বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৪ই জানুয়ারী, সোমবার, ১৯৭৪, ২৯শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
তেল নিয়ে এ কেলেংকারীর তদন্ত চাই
গাধার ঘোলা করে পানি পান করার কেচ্ছা বহুলপ্রচলিত। একশ্রেণীর আমলাদের কল্যাণে বাংলাদেশে তাই হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। সোজা সরল পথে তাঁরা হাঁটতে নারাজ। বাঁকা পথ, বাঁকা বুদ্ধির প্যাচ কষে ‘হয়’কে ‘নয়’ করে দেবার কেরামতিতে যে তাঁরা সিদ্ধহস্ত এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। যদি তাই না হবে তাহলে স্বাধীনতার তৃতীয় বছরে পদার্পণ করার পর কেন সংবাদ বের হয় যে, ‘ইরাক চলতি সালে দশ লাখ টন অশোধিত তেল দেবে।’ আর সেই তেল নেবার জন্যে ছুটতে হয় সুদূর ইরাকে প্রাকৃতিক সম্পদ এবং খনিজ ও কারিগরি গবেষণা দপ্তরের মন্ত্রী ডঃ মফিজ চৌধুরীকে। এর রহস্য কোথায়?
গতকাল সবগুলো দৈনিক পত্রিকাতেই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, ডঃ চৌধুরীর নেতৃত্বে তিন-সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আগামী ১৬ই জানুয়ারী ইরাক পৌঁছবে।
বন্ধুদেশ ইরাক আমাদের মন্ত্রী যাবেন, তেল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। আমাদের মন্ত্রী যাবেন সেখানে সেদেশের মন্ত্রী আসবেন এখানে আর এই আসা-যাওয়ার মধ্যেই গড়ে উঠবে প্রীতি ও বন্ধুত্বের সেতুবন্ধন। এতো সোজা হিসাব। সোজা পথ।
কিন্তু কথা এটা নয়। কথা হলো ইরাক বাংলাদেশকে তেল সরবরাহ করার আশ্বাস তো আজ দেয়নি। স্বাধীনতার পর পরই বন্ধুদেশ ইরাক এগিয়ে এসেছিলেন সাহায্য ও সহযোগিতার হস্ত প্রসারিত করে। বাংলাদেশ একটা রক্তাক্ত বিপ্লবের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয়েছে। বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদের সংগ্রামে জয়ী হয়েছে এটা ভালো করেই মধ্যপ্রাচ্যের প্রগতিশীল দেশ ইরাক জানে। ইরাক এটাও জানে সদ্য স্বাধীনতা প্রাপ্ত বাংলাদেশকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে দেবার মতো আন্তর্জাতিক চক্র খুবই তৎপর। পাকিস্তান ইরানের সঙ্গে দোস্তী করে বাংলাদেশকে বেকায়দায় ফেলতে চায়। ইরান কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশকে তেল সরবরাহ করবে না। তাছাড়া পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর অপ-প্রচারের জন্যে জন্ম লগ্নে বাংলাদেশের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোর তখনও পর্যন্ত একটা হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। এমনি সংকটজনক ও ক্রান্তিলগ্নে যখন বন্ধুদেশ ইরাক বাংলাদেশকে তেল সরবরাহ করার আশ্বাস দিয়েছিলেন তখন একশ্রেণীর আমলারা এ প্রস্তাবের স্বপক্ষে সায় দেয়নি। তাঁরা জ্ঞানপাপীর মতো মাথা দুলিয়ে বলেছেন যে, ইরাকী অপরিশোধিত তেল আমাদের শোধনাগারের পক্ষে ‘সুবিধেজনক’ হবে না। এই তেল দিয়ে ‘কাজ’ চালানো যাবে না। একশ্রেণীর আমলাদের এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন সম্ভব হয়নি ইরাকের সঙ্গে তেল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করা। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত ইরাকের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেছেন। তেল সম্পর্কিত চুক্তিও করেছেন। সে সময়ে আমরা অনায়াসে ও অবলীলা ক্রমে ইরাকের সঙ্গে চুক্তি করতে পারতাম। আর তা যদি হোত তাহলে তেল নিয়ে আমাদের দীর্ঘ দু’বছর দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। আমলাদের এই ‘হয়কে’ ‘নয়’ আর ‘নয়কে’ ‘হয়’ করার অদৃশ্য কেরামতিতে যে রহস্য নাটকের সূচনা হয়েছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এ থেকে স্পষ্টই প্রতীয়মান হচ্ছে যে, একশ্রেণীর আমলা ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক প্রভুদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য এক বিশেষ চক্রজাল সৃষ্টি করেছেন। আর এই চক্রজালের কল্যাণেই ইরাকী তেলের দামের চেয়ে চারশ’ ভাগ বেশী দামে এতোদিন ধরে তেল কিনতে হয়েছে। এতে একদিকে বাংলাদেশের কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার যেমন অপচয় হয়েছে অন্যদিকে কোনো কোনো আমলার পকেট ভারীও যে হয়নি এমন নয়। এদেরই জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে গরীব জনসাধারণকে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, এই আমলাচক্র যে কতটা সক্রিয় তারই প্রমাণ পাওয়া যাবে বন্ধুদেশ ভারতের সাম্প্রতিক ঘটনা থেকে। ভারতীয় প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ডঃ বি.এস. মিনহাস কিছুদিন আগে আকস্মিকভাবে পদত্যাগ করেন। তিনি পদত্যাগ করেন এমন একটি সময়ে যখন সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান মিঃ লিওনিদ ব্রেজনেভ ভারত সফরে আসছেন। ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার অর্থনৈতিক ও কারিগরি বিষয়ে সহযোগিতামূলক চুক্তি সম্পাদিত হতে যাচ্ছে। ডঃ মিনহাসের পদত্যাগের রহস্য উদ্ঘাটিত না হলেও পত্র-পত্রিকায় যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তাতে দেখা যায় যে, ডঃ মিনহাস সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযোগিতাকে সুনজরে দেখতে পারেননি। তাই তিনি ‘ভারতের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অবাস্তব’ এই খোঁড়া যুক্তি দেখিয়ে প্ল্যানিং কমিশন থেকে স্বেচ্ছায় বিদায় নিয়েছেন।
সবচেয়ে আশ্চর্য্যের বিষয় হলো ডঃ মিনহাসের পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন মুল্লুকের পত্র-পত্রিকাগুলো সোচ্চার হয়ে উঠেছে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার গত ১০ই ডিসেম্বর সংখ্যায় সাংবাদিক মিঃ বার্নাড উইনরাব লিখেছেন সকল মতানৈক্যের মূলে হলেন স্পষ্টভাষী সম্মানিত ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য ডঃ বি.এস. মিনহাস। ডঃ মিনহাস বেসরকারী পর্যায়ে বলেছেন যে, ‘ভারতের নতুন অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অবাস্তব।’
আমরা এখনো পর্যন্ত জানি না ভারত যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন তা বাস্তব কি অবাস্তব। ডঃ মিনহাসের বক্তব্যের পেছনে কতটুকু সত্যতা নিহিত তাও জানবার কোনো উপায় আপাততঃ নেই। তবে এটা বুঝি যে, ভারত পুঁজিবাদী দেশ বিশেষ করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তথাকথিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নামে সাহায্য ও সহযোগিতার উপর ভিত্তি করে এগিয়ে যেতে নারাজ। ভারত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও কারিগরি সাহায্য এবং সহযোগিতার মাধ্যমে আগামী দিনগুলোতে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। অথচ ভারতের বর্তমান মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে সেখানকার দক্ষিণপন্থী ও অতি বামপন্থী দলগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। হৈ চৈ আর চরম নৈরাজ্যের সৃষ্টি করে অচলাবস্থার সৃষ্টি করা যায় কি না সেটাই হচ্ছে তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। আর এদেরই সঙ্গে হাত মিলিয়েছে একশ্রেণীর আমলা। এই আমলা আর পদস্থ কর্মকর্তাদের কেউ যদি কোণঠাসা হয়ে পড়েন তখনই মার্কিন মুল্লুকের পত্রিকাগুলো সোচ্চার হয়ে ওঠে ‘গেলো গেলো’ বলে।
বাংলাদেশেও যে এমনটি হচ্ছে না তেমন মনে করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। হচ্ছে হচ্ছে বলেই ‘নয়কে’ ‘হয়’ করার জন্যে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এগিয়ে আসতে হয়। কোথায় এবং কার সাথে তেল নিয়ে আলাপ-আলোচনা করতে হবে প্রয়োজনে চুক্তি সম্পাদন করতে হবে সে নির্দেশ দিতে হয়।
পরিশেষে আমরা এ কথাই বলবো যে, এমনিভাবে ‘হয়’ আর ‘নয়’ এর নাটক যদি চলতে থাকে তাহলে বাংলাদেশের পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব হবে না সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাওয়া। সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সম্ভব হবে না জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা মোচন করা এবং বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় রোধ করা। তাই আজকের দিনে সর্বাগ্রে প্রয়োজন হলো ‘ইরাকী তেলে কাজ হবে না’ বলে যাঁরা সেদিন রায় দিয়েছিলেন সেই সব রথী মহারথীদের খুঁজে বের করে তাদের সমুচিত শাস্তি প্রদান করা। দেশের ও দশের স্বার্থেই তেল নিয়ে এ কেলেংকারীর তদন্ত করতে হবে। কারণ পেছনে শত্রু রেখে কোনোদিনই যে যুদ্ধে জয় করা যায় না এটা সর্বজনবিদিত সত্য।
কয়লা আমদানীর ব্যাপারে অদূরদর্শিতা পরিহার করুন
দেশে আমদানীকারক মওজুত কয়লা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে বলে ঢাকার একটি পত্রিকায় সম্প্রতি এক খবর প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে যে, গত বছরের ২৭শে ডিসেম্বর কোক কয়লার মওজুত শেষ হয়ে গেছে। ফলে দেশের বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার পথে। জানা গেছে, স্টীম কয়লার মওজুতও প্রায় শেষ হওয়ার পথে। বাংলাদেশে সারা বছরে আট লাখ টন কয়লার প্রয়োজন. সেখানে পতেঙ্গা কয়লা ডিপোতে মাত্র ১৯ হাজার টন কয়লা রয়েছে। গত বছর ভারত থেকে ৭৭ হাজার টন স্টীম কয়লা চট্টগ্রামে এসেছিল এবং আরো কয়েক হাজার টন ভারতীয় কয়লা খুলনা নদীপথে ও বেনাপোল দিয়ে বাংলাদেশে আসে। গত বছর এক লাখ বিশ হাজার টন স্টীম কয়লা আমদানীর জন্যে ভারতীয় কয়লা সরবরাহকারীদের সঙ্গে এক চুক্তি হয়েছিল; কিন্তু সে কয়লা এখনো আনা হয়নি। জানা গেছে, শিপিং কোম্পানীগুলোর সাথে নাকি যথাসময়ে চুক্তি না হওয়ার দরুণ উক্ত কয়লা আনা আর সম্ভব হচ্ছে না। গত পয়লা জানুয়ারী থেকে বাংলাদেশ রেলওয়েকে পতেঙ্গা ডিপো কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। এখন থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে সরাসরি ভারত থেকে তাদের প্রয়োজনীয় কয়লা আমদানী করবে। বর্তমানে কাগজকল, কতিপয় শিল্প, জুট মিল, রি-রোলিং মিল ইত্যাদি কারখানায় অত্যাধিক কয়লার প্রয়োজন। প্রতিটি ইটের ভাটার জন্যে যেখানে লক্ষ লক্ষ টন কয়লার প্রয়োজন সেখানে কয়লা বিভাগ মাত্র ৫০ টন করে কয়লা মঞ্জুর করতে সক্ষম হচ্ছে। টাকাটা ভাটার মালিকদেরকে কাঠ পুড়িয়ে পুষিয়ে নিতে হচ্ছে। উক্ত খবরে আরো একটি বিস্ময়কর সংবাদ রয়েছে তাহলো—স্বাধীনতার পর নাকি কোনো কয়লার আমদানী আর হয়নি, যে মওজুত কোক কয়লা ছিলো তা স্বাধীনতার পূর্বে পোল্যান্ড থেকে আমদানীকৃত কয়লা।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকার মিল-কারখানা ও রেলওয়ে ছাড়াও লক্ষ লক্ষ টন কয়লার প্রয়োজন হয় ইটের ভাটার জন্য। অতীতে এই সকল কয়লা বিদেশ থেকে অধিক মূল্যে আমদানী করে আনা হতো। যেহেতু ভারতের সঙ্গে তৎকালে সদ্ভাব ছিল না সেহেতু অধিক মূল্যে কয়লা আনার ব্যাপারেও তারা দ্বিধা করেনি। আজ স্বাধীনতার পর চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কয়লার আমদানী নিশ্চিত করা হয়নি। বিভিন্ন সময়ের এই অনিশ্চিত আমদানীর দরুণ দেশের কোটি কোটি টাকার সম্পদ উৎপাদনের কাজ ব্যাহত হচ্ছে। এ ব্যাপারে আমরা পূর্বেও বলেছি কয়লা আমদানী নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করা হোক। ভারতের সঙ্গে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় চুক্তি ও অন্যান্য বিষয় চূড়ান্ত করা হোক।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক