You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১২ই জানুয়ারী, শনিবার, ১৯৭৪, ২৭শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

বক্তব্যের বাস্তবায়ন চাই

দেশের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্টকারী ও স্বাভাবিক জনজীবনে বিঘ্নসৃষ্টিকারী এবং তাদের উস্কানিদাতা ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যে তাদের ব্যবহারকারীদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে গতকাল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি বক্তব্য রাখা হয়েছে। এই বক্তব্যে বলা হয়েছে যে, কেউ স্বহস্তে আইন তুলে নেওয়া অথবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি এবং জনজীবনে অচলাবস্থার সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে দেশের আইন অনুযায়ী সরকার তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সরকার গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছেন যে, সম্প্রতি কোনো কোনো রাজনৈতিক মহল থেকে মারাত্মক উস্কানিমূলক ও দায়িত্বজ্ঞানহীন বিবৃতি উচ্চারিত হয়েছে। এই সকল রাজনৈতিক মহল থেকে বেআইনী কার্যকলাপ প্রয়োগ, জনগণের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা অচল, যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন, বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র সহ গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে হামলা চালাবার প্রকাশ্যে হুমকি দিয়েছে। তারা এমনকি দেশে গৃহযুদ্ধ শুরু করারও হুমকি দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে জনগণের কল্যাণ এবং জনজীবনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার দীর্ঘ সময় নীরব দর্শক হয়ে থাকতে পারেন না। সরকার এ ধরনের কার্যকলাপ এবং হুমকি সহ্য না করার সংকল্পের কথা দৃঢ়তার সাথে পুনরায় স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছেন।
গতকাল সরকারের পক্ষ থেকে প্রদত্ত এই বক্তব্য অত্যন্ত সময়োচিত বলে আমরা মনে করি। কেননা, গত ১৪ই ডিসেম্বর ও গত ৩০শে ডিসেম্বর পল্টন ময়দানে আয়োজিত দু’টি পৃথক সাইনবোর্ডধারী এবং একই ধরনের আদর্শে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের প্রবীণ ও নবীন নেতারা এবং গত পরশু একটি সাংবাদিক সম্মেলনে শেষোক্ত দলের তথাকথিত নেতারা যে হিংসাত্মক, নাশকতামূলক ও ধ্বংসাত্মক কাংর্যে অংশ গ্রহণের জন্য জনগণের কোনো কোনো অংশের প্রতি যে প্ররোচণামূলক বক্তব্য রেখেছেন এবং তার সাথে সাথে নিজেদের দল ও দলীয় কর্মী বলে কথিত একশ্রেণীর দেশদ্রোহীদের প্রতি উপরোক্ত কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে করে দেশের সাধারণ মানুষ কিছু না কিছু উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক। দেশের মানুষের মঙ্গলসাধন তথা দুষ্টের দমন এবং শিষ্টের পালন যেখানে সরকারী নীতির ভিত্তি সেক্ষেত্রে জনগণ সরকারের কাছ থেকে এসব হিংসাত্মক, নাশকতামূলক ও ধ্বংসাত্মক তৎপরতা প্রতিরোধের জন্য যখন উন্মুখ, তখন তার সাথে সাথে এ প্রশ্নে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখারও কর্মসূচী গ্রহণ অনিবার্য। আমরা সরকারের এই বক্তব্যকে অভিনন্দন জানাই এবং তার সাথে সাথে সরকারের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য উচ্চারিত হয়েছে—সরকারের কাজে তার প্রতিফলন ঘটুক, সেটাই কামনা করি।
আমাদের দেশ সমাজতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের দেশ। এমতাবস্থায় গণতন্ত্রের নামে যারা ফ্রি স্টাইল কায়দায় দায়িত্বজ্ঞানহীন কথাবার্তা বলে দেশের মানুষের শান্তি ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপন্ন করতে উদ্যত, দেশ স্বাধীন হবার পর দীর্ঘ দুই বছর তাদের শুভবুদ্ধির উদয় হবার জন্যে সময় দেওয়া হয়েছে—কিন্তু চোরারা ধর্মের কথা শোনেনি—শুভবু্দ্ধি তাদের উদয় তো হয়ইনি—পরন্তু যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে অচলাবস্থা, নৈরাজ্য ও নিরাশা সৃষ্টির কাজে তারা তৎপর হয়েছে। লুটপাট, ডাকাতি, রাহাজানি, গুপ্তহত্যা, ব্যাংক ডাকাতি আর অপরিপক্ক রাজনীতির অসহিষ্ণু মনের প্রলাপ বকে গোটা দেশে একটা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব করে চলেছে। গণতন্ত্রের মহান বক্তব্য পরমত সহিষ্ণুতাকে ওরা জলাঞ্জলি দিয়েছে। এখন সরকারকে দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণের স্বার্থে প্রকৃত গণতন্ত্র, দেশ ও জাতিকে রক্ষার কাজে গৃহীত কর্মসূচী বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে হবে।

নয়া পাট নীতি : এখনো যে ফল পাকেনি

গত মৌসুমের পাটনীতির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলেও চলতি মৌসুমের পাটনীতি এখনো ঘোষণা অপেক্ষায়।
অবশ্য, একটা অনিশ্চিত আশ্বাস বাণী পাওয়া গেছে। গত পরশুদিন নারায়ণগঞ্জে কোনো এক অনুষ্ঠানে উদ্বোধনকালে আমাদের পাটমন্ত্রী বলেছেন, আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিল অধিবেশনের পর এ মাসের শেষ সপ্তাহ নাগাদ সরকার চলতি মৌসুমের পাটনীতি ঘোষণা করবেন।
তিনি বলেছেন যে, আমাদের সোনালী আঁশের যাবতীয় সমস্যা সম্পর্কে সরকার অত্যন্ত সজাগ আছেন এবং এ সমস্যাগুলো খুঁজে বের করে তার সুষ্ঠু সমাধান করতে পারলেই পাটের সার্বিক উন্নতি সাধন সম্ভব হবে।
বিলক্ষণ, আমরাও তার সঙ্গে একমত। কিন্তু কথা হচ্ছে, এমন ‘হচ্ছে-হবে’ ভাব তো আমরা বহুদিন থেকেই শুনে আসছি আর শুনতে শুনতে চলতি মৌসুমকেও প্রায় ছাড়িয়ে যেতে চলেছি, তবুও এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি এখনো ঘোষণা অপেক্ষায় কেন? আমাদের মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রার সিংহভাগ অর্জনকারী সম্পদ ‘পাট’ সম্পর্কে এই অবহেলামূলক বিলম্বনীতিই কি কর্তৃপক্ষের এ সম্পর্কে ‘পূর্ণ সজাগতা’র পরিচায়ক?
মন্ত্রী বলেছেন, এই প্রণিতব্য নয়া পাটনীতিতে পাটচাষীদের পাটের ন্যায্যমূল্য পাবার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। এও উত্তম কথা, কিন্তু ভবিষ্যত সব সময়েই অনিশ্চিত এবং অতীতকে বিচারের পরই সাধারণতঃ ভবিষ্যতকে মোটামুটি ভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় এটা কে না জানে? অথচ, গত মৌসুমে সরকার ঘোষিত পাটনীতিকে চাষীরা তাদের পাটের জন্যে ন্যায্যমূল্য পেয়েছে কি না এ সম্পর্কে মন্ত্রী মহোদয় কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখতে পারেননি।
তিনি আরো জানিয়েছেন যে, দেশে বর্তমানে চালু ৭৫টি চটকলে যে প্রায় ২৫ হাজার ভুয়া শ্রমিক বা উদ্বৃত্ত শ্রমিক আছে তাতে সরকার প্রতিমাসে প্রায় ৬ কোটি টাকা গচ্চা দিচ্ছেন। এদের উচ্ছেদ করার জন্যে সরকার কঠোর ব্যবস্থা করবেন।
আমাদের মতে, এও হবে সরকারের পক্ষে একটা মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ। আর, আমাদের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত চটগুলোতে যে এতো বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত শ্রমিক নিয়োজিত আছে, কিম্বা, সরকার প্রতিমাসে যে এতো বিপুল পরিমাণ টাকা গচ্চা দিচ্ছেন সে খোঁজ এতদিন পরে কেন এলো? এতদিন এ সম্পর্কে কেন কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি? তবে কি ধরে নিতে হবে কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে আগে অবহিত ছিলেন না, কিম্বা এতদিন কর্তৃপক্ষ নাকে তেল দিয়ে সুখনিদ্রা যাচ্ছিলেন? এর কোনোটিও যদি সত্যি হয়, তবে কি নিশ্চিন্তে বলা চলেনা যে, কর্তৃপক্ষ পাটরাজ্যে তার সুযোগ অনুসন্ধানী দৃষ্টি রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন?
আমরা কিন্তু কর্তৃপক্ষের এ উচ্ছেদ পরিকল্পনাকে সর্বান্তকরণে সুযোগ পদক্ষেপ বলে ভাবতে পারছি না। আমাদের মতে, এই প্রকট বেকার সমস্যার নাজুক সময়ে এতোগুলো শ্রমিককে অযথা নাড়িয়ে বর্তমান সমস্যাকে আরো ঘোলাটে করা সমুচিত হবেনা। বরং তাদের উচ্ছেদ না করে তাদের শ্রমের সদ্ব্যবহার করা হোক এবং দেশে উৎপাদন বৃদ্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করা হোক। কারণ, দেশের বিভিন্ন মিলে যে দারুণ নৈরাজ্য বিরাজ করছে, তা শুধু উদ্বৃত্ত শ্রমিকের গায়ে ধরিয়ে অসাধু ও অযোগ্য কর্মকর্তাদের বাঁচানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করলে চলবেনা। তাদের বিরুদ্ধেও কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করে পাট-সম্পদকে জঞ্জালমুক্ত করতে হবে। তর্ক না হলে পাট সম্পর্কে যে কোনো নীতিই প্রণীত হোক না কেন, এসব অসাধু ও অবাঞ্ছনীয় অর্বাচীনদের চক্রান্তে তা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে বাধ্য।
সুতরাং পাটের বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে আমরা এ যাবত যে সব কথা আলোচনা করে এসেছি, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা সরকারের কাছে একান্তভাবে অনুরোধ রাখবো যাতে সরকার তার আগামী নয়া পাটনীতিতে অন্ততঃ নীচের কয়েকটি বিষয়ের প্রতি যেন বিশেষ দৃষ্টি রাখেন :
(ক) পাট উৎপাদনে চাষীর যে কোনো প্রাথমিক প্রতিবন্ধক দূর করার ব্যবস্থা করতে হবে।
(খ) পাট-চাষে চাষী সত্যিই যাতে উৎসাহ অনুভব করে সেজন্যে যাবতীয় উৎসাহদানমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
(গ) উৎপন্ন পাট সংগ্রহ বা সরবরাহে টাউট ফড়িয়াদের সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা। সরকার প্রত্যক্ষভাবে চাষীর কাছ থেকে পাট সংগ্রহ করলে এ দৌরাত্ম্য কমে যাবে।
(ঘ) পাট খুব ভালো হয় এমন ক্ষেতে কেউ অন্য ফসল বুনছে কি না কিম্বা পাটের উপযুক্ত মৌসুমে কেউ পাট বোনা থেকে বিরত আছে কি না সেদিকে কঠোর দৃষ্টি দিতে হবে। কারণ এও এক ধরনের পরোক্ষ সমাজ-বিরোধী কান্ড। এ জন্যে শাস্তির প্রয়োজন।
(ঙ) দেশে পাটের সরকারী মূল্য অপরাপর স্থানীয় পাটের মূল্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা রেখে চাষীকে যাতে তার সর্বশ্রেষ্ঠ মূল্য দিতে পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখতে হবে। কারণ, পাচারে পাটের বেশী মূল্য পাওয়া যায় বলেই সীমান্ত পাচার বৃদ্ধি পেয়েছে।
(চ) দেশের সমস্ত অনাবাদী অঞ্চলে সরকারী তদারকে ধান ও পাট বোনায় প্রাধান্য দিতে হবে।
(ছ) আভ্যন্তরীণ জল বা সড়ক পরিবহনের যাবতীয় সমস্যা দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
(জ) অযথা কোথাও যাতে পাট গুদামজাত না হয়ে থাকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে এবং অপরাধীকে শাস্তি দিতে হবে।
(ঝ) মিলে পাট নিয়ে এ পর্যন্ত যত ঘাপলার কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তা দূর করার চেষ্টা করতে হবে।
(ঞ) বিদেশে কোনো নিম্নমানের পাট একমাত্র পার্টির ইচ্ছামাফিক ছাড়া যাতে অসাধুর চক্রান্তে রপ্তানী না হয় এবং বিদেশে আমাদের বাজার ও সুনাম অটুট থাকে সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। সবশেষে পাটের উৎপাদন থেকে পাটজাত দ্রব্যের রপ্তানী পর্যন্ত যাবতীয় ঘাপলা যাতে না আর থাকে সেজন্য সর্বক্ষেত্রে সর্বাত্মক সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!