৬ দফার ব্যাপারে দলের মধ্যে কোন্দল
কারাগার থেকে বিভিন্ন নেতার পদক্ষেপ
পাকিস্তানের চক্রান্ত
:::::::::::::::::::::
১৭ তারিখে রেণু ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে এসেছিল। হাচিনা আইএ পরীক্ষা দিতেছে। হাচিনা বলল, “আব্বা প্রথম বিভাগে মনে হয় পাশ করতে পারব না তবে দ্বিতীয় বিভাগে যাবো”। বললাম, “দুইটা পরীক্ষা বাকি আছে মন দিয়ে পড়। দ্বিতীয় বিভাগে গেলে আমি দুঃখিত হব না, কারণ লেখাপড়া তো ঠিকমত করতে পার নাই”। রাসেল আমাকে নিয়ে জেতে চায় বাড়িতে। এক বৎসর হয়ে গেছে জেলে এসেছি। রাসেল একটু বড় হয়ে গেছে। জামাল আসে নাই, খুলনায় গিয়াছে। শুনলাম বাইরে খুব গোলমাল আওয়ামী লীগের মধ্যে। একদল পিডিএমএ যোগদান করার পক্ষে, আর একদল ছয় দফা ছাড়া কোনো আপোষ করতে রাজি নয়। ১৯ তারিখে ওয়ার্কিং কমিটির বর্ধিত সভা। জেলা ও মহকুমার প্রেসিডেন্ট ও সম্পাদকদেরও ডাকা হয়েছে। সভা আমার বাড়িতে করতে হবে বলে একটিং সভাপতি ও একটিং সম্পাদক রেণুকে অনুরোধ করেছে। আমি বলেছি সকালে যদি রাজি হয় তাহা হইলে করিও। আমার আপত্তি নাই। আপোষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নাই। জেলের মধ্যে যারা আছে তাদের মধ্যেই মতবিরোধ আছে। তাজউদ্দিন, মোমিন সাহেব, অবায়দুর, শাহ মোয়াজ্জেম ও মণি কিছুতেই ৬ দফা ছাড়া পিডিএমএ যোগদান করতে রাজি নয়। খোন্দকার মোশতাক যাতে দলের মধ্যে ভাঙন না হয় তার জন্যই ব্যস্ত। যদিও আমার কাছে মিজানুর রহমান এ কথা ও কথা বলে, তবে সেও পিডিএমএর পক্ষপাতী। রফিকুল ইসলাম আমার কাছে এ কথা বলে আর বাইরে অন্য কথা পাঠায়। জালাল ও সিরাজের মতামত জানি না, কারণ কুমিল্লায় আছে। তাজুদ্দিন ময়মনসিংহ থেকে আমাকে খবর দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের মহীউদ্দিনের মতামত আমি জানি না। তবে ছাত্রনেতা নূরে আলম, নূরুল ইসলাম-আওয়ামী লীগ কর্মী, সুলতান ঢাকা সিটি কর্মী, শ্রমীক নেতা মান্নান ও রুহুল আমিনও আমাকে খবর দিয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হতে পারে না। কিছু কিছু নেতা পিডিএমএ এর পক্ষে, কর্মীরা কেউই রাজি না। মানিক ভাইও পিডিএমএ এর পক্ষে। ৮ দফা পিডিএমএ দিয়েছে। আমাদের দলের চার নেতা জহির, রশিদ, মুজিবুর রহমান ও নূরুল ইসলাম সাহেব তো বিবৃতিই দিয়েছে আট দফা আওয়ামী লীগের ‘মানস পুত্র’ বলে। তাদের বিবৃতিতে মনে হয় ৮ দফা দাবি ৬ দফা দাবির চেয়েও ভালো। আমি এটা স্বীকার কররে পারি নাই-তাই আমার মতামত পূর্বেই দিয়ে দিয়েছি। আকাশ-পাতাল ব্যবধান রয়েছে এর মধ্যে। পূর্ব বাংলার লোকদের ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা, বিশেষ করে মাওলানা মওদুদী চৌধুরী মহম্মদ আলী । ৮ দফা পূর্ব বাংলাকে ৬ দফা দাবি থেকে মোড় ঘুরাইবার একটা ধোঁকা ছাড়া কিছুই না। ঐক্যবদ্ধ অন্দোলন আমিও চাই, তবে এই সকল বড় বড় নেতারা আন্দোলন করার ধার দিয়েও যাবে না তা আমার জানা আছে।
মাওলানা মওদুদী আমাকে বিচ্ছন্নতাবাদী বলে আক্রণও করেছে। ১৮ তারিখে জহির সাহেব, সৈয়দ নজরুল সাহেব, মশিয়ুর রহমান ও আবুল হোসেন আমার সাথে দেখা করতে আসেন। অনেক আলাপ করার পরে আমি বলে দিয়েছি পিডিএম এ যোগদান করতে পারেন না এবং যারা দরখস্ত করেছে সেটা অনুমোদনও করতে পারে না ওয়ার্কিং কমিটি। কারণ কাঊন্সিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে ৬ দফা ছাড়া আপোষ হবে না। অন্য কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হলে কাউন্সিল ডেকে সিদ্ধান্ত করাইয়া নিবেন। আমার ব্যক্তিগত মত ৬ দফার জন্য জেলে এসেছি বের হয়ে ৬ দফার আন্দোলনই করব। যারা রক্ত দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফার জন্য, যারা জেল খেটেছে ও খাইছে তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে আমি পারব না।
সূত্র – কারাগারের রোজনামচা, শেখ মুজিবুর রহমান