ক্যাটাগরির শ্রমিকই তাদের উৎসবের সময় বোনাস হিসেবে একমাসের মূল বেতন পাবেন৷ এ ছাড়া বর্ধিত উৎপাদনের জন্য শ্রমিকদের ‘উৎসাহ মজুরি’ (ইনসেন্টিভ বেনিফিট) দেয়া হবে। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকদের চিকিৎসা ভাতা, বাড়ি ভাড়া ও যাতায়াত ভাতার সুপারিশও গৃহীত হয়েছে। তবে যেখানে শ্রমিকদের জন্য গৃহসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে বাড়ি ভাড়া দেওয়া হবে না। যেখানে বিনা মূল্যে চিকিৎসার জন্য ডিসপেন্সারী নেই সেখানেই কেবল চিকিৎসা ভাতা দেওয়া হবে। চিকিৎসা ভাতা সবার জন্যে মাসে ২০ টাকা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
ছুটির বিশেষ সুবিধা ছাড়াও ২১০ টাকার কম যাদের বেতন শিল্পাঞ্চল ও শিল্পাঞ্চল বহির্ভূত কলকারখানায় তাদের যাতায়াত ভাতা ও বাড়ি ভাড়ার পরিমাণ হবে যথাক্রমে ৪০ টাকা ও ৩০ টাকা। যাদের বেতন ২১০ টাকার কম নয় কিন্তু ৩২০ টাকার নিচে তারা পাবেন যথাক্রমে ৪৫ টাকা ও ৩৫ টাকা। যাদের বেতন ৩২০ টাকার কম নয় কিন্তু ৪৯০ টাকার নিচে তাদের ভাতার পরিমাণ হবে যথাক্রমে ৬০ টাকা ও ৫০ টাকা। যাদের বেতন ৪৯০ টাকার নীচে নয় কিন্তু ৬৫০ টাকার কম তারা পাবেন যথাক্রমে ১১০ টাকা ও ১০০ টাকা। গত অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প শ্রমিকদের বেতন হার ও সুবিধা সম্পর্কে রিপোর্ট সরকারের কাছে পেশ করা হয়েছিল। রিপোর্ট পেশ করার পর কয়েক মাস অতিবাহিত হওয়াতে গত ২৭শে ডিসেম্বর সংখ্যা বাংলার বাণীতে সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমরা এই রিপোর্ট অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন জানিয়েছিল।
সম্পাদকীয় নিবন্ধে আমরা বলেছিলাম যে, ঈদের আগেই যেন রিপোর্টে কার্যকর করার সব রকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। শুধু তাই নয়, পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে ডিসেম্বর ‘কর্তাদের গরজ নেই’ শীর্ষক সংবাদে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প শ্রমিকদের সরকার নির্ধারিত মজুরি স্কেল বাস্তবায়নে যে টালবাহানা চলছে তারই একটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, একমাত্র বাংলার বাণীতেই এ রিপোর্ট গত অক্টোবর মাসে প্রকাশিত হয়েছিল।
একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে, পাকিস্তানি আমলে শ্রমিকদের যেটুকু ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা পাওয়া উচিত ছিলো তা তারা পায়নি। তাছাড়া শ্রমিকদের রক্তের বিনিময়েই সেদিন সুবিধাভোগী বাইশ পরিবার গড়ে তুলেছিলো মুনাফার পাহাড়। সেদিন তীব্র শ্রমিক অসন্তোষকে ধামাচাপা দেবার জন্য অবশ্য নামকাওয়াস্তে সর্বনিম্ন বেতন ১২৫ টাকা ধার্য করা হয়েছিল। কিন্তু তাও সর্বক্ষেত্রে কার্যকর হয়নি। বর্তমান সরকার সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন বলেই স্বাধীনতা লাভের পর পরই নানান অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও প্রধান মন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ১২৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫০ টাকা করেন। এবং পরবর্তী পর্যায়ে বেতন সম্পর্কিত বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য মজুরি কমিশন নিয়োগ করেন।
রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প শ্রমিকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধাদি ঘোষণার ফলে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দুর্মূল্যের বাজারে একটু আশার আলো যে শ্রমিকরা দেখতে পাবেন এতে কোন সন্দেহ নেই। তবে এ সম্পর্কে এখনই সুস্পষ্ট মতামত দেয়া সম্ভব নয়। কারণ এ রিপোর্ট কার্যকরী করার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিক্রিয়া কি হবে তাও ভেবে দেখতে হবে। সেজন্য পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। উচ্ছাস আর আবেগে ফেটে পড়ে একে যেমন অভিনন্দন জানানো ঠিক হবে না, তেমনি আবার এ কথায় বর্জন করাটাও বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, জাতীয় বেতন কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর থেকে আমরা দেখেছি যে, সারাদেশে এ রিপোর্ট সম্পর্কে কি গভীর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এবং শেষ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীকে বলতে হয়েছে যে, “কোন রিপোর্টই ঐশী গ্রন্থের মত অপরিবর্তনীয় লিখন নয়- অতএব বেতন কমিশনের রিপোর্টও পরিবর্তন হতে পারে।” পরিশেষে আমরা বলবো যে, বর্তমান সরকারের লক্ষ্যই হলো শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা। যে সমাজে থাকবে না কোন অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, শোষণ ও নিপীড়ন। শ্রমিক শ্রেণী সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনে গ্রহণ করবে বলিষ্ঠ ভূমিকা। সুতরাং তাদের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য অবশ্যই সরকারকে রাখতে হবে। সেজন্য যদি বর্তমান রিপোর্টে ত্রুটি বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয় তাহলে তাকে তৎক্ষণাৎ বদলাতে হবে। অন্যদিকে শ্রমিকদেরও এগিয়ে আসতে হবে দেশের ও দশের সামগ্রিক স্বার্থে কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য।
নদীর ভাঙ্গন ও গৃহহীনের পুনর্বাসন সমস্যা
অনন্ত প্রবাহমান সমযয়ের মতো নদীও এক ‘আপন বেগে’ ‘নূসুর-নিক্কণে’ সামনে এগিয়ে চলার নাম। ঘরের বাঁধন বা পিছু টানের দেবতা কোনদিনও একে গ্রাস করতে পারেনি, পারবেনা। সাধারণতঃ পাহাড়ের এর জন্ম আর সাগরে শেষ আলিঙ্গন।
নদীর ধর্ম ভাঙ্গন আর গড়ন। কখনো এ কুল, কখনো ওকুল। একেই লোকে বলে নদীর খেলা। তার এ খেলা অনন্ত শাশ্বত। তার এ খেলার রূপ বিচিত্র হয় বটে, তবে কখনোই ব্যতিক্রম নেই। চির করুণাময়ী ধরণীর যেখানেই নদ-নদী আছে, সেখানেই নদীর এ আপনহারা খেলাও বিচিত্ররূপ আছে। আমাদের সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশও অঢেল পলিবাহিত এক নদীমুখরা দেশ। এখানে গ্রামীণ জীবনের ওপর মেঘনা, যমুনা, মধুমতি, রূপসা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, বা ধলেশ্বরী নদীর প্রভাব ও অনুকম্পা মিশরের ইতিহাসখ্যাত নীল নদের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। বরং বেশীও বলা যেতে পারে। কারণ, একদিনও নদী ছাড়া বাঙালি জীবন সম্পূর্ণই অচল ও নিরর্থক। বিভিন্ন নদ-নদীর আশে-পাশেই গড়ে উঠেছে অসংখ্য শান্ত-স্নিগ্ধ দোয়েল শ্যামা ও ডাহুকি ডাকা মুক্ত মুখর গ্রামীণ জীবন।
নদীর ওপর গ্রাম এবং গ্রামের ওপর শহর এইভাবেই গড়ে উঠেছে আমাদের জাতীয় জীবন। সুতরাং, আমাদের জাতীয় জীবনের ক্ষেত্রে নদীর অমেয় অপরিহার্যতা নিছক স্বপনের দোহাই দিয়েও অস্বীকার করা চলে না। যারা আমাদের দেশের জনজীবন ও নদ-নদী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল তারা সবাই জানেন, আমাদের দেশের এক বিপুল পরিমাণ জনসম্পদ কিভাবে বিভিন্ন নদ-নদীর উভয় কূলে সারিবদ্ধ পিপীলিকার মতো তাদের দৈনন্দিন সমাজ জীবন প্রবাহ গড়ে তুলে জাতির বিভিন্ন রকম সেবায় নিয়োজিত আছে। কেউ চাষা, কেউ জেলে, কেউ কামার, কেউ কুমোর, কেউ তাঁতী, কেউবা মহাজন বা বনেদী ব্যাপারী। আরো কত বিভিন্ন তাদের পেশা ও বিচিত্র তাদের স্বপ্নের আঁচড়। এই নদ-নদীর উভয় কূলেই গড়ে উঠেছে কত হাট-বাজার, কতো মোকাম ও কতো দালানকোঠা কিম্বা সেই স্বপ্ন বিজড়িত জীর্ণ কুড়ে ঘর। এই হচ্ছে আমাদের জীবন, এখানেই যুগ যুগের খাঁটি বাঙালি চিত্র ও চরিত্র একান্ত আপন ও নির্দোষ বিশ্বের চোখে ধরা দিয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা পশ্চিমা সংস্কৃতি ধর্ষিত ব্যস্ত ও উদভ্রান্ত গড্ডালিকাময় শহুরে জীবনের শুয়ো পোকা দংশন থেকে একটু অব্যহতি পেলে আমরা এখান এসেই প্রথম এক বিপুল স্বর্গীয় শীতল প্রশান্তি লাভ। অনেক সময়ে অভিযোগ পাওয়া যায়, নদীর ভাঙ্গনের দরুন যারা গৃহহীন হয়েছেন, তারা নানান সমস্যা সাগরে নিপতিত হয়ে কোনো গতি বা কূল-কিনারা করতে না পেরে যখন কর্তৃপক্ষের কাছে নিম্নতম সাহায্যের জন্যও আবেদন করেন তখন প্রায়ই দিনের পর দিন চরম প্রতীক্ষায় ভাগ্যহীনের স্নায়ু-শক্তি নষ্ট হয়ে যায়। সাড়া পাওয়া গেলেও তা নিশ্চিত ভাবে এই যে, “কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে কোনো তহবিল নেই” কিংবা, “তহবিলে এ ক্ষেত্রে দেবার মত কোন টাকা নেই।” ফলে এসব প্রত্যাখ্যাত ভাগ্যহীনেরা জীবনের কঠোর প্রয়োজনে নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেই জোড়াতালি দিতে গিয়ে নানান সামাজিক অনাচার ও জীবন নিষ্পেষণে নিমজ্জিত হন। আর এই ভাবেই ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠে আমাদের সামাজিক দুর্গতির নভোভেদী সমস্যা-পর্বত ও হৃদয়-জ্বালা।
অথচ, আমরা ভুলে যাই, এসব হতভাগ্য গৃহহীনদের পূনর্বাসনের বিষয়টিও আমাদের জাতির জন্য অন্যান্য বিভিন্ন সমস্যার মতোই এক প্রকটতম সমস্যা এবং এ সমস্যা দূরীকরণের ওপরই আমাদের জাতীয় সুখ-সমৃদ্ধি অধিকাংশেই নির্ভরশীল। এটা একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সমস্যা, অন্যদিকে তেমনি জাতীয় সমস্যাও বটে। সুতরাং, এ সমস্যা দূরীকরণের দিকে গুরুত্বপূর্ণ নজর দেয়াও আমাদের একটি জাতীয় প্রয়োজনীয়তা আছে। শোনা যাচ্ছে, হালে পদ্মা-মেঘনার উভয় কুলে দারুণ ভাঙ্গন তান্ডব নৃত্যে শত শত আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা গৃহহীন হয়ে পড়েছেন এবং এখনো পড়ছেন। এদের যথোপযুক্তভাবে পুনর্বাসন করা একটি তাৎক্ষণিক প্রয়োজন এবং এজন্য এই মুহূর্তেই ব্যাপক চলমান ও স্থায়ী কর্মসূচি গ্রহণ করার জন্যে কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন ব্যবস্থাও গ্রহণ করা উচিত।
তবে, সব চেয়ে প্রথম যা প্রয়োজন তা হচ্ছে আক্রান্ত এলাকায় অবিলম্বেই অস্থায়ী পুনর্বাসন ব্যবস্থা সাধন করে স্থায়ীভাবে সমস্যার আসল ও নানান দিক বিচার করে বৈজ্ঞানিক কর্মসূচি গ্রহণ ও তা অকলুষভাবে বাস্তবায়ন করার ব্যবস্থা গ্রহণ। তা না হলে, আমাদের জাতীয় সমস্যা দূরীকরণের অন্যান্য সমস্ত কর্মসূচি ও ব্যবস্থাও চরমভাবে ব্যাহত হতে বাধ্য হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক