You dont have javascript enabled! Please enable it!
শুধু ভূয়া মুক্তিযােদ্ধা কেন – বীরউত্তম নিয়েও প্রশ্ন
মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ১৫ মে তারিখে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে, মুক্তিযুদ্ধে যারা বীরত্ব দেখিয়েছেন তারা চার স্তরে গ্যালাট্রি অ্যাওয়ার্ড পাবেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডের নাম পরিবর্তন করে ১ নং স্তবকে বীরশ্রেষ্ঠ, ২নং স্তবকে বীর উত্তম, ৩ নং স্তবকে বীর বিক্রম এবং ৪নং স্তবকে বীর প্রতিক নামকরণ করা হয়। ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সর্বোমােট ৪৩ জনকে উপাধি প্রদানের জন্য বাছাই করা হয়। এছাড়া ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ প্রতিরক্ষা দপ্তরের আন্তঃসার্ভিস প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ৭ জনকে বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জনকে বীরউত্তম, ১৫৯ জনকে বীরবিক্রম ও ৩১২ জনকে বীরপ্রতীক অর্থাৎ ৫৪৬ ব্যক্তিকে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদান করা হয়েছে। এই উপাধি ঘােষণার পর মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এ কারণে যেমনটি জেনারেল মঈনুল হােসেন প্রশ্ন তুলেছেন ভারতের অভ্যন্তরে স্থাপিত হেডকোয়ার্টারে বসে অধিকাংশ সেক্টর কমান্ডারগণ যুদ্ধের নয় মাস কাটিয়ে দিয়েছেন, তারা কিভাবে বীরউত্তম হন। কিন্তু যারা যুদ্ধক্ষেত্রে সম্মুখসমরে শক্রদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অসীম সাহসিকতা নিয়ে, তারা কোনাে খেতাব বা পদক কোনাে কিছুই পাননি। যারা সেনা-অধিনায়ক কিংবা সেক্টর কমান্ডার ছিলেন যাদের মধ্যে অধিকাংশই সম্মুখসমরে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি, শুধুমাত্র প্ল্যানিং, প্রশাসন বা প্রশিক্ষণ নিয়ে থেকেছেন তাদেরকে বিশেষ মর্যাদার মেডেল দেয়া যেতে পারে কিংবা প্রশাসনিক খেতাব দেয়া যেতে পারে কিন্তু গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড বা বীরউত্তম খেতাব দেয়া যায় না।
যে ৬৮ জন বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তারা অধ্যাদেশের শর্ত অনুযায়ী কীভাবে বীরউত্তম হলেন তার পুরাে নথি এবং সাইটেশন জাতির সামনে প্রকাশ করা উচিত। মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবন বাজি রেখে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অনেককে বাদ রেখে যেমন ভুয়া মুক্তিযােদ্ধার সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে, তেমনি বিতর্কিত ও নিয়ম বহির্ভূতভাবে বীরউত্তম খেতাব দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও এসব প্রশ্ন তামাদি হয়ে যায় না যাবে না ।
১. বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্ব ও আত্মত্যাগের মহান দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সেই সব অনন্যসাধারণ বীর মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য খেতাব প্রদানের বিষয়টি মুক্তিবাহিনীর সেনাপ্রধান আতাউল গণি ওসমানী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভায় ১৯৭১ সনের মে মাসের প্রথম দিকে প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে স্বাভাবিকভাবেই বলা হয়েছিল, যারা স্বাধীনতা যুদ্ধে শক্ৰহননে বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতায় জীবন-উৎসর্গ করেছেন তাদেরকে বীরত্বসূচক খেতাব (Gallantry Award) প্রদান করা হলে অন্যরাও তাদের অনুসরণে অনুপ্রেরণা লাভ করবে। মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সেক্টর ও ইউনিটে সিদ্ধান্তটি প্রচার করা হয় এবং বীরত্বপূর্ণ খেতাবের সুপারিশ পাঠানাের জন্য নির্দেশ প্রদান করা হয়।
২. ১৬ই মে মিটিং-এর সিদ্ধান্তের আলােকে ২৮ই অগাস্ট ৭১ কেবিনেট সচিব প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুযায়ী সেনাপ্রধানকে গ্যালান্ত্রী অ্যাওয়ার্ডস স্কীমটির কপি পুনরায় মন্ত্রী পরিষদে পাঠানাের অনুরােধ করেন। (পরিশিষ্ট-ক)
৩. ১৯ অক্টোবর ‘৭১ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি পূর্বে বর্ণিত মন্ত্রীসভার কার্যক্রম খেতাব প্রদানের স্কীমসহ অনুমােদনে স্বাক্ষর করেন।
৪. মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ঘােষিত অধ্যাদেশ সেক্টর কমান্ডার, ইউনিট কমান্ডার, উইং কমান্ডার ও সেনা অফিসারদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। কে কিভাবে যুদ্ধ করেছেন, পাকিস্তান শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে কী ধরনের বীরত্বপূর্ণ কাজ করেছেন এবং এর ফলাফল সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য ও বিবরণী আহ্বান করা হয়। কিছু কিছু এ ধরনের রিপাের্ট মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েই ৮নং থিয়েটার রােড কলকাতা প্রধান সেনাপতির অফিসে চলে আসে। সে সময় মেডেল বা সার্টিফিকেট দেয়া হয়নি। কেবলমাত্র একটি পত্র দ্বারা তাদের জানিয়ে দেয়া হয়।
৫. এই প্রস্তাবটি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৫ মে তারিখে মুজিবগনর মন্ত্রীসভা কর্তৃক অনুমােদিত হয়। সে সময় চার ক্যাটাগরিতে উক্ত গ্যালাষ্ট্রি অ্যাওয়ার্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
এক. সর্বোচ্চ পদ (Highest Order),
দুই. উচ্চ পদ (High Order),
তিন, প্রশংসনীয় পদ (Commendable Order),
৪. বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্র (Gallantry Certificate)।
৩০ জুলাই এ সম্পর্কিত একটি গােপনীয় পত্র প্রধান সেনাপতি সেক্টর কমান্ডারদের নিকট প্রেরণ করেন। সেই পত্রে তিনি বলেছেন তখন পর্যন্ত গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডের জন্য কোন সুপারিশ পাননি। সেজন্য তিনি বিস্তারিতভাবে বিভিন্ন ক্যাটাগরি অনুযায়ী যােগ্যতা নির্ধারণ করে দেন। সর্বোচ্চ পদঃ সর্বোচ্চ পদ তারাই পাবেন যারা জীবনের সর্বোচ্চ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও এমন কাজ করেছেন, যা না করলে বাংলাদেশ বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধিত হতে পারত। তাছাড়া ঐ বীরত্বপূর্ণ কাজের দ্বারা শত্রুসেনাদের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে যুদ্ধের গতিধারাকে নিজেদের স্বপক্ষে প্রভাবিত করেছেন। উচ্চ পদঃ যারা এই স্তরে অ্যাওয়ার্ড পাবেন তাদের পূর্ব বর্ণিত খেতাবের যােগ্যতা অর্জন করতে হবে, তবে তার মাত্রা হবে অপেক্ষাকৃত কম। তাদেরও সম্মুখ সমরে অংশ নিতে হবে। প্রশংসনীয় পদঃ এই অ্যাওয়ার্ড পাবেন তারাই যারা পূর্ব বর্ণিত খেতাবের মতাে যােগ্যতা অর্জন করতে সমর্থ হবেন, তবে তা অপেক্ষাকৃত আরও কম মাত্রায়। বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্রঃ উপরের তিন প্রকার খেতাবের যােগ্যতা অর্জন না করলেও এমন সাহসিকতাপূর্ণ কাজ করেছেন যার স্বীকৃতি প্রদান প্রয়ােজন।
৬. এসব গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রথম ক্যাটাগিরিতে তিনজন সাক্ষ্য, উচ্চ স্তরে দু’জন সাক্ষ্য, তৃতীয় স্তরে একজন এবং চতুর্থ স্তরে কোনাে সাক্ষ্যের প্রয়ােজন হবে না। গ্যালান্টি অ্যাওয়ার্ডদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে দশ হাজার, উচ্চ পর্যায়ে পাঁচ হাজার, তৃতীয় পর্যায়ে দুই হাজার টাকা প্রদান করা হবে। বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্র যারা পাবেন তারা কোন অর্থ পাবেন না।
৭. এই পত্রে যাদের অ্যাওয়ার্ড দেয়া হবে তাদের গােপনীয়তা রক্ষা করার কথা বলা হয়েছে। তাছাড়া অবিলম্বে যাদের অ্যাওয়ার্ড দেয়া প্রয়ােজন তাদের জন্য বিশেষ প্রভিশন রাখা হয়েছে। যারা অপারেশনে সাহস ও বিশেষ ধরনের উল্লেখযােগ্য বীরত্বপূর্ণ কর্ম করেছেন তাদেরকে অবিলম্বে এই অ্যাওয়ার্ডের জন্য সুপারিশ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডের জন্য একটি বাছাই কমিটি গঠন করার প্রস্তাব রাখা হয়। উক্ত পত্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শেষ অনুচ্ছেদটি হচ্ছে যারা এ ধরনের খেতাব পাবেন তাদের যুদ্ধে সাহসিকতার বিস্তারিত বিবরণ থাকতে হবে, সাইটেশন থাকবে এবং তা অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে হবে এবং প্রয়ােজনীয় ব্যক্তি ছাড়া কাউকে দেখানাে যাবে না । খেতাব প্রদানের সংবাদ রেডিও বা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশের পর সংযােজন বা বিয়ােজন করা যাবে। পরিশিষ্ট-খ।
৮. এই সঙ্গে সুপারিশমালার বিভিন্ন সিরিয়াল বা অনুচ্ছেদের বর্ণনা রয়েছে। পরিশিষ্ট-গ।
৯. বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্যালাষ্ট্রি অ্যাওয়ার্ডের পুনঃনামকরণ করা হয়। সর্বোচ্চ পদ- বীরশ্রেষ্ট, উচ্চ পদ- বীর উত্তম, প্রশংসনীয় পদ- বীর বিক্রম, বীরত্বসূচক প্রশংসাপত্র- বীর প্রতীক নাম করা হয় ।
১০. ১৯৭২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ গেজেট ৬ই এপ্রিলে প্রকাশিত এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ৪৩ জনের নাম প্রকাশ করে। এর মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বীরশ্রেষ্ট মাত্র ১ জন (Highest Order), বীর উত্তম ৩ জন (High Order), বীর বিক্রম ১৪ জন (Corrumendable Order), বীর প্রতিক ২৫ জন। (Gallantry Certificate) এর নাম প্রকাশিত হয়। পরিশিষ্ট -ঘ।
১১. ১৯৭৩ সালের ২৬ মার্চ ৫৪৬ জন মুক্তিযােদ্ধাকে উপাধি প্রদান করা হয় উপযুক্ত ৪৩ জনসহ। এয়ার ভাইস মার্শাল এ, কে খন্দকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকালীন বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন ইউনিট, সেক্টর ও ব্রিগেড থেকে পাঠানাে সুপারিশ যাচাই বাছাই করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এ তালিকা অনুমােদন করেন এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে যা র্যাটিফাই করা হয় । ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে সর্বোমােট ৬৭৬ মুক্তিযােদ্ধাদের উপাধি প্রদান করা হয় । উপাধি ও খেতাবপ্রাপ্তদের অ্যাওয়ার্ড বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আর্মি -২৮৮ জন, নেভি ২৪ জন, এয়ার ফোর্স ২১ জন, বাংলাদেশ রাইফেলস্ ১৪৯ জন, পুলিশ ৫ জন, মুজাহিদ/আনছার ১৪ জন, গণবাহিনী(গেরিলা) ১৭৫ জন।
১২. ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের প্রথমার্ধে সেক্টর কমান্ডারদের নিকট জানতে চাওয়া হয়, কোন কোন অফিসার, সৈন্য বা অনিয়মিত বাহিনীর কোনাে সদস্য বীরত্বপূর্ণ কোন কাজ সম্পাদন করেছেন তার রিপাের্ট । এবং উক্ত রিপাের্টে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত বিবরণ চাওয়া হয় যার (রিকোমেন্ডেশন ফর গ্যালাষ্ট্রি অ্যাওয়ার্ড, হেডকোয়ার্টার বাংলাদেশ, ফোর্সেস লেটার নং- ১০/১৫ এ ৩০জুলাই ১৯৭১) ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। উক্ত অনুচ্ছেদে তারিখ, সময়, স্থান ইত্যাদি যুক্ত করে সাহসিকতাপূর্ণ যুদ্ধের জন্য বিবরণ প্রদাণের উল্লেখ করা হয়। গ্যালান্ট্রি অ্যাওয়ার্ডের সুপারিশের জন্য ১, নাম, রেজিমেন্ট, সার্ভিস নম্বর ২. তারিখসহ ব্যাঙ্ক ৩, ট্রেড বা ক্লাস ৪. যারা শহীদ হয়েছেন তাদের নাম ও পুর্ণ ঠিকানা ৫. ব্রাঞ্চ- আর্মি, নেভি, এয়ার ফোর্স, গেরিলা স্পেশাল ফোর্স ৬. সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে রেজিমেন্ট/ক্রম্প ৭. সাব-ইউনিট এবং ইউনিট যেখানে পূর্বে যারা কাজ করত এবং সাহসিকতা প্রদর্শন করেছিল ৮, বর্তমানে তাদের অবস্থান ১০, নাম, স্বাক্ষর এবং সাক্ষ্য ১১. তাৎক্ষণিক কমান্ডারের স্বাক্ষর ১২. ব্যাটিলিয়ান বা তৎসমতুল্য কমান্ডারের সুপারিশ ও তারিখ ১৩, সেক্টর বা তৎসমতুল্য কমান্ডারের সুপারিশ ও স্বাক্ষর ১৪, বাছাই বাের্ডের সুপারিশ ও স্বাক্ষর ১৫, প্রধান সেনাপতির স্বীকারযুক্ত স্বাক্ষর ১৬, ডিফেন্স মিনিস্টার কর্তৃক অনুমােদন ও স্বাক্ষর ১৭, তারিখ ও খেতাবের নম্বর ১৮, তারিখ ও খেতাব বা অর্থের পদ্ধতি ১৯, মূল রেকর্ড কপি/রিসিপ। পরিশিষ্ট-।। ১৩, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জেনারেল ওসমানী মিন্টো রােডে অবস্থান করেন। সেখানে মাত্র কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের জন্য মেডেল প্রদানের একটি তালিকা তৈরী করেন।
সেনা প্রধান জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী কর্তৃক স্বাক্ষর করার পর তালিকাটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তা অনুমােদন করেন এবং গেজেট আকারেও সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়।
১৪. এই তালিকা অবলােকন করে জুনিয়ার অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। এর অন্যতম কারণ হলাে সকল সেক্টর কমান্ডারকে বীর উত্তমএ ভূষিত করা হয়েছে। কিন্তু সর্বোচ্চ এই খেতাবে ভূষিত সেক্টর কমান্ডারগণ যারা “ভারতের অভ্যন্তরে স্থাপিত হেড কোয়ার্টারে বসে যুদ্ধের নয় মাস কাটিয়ে দিয়েছেন। জেনারেল মঈনুল হােসাইন প্রশ্ন তুলেছেন- “সেখানে বসে তারা কি ধরনের সাহসিকতা দেখিয়েছেন?” তাদের এই পদবী গ্রহণের ক্ষেত্রে চারিদিকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়।
১৫. সেক্টর কমান্ডারদের দায়িত্ব ছিল প্রশিক্ষণ, যুদ্ধ-নির্দেশ, এবং অ্যাডমিনেসট্রেশন ইত্যাদি। সুতরাং তারা বীরত্বের সঙ্গে কোথায় যুদ্ধ করেছেন তার কোনাে প্রমাণ ছিল না। এমনকি অনেক সেক্টর কমান্ডারের নিয়ােগ নিয়েও বিতর্ক ছিল। যারা সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়ে বীরত্বের সঙ্গে দীর্ঘ নয় মাসব্যাপী যুদ্ধের মাঠে ছিলেন তাদের অনেকের স্বীকৃতি মেলেনি। স্বীকৃতি প্রদানের ক্ষেত্রে সিনিয়রিটি, যােগ্যতা বা দক্ষতার কোনাে নিয়মনীতি বা শর্ত মানা হয়নি।
এমন অনেককে বীরত্বপূর্ণ খেতাব দেয়া হয়েছে যারা বাংলাদেশের ভেতরে তেমন কোনাে যুদ্ধ করেনি। এই অভিমত প্রকাশ করে জেনারেল মঈনুল বলেছেন যে, “যারা প্ল্যানিং, প্রশাসন, প্রচার বা প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করেছেন তারা কোনােক্রমেই সম্মুখসমরে যুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ অ্যাওয়ার্ড পেতে পারেন না। জেনারেল মঈনুল বলেছেন, তাদের অন্যভাবে যথাযােগ্য মেডেল/পদবি দেয়া যেতে পারত- যেমনটি হতে পারতাে বিশেষ প্রশাসনিক মেডেল। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এটাই রীতি, যারা সম্মুখসমরে অংশগ্রহণ করেননি তাদেরকে এভাবেই সম্মানিত করা হয় কিন্তু বীরত্বের খেতাব দেয়া হয়না।”
খেতাব নিয়ে প্রশ্ন
১৬. জেনারেল মঈনুল হােসেন লিখেছেন, জুনিয়র অফিসার ও সাধারণ সৈন্যদের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়ে তিনি সেনা প্রধান শফিউল্লাহর সঙ্গে আলােচনা করেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরেন। সবকথা শুনে বঙ্গবন্ধু অবিলম্বে পূর্ব-অনুমােদন প্রাপ্ত তালিকা বাতিলের নির্দেশ দেন। তার তালিকা বাতিলের আদেশটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় পরের দিন।”
১৭. লক্ষ্যণীয় যে বঙ্গবন্ধুর সেই নির্দেশের প্রেক্ষিতে ৩ এপ্রিল ১৯৭৩ সালের আই, এস, পি, আর ডাইরেক্টর কর্তৃক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বলা হয়, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে যে তালিকা প্রকাশিত হয়েছে তা চূড়ান্ত নয়, যা আরাে যাচাই বাছাইয়ের প্রক্রিয়াধীন আছে। পরিশিষ্ট-চ
১৮. জেনারেল মঈনুল বলেছেন, তিনি যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল ছিলেন তখন তালিকাটি তন্ন তন্ন করে দেখেছেন, সেখানে কোনাে সাইটেশন নেই, যারা অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। তিনি সমস্ত তালিকার নামগুলাে এবং সরকারী গেজেটে নামগুলাে দেখেছেন। এখানে একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় উল্লেখ্য যে, এ্যাওয়ার্ড প্রাপ্তির ক্ষেত্রে বিধি হলাে সেখানে দু’বা তিনজন প্রতক্ষ্যদর্শীর সাক্ষ্য প্রয়ােজন এবং অন্যান্য প্রয়ােজনীয় অনুসন্ধান নােট থাকা দরকার তা ছিল না। “প্রয়ােজনে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা পূর্বক অ্যাওয়ার্ড দেবার রীতি । কিন্তু যে পদবী বা মেডেল দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মাটিতে নয় মাসে তাদের অনেকেই পা রাখেননি।”
১৯. লেখক ও গবেষক মুহাম্মদ লুৎফুল হক, স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেছেন। তার বইতে বলা হয়েছে, “খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা পত্রিকায় প্রকাশের পর বাংলাদেশ বাহিনীর (নিয়মিত ও গণবাহিনী) সদস্যদের থেকে কিছু কিছু প্রতিবাদ পত্র (Representation Letter of grivances) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনী সদর দপ্তরে এসে পৌছাতে থাকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পত্রপ্রেরক কোনাে প্রকার খেতাব না পাওয়ার প্রেক্ষিতে খেতাব দাবি করে এবং দাবির স্বপক্ষে সামরিক কমান্ডার বা রাজনৈতিক নেতার বরাত ও সুপারিশ প্রদান করেন। কেউ কেউ খেতাব পেলেও যথাযথভাবে খেতাব দেয়া হয়নি বলে উল্লেখ করে পত্র দেন। এদের সবাই খেতাব তালিকা পুনরায় বিবেচনা করার জন্য আবেদন করেন। নিয়মিত বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে অনেকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের মারফত প্রতিবাদপত্র প্রেরণ করেন। কেউ কেউ এতটাই ক্ষুদ্ধ হন যে তাকে প্রদত্ত খেতাব যথাযথ না হওয়ার প্রেক্ষিতে খেতাব প্রত্যাখ্যান করেন। এ সব প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে সরকার খেতাব বিষয়ে পুনর্বিবেচনা বা পুনঃনিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেয়।
২০. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৩১ মার্চ ১৯৭৩ তারিখে বীরত্বসূচক খেতাব বিষয়ে সকল কাগজপত্র যা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবসের পূর্বে অনুমােদন করেছিলেন এবং সেনাসদরে রক্ষিত ছিল, তা ফেরত পাঠানাের জন্য সেনাবাহিনীপ্রধানকে অনুরােধ করেন। পরবর্তীকালে এই কাজপত্রগুলি তৃতীয় নিরীক্ষা বাের্ডের সভাপতি এবং বিমান বাহিনীপ্রধানের নিকট পাঠানাের জন্য নির্দেশ দেন।
একই সাথে ১২ এপ্রিল ১৯৭৩ তারিখে সেনাসদর থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে খেতাবপ্রাপ্তদের তালিকা গেজেটে প্রকাশ না করার অনুরােধ করে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাহিদার কারণে ৩ এপ্রিল ১৯৭৩ তারিখে সেনাবাহিনী ৬৩০ জনের খেতাব বিষয়ে দলিলাদি বিমান বাহিনী প্রধানের কাছে প্রেরণ করে।
সেনা-অফিসার সংখ্যা কত?
২১. ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে মােট সেনা অফিসার কর্মকর্তার সংখ্যা ছিল ৪৩ জন, যার মধ্যে যুদ্ধ করেছেন ৩৩ জন, ৫ জন বন্দি অথবা নিহত হয়েছেন, বাকিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। নিচে এর বর্ণনা দেয়া হলাে: ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ৮জন সেনা অফিসারদের মধ্যে ৪ জন বাঙালি অফিসার ছিলেন। এদের মধ্যে লে. কর্নেল রেজাউল জলিল, যিনি ছিলেন অধিনায়ক কিন্তু তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। অংশগ্রহণ করেননি লে, শফি ওয়াসি উদ্দিন। শহীদ হয়েছেন লে, আনােয়ার হােসেন । ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট জয়দেবপুরে ১৩ জন বাঙালি সেনা অফিসার ছিলেন। মাত্র ৪ জন অবাঙালি অফিসার ছিলেন। এর মধ্যে ২ জন যুদ্ধে অংশ নেননি। ২৩শে মার্চ অপসারিত হয়েছেন অধিনায়ক লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান খান। ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি অফিসার ছিলেন ছয়জন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন ৩ জন। বন্দি অবস্থায় শহীদ হন সিরাজুল ইসলাম ও রফিক আহমদ সরকার এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হন মেজর নিজাম উদ্দীন। ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ৯ জন বাঙালি সেনা অফিসার ছিলেন তারা সবাই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে বাঙালি সেনা অফিসার। ছিলেন ৭জন যারা সকলেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ২ জন বাঙালি সেনা অফিসারদের মধ্যে মেজর এ, ওয়াই মােশতাক আহমদ শহীদ হন। ১০ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছিল মূল: ক্যাডেট ব্যাটেলিয়ান থেকে কোনাে কর্মকর্তাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেননি। তবে ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ক্যাডেট ইউনিয়নে ২ জন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
রাইফেলস
২২. পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস একটি আধা-সামরিক বাহিনী। এই বাহিনীর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে অনেকটা যােগাযােগ থাকায় তারা দেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের পর্যায়ক্রমিক ধারাবাহিকতায় নিজেদের মানসিকভাবে প্রস্তুত রাখেন। সেজন্য ২৫ মার্চ রাতে পিলখানায় ইপিআর বাহিনী আক্রান্ত হলে তাদের নিজস্ব বেতার যন্ত্রের মাধ্যমে ক্যাপ্টেন দেলােয়ার ঢাকায় পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর আক্রমণের ঘটনা ইপিআরের সকল ইউনিটকে জানিয়ে দেন। এই বাহিনী ২৫ তারিখের মধ্যরাত হতে বিদ্রোহ ঘােষণা করে এবং পূর্ব-প্রস্তুতির কারণে অধিকাংশ জায়গায় তারা সফল হয়। পরবর্তীকালে তাদেরকে মুক্তিবাহিনীর সশস্ত্র কাঠামােতে অর্ন্তভূক্ত করা হয়। এদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১২ হাজার ।
এখানে ইপিআরের অফিসার যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের সেক্টর ভিত্তিক পরিসংখ্যান তুলে ধরা হলো : সদর দপ্তর, পিলখানা, ঢাকা। বাঙালি অফিসার ছিল ৬ জন। তাদের কেউই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। সেক্টর ১, পিলখান, ঢাকা। ৫ জন বাঙালি অধিনায়ক ও ২ জন সুবেদার দায়িত্ব পালন করেন। এই দুই জন মাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেক্টর ২, সিলেট। ৮ জন বাঙালি সেনা অফিসারের মধ্যে ১ জন। ক্যাপ্টেন বন্দি অথবা নিহত হন, ১ জন মেজর (মেডিকেল অফিসার) মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন, ২ জন সুবেদার তারাও যােগদান করেন। সেক্টর ৩, যশাের। ৪ জন বাঙালি অফিসারের মধ্যে ২ জন মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেনি, কিন্তু ৮ জন সুবেদার ও ১ জন নায়েক সুবেদার মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন। সেক্টর, ৪, রাজশাহী।
৪টি উইং-এ ১৮ জন এর মধ্যে ৪ জন মেজর ও ক্যাপ্টেন অন্তর্ভুক্ত ছিলেন বাকি সকলেই সুবেদার বা নায়েব সুবেদার হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। এর মধ্যে ১ জন ক্যাপ্টেন বন্দী বা নিহত হন, ৩ জন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। আর বাকি ১৪ জন সুবেদার ও নায়েব সুবেদার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেক্টর ৫, দিনাজপুর। ৬ জন বাঙালি কর্মরত ছিলেন। যার মধ্যে ২ জন ক্যাপ্টেন, ১ জন মেজর ও ৩ জন সুবেদার কর্মরত ছিলেন। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন নজির আহমেদ পাকিস্তান পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জাভেদ আলমকে বাঁচাতে গিয়ে ক্ষিপ্ত জনতার হাতে নিহত হন। বাকিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সেক্টর ৬, চট্টগ্রাম । ৬ জন বাঙালি কর্মরত ছিলেন। যার মধ্যে ২ জন ক্যাপ্টেন, ১ জন মেজর, ও ২ জন সুবেদার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু ১ জন মেজর মেডিকেল অফিসার বন্দি অথবা নিহত হন। মােট ইপিআর কর্মকর্তার সংখ্যা ৬৪ জন। যার মধ্যে সেনা অফিসার ছিল ২৮ জন, ১৩ জন যুদ্ধ করেছে, ২ জন বন্দি অথবা নিহত হয়েছেন, বাকিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সুবেদার ছিলেন ৩৬ জন, যার মধ্যে ৩২ জন যুদ্ধ করেছেন বাকিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ইপিআর সেনাবাহিনী ছিল মাটির কাছাকাছি এবং জনগণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। সেজন্য লক্ষ্য করা যায় ১২ হাজার ইপিআর সদস্যদের মধ্যে প্রায় ৮০ ভাগই ছিল বাঙালি কিন্তু প্রত্যেকটি সেক্টরের ৯০ ভাগ ক্ষেত্রেই অধিনায়ক ছিলেন অবাঙালি অফিসার। পিলখানায় আড়াই হাজার বাঙালি ইপিআর ছিল কিন্তু বেলুচ রেজিমেন্ট তাদের অধিকাংশকেই নিরস্ত্র করে। ৭০০ বাঙালি সৈন্যকে হত্যা করা হয় । ৬০০ জন সিপাহী পালাতে সক্ষম হয়। বাকিরা বন্দি হয়ে যায় । সমগ্র বাংলাদেশে প্রধানত প্রতিরোধ যুদ্ধে ইপিআরের ভূমিকা উজ্জ্বল। তারা আত্নত্যাগ ও দেশপ্রেমের অনন্যসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
২৩. এখন স্বাভাবিকভাবেই মনে হতে পারে, সেক্টর-কমান্ডারগণ সেনাপ্রধানের সঙ্গে বসে নিজেরা নিজেদেরকে বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করেছেন। উল্লেখিত ১৯৭৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর গেজেটে উল্লেখিত প্রদত্ত বীরত্তমদের যে তালিকা প্রদান করা হয়েছে যা পরিশিষ্টে উল্লেখ করা হল, (পরিশিষ্ট ঘ) তারা কীভাবে কোথায় কোন অবস্থানে, কোন স্থান থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিধি অনুসারে শত্রুপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করে তাদের পরাজিত করেছিলেন অথবা বৈরী পরিস্থিতির ভিতরে নিজের জীবন উৎসর্গ করে তার অধীনস্থ সেনাদের জীবন রক্ষার্থে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অবশ্যই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।
২৪. লক্ষ শহীদ ও গেরিলা যােদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগকে স্বীয় মহিমাকীর্তনের জন্য কীভাবে তারা ব্যবহার করেছেন তারও অনুসন্ধান হওয়া প্রয়োজন। সাধারণ সৈনিক ও গেরিলা যােদ্ধারা যেভাবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন তাদের কয়জন বীরশ্রেষ্ঠ বা বীরউত্তম বা বীরবিক্রম কিংবা বীরপ্রতীকে ভূষিত হয়েছেন এ প্রশ্ন জাতির সামনে থেকেই যাবে এ কারণে যে ২৩ মার্চ ১৯৭৩ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী স্বহস্তে লিখিত ‘My dear Bongobondhu’ সম্বােধন পূর্বক একটি গােপনীয় পত্র লেখেন সেখানে মাত্র ১৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ২৪ মার্চ তারিখে তা অনুমােদন করেন। (পরিশিষ্ট- ২)
মুহাম্মদ লুৎফল হকের ধারণা যে প্রধান সেনাপতি চিঠির প্রাধিকারেই বর্ণিত ১৪ জনকে বীরউত্তম খেতাব প্রদান করা হয় । কিন্তু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে তাদের এই খেতাব প্রাপ্তির বিষয়টি বাের্ডের কাছে প্রেরণ করার সুযােগ হয়নি এবং সাইটেশন নিরীক্ষা করার কোনও নজির পাওয়া যায়না। সেক্টর-কমান্ডরগণ বৈঠক করে নিজেদেরকে বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করেন। মিটিং-এ সভাপতিত্ব করেন সেনাপ্রধান। কিন্তু এই তালিকায় মেজর এম এ জলিল সেক্টর ৯ এবং মেজর আবু ওসমান চৌধুরী সেক্টর ৮ তাদেরকে কেন বীরউত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়নি? নির্মম সত্য হলাে বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম,এ,জি ওসমানী কোনাে বীরত্বসূচক খেতাব বা মুক্তিযুদ্ধের কোনাে খেতাব পাননি। এমনকি স্মারক পদকও পাননি।
২৫. পরবর্তীকালে ১৯৮০ সালে ১৪ ও ১৭ জুলাই এবং ৮ই নভেম্বর ১৯৮০ সালে সরকারের বিবেচনার জন্য সুপারিশমালা তৈরী করেন। সুপারিশমালার প্রথমেই ক. বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব শুধুমাত্র ঘােষিত যুদ্ধে প্রতিরক্ষা বাহিনী সদস্যদের প্রদান করা যেতে পারে। খ, অন্যান্য খেতাব যুদ্ধ বা অন্যান্য কর্তব্য পালনকালে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের প্রদান করা যেতে পারে। গ, অন্যান্য বাহিনীর সদস্যগণ প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনে কর্মরত থাকলে খেতাব পেতে পারে। এর অর্থ হলাে প্রতিরক্ষাবাহিনীতে নাম অন্তর্ভুক্ত করেনি এমন হাজার হাজার গেরিলা বা অনিয়মিত বাহিনী যে বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করেছিলেন তাদের উপেক্ষা করার নির্দেশ প্রদান। খেতাব প্রদানের জন্য সুপারিশমালার নিরীক্ষার জন্য ৩০ জুলাই ১৯৭১, ১৫ অক্টোবর ১৯৭১, ৩১ অক্টোবর ১৯৭২ এবং মার্চ মাসে ১৯৭৩ সালে যে নিরীক্ষা বাের্ডগুলাে গঠিত হয়েছিল তার সবটির প্রধান/চেয়ারম্যান সবাই ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকর্তা।
সাইটেশন ব্যতিরেকেই খেতাব
২৬. খেতাব প্রাপক কোন বীরত্বপূর্ণ ও সাহসিকতার জন্য বা কেন খেতাব পেয়েছে তার প্রমাণ হিসেবে খেতাবের সাইটেশনের একটি কপি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রাপককে বা প্রাপকের উত্তরাধিকারীকে প্রদান করা হয়। আমাদের ক্ষেত্রে বেশীর ভাগ খেতাবপ্রান্তের সাইটেশন নেই, তাই সাইটেশনের কপিও দেয়া সম্ভব হয়নি। এমনকি বীরশ্রেষ্ঠদের (একজন ব্যতীত) সাইটেশনও কোথাও সংরক্ষিত নেই। যাদের সাইটেশন সেনাবাহিনীতে মজুদ আছে তাদেরও সাইটেশনের কপি দেয়া হয়নি বা বেশীর ভাগের কাছে সাইটেশনের কোনাে কপি নেই ।”” সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল নাসিম বীরবিক্রম, সাবেক অ্যাডিজুটেন্ট জেনারেল মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী বীরবিক্রম এবং আরও কেউ কেউ এ সমস্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সাইটেশন একত্র করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ কাজটি সম্পূর্ণ হয়নি।
জনযুদ্ধের গণযােদ্ধা
২৭. নিয়মিত বাহিনীর সদস্যগন ১৯৭৩ সালে খেতাব বিষয়ক গেজেট প্রকাশের পর দাপ্তরিক চিঠিপত্র আদান প্রদানের মাধ্যমে তার খেতাবপ্রাপ্তি বিষয়ে অবগত হন। কিন্তু গণবাহিনীর সদস্যদের সরকারিভাবে খেতাবপ্রাপ্তির বিষয়টি অনেকে দীর্ঘদিন পর্যন্ত জানতে পারেননি। মুহম্মদ লুৎফল হক এরকম একটি উদাহরণ দিয়েছেন। যেমন, মৃত নিলমণি সরকার বীরবিক্রমের পিতা খেতাব প্রদানের ২৫ বছর পর ১৯৯৮ সালে প্রথম জানতে পারেন যে তার সন্তান একজন খেতাবপ্রাপ্ত বীর। মােসাম্মৎ তারামন বেগম (বিবি) বীরপ্রতীক গেজেট প্রকাশের ২২ বছর পর জানতে পারেন যে তিনি বীরপ্রতীক খেতাব পেয়েছেন। আজও বেশ কিছু খেতাবপ্রাপ্তের হদিস পাওয়া যায়নি। হয়তাে তারা বেঁচে আছেন অজান্তে এবং জানেন না যে তারা খেতাবপ্রাপ্ত । হয়তাে আর কোনােদিনই এ সমস্ত খেতাবপ্রাপ্তদের খোঁজ পাওয়া যাবে না। অজ্ঞাতেই থেকে যাবে বাংলাদেশের এ সমস্ত শ্রেষ্ঠ বীরেরা। তিনি আরাে বলেছেন যে, সরকারের তরফ থেকে এই সমস্ত হারিয়ে যাওয়া বীরদের খোঁজার কোনাে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সেক্টর কমান্ডার বা সাব-সেক্টর কমান্ডারগণও খেতাবের জন্য নাম সুপারিশ করা ছাড়া এ বিষয়ে আর কোনাে উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। অনেক সেক্টর কমান্ডার বা সাব সেক্টর কমান্ডাররা সুপারিশকৃতদের কখনও দেখেননি বলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। মুক্তিযােদ্ধা সংসদের বিশাল নেটওয়ার্কও এ সকল কাজকে গুরুত্ব দিয়েছে বলে মনে হয়নি। আমরা জাতির শ্রেষ্ঠবীরদের খামখেয়ালির মাধ্যমে হারিয়ে ফেলেছি। পৃথিবীর অন্য কোনাে দেশেই বীরত্বসূচক খেতাবপ্রাপ্তরা এভাবে নিখোজ হয়ে যায় না।”
২৮. টাঙ্গাইলের কাদের বাহিনীর সদস্যদের বীরত্বসূচক খেতাবের জন্য একটি তালিকা ১৯৭২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সদর দপ্তর এফ জে সেক্টর, প্রযত্নে ৯৯ এ পি। ও (ভারতীয় সেনাবাহিনী) থেকে সদর দপ্তর বাংলাদেশ বাহিনীতে প্রেরণ করা হয়। পত্রে স্বাক্ষর করেন বিগ্রেডিয়ার সান্ত সিং। খেতাব প্রাপ্তির জন্য পত্রের সাথে কাদের বাহিনীর ১৩৪ জনের একটি তালিকা সংযুক্ত ছিলাে। পত্রে উল্লেখ ছিল যে কাদের বাহিনীর এ সমস্ত সদস্যদের সুপারিশমা কাদের সিদ্দিকী লিখবেন। মার্চ ১৯৭২ সালে কাদের বাহিনীর সদস্যদের সুপারিশনামা ৩০ জুলাই ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত সুপারিশনামা ফর্মের পরিবর্তে সাদা কাগজে বাংলায় হাতে লিখে পাঠানাে হয়। কাদের বাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ কাদের সিদ্দিকীসহ কয়েকজনের সুপারিশনামায় বিগ্রেডিয়ার সান্ত সিং স্বাক্ষর করেন। বাকি সকলের সুপারিশনামায় কাদের সিদ্দিকী। স্বাক্ষর করেন। সাদা কাগজে লেখার একটি সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে যে খেতাব যােগ্য বীরদের নামের তালিকা পাঠানাের কর্ম বেসরকারিভাবে কাউকে দেয়া হয়নি।
২৯. বাংলাদেশ বাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামাের বাইরে যুদ্ধরত কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধাকে ব্যতিক্রমধর্মী বা অত্যন্ত অসাধারণ মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে বীরত্বসূচক খেতাব দেয়া হয়েছে। স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক নেতাসহ বিভিন্ন বেসামরিক সূত্র থেকে বিচ্ছিন্নভাবে পত্র মারফত কিছু কিছু নিয়মিত বা গণবাহিনীর সদস্যদের খেতাব প্রদানের জন্য সুপারিশ বা আবেদন বাংলাদেশ বাহিনীতে প্রেরণ করা হয়।
উপেক্ষিত বীরত্ব।
৩০. সামরিক ও বেসামরিক উভয় কারণে এই বেসামরিক খেতাব প্রদান করা হয়েছে। স্বাধীনতা পুরস্কার’ শুধুমাত্র বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য প্রযােজ্য। স্বাধীনতা পুরস্কারের নির্বাচন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ হতে প্রক্রিয়া করা হয়। স্বাধীনতা পুরস্কারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী দিয়ে থাকেন। এই পুরস্কার জীবিত ও মৃত উভয়েই পেতে পারে। সাধারণত প্রধানমন্ত্রী প্রাপক বা প্রাপকের বৈধ প্রতিনিধি বা উত্তরাধিকারীকে পদক প্রদান করেন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবনের মেধা, মনন, সময় এবং অগ্নিসংগ্রামের সংগঠক তাদের কোননা পুরস্কার সম্মান বা পদক দেয়া হয়নি অর্থাৎ যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিভিন্ন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তাদের বিভিন্নভাবে অসম্মান ও উপেক্ষা করা। হয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যে সকল জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও শ্রেণীপেশার মানুষ যাদের সম্পদ ধ্বংস করেছে, ফাঁসির রশিতে ঝুলানাের জন্য সামরিক ফরমান জারী করেছে তাদেরকে উপেক্ষা করা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকেই অসম্মান করা- এই সহজ সত্যটি অনুধাবন করার সময় এসেছে।
৩১. ভুয়া মুক্তিযােদ্ধা কেন? বাংলাদেশ সরকার বা ব্যক্তি উদ্যোগে প্রায় দুশাে’টি ট্রানজিট ক্যাম্প বা যুব অভ্যর্থনা কেন্দ্র ছিল। এগুলাে স্বাভাবিকভাবেই পরিচালিত হতাে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা। মুজিবনগর সরকারের নির্দেশেও তাই ছিল। সেই সব ক্যাম্পে কোন তরুণ যুবক কবে এসেছেন, প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কিনা অথবা কবে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরিত হয়েছেন তার নাম তালিকা প্রায়শ লিপিবদ্ধ থাকতাে। লেখকের পরিচালিত কুরমাইল ক্যাম্পে এরকম তালিকা সংরক্ষণ করা হতাে। গ্রন্থকার রৌমারী ক্যাম্পে গিয়ে দেখেছেন প্রায় অনুরূপ ব্যবস্থাদি চালু ছিল। এমনকি জুলাই, আগস্ট মাস থেকে কিছু কিছু যুব-ক্যাম্পে মুজিবনগর সরকারের নিয়ােগপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা অনেক ক্ষেত্রে অবস্থান করতেন। তাছাড়া কলকাতা মুজিবনগর অফিস থেকে প্রতি মাসে একজন কর্মকর্তা এসে ক্যাম্পগুলাে পরিদর্শন করতেন, সুবিধাঅসুবিধা দেখতেন এবং মাথাপিছু যৎ সামান্য অর্থ বরাদ্দ করতেন। কলকাতায় যারা কেন্দ্রীয়ভাবে যুব ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের নিকট সম্ভবত প্রতিটি ক্যাম্পের নাম, প্রশিক্ষণের জন্য যুবকদের সংখ্যা অবশ্যই সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক্কালে যুব ক্যাম্প পরিচালনার জন্য যে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল বলতে গেলে তা ছিল অকেজো। যারা যুব ক্যাম্প পরিচালনা করতেন তাদের কাছে কেন্দ্রীয় কমিটির অহেতুক বাস্তবতা বর্জিত প্রেরিত কাগজপত্রের তেমন কোনাে গুরুত্ব ছিলনা ।
মুক্তিযুদ্ধের তালিকা প্রণয়নের সময় যারা ক্যাম্প পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তাদের কারাে সাথে আলােচনা, পরিসংখ্যান, নাম পরিচয় নেয়া হয়েছে বলে আমার জানা নেই । প্রকৃতপক্ষে কলকাতায় যুব-ক্যাম্পের কর্মকর্তাদের অধিকাংশ একটি আমলাতান্ত্রিক মন মানসিকতা নিয়ে কার্যক্রম করেছেন- বলতে গেলে ঘরে বসে তারা ‘কামান’ দেগেছেন। বেহাল ও এলােমেলােভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী দুটি বাহিনীই তাদের অধীনে প্রশিক্ষিত বা যুদ্ধরত গেরিলাদের সার্টিফিকেট দিয়েছে। মুজিব বাহিনীর সার্টিফিকেট প্রদান বা নিয়মিত বাহিনীর সার্টিফিকেট কোনােটিই নির্ভুল বা সঠিক পদ্ধতি অনুসারে করা হয়েছে তা বলা যাবেনা।
প্রথম তালিকা হয় সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং মুজিবনগর সরকারের ৫ জনের নাম লিপিবদ্ধ আছে। লক্ষ্যণীয় মুজিবনগর তালিকায় যাদের নাম পাওয়া যাচ্ছে তারা মুজিবনগর অফিসে বসে কাজ করেছেন। যুদ্ধক্ষেত্রে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। বলতে গেলে তারা চেয়ার টেবিলের লােক। এভাবে প্রথমে ৫০৩ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত করে গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। আরাে বিস্মিত হতে হয় মুজিবনগর তালিকায় ৩নং ক্রমিকে তাজউদ্দিন আহমদের নাম আবার ৩৩৮ নম্বরে উল্লেখিত আছে। তেমনিভাবে এর প্রথম ক্রমিক নং যথারীতি ২ এবং আবার ২২৭নং ক্রমিকে উল্লেখিত আছে। গ্রন্থকারের নাম মুক্তিযুদ্ধের অন্যস্থানে রয়েছে ৫১ নং ক্রমিকে। সতর্ক ও সচেতনভাবে তালিকা করার নমুনা দেখে বােঝা যায় এটি করা হয়েছে অযত্নে ও অশুদ্ধভাবে। অথচ ২০০৪ সালের ১১ মার্চ গেজেটে “নির্ভুল ও সঠিকভাবে চূড়ান্তকরণের কথা বলা হয়েছে। এত অবহেলা, অযত্ন, অসর্তকতা কোনাে দেশের মুক্তিযােদ্ধা তালিকা প্রণয়নে হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। এক্ষেত্রে মুহম্মদ লুৎফুল হক লিখিত স্বাধীনতা যুদ্ধের বীরত্বসূচক খেতাব শীর্ষক বই পড়লে গ্রন্থকারের এই মন্তব্য প্রমাণিত হবে।
এক্ষেত্রে বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত বা বীরবিক্রম খেতাব প্রাপ্ত কোনাে গণবাহিনী বা গেরিলা বাহিনীর মধ্যে থেকে কাউকে চেয়ারম্যান বা সদস্য করা হয়নি। সেজন্য গেরিলা বাহিনীদের বীরত্বপূর্ণ সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ সামরিক অধিকর্তাগণ ‘নিজেরাই হজম’ অথবা অবহেলা করেছেন। এছাড়াও যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন, যারা জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছেন সেইসব বেসরকারি ব্যক্তি বা গেরিলাদের এখন পর্যন্ত স্বাধীনতা পুরস্কার বা কোনাে সম্মানজনক পদকে ভূষিত করা হয়নি। কিন্তু যারা বীরউত্তম খেতাব পেয়েছেন তাদের কেউ রণাঙ্গনে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন কিনা এ প্রশ্নের মুখােমুখি আজ না হােক কাল না হােক পরত হতে হবে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!