বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৪ঠা ডিসেম্বর, মঙ্গলবার, ১৮ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০
পাট নিয়ে নৈরাজ্য
বাংলাদেশের পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিভিন্ন মহলে আজ নানা প্রকার প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে। দেশের পত্র পত্রিকাগুলো এ নিয়ে বহু মতামত ব্যক্ত করেছে। কিন্তু অবস্থার তেমন পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। গত জুলাই মাসে যখন ১৯৭৩-৭৪ সালের পাট নীতি ঘোষণা করা হয়েছিল তখন অনেক প্রকার আশ্বাসের কথা আমরা শুনেছিলাম। তখন বলা হয়েছিল আগামী নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে চাউল ও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের মূল্যের প্রতি লক্ষ্য রেখে নির্ধারিত পঞ্চাশ টাকা মণ পাটের মূল্য পুনর্বিবেচিত হবে। নভেম্বর শেষ হয়ে ডিসেম্বর চলছে, অথচ পাটের মূল্য পূনর্বিবেচনার পূর্ব প্রতিশ্রুতি পালনের কোন লক্ষণই আমরা দেখছি না। অন্যদিকে পাট ক্রয় ও পাট রপ্তানীর বিষয়টিও নৈরাজ্যজনক হয়ে পড়েছে। পাটনীতি ঘোষণার সময়ই আমরা জেনেছিলাম, বিগত বছরের তুলনায় দুই লাখ আটান্ন হাজার একর জমিতে কৃষকেরা পাট বোনেনি।
কেন এই বিরাট পরিমাণ জমিতে এবার পাট বোনা হয়নি সে কারণটিও কর্তৃপক্ষ সূত্রে বিষদ ব্যক্ত করা হয়নি। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের বাজারদর এবং পাটের মূল্য পরস্পরের সঙ্গতি রাখতে সক্ষম হয়নি। ফলে পাট বোনার ব্যাপারে কৃষকদের উৎসাহ বিনষ্ট হয়ে গেছে। পাটনীতি ঘোষিত হবার পর আমরা পাটের মূল্য পুনর্বিবেচনার প্রশ্নে মন্তব্য করে ছিলাম যে, নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে যদি পাটের মূল্য আনুষঙ্গিক কারণে পুনর্বিবেচনা করা হয় তাহলে সে সুযোগ সাধারণ কৃষকরা পাবেনা বলেই আমাদের ধারণা। কেননা এ সময় কৃষকদের হাতে পাট থাকেনা। এবছর পাট ক্রয়ের ব্যাপারে আমরা নিদারুণ নৈরাজ্য লক্ষ্য করেছি। গত বছর সরকারি পাট ক্রয় কেন্দ্র ছিল তিনশটি। পাটনীতিতে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল যে, এরপর পাঁচশত সরকারী পাট ক্রয় কেন্দ্র খোলা হবে যাতে করে কৃষকরা সরকার নির্ধারিত মূল্যে সরাসরি পাট বিক্রি করতে সক্ষম হয়।
জে.টি.এস ছাড়াও অন্য তিনটি সরকারি সংস্থা এবার পাট করেছে। অন্যদিকে বিভিন্ন মিল ও কোম্পানি তাদের নিজস্ব করার কেন্দ্রের মাধ্যমে পাট কিনেছে। এতদসত্ত্বেও এবার প্রমাণ হয়েছে যে, দেশের অগণিত সাধারণ কৃষকরা পাটের ন্যায্যমূল্য পায়নি। বিভিন্ন ক্রয় কেন্দ্র বা সংস্থা গোডাউনের অভাব দেখিয়ে যথাযথ পাট ক্রয় থেকে বিরত থেকেছে। ফলে ফড়িয়া এবং ছোট বড় ব্যবসায়ীরা যেনতেন একটা মূল্যে কৃষকদের কাছ থেকে পাট কিনেছে। প্রয়োজনীয় সংখ্যক গোডাউনের অভাব যতই হোক না কেন সরকার এ ধরনের অজুহাত দেখিয়ে দেশের গোটা কৃষকদের নৈরাশ্যের মাঝে ঠেলে দিতে পারে না। ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের শিকারে কৃষকদের প্রাণান্ত করতে পারেনা। পাটনীতি ঘোষিত হবার পর পরই সরকারের উচিত ছিল ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের হাত থেকে কৃষকদের বাঁচিয়ে তদের পাটের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার জন্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া।
কিন্তু সরকার সে কাজে ব্যর্থতা দেখিয়েছেন। কৃষকদের কাছ থেকে সঠিকভাবে পাট ক্রয়ের ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ যেমন তাদের অযোগ্যতা প্রদর্শন করেছেন ঠিক তেমনিভাবে পাট বিদেশে রপ্তানির ব্যাপারেও কর্তৃপক্ষের অকৃতকার্যতা জাতিকে নিরাশ করেছে। পাটনীতি প্রাকৃতিক ঘোষণার সময়ই উল্লেখ করা হয়েছিল যে, বিগত বছরের রপ্তানির লক্ষ্য পরিমাণ পূরণ করা হয়নি। অর্থাৎ বাইশ লক্ষ্য বেল পাট গত বছরই রপ্তানি করতে কর্তৃপক্ষ ব্যর্থ হয়েছেন। পাটনীতি ঘোষণার সময় সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা জানিয়েছেন যে, এ বছর পঞ্চান্ন লাখ বেল পাট উৎপাদিত হবে এবং গতবার ও এবার মিলিয়ে সরকারের হাতে সাতাত্তর লাখ বেল পাট থাকবে। বিদেশে কাঁচা পাট রপ্তানীর লক্ষ্য হলো তেত্রিশ লাখ বেল এবং দেশের মিল-কারখানায় লাগবে তেত্রিশ লাখ বেল। এছাড়া গ্রামের মানুষের কাজে দেড় লাখ বেল সংরক্ষিত রাখার পর সরকারের হাতে নয় লাখ বেল পাট অবশিষ্ট থেকে যাবে।
এই সহজ ও সাদামাটা অংক কষে পাট মন্ত্রণালয় জাতিকে যে জ্ঞানদান করে রেখেছেন তা কতটুকু বাস্তবানুগ হবে সেটা অবশ্যই বিবেচ্য। জানা গেছে এবারও নাকি বিদেশে রপ্তানির জন্যে যে সময় ও পাটের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়েছে তা কর্তৃপক্ষ পূরণ করতে পারবেননা। বিদেশে পাটের চাহিদা থাকা সত্বেও রপ্তানির ব্যাপারে আমাদের কর্তৃপক্ষীয় অযোগ্যতা কোন প্রকারেই গ্রহণযোগ্য নয়। সময়মত ও পরিমাণ মোতাবেক পাট রপ্তানী ত্বরান্বিত না করার দরুন ফড়িয়া ও ব্যবসায়ীদের অধিকাংশ পাট পাচার করে দিচ্ছে। কেননা গুদামে অনিশ্চিতকালের জন্যে পাট রাখার যেমন নানা কারণে অসুবিধা তেমনি বিভিন্ন ভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্যে কেউ ব্যবসায়ে টাকা আটকিয়ে রাখতেও অনিচ্ছুক। ফলে তারা পাট পাচার করে দিয়ে এবং অনেক ক্ষেত্রে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে বীমার টাকা উসুল করার মাধ্যমে কৃষকদের রক্তের মূল্যে উৎপাদিত বাংলাদেশের সোনার আঁশের সদ্ব্যবহার করছে।
সরকারের লক্ষ্য রয়েছে পাট রপ্তানির মাধ্যমে দুইশত পঁচাত্তর কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করার। এর মধ্যে একশত পনেরো কোটি টাকা কাঁচা পাট থেকে ও একশত ষাট কোটি টাকা পাটজাতদ্রব্য থেকে। আমরা তাই আবার অনুরোধ করবো, কর্তৃপক্ষ জাতির বৃহত্তর কল্যাণের কথা চিন্তা করে পাট রপ্তানির ঘোষিত প্রতিশ্রুতি যেন পূরণ করতে এবং দেশের সর্বত্র রপ্তানির অপেক্ষায় জমাকৃত পাটের বিনষ্টি ও পাচার না হবার নিশ্চয়তা বিধান করেন। নিজেদের অযোগ্যতা, অদূরদর্শিতা ও খামখেয়ালীর দরুন স্বদেশের পাট পরদেশের মাধ্যমে বিদেশী বাজারে আদৃত হোক- এটা আমরাও যেমন আশা করিনা তেমনি গোটা জাতিও চায় না।
আচকজাইয়ের মৃত্যুঃ অনেক প্রশ্ন
পাখতুন নেতা খান আবদুস সামাদ আচকজাই আততায়ীর বোমার আঘাতে নিহত হয়েছেন। সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী তার বাড়ীতে প্রবেশ করে শয়নকক্ষে হাতবোমা নিক্ষেপ করলে জনাব আচকজাই নিহত হন। জনাব আচকজাই ১৯৭০ সালে ওয়ালী খানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে সরে আসেন এবং ‘পাখতুনী খাওয়া’ নামে নতুন একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। তার এই নতুন সংগঠনের উদ্দেশ্য ছিলো পাঠানদের জন্য পাখতুনিস্তান প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন। তার এই জয়লাভের পেছনে ছিলো পাঠানদের আবাস ভূমি পাখতুনিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে তার অবদান।
পাখতুন নেতা খান আবদুস সামদ আচকজাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু কোন একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে মনে হয় না। পাকিস্তানী শাসকচক্রের অদৃশ্য অঙ্গুলি সংকেত এ মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে কি না একথা আপাতত বলা না গেলেও সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে অনেক প্রশ্নই উত্থাপিত হতে পারে। পাকিস্তানের নিপীড়িত ও নির্যাতিত জনসাধারণ আজ চরম বিক্ষোভের মুখে ফেটে পড়তে চাইছে।
এ বিক্ষোভের ঢেউ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান থেকে আরম্ভ করে সিন্ধু নদের তীর পর্যন্ত প্রবাহিত। উত্তাল জনসমুদ্রের প্রচন্ড ঢেউয়ের মুখে পাকিস্তানি শাসকচক্র আজ চোখে সর্ষে ফুল দেখছে। আর তারই পরিণতিতে পাকিস্তানী শাসকচক্র দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকাবার জন্য চিরাচরিত নিয়মেরই আশ্রয় গ্রহণ করা হয়েছে সেখানে। পাকিস্তানে আজ নামে মাত্র গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ভুট্টো সরকার বর্তমানে সামরিক চক্রের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। এই সামরিকচক্র বাংলাদেশে যা করেছিলো তাই করে যাচ্ছে পাকিস্তানে। নির্যাতন আর অত্যাচারের ষ্ট্রীম রোলার চালিয়ে স্তব্ধ করে দিতে চাইছে।
পাকিস্তানি জনসাধারণ আজ কতটা বিক্ষুব্ধ তারই প্রমাণ হলো করাচির ও লাহোরের ঘটনা। পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির জন্য বাসের ভাড়া বৃদ্ধি করা হলে গত সপ্তাহে করাচি, লাহোর এবং অন্যান্য শহরে বিক্ষুব্ধ জনতার বিক্ষোভ চরম আকার ধারণ করে। বিক্ষুব্ধ জনতা করাচির দু’টি ব্যাংক ধ্বংস করে এবং দু’টি গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এদিকে ইশতিকলাল পার্টি প্রধান আসগর খানের উপর পুলিশ হামলা চালায়।
ভুট্টো সরকার যে কোন উপায়েই গদীতে টিকে থাকতে বদ্ধপরিকর। আর তাই সেখানে চলছে নির্যাতনের ষ্ট্রীমরোলার। সে জন্যে যদি বিরোধী দলীয় নেতাদের এ পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে হয় তাতেই ভুট্টো সরকার পিছপা হবে না। তারই প্রমাণ হলো আততায়ীর হস্তে জনাব আচকজাইয়ের মৃত্যু, ন্যাপ নেতা ওয়ালী খানের উপর চার বার অদৃশ্য আততায়ীর হামলা, আসগর খানের উপর পুলিশী নির্যাতন। ভুট্টো সরকার আজ যে পথে এগিয়ে যাচ্ছে তা যে অত্যন্ত বিপদসংকুল পথ সেকথা ভেবে দেখার মত সময় ভুট্টো সাহেবের নেই। পাকিস্তানের বর্তমান অশান্ত অবস্থা, পুলিশী নির্যাতনের পরিণতি হলো আবার সেখানে সামরিক শাসন কায়েম। সামরিক চক্র ওৎ পেতে আছে কখন আবার তারা গদীতে বসবে। ভুট্টো সাহেব বিক্ষুদ্ধ জনতাকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য নির্যাতনের ষ্ট্রীম রোলার চালিয়ে সেই পথই প্রশস্ত করে দিচ্ছে। ভুট্টো সাহেব ইতিহাসের শিক্ষা নিতে নারাজ। ইতিহাস কিন্তু সে কথা বলে না। গুপ্তহত্যা আর নির্যাতনের ষ্ট্রীম রোলার চালিয়ে আর যাই হোক, কোন সমস্যার সমাধান হয় না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক