You dont have javascript enabled! Please enable it!
রাষ্ট্রদ্রোহিতা কাকে বলে?
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে বন্দী অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে অভিযুক্ত করে সামরিক আদালতে ক্যামেরা ট্রায়াল শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু যখন জানলেন ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রদত্ত ভাষণ অসহযোগ আন্দোলন, হরতাল, নির্দেশ ইত্যাদি রাষ্ট্রদ্রোহিতা মূলক কাজ বলে তার। বিরুদ্ধে অভিযােগ উত্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অখন্ডতা ধ্বংসের জন্য তিনি দায়ী। সাক্ষ্য তালিকা ছিল ১০৬ জনের তারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা, প্রকাশ্যে বিদ্রোহ, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের বিষয়গুলাে উথাপন করেন। বিচারের পূর্বে ইয়াহিয়া খান বলেন শেখকে মরতেই হবে। এই অবস্থায় তিনি তার পক্ষ থেকে আইনজীবি ব্রোহীকে বিদায় করে দেন। বলেন, এ বিচার প্রহসন এবং এটা হবে সাজানাে মৃত্যুদন্ড। প্রতিটি সাক্ষ্যের পর তার কাছে অনুসাক্ষ্যরের জন্য কাগজপত্র নিয়ে আসলে তিনি প্রতিটি পাতায় লেখেন সৰ মিথ্যা। কখনাে লেখেন “আমরা যে নির্যাতিত এটা। মনে করা কী রাষ্ট্রদ্রোহিতা, কাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা?” বঙ্গবন্ধুর বিচার নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলােড়ন সৃষ্টি হয়।
ভারত, সােভিয়েত রাশিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জাপান, পােলান্ড দেশসমূহ বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে যেমন সােচ্চার ছিলেন তেমনি বুদ্ধিজীবি, শিক্ষক, সিভিল সােসাইটি এবং মানবাধিকার কমিশনসহ মুক্তিকামী জনগণ ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির লক্ষ্যে গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল কার্যকর ও ইতিবাচক। বিশ্ব কুটনীতি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির ব্যাপারে কীভাবে সােচ্চার হয়ে উঠেছিলেন তার রূপরেখা এই অধ্যায়ে বর্ণিত রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়টির সঙ্গে রাজনৈতিক সমঝােতার প্রশ্নটি সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর পত্রগুলাে। বঙ্গবন্ধুর মুন্নি ক্ষেত্রে ছিল বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বিবেককে ধাক্কা দেয়ার মতাে। ২৬ মে যখন পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে শেখ মুজিব সম্পর্কে তার মনােভাব জানতে চান তখন প্রেসিডেন্ট খুব উত্তেজিত হয়ে পড়েন এবং বলেন, সে বড় ধরনের অন্যায় করেছে এবং তাকে এ জন্য কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। ফারল্যান্ড জানতে চান, শেখ মুজিবকে সুবিচারের সুযােগ দেয়া কি সম্ভব? কেননা এরকমটাই সবাই বলছেন এবং এ নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে । প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া প্রশ্নটি এড়িয়ে যান। তবে ১৯ জুলাই (১৯৭১) ফিনান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার প্রতিনিধি নেভিল ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে দুইঘণ্টাব্যাপী এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান বলেন যে, মুজিবের বিচার হবে। তার পক্ষ সমর্থনের জন্য একজন পাকিস্তানী আইনজীবী থাকবেন, কোনাে বিদেশী আইনজীবী নয়। এই বিচার সামরিক আদালতে হবে এবং গােপনে হবে। যেসব অভিযােগ করা হবে তা প্রমাণিত হলে তাঁর মৃত্যুদণ্ড হবে।
২০ আগস্ট পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে ইয়াহিয়া খান এক সাক্ষাতকারে বলেন যে, শেখ মুজিবের বিচারে সবচেয়ে ভাল আইনজীবী এ, কে, ব্রাহীকে নিয়ােগ দেয়া হয়েছে, সামরিক ট্রাইবুনালকে বলা হয়েছে সতর্ক ও নিরপেক্ষভাবে বিচার কাজ পরিচালনা করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ রেকর্ডসমূহ রক্ষা করতে। ইয়াহিয়া খান বলেন, যে সমস্ত অভিযােগ রয়েছে তাতে সম্ভবত তাঁর মৃত্যুদন্ড হবে। ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসনের প্রেস নােটে বলা হয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা ও ঘােষণার জন্য পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক শেখ মুজিবের গােপন বিচারের জন্য বিশেষ মিলিটারী কোর্ট গঠন করেছেন। ১১ আগষ্ট ৭১ থেকে বিচার আরম্ভ হয়। কোর্ট ঐ দিনই মুলতবী হয়, যাতে শেখ মুজিবের বিচার সুষ্ঠু ও আইনানুগ হতে পারে; যে ক্ষেত্রে শেখ মুজিব স্বইচ্ছায় পছন্দমত ডিফেন্স কাউন্সিল নিয়ােগ করতে পারেন। ৭ সেপ্টেম্বর এ, কে, ব্রাহী এবং তিনজন সহকারী মােহাম্মদ গােলাম আলী মেনন, আকবর মীর্জা এবং গগালাম হােসেনকে নিয়োগ দেয়া হয় এবং সাক্ষীগণের জেরা শুরু হয়। প্রসিকিউশন ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করে যার দ্বারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রজু করা অভিযােগ প্রমানিত হয় । শেখ মুজিবের পক্ষে এ, কে, ব্ৰোহী আইনজীবী হিসেবে দায়িত্ব নেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণার অভিযােগে ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ক্যামেরা ট্রায়াল পুনরায় শুরু হয়েছিল। লায়ালপুর জেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার কার্যক্রম শুরু করা হয়। রাওয়ালপিণ্ডি থেকে ২৪০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে পাঞ্জাবের শিল্প নগরী লায়ালপুর ।
যােলফুট উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা লায়ালপুর সেন্ট্রাল জেল। লায়ালপুরের লাল ইটের আদালত-ভবনটি মূল কারাগারের লাগােয়া হলেও, বন্দিকে লম্বা সরু করিডাের দিয়ে আদলতে প্রবেশ করতে হতাে। সেখানে ছিল চারটি ভারি লােহার দরজা প্রতিটি দরজার পাশে সাব-মেশিনগান হাতে যুদ্ধ-পােশাক সজ্জিত সৈনিক দাড়িয়ে থাকতাে । সারি-বাধা বেঞ্চ ও উঁচু প্ল্যাটফর্ম এবং পাকিস্তানি পতাকা সজ্জিত আদালত-কক্ষে প্রবেশ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পুরােপুরিভাবে উপেক্ষা করতেন বিচারকার্য । শান্ত । সৌম্য । অবিচল একজন মানুষ। বিচার সপ্তাহকাল ধরে চলে এবং প্রতিদিন বিকেল চারটা নাগাদ শেখ মুজিব সেলে ফিরে আসতেন। কখনাে কখনাে অভিযুক্তের পক্ষে নিয়ােজিত কৌসুলিকে তার সঙ্গে দেখা করতে দিতে হতাে। তবে বন্দি প্রায় কখনােই কোনাে কথা বলতেন না। একবার আদালতের কার্যক্রমের বিবরণী তাকে দেয়া হলে তিনি এর ওপরে লেখেন, ‘সব মিথ্যা। আরেকবার লেখেন, ‘কাকে বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা? আমরা যে নির্যাতিত এটা মনে করাটা কি রাষ্ট্রদ্রোহিতা?” আগস্টের শেষ সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে বিবৃতি দেন তাতে আর সন্দেহ ছিল না যে, এই বিচার ন্যায়য়ানুগ হবে না এবং বিচারের রায় আগেই স্থির করে রেখেছে। আদালত কেবল স্থিরকৃত রায় পাঠ করে দেবে।’
তাঁর বিচার প্রহসনের সামরিক ও অসামরিক বিচারপতিরা সার্কিট হাউসে থাকতেন। স্থানীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যেই সার্কিট হাউসটি অবস্থিত ছিল। বিচার প্রক্রিয়ার সংগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের রাখবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে কয়েকটি বাড়ি রিকুইজিশন করা হয়। জেলখানায় পাহারার দায়িত্ব ছিল সেনাবাহিনীর। জেলখানায় ফটকের ২০০ গজের মধ্যে কোনাে সাংবাদিককে যেতে দেওয়া হতাে না। ট্রায়ালের জন্য ১৯ আগস্ট শেখ মুজিবকে স্পেশাল মিলিটারী ট্রাইবুনালের নিকট হাজির করা হয়। প্রিজাইডিং বিচারপতি ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার । কোর্টের অন্যান্য সদস্যের মধ্যে দুজন ছিলেন সামরিক অফিসার, একজন নেভাল অফিসার এবং পাঞ্জাব থেকে আগত একজন জেলা জজ। তাঁর বিরুদ্ধে ১২টি অভিযােগ উত্থাপন করা হয় যার মধ্যে ছয়টি ছিল মৃত্যুদণ্ডের । সবচেয়ে গুরুতর অভিযােগ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করা। যখন মুজিবকে তার ডিফেন্স কাউন্সিল সিলেক্ট করার জন্য বলা হয় তখন তিনি ড. কামাল হােসেনকে আইনজীবী হিসেবে নিয়ােগের কথা বলেন। তাকে বলা হলো এটা সম্ভব নয় । তখন শেখ মুজিব এ.কে. ব্রোহীকে সিলেক্ট করেন, তিনি ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এবং সংবিধান বিশেষজ্ঞ। কিন্তু বিচার কার্যের এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষ কর্তৃক ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রদত্ত ভাষণে শেখ মুজিবের কার্যক্রম, অসহযোগ আন্দোলন থেকে হরতাল, নির্দেশ ইত্যাদিকে রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক কাজ বলে অভিযােগ পত্রে উল্লেখিত হওয়ায় শেখ মুজিব এই ট্রায়ালে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান এবং তার নিয়ােজিত আইনজীবী ব্রোহীকে বিদায় করে দেন। কিন্তু বোর্ডের অনুরােধে ব্রোহী রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রতিনিধিত্ব করতে থাকেন।
শেখ মুজিবের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, এটা বিচারের নামে প্রহসন চলছে যা হবে সাজানাে মৃত্যুদণ্ড। তিনি নির্বিকার। একের পর এক সাক্ষীগণ আসছেন। পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে ধ্বংসের জন্য দায়ী করে সাক্ষ্য দিচ্ছেন। প্রসিকিউশন ১০৬ জনের সাক্ষ্যতালিকা ট্রাইবুনালে পেশ করেন, কিন্তু তার অর্ধেককে বাের্ডের সামনে উপস্থিত করা হয়নি। যারা কেবলমাত্র সামরিক অফিসে বা পুলিশের কাছে জবানবন্দি দিয়েছিল কেবলমাত্র তাদেরই হাজির করা হয়। ব্ৰোহী কোর্টের নিকট আবেদন করেন যারা ক্র্যাক ডাউনের পূর্বে ঢাকায় নেগােসিয়েশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন কর্নেলিয়াস, পীরজাদা, এম.এম, আহমদ তাদের হাজির করা হােক। তাদের জেরা করার আবেদন জানান। তখন কোর্ট তাঁর আবেদন নাকচ করে দেন। অর্থাৎ বিচার প্রক্রিয়ার শেকড়ে যাবার ক্ষেত্র বন্ধ করে দেয়া হয়। | জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রকাশ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বন্দী শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, প্রকাশ্য বিদ্রোহ এবং রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহের বিষয়গুলি ক্রমাগত উপস্থাপন করেন।’ রেডিও অস্ট্রেলিয়া জানিয়েছিল যে, মুজিবকে গ্রেফতারের পর ২৬ মার্চ রাত প্রহরেইয়াহিয়া খান ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলেন, “শেখকে মরতেই হবে”। এমন কি তথাকথিত বিচারানুষ্ঠানের আগেই তাকে চুপিসারে খতম করে দেয়ার ভাবনা তলিয়ে দেখছিলেন ইয়াহিয়া খান। তিনি ভালােভাবেই সচেতন ছিলেন যে, বিপজ্জনক পথ তিনি মাড়াচ্ছেন। সেই সঙ্গে বন্দির যে অচিরেই জীবনাবসান ঘটবে এই প্রত্যাশা চাপা রাখতেও তিনি সমর্থ ছিলেন না। ১৯৭১ সালের জুলাইতে তিনি বলেন, “বাঙালি নেতা পশ্চিম পাকিস্তানের এক কারাগারে সুস্থ ও জীবিত রয়েছেন। তবে আজকের পরে কাল শেখ মুজিবের জীবনে কী ঘটবে সেটা আমি হলফ করে বলতে পারবাে না। তার বিচার করা হবে এবং এর মানে এই নয় যে, আগামীকালই আমি তাকে গুলি করবাে । তার স্বাভাবিক মৃত্যুও ঘটতে পারে। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার ও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা করার জন্য জেনারেলরা চাপ দিচ্ছেন। আমি সম্মত হয়েছি এবং খুব শিগগিরই বিচার অনুষ্ঠিত হবে। এসবই ছিল ন্যায়বিচারকে প্রভাবান্বিত করার অপচেষ্টা। এ বিষয়ে আরাে কতিপয় বক্তব্য, মন্তব্য উপস্থাপন করা যেতে পারে। এসব প্রচারণা ছাড়াও বন্দি শেখ মুজিবের বিচার প্রভাবান্বিত করার লক্ষ্যে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে এমন কথাও তিনি বলেছেন, যার অর্থ জনগণকে জানানাে যে, শেখ মুজিব কী ভয়ঙ্কর দেশদ্রোহী! অন্যদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন বরাবর একটি বার্তা ওয়াশিংটনে ভারতের নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত এল, কে, ঝা-এর মাধ্যমে পৌছে দেন।
“বিদেশি আইনজীবীদের কোনাে প্রকার সহায়তা ছাড়াই সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে ঘােষণা দিয়েছেন তা ভারত সরকার, অনগণ ও সংবাদমাধ্যমকে নিদারুণভাবে উদ্বিগ্ন। করে তুলেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এই তথাকথিত বিচার প্রক্রিয়া শেখ মুজিবকে হত্যা করার প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যবহৃত হবে। এটা পূর্ব পাকিস্তানে ও ভারতে ভয়ঙ্কর অবস্থার জন্ম দেবে, কেননা আমাদের জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দল বিষয়টিকে কোনভাবেই মেনে নেবে না। তাই আমরা এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগের মধ্যে রয়েছি। এই অঞ্চলে স্থিতি ও শান্তি প্রতিষ্ঠার নিমিত্তে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ হিসেবে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ প্রয়ােগের জন্য আপনার সাহায্য প্রার্থনা করছি।” শেখ মুজিবের জীবনরক্ষায় ২৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। আবেদন করেন। আবেদনে শেখ মুজিবের কোনাে ক্ষতি বা মৃত্যুদণ্ড হলে তা মারাত্মক ফল বয়ে আনবে বলে তিনি পত্রে উল্লেখ করেন। আবেদনে বলা হয়, স্ব স্ব রাষ্ট্র যেন পাকিস্তান সরকারের ওপরে চাপ সৃষ্টি করেন যাতে পাকিস্তান ও ভারতকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়তে না হয়।  ১৯ আগষ্ট শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বন্দি শেখ মুজিবের ভাগ্য নিয়ে যে উদ্বেগ প্রকাশ। করে চিঠি লিখেছেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন তা পড়েছেন বলে চিহ্নিত করা আছে।
চিঠিতে শ্রীমতি গান্ধী যে মূল বিষয়গুলাে অবতারণা করেছেন তার মূল কথা হলাে: ১. পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনে ভারতের আপত্তি নেই। তবে ইন্দিরা গান্ধী মনে করেন এটা কোনাে ফলদায়ক কিছুই আনবে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যদি পূর্ববঙ্গে একটি বেসামরিক সরকার স্থাপন করে শরণার্থীদের তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারে তাহলে ভারত হাপ ছেড়ে বাঁচবে। ২. ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষণ নিয়ােগের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান। করেন। ৩. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহ বৈঠক করার পর পূর্ব পাকিস্তানে আরাে বেশি অত্যাচারের মাত্রা বেড়েছে; যা নাজিদের নৃশংসতা ছাড়িয়ে। গেছে, ফলে শরণার্থীরা দেশ ছেড়ে ভারতে চলে আসছে। শেখ মুজিবের মুক্তি এক্ষেত্রে সহায়ক হবে বলে ভারত মনে করে। ৪. যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক পাকিস্তানে নতুন করে অস্ত্র প্রেরণ উপমহাদেশের জন্য একটি দুঃখের অধ্যায়।” ১১ আগস্ট নিক্সনের সভাপতিত্বে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকো অভিমত দেন যে, কোনাে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের যে কোনাে বু প্রিন্ট নেই তা জানিয়ে রাখা সম্ভব। তবে একটা সুপারিশ রাখা যেতে পারে যে, পাকিস্তানীরা যেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে বিচারাধীন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর না করে। নিক্সনের মন্তব্য ছিলাে। যুক্তরাষ্ট্র সাহায্য বন্ধ করেনি। ইয়াহিয়ার সঙ্গেও রয়েছে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। সুতরাং তিনি যদি পুরােপুরি ফাদে না পড়েন তাহলে এ কথায় তিনি হয়তাে সায় দেবেন। ইয়াহিয়া খান মনে করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড তার বন্ধু।
মুজিবকে হত্যা করাে না’- এমন সুপারিশ ইয়াহিয়ার কাছে ফারল্যান্ড রাখতে পারেন। নিক্সন আরাে মন্তব্য করেন, যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে, রাজনৈতিক সমঝােতা প্রশ্নে জনসমক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা। তবে ঘরােয়াভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলা যেতে পারে, মুজিবকে হত্যা করা তার উচিত হবে না। | ১২ আগষ্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত পামফ্রে ইসলামাবাদ থেকে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডগলাস হিউম বরাবর একটি টেলিগ্রাম পাঠান। টেলিগ্রামে বলা হয়েছে এক, শেখ মুজিবকে রক্ষার জন্য অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ও সঠিক ব্যক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক চাপ ফলপ্রসূ করতে হবে। দুই. কোনাে তৃতীয় দেশের মাধ্যমে আমেরিকা ও বৃটেনের মিলিত চাপ ফলপ্রসূ হতে পারে। এক্ষেত্রে তৃতীয় দেশ হিসেবে ইরানকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বেছে নেয়া যায়, কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখনও পর্যন্ত শাহ্র কথা শুনতে রাজি, যদিও মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের বিরােধের ব্যাপারে শাহ্-এর মধ্যস্থতা ব্যর্থ হয়েছে। তুরস্ককেও একটি সম্ভাব্য দেশ হিসেবে ধরা যেতে পারে, একই কথা প্রযােজ্য মালয়েশিয়া এবং কয়েকটি প্রধান আরব রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও। আবুধাবির শেখ জাঈদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি। যদিও রাষ্ট্রদ্রোহী’র শাস্তির ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করতে পারে যে উ থান্টএর উদ্যোগ ভারত কর্তৃক প্রভাবিত। তাই উ থান্টের এমন কিছুই করা উচিত হবে , যাতে মনে হতে পারে ভারতের চাপ তাকে তাড়া করছে।
তিন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপর বৃটেনে পাকিস্তানের বন্ধু হিসেবে পরিচিত ব্যক্তিবর্গ যেমন নেভিল ম্যাক্সওয়েল, মিসেস জিল নাইট এবং প্রফেসর রাব্রুক উইলিয়ামের মতাে ব্যক্তিবর্গের চাপও এই মুহূর্তে কাজে আসতে পারে, তবে এটা যে ব্যক্তিগত অর্থাৎ এর পেছনে যে কোনও সম্মিলিত উদ্যোগ নেই, সেটা নিশ্চিত করতে হবে এবং এটাও যাতে মনে না হয় যে, এসব ব্যক্তিবর্গ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সামরিক ট্রাইবুনালে ক্যামেরা ট্রায়ালের সম্মুখিন করা হচ্ছে এই খবর প্রকাশ হওয়া মাত্র সােভিয়েত সরকার উদ্বেগ প্রকাশ করে। খবরটি ১৩ আগষ্ট প্রাভদায় প্রকাশিত হয়। ১৭ আগষ্ট ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশনস্ গ্রুপ মিটিং হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় এক কর্মকর্তার বক্তব্যে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে, যার ফলে ভারতে আরাে শরণার্থীদের ঢেউ এসে লাগবে । পলিটিক্যাল একোমােডেশনে ব্যর্থ হলে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হলে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হবে। ভারত সীমান্তে সামরিক সংঘর্ষ, দুর্ভিক্ষ অথবা শেখ মুজিবকে হত্যা করা হলে সবদিক থেকেই বিপদ ঘনীভূত হবে। উক্ত বৈঠকে উক্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন যে, মুজিবকে ফাসিতে ঝােলানাে হলে তা পরিস্থিতিতে বিরাট পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে । তিনি বলেন যে, ‘মুজিবের মৃত্যুদন্ড কার্যকর হলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে। সেজন্য যুক্তরাষ্ট্র যে নীতি গ্রহণ করে তা হলাে: ভারতকে পাকিস্তান আক্রমন করা থেকে নিবৃত্ত রাখা, দুর্ভিক্ষ যাতে না হয় তাঁর কার্যকর ব্যবস্থা নিতে জাতিসংঘকে কাজে লাগানাে। 
২০ আগষ্ট পাকিস্তান দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেরিত টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কিত। ফারল্যান্ডের ধারণা ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সঙ্গে একাকি কথা বলতে সাচ্ছন্দ্যবােধ করেন। ১৯ আগস্ট ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে দেখা করেন। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্পষ্টভাবে বুঝেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘নিশ্চিতভাবে এবং নির্দিষ্টভাবে মানবিক ও অর্থনৈতিক সার্বিক সাহায্য ইয়াহিয়া খানকে প্রভাবিত করবে। তিনি ইয়াহিয়াকে বলেন, বিশ্বের সব না হলেও অধিকাংশ জাতি অধীর আগ্রহে এবং উদ্বেগের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার প্রক্রিয়ার দিকে নজর রাখছে । আর সবাই না হলেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই সেই বিচারের ফলাফল সম্পর্কে একটা ধারণা পােষণ করছে এবং তারা সে কারণে উদ্বিগ্ন। ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে আশ্বস্ত করেন এই বলে যে, আমি কারাে মৃত্যুদন্ড নিশ্চিত করতে যাচ্ছি না, যদিও তিনি একজন “বিশ্বাসঘাতক’ হয়েও থাকেন। ৩১ আগস্ট মুজিবের বিচার প্রশ্নে আরেকটি নির্দিষ্ট টেলিগ্রাম স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ভারতীয় মার্কিন দূতাবাসে প্রেরণ করা হয়। এতে বলা হয় ভারতীয়রাযেহেতু মুজিবের বিচার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে লিখিত কোনাে উত্তর চাইতে পারে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রদূত কিটিং মার্কিন প্রেসিডেন্টের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব কাউলকে মৌখিক বক্তব্য জানিয়ে দিতে পারেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত এক্ষেত্রে নিমােক্ত নির্দেশনা অনুসরণ করবেন: এক. যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে প্রেরিত বার্তা গ্রহণ করেছেন এবং যত্নের সঙ্গে তা বিবেচনায় নিয়েছেন। দুই. মুজিবের বিচার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গভীর আগ্রহ রয়েছে। তিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স মুজিবের সংক্ষিপ্ত বিচার প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছেন। চার, ভবিষ্যতের যে কোনাে উপযুক্ত সুযােগ উপলক্ষে এই উদ্বেগ জানানাে অব্যাহত থাকবে, এটা শুধু মানবিক কারণে নয়, কারণ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বাস করে যে, মুজিবের বিচার এবং তার সম্ভাব্য মৃত্যুদন্ড দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশলগত অবস্থান ক্রমাগতভাবে অগ্রসর হয়।
বিভিন্ন মিটিং-এ তা স্পষ্টতর হতে থাকে। ৮ সেপ্টেম্বর হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে স্পেশাল অ্যাকশনস্ গ্রুপের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এই মর্মে সিনেটর কেনেডি কর্তৃক উত্থাপিত প্রশ্নের প্রেক্ষিতে কিসিঞ্জার বলেন, আমি চিন্তাও করতে পারি না শেখ মুজিব মৃত। এইড গ্রুপের মিঃ উইলিয়াম বলেন, সম্ভবত মাত্র ১৬জন আওয়ামী লীগ এম, এন, এ. ঢাকা আছেন। পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তার জিজ্ঞাসার উত্তরে বলেছেন, মুজিবের বিচার হবে। তার মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলা আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সিসকো বলেন, রাজনৈতিক সমঝােতায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে অখন্ড পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় রাখার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্র যে গােপনে বাংলাদেশের সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের অনুরােধে আলােচনা করছে এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগকে যথার্থভাবে মূল্যায়ন করেছে। ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে কিসিঞ্জার হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলেন, সিনেটর কেনেডি আজ তার সঙ্গে দেখা করেন। তার আশঙ্কা মুজিবকে সম্ভবত ইতােমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে। তাদের কী মনে হয় এটা সম্ভব? মার্কিন কর্মকর্তাগণ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের বলা হয়েছে বিচার চলছে, আইনজীবী নিয়ােগ করা হয়েছে অথচ তাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, এটা কী করে হয়। তা যদি হয় তা হলে নিশ্চিত করে বলা যায় মৃত মুজিবের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জীবিত মুজিবের অনেক মূল্য। ২১ সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু মুজিবের বিচার প্রশ্নে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড আবারও কথা বলেন।
ফারল্যান্ড সংবাদপত্রের রিপাের্টের বরাত দিয়ে জানতে চান যে, মুজিবের বিচার শেষ হয়েছে কি না? ট্রাইবুনাল কি ইয়াহিয়ার কাছে। সুপারিশ পেশ করেছে। ইয়াহিয়া জবাব দিয়েছেন, বিচার চলছে। তবে তার ইচ্ছা রয়েছে, এই বিচারের পূর্ণ বিবরণ তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে বিচার অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ফারল্যান্ড জানতে চান, বিচারের পরেওপূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য তিনি কি মুজিবকে ট্রামকার্ড হিসেবে আগের মতােই গণ্য করার কথা বিবেচনায় রেখেছেন। ইয়াহিয়া ইঙ্গিত দেন, এই সম্ভাবনার বিষয়ে তার ভাবনার অবকাশ আছে। তবে তিনি এ কথা উল্লেখ করেন যে, মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার সাক্ষ্য-প্রমাণ এতই অকাট্য যে, তাকে মুক্তি দেয়া হলে পশ্চিম পাকিস্তানে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভয়ানক। | ২ অক্টোবর, ১৯৭১ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিবরণ সম্বলিত এক টেলিগ্রাম বার্তায় ইসলামাবাদ, নয়াদিল্লি ও কলকাতার মার্কিন মিশনে প্রেরণ করা হয়। এতে বলা হয় তাদের ফমূলা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমতি নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় কোনাে সমঝােতা হতে পারে কিনা। দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠককালে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ সিসকো ২৭ সেপ্টেম্বর এল.কে. ঝায়ের সঙ্গে আলােচনাকালে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক অনুষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে ভারতের সহযােগিতা কামনা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের কোনাে প্রভাব নেই। তাদের রয়েছে তহবিল সংগ্রহের স্বাধীন উৎস।
ভারত কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হচ্ছে, সে কারণে বাংলাদেশ নাখােশ। কিন্তু, এর অর্থ এই নয় যে, ভারত সংলাপ চায় না। মিঃ রজার্স ভারতকে সংলাপের উদ্যোগ নিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তবে শর্ত দেন যে, ভারত যেন মুজিবের অংশগ্রহণ প্রশ্নে চাপ সৃষ্টি না করে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে একটা সমঝােতায় পৌছানাে যায় সে নিয়ে আলোচনায় মুজিবকে জড়াতে চায় না। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপসংহার টানেন এই বলে যে, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সমঝােতার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভব সব কিছুই করবে। ২ অক্টোবর ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ শরণ সিং ও যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারী রজার্সের ডিতরে এক আলােচনায় দুই নেতাই একমত হন যে, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিরসনে নিচুপর্যায়ে যে আলােচনা হােক না কেন তাতে কিছু আসে যায় না। মুজিব ব্যতীত কোনাে কিছুরই গুরুত্ব নেই।”
৭ অক্টোবর স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের গৃহিত রাজনৈতিক কার্যকলাপ সম্পর্কে পর্যালােচনা করে। পর্যালােচনায় দেখা যায় তখন পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান কোলকাতায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সঙ্গে সমঝােতার বিষয়টি বাইরে রেখেছেন। রাজনৈতিক পর্যালােচনায় বাংলাদেশ নেতৃত্বের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের আলােচনা শুরু করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু লক্ষ্য করা গেছে যে, ইয়াহিয়া খান সবসময় হােচট খেয়েছেন এই ভেবে যে বাংলাদেশ নেতৃত্ব আলােচনায় শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে শর্ত হিসেবে জুড়ে দিয়েছে। ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট মনে করে ভারত বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে একটি সংলাপের ব্যাপারে তাদের প্রভাব খাটাতে তখনই রাজি থাকবে যখন তারা বুঝতে পারবে ইয়াহিয়ার ওপর প্রভাব খাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তুত রয়েছে । বলা বাহুল্য, এর সরল অর্থ হচ্ছে যুদ্ধ শুরু হলে ‘সি-ফায়ার-কার্যকর করার ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র উদ্যোগী হবে। ৭ অক্টোবর হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল এ্যাকশনস্ গ্রুপ মিটিং-এর এক সভায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইউ. এ, জনসন বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যােগাযােগ রেখেছে এবং বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আলােচনা এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে উৎসাহ প্রদান করে যাচেছ। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে জোরাজুরি করা হচ্ছে অবিলম্বে নিঃশর্তভাবে শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ।
কিসিঞ্জারের জিজ্ঞাসা ছিল এটি কি তাদের প্রারম্ভিক কথা? জনসনের মন্তব্য হলাে, হ্যা এটা তাদের প্রথামিক অবস্থান, কিন্তু মূল চাবিকাঠি শেখ মুজিবুর রহমান। ইয়াহিয়া খান যদি শেখ মুজিবকে মুক্তি দেন এবং তার সাথে আলােচনায় বসেন তাহলে রাজনৈতিক সমঝােতার সুযােগ সৃষ্টি হবে। ইয়াহিয়া খান সে সময় নেতিবাচক মনােভাব দেখান নি। এ থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় পাকিস্তান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনা করতে চায় । কিসিঞ্জার বলেন, ভারতের সঙ্গে আলােচনায় তার অভিমত হলাে তারা পাকিস্তানকে শক্তভাবে আঘাত করতে চায় যাতে সব সমস্যা সমাধান হয়। তিনি বলেন, ভারত যদি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতা করে এবং উভয়ে যদি একসঙ্গে কাজ করে তাহলে শেখ মুজিবের মুক্তিসহ বাংলাদেশের স্বায়ত্বশাসন সবকিছুই শতকরা ৯০ ভাগ অর্জন করা সম্ভব।” ৭ অক্টোবর স্পেশাল গ্রুপের উক্ত বৈঠকে সিআইএ পরিচালক সভাকে অবগত করে যে, দেশদ্রোহিতার অভিযােগে মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার পূর্ব পাকিস্তানকে বিক্ষুব্ধ করেছে। এমতাবস্থায় মুজিবের মুক্তিই এখনাে সমঝােতার চাবি। ইয়াহিয়া যদি তাকে মুক্তি দেন এবং তার সঙ্গেই যদি একটা ‘আপােসে আসেন’, তা হলে সমঝােত সম্ভব।১৯ ৮ অক্টোবর ভারতের রাষ্ট্রদূত এল, কে, ঝা-এর সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
মি: ঝা হেনরি কিসিঞ্জারকে জিজ্ঞেস করেন তার এমন অবস্থান রয়েছে কিনা যেখান থেকে তিনি শেখ মুজিবের মুক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার বিষয়টি পাকিস্তানের নিকট আবেদন করতে পারেন। কিনা। ঝা তাকে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম দিনে দিনে বাম দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে, কোলকাতায় ইতােমধ্যেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপর হামলা হয়েছে এবং যতই দিন যাবে তা উগ্রপন্থীদের অবাধ বিচরণ ক্ষেত্র উন্মুক্ত করবে। কিসিঞ্জার সম্মতি দিয়ে বলেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং এ বিষয়ে সম্ভাব্য সমঝােতা হওয়া উচিৎ কিন্তু একতরফাভাবে কিছু না করার জন্য সতর্ক করে দেন। ২২ অক্টোবর ভারত পাকিস্তান অবস্থা সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রণীত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের কার্যকর রাজনৈতিক সমাধান অবহেলিত হওয়ার কারণে ভারত-পাকিস্তান উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে পরামর্শ দিয়েছে অবিলম্বে ইয়াহিয়া খানকে একটি সমাধানে উপনীত হতে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যেহেতু বাংলাদেশ নেতৃত্বের সঙ্গে আলােচনায় সম্মত আছেন সে জন্য পূর্বে নির্বাচিত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তিনি আলােচনায় উদ্যোগী হতে পারেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা বলেছেন, আলােচনায় বাংলাদেশের পক্ষে শেখ মুজিব নেতৃত্ব দেবেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে হবে।
আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে সমস্যার নিষ্পত্তি করতে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে এই মর্মে পরামর্শ দেয়া হয় যে তিনি এই প্রশ্নটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট উত্থাপন করতে পারেন কিনা যে শেখ মুজিব এই নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখবে। ২ নভেম্বর মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড-এর রিপাের্টে জানা যায় ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের নেতা নুরুল ইসলাম (আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য যিনি অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার ব্যাপারে আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তানে ছিলেন) ও তার গ্রুপের সঙ্গে শেখ মুজিবের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা করবেন এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের সঙ্গে কিভাবে কার্যকর যােগযােগ করা যায় তা উদ্ভাবন করবেন। ইয়াহিয়া খান ফারল্যান্ডকে বলেন, মুজিবকে তার প্রতিনিধি নিয়ােগের সুযােগ দেয়া হবে। ইয়াহিয়া খান স্বীকার করেন শেখ মুজিব হলেন সমস্যার মূল কেন্দ্রবিন্দু, প্রশ্নাতীতভাবে মুজিবের ভাগ্য সমস্যার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। ৩ নভেম্বর এক রিপাের্টে দেখা যায়, রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়েছে। শেখ মুজিবের বিচারের কাগজপত্র জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না। ইয়াহিয়া খান আলােচনা সমাপ্ত করেন এই বলে যে, তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন যারা গঠনমূলক কাজ করার অবস্থানে আছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, উপমহাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে রাজি আছেন। ৫ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন। মি. রজার্স বৈঠকের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান সমস্যা নিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চান। ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলির কারণে ভারতীয় নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখিন।
এই হুমকি কেবল ভারতের সীমান্তে পাক-সেনাবাহিনীর উপস্থিতিরি কারণে নয়, এটা ব্যাপকভিত্তিক উদ্বাস্তু স্রোত এবং এটা আরাে তীব্র হচ্ছে, যা পাকিস্তান সরকারের দমন-পীড়ন থেকে উদ্ভূত। এটা ভারতের ওপর শুধু অর্থনৈতিক বােঝা সৃষ্টি করেনি, এটা রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যারও জন্ম দিয়েছে। এমনকি ভারতীয় স্থিতিশীলতা ও অখন্ডতার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করেছে। ইন্দিরা গান্ধী উল্লেখ করেন যে, এই সংকট তার ওপর এক বিরাট চাপ বয়ে এনেছে। এমনকি তার মন্ত্রিসভার মধ্যেও এই অনুভূতি রয়েছে যে, দূর্বল নীতি অনুসরণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী ভারতের নিরাপত্তাকে সংকটাপন্ন করে তুলেছেন। | মি. রজার্স বলেন, ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে রাজনৈতিক সমস্যা নিয়ে সক্রিয় আলােচনায় যুক্তরাষ্ট্র নিয়ােজিত রয়েছে। ইয়াহিয়া এই মর্মে সম্মতি জানিয়েছেন যে, মুজিব কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেয়া বাংলাদেশের কোনাে নেতার সঙ্গে তিনি বৈঠকে বসবেন। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এটা একটা উৎসাহব্যঞ্জক ইঙ্গিত। এ রকমের আলােচনার প্রক্রিয়ায় সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার এবং রাজনৈতিক সমঝােতার প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। এই প্রক্রিয়া যাতে শুরু হয়, সে লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। যুক্তরাষ্ট্র ইয়াহিয়াকে এটা বলতে পারে না যে মুজিবকে মুক্তি দেন। এটা বললেও কাজ হবে না। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, ইয়াহিয়া যদি সত্যি একতরফাভাবে সৈন্য প্রত্যাহার কার্যকর করেন তাহলে ভারত যেন সমরূপ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বিবেচনা করে।
ইন্দিরা জবাবে বলেন, ইয়াহিয়া হয়তাে পশ্চিম সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। কিন্তু ভারতের ওপর প্রচণ্ড চাপ পূর্ব পাকিস্তানের। মি, হাকসার এই সময় ব্যাখ্যা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস স্বপক্ষ ত্যাগের ঘটনায় পাকিস্তান সরকার সীমান্তে নিয়মিত সেনাবাহিনী মােতায়েন করেছে। আর এটা স্পষ্টভাবেই বিধির লঙ্ঘন। এই সৈন্যবাহিনী ক্রমাগতভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে হামলা চালাচ্ছে। কাউল উল্লেখ করেন, পাকিস্তানের ঘাঁটিগুলাে সীমান্তের কাছাকাছি এবং সে কারণেই তাদের পক্ষে অধিকতর সহজে প্রত্যাহার করে নেয়া সম্ভব। তারা প্রশ্ন রাখেন, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে কি এমন প্রমাণ আছে, যা থেকে বােঝা সম্ভব ইয়াহিয়া সত্যিই রাজনৈতিক সমাধান চান? মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জবাবে বলেন, তারা এটা স্পষ্ট করে বলতে পারেন, এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ইতােমধ্যেই যা করার তা সম্পন্ন করেছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলােচনার শেষ পর্যায়ে উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিশ্বের বহু স্থানে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন। তারা এটা বুঝতে পারছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যার কারণে ভারতের ঘাড়ে বিপদ চেপেছে। যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধের বিপদ এড়াতে সম্ভাব্য সব চেষ্টা করছে। কিন্তু এসব আলােচনার মূল কেন্দ্রের দিকে ধাবিত হয়, যেখানে দাড়িয়ে আছেন বন্দি মুজিব। বিভিন্ন বার্তায় তা যথার্থভাবে প্রমাণিত। | ১২ নভেম্বর ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশনস্ গ্রুপের বৈঠকে হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের মি. সিসকো বলেন, ভারত বারবার এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে একটি দাবি করে আসছে সেটি হল শেখ মুজিবের মুক্তি। শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে ইয়াহিয়া খান আলােচনা করতে পারেন ।
কিসিঞ্জার বলেন, তারা বলেছিল ইয়াহিয়া খান প্রথমে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন এবং অবশ্যই তিনি মুজিবকে হত্যা করবেন না আর আলােচনায় একটি এগ্রিমেন্ট হবার পর ইয়াহিয়া খান অবশ্যই শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলবেন। বৃটেনের জানা মতে, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার পর্ব ১০ দিন ধরে চলবে এবং মনে হচ্ছে মৃত্যুদণ্ড অবিলম্বে কার্যকর করা হবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের। উপর চাপ প্রয়ােগ করতে হলে তা সম্মিলিতভাবে এবং ক্রমান্বয়ে করতে হবে। একসঙ্গে সব গােলাবারুদ নিঃশেষ করা উচিত হবে না। পাঁচ, পাকিস্তানী হাই কমিশনার মি. সালমান আলীর সঙ্গে বৃটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আলােচনা প্রসঙ্গে বলা হয়, যে বা যারাই শেখ মুজিবকে রক্ষা করতে চান তাদের সকলকেই ইয়াহিয়ার সহজাত ধারণার কথা মনে রাখতে হবে। তিনি রূঢ় নীতি ধারণ করেন। বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথ ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রেরিত বার্তার উত্তরে বলেন, ‘শেখ মুজিবের বিচারে বৃটেন উদ্বিগ্ন। পত্রে বলা হয়, “১৪ আগষ্ট “শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে পাঠানাে আপনার বার্তাটি ভারতীয় হাই কমিশনারের মাধ্যমে আমার হস্তগত হয়েছে। শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে আপনার মতাে আমিও সমভাবে উদ্বিগ্ন। ইতােমধ্যেই। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে পাঠানাে আমার বার্তায় যতাে দ্রুত সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে পরিষ্কারভাবে বলেছি।
শেখ মুজিবকে প্রাণদণ্ডদান সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের মনােভাব পরিবর্তনের উদ্দেশ্য স্যার আলেক ডগলাস হিউমও লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানী হাই কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছেন। হাই কমিশনার আমাদের এই উদ্বেগের কথা তার সরকারকে পৌছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আমরা ইতােমধ্যেই আমাদের মনােভাব পরিষ্কারভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে তুলে ধরেছি। তথাপি কোনও প্রকার অবিবেচনা প্রসূত পদক্ষেপ যেন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া গ্রহণ না করেন তা নিশ্চিত করার জন্য আরও কী। করা যেতে পারে, তা আমরা বিবেচনা করে দেখছি। শুভেচ্ছাসহ, এডওয়ার্ড ১৯ নভেম্বর রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড হেনরি কিসিঞ্জারকে জানান যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছেন তিনি বিদ্রোহী বাংলাদেশ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতে সম্মত আছেন। তিনি তাদের পশ্চিম পাকিস্তানের আসা ও যাবার জন্য সাদা পতাকা অনুমােদন দেবেন কিন্তু গুরুত্বর অভিযােগের সঙ্গে যে সমস্ত প্রতিনিধি যুক্ত তাদের। সাথে সাক্ষাৎ করবেন না। ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, মুজিব নেগােসিয়েশনের মূল চাবিকাঠি নন বরং ইন্দিরা গান্ধীর কাছে রয়েছে ‘তালা ও চাবি’ উভয়ই (both the key and the lock).” ২৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হীথের মধ্যে টেলিফোনে দীর্ঘ কথােপকথন হয় । এই কথােপকথনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হীথ নিক্সনকে বলেন যে, পাকিস্তান ইচ্ছে করলেই ভালাে অবস্থান পেতে পারতাে যদি তারা (হীথ-নিক্সন) প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে ও অতীত ভুলে যেতে রাজি করানাে যেতাে। মানুষকে কারাগারে পাঠিয়ে, পরে তাদের সঙ্গে আলােচনা করে এবং তাদেরকে প্রেসিডেন্ট বানানােসহ অন্য অনেক কিছু করার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা সম্ভবত বৃটেন-মার্কিনীদের রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী হীথ নিশ্চিতভাবে বলেন , যদি ইয়াহিয়া খান চাইতেন তাহলে তিনি পরিস্থিতিকে সফল ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন। কিন্তু নিক্সন বলেন যে, মাথায় বন্দুক ঠেকানাে অবস্থায় ইয়াহিয়া খানের কিছু করার নেই।” ৪ নভেম্বর ১৯৭১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মন্তব্য করেন, এ বিশাল ট্র্যাজেডির বিষয়ে আর্ন্তজাতিক উদ্যোগ নিতান্তই নগণ্য। তিনি নিক্সনকে রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরত্ব আরােপ করেন। রাজনৈতিক সমাধান বলতে ইন্দিরা গান্ধী বােঝাতে চেয়েছেন বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি। নিক্সনকে জোর দিয়ে বলেন, অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও উভয়দেশের সৈন্যদের সীমান্ত থেকে প্রত্যাহার করা। প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কারভাবে বলেন, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তান একত্রে থাকার আর কোনাে অবকাশ নেই। ৫ নভেম্বর বৈঠকে নিক্সন পাশের ঘরে বসে কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “এই বুড়ি ডাইনিকে আমরা মাত্রাতিরিক্ত প্রশ্রয় দিয়েছি এবং ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি কুকুরী বলে গালাগাল করতে থাকেন। তিনি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে অবহেলা করার জন্য ৪৫ মিনিট পর আলােচনায় বসেন। আলােচনা ভেঙে যায়। নিক্সন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে সতর্ক করে বলেন, সামরিক ব্যবস্থা কারাে জন্য ভালাে হবে না। এর জবাবে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “তিন/চার হাজার মাইল দূর থেকে শুধুমাত্র বর্ণগৌরবে কোনাে দেশ ভারতকে তাদের ইচ্ছে মতাে আদেশ দেয়ার ক্ষমতার দিন শেষ হয়ে গেছে।’
যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সামরিক বাহিনীকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের সিগন্যাল দেন। সে সময় তিনি বলেন, এখনও সময় আছে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে অবিলম্বে পাকিস্তানকে রাজনৈতিক সমঝােতায় আসতে হবে। আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে নেকড়েদের হাতে ছেড়ে দিতে পারি না।’ ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতে আক্রমণ করলে কলকাতা জনসভা থেকে সংবাদ পেয়ে বিমানে দিল্লী ফেরার পথে মিসেস গান্ধীর মন্তব্য ছিল, “The fool has done exactly what one had expected.’ ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন পাকিস্তান প্রথমে আক্রমণ করুক। পাল্টা আক্রমণ করবে ভারত এবং মিত্রবাহিনী বাংলাদেশে ঢুকে পড়বে। ১২ নভেম্বর ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশনস্ গ্রুপের বৈঠকে হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। সভায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের মি. সিসকো বলেন, ভারত বারবার এবং অপরিবর্তনীয়ভাবে একটি দাবি করে আসছে সেটি হল শেখ মুজিবের মুক্তি। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যার সঙ্গে ইয়াহিয়া খান আলােচনা করতে পারেন। কিসিঞ্জার বলেন, তারা বলেছিল ইয়াহিয়া খান প্রথমে আওয়ামীলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলবেন এবং অবশ্যই তিনি মুজিবকে হত্যা করবেন না এবং আলােচনায় একটি এগ্রিমেন্ট হবার পর ইয়াহিয়া খান অবশ্যই শেখ মুজিবের সঙ্গে কথা বলবেন। সিসকো বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর নিকট প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব ছিল। খুবই স্পর্শকাতর। যদি ইন্দিরা গান্ধী তার বাধাগুলাে অপসারণ করে তাহলে এটা হবে আনন্দের সমঝােতা ।
কিসিঞ্জার মি. সিসকোকে জিজ্ঞেস করেন প্রস্তাবগুলাে কী। ছিল? সিসকো উত্তরে বলেন, তিনটি বিকল্প প্রস্তাবের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে সবচেয়ে আগ্রহী করে তুলেছিল শেখ মুজিব কর্তৃক অনুমােদিত প্রতিনিধির সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলােচনার ইচ্ছাকে।” ৫ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলেন, বর্তমান অবস্থায় ভারতের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদে কিছু উপস্থাপন করা হলে সে ক্ষেত্রে রাশিয়া ভেটো প্রয়ােগ করবে, আবার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনাে প্রস্তাব আসলে চীন সেখানে ভেটো প্রয়ােগ করবে। প্রেসিডেন্ট বলেন, এর ভিতর কীভাবে সমন্বয় করা যায়, ভারত বর্তমান কোন পথ ধরেছে। কিসিঞ্জার বলেন, তাদের পরামর্শ হলাে যা তারা সর্বদাই বলে আসছে তা হলাে শেখ মুজিবের মুক্তি। ১৫ ডিসেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি অতি জরুরী বার্তা পাঠান । ঐ বার্তায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “আমি এমন এক সময় আপনাকে চিঠি লিখছি, যখন ভারত-আমেরিকার মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছুটা অসুবিধাজনক অবস্থা তৈরি হয়েছে। সেহেতু আমি আপনাকে ধৈর্যের সঙ্গে গোড়া থেকেই পুরাে ব্যাপারটি নিয়ে ভাবতে অনুরােধ করছি। এমন কিছু কিছু সময় আসে যখন বর্তমানের গভীর সংকটকে অতীতের কিছু মহৎ ঘটনাবলী দিয়ে আলােকিত করতে হয়। তেমনি একটি ঘটনা আমেরিকা কর্তৃক তার ঐতিহাসিক স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। সেই ঘােষণায় বলা হয়েছিল, যখন কোন সরকার তার জনগণের অধিকারের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর বিবেচিত হয়, তাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা সেদেশের জনগণের রয়েছে। বিশ্বের সকল মানবিক দেশ ২৫ মার্চের ভয়াবহ ঘটনাকে সাড়ে সাতকোটি মানুষের বিদ্রোহ বলে দেখছেন।
যারা সারা জীবন কেবল উপেক্ষা আর বঞ্চনাকে সহ্য করেছে। বিশ্বের প্রায় সকল প্রচার মাধ্যমে ২৬ মার্চের ভয়াবহতাকে তুলে ধরেছে, যা আপনি অবগত। আমেরিকার বােদ্ধা জনগণও পূর্ববাংলার মানুষের দাবি সমূহকে উপস্থাপন করেছেন তাঁদের বিশ্লেষণে । | ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান কর্তৃক ভারত আক্রমণের পূর্ব পর্যন্ত ৯ মাসের দুঃখজনক পরিস্থিতিকে এড়ানাে যেত, যদি বিশ্বের বড় বড় দেশগুলাে ও তাঁদের নেতারা বিষয়টির প্রতি মনােযােগ দিতেন এবং প্রকৃত বাস্তবতাকে বুঝতে চেষ্টা করতেন। যদিও আমি এ বিষয়ে যথেষ্ট চেষ্টা করেছি। বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে প্রকৃত অবস্থা বােঝানােনার পরও শরণার্থীদের ব্যাপারে সহানুভূতি দেখালেও সবাই সমস্যার মূল কারণ অনুসন্ধানে উদাসীন থেকেছে। বিশেষ করে আমেরিকা যদি এক্ষেত্রে তার প্রভাব ও কর্তৃত্ব দিয়ে অন্তত শেখ মুজিবকে মুক্তি প্রদানের ব্যবস্থা করত, তাহলে অন্তত যুদ্ধ এড়ানাে যেত। কেউ কেউ একটি মীমাংসার কথা বললেও প্রকৃত সমস্যা নিরসনে কেউ বাস্তব উদ্যোগী হননি। জনাব রাষ্ট্রপতি আমি বিনীতভাবে আপনার নিকট জানতে চাই শেখ মুজিবের সঙ্গে আলােচনার চেয়ে একটি যুদ্ধকে অনিবার্য করে তােলা কি বেশি ধ্বংসাত্মক নয়? তিনি আরাে বলেন, আমরা বাংলাদেশ কিংবা পাকিস্তানের কোনাে অংশ চাই না। আমরা বহুবার পাকিস্তানের সঙ্গে চুক্তি করতে চেয়েছি, কিন্তু প্রতিবারই তাঁরা তা প্রত্যাখান করেছে। মিঃ কিসিঞ্জার আগস্টে ভারত সফরে এলে তার কাছে একটি রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছিলাম, কিন্তু সে বিষয়ে আমরা কোনাে ধরনের প্রতিউত্তর পাইনি। আমাদের একান্ত অনুরােধ, আপনার গভীর জ্ঞান এবং মানবিক বােধ দিয়ে আমেরিকার মানুষের ইচ্ছা ও আদর্শের প্রতীক হিসেবে আপনি আমাকে জানতে দিন যে, আমরা কোথায় ভুল করছি। 
এই পত্রে আরাে বলা হয়, আমাদের উদ্দেশ্য সীমিত। আমাদের লক্ষ্য ছিল ত্রাসের রাজত্ব থেকে দেশকে মুক্তি করার ব্যাপারে বাংলাদেশের বীর জনতা ও মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করা এবং আমাদের মাতৃভূমির উপর আক্রমণ প্রতিহত করা । প্রয়ােজনের বেশি একিদনও ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে থাকবে না। যে লক্ষ লক্ষ লােক তাঁদের ঘর বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়ে আমাদের সীমান্ত অতিক্রম করেছিল, তাঁরা ইতিমধ্যেই ফিরে যেতে শুরু করেছে। যুদ্ধ বিধস্ত সেই দেশের পুনর্বাসনের জন্যে সরকার ও জনগণকে ত্যাগের মনােভাব নিয়ে কাজ করা প্রয়ােজন। আমরা আশা ও বিশ্বাস করি যে, এই নতুন দেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জনগণের মধ্যে যথাযােগ্য স্থান গ্রহণ করে বাংলাদেশকে শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন। সােনার বাংলায় একটি সার্থকতাপূর্ণ ভবিষ্যত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে আত্মনিয়ােগ করার জন্য বাংলাদেশের জনগণের সময় এসেছে। তাঁদের জন্য আমাদের শুভেচ্ছা রইল। তাঁদের এ বিজয় শুধু তাঁদের একার নয়। যেসব জাতি মানবিক চেতনার মূল্য দিয়ে থাকে, সে সব দেশও বিজয়কে মুক্তির সন্ধানে মানুষের বিরাট সাফল্য হিসেবে স্বীকৃতি দেবে।  প্রেসিডেন্ট নিক্সন চিঠিটি পেয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে নিক্সন এবং কিসিঞ্জার আলােচনা করেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রীর চিঠির জবাব দেয়ার জন্য স্টেট ডিপার্টমেন্টকে নির্দেশ দেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩১৪ নম্বর দলিলে লক্ষ্য করা যায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর চিঠিটি গভীর মনােনিবেশ সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যবস্থা করলে বেসামরিক প্রশাসন কাজ করতে সমর্থ হতাে। এ কথাটিকে প্রহসন হিসাবেই চিহ্নিত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছে শেখ মুজিব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু। পাকিস্তানিরা ভেবেছে, শেখ মুজিব যুদ্ধ। ঘােষণা করেছে। তাই তাকে ছেড়ে দেয়া, মুক্তি দেয়ার অর্থই হবে পাকিস্তানের সংহতি বিনিষ্ট করা। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলির পাঠা বানাতে পারেনা। মিসেস গান্ধীর পত্রটি যে কর্কশ ভাষায় লেখা একথাটি তাকে জানানাে যেতে পারে। ঐ দিনই সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে আলােচনায় যুক্তরাষ্ট্র উপলব্ধি করে খুব শিগগিরই বাংলাদেশ স্বাধীন হতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র নিক্সনের নির্দেশে সপ্তম নৌবাহিনী বঙ্গোপসাগরে পাঠানোর উদ্যোগ নিলে সােভিয়েত রাশিয়ার কূটনীতিক বলেন যে, সােভিয়েত নৌবহর কোনােক্রমেই বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহরকে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। চীন লাদাক সীমান্তে এগিয়ে এলে সােভিয়েত চীনের সিনকিয়াং অঞ্চলে অ্যাকশনে যাবে। এই পরিস্থিতিতে মিসেস গান্ধীর ১৫ ডিসেম্বর প্রেরিত চিঠি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত রাশিয়া ও জাতিসংঘের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। | ১৫ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী প্রেরিত চিঠির জবাব দেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। চিঠির মূলকথা ছিল জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহার সংক্রান্ত । নিক্সন চিঠিতে বলেছেন, সবরকম রাজনৈতিক আলােচনার পথ রুদ্ধ হওয়ার আগেই সামরিক কার্যক্রম গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্র যথার্থ মনে করেনি। আগামী দিনে আমরা পুনরায় একসঙ্গে কাজ করতে পারবাে এবং দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে পারবে। | ১৮ তারিখে ভুট্টোর সঙ্গে নিক্সনের বৈঠক হয়। ভুট্টো বলেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতে তিনি সন্তুষ্ট। পাকিস্তান সবসময় বিশেষ করে বর্তমান মুহূর্তে সহযােগিতা করায় কৃতজ্ঞ। তবে তিনি মনে করেন পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটে চলেছে সেসবের কিছুই বন্দী মুজিব জানতেন না। তবে অনেক কিছু তিনি অনুমান করতে পারতেন। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা যদি পূর্ব পাকিস্তান দখলে নিয়ে আসতে পারে, আওয়ামী লীগ যদি আত্মসমর্পণ করে থাকে, তবে তাকে হত্যা করা হবে। জিম্মি হিসেবে যতক্ষণ পর্যন্ত তার কোনাে কার্যকারিতা ইয়াহিয়া খানের কাছে থাকবে, তাকে ততক্ষণ বাচিয়ে রাখা হবে। কোনাে খবরের কাগজ, বই বা রেডিও তাকে দেয়া হয়নি। তাঁর যেটা একমাত্র বিলাসিতা সেই তামাক তাকে দেয়া হয়েছিল। তিনি দিনের গণনা রাখতেন, পাঠ করতেন কোরান, তাকিয়ে থাকতেন ক্ষুদ্র এক খণ্ড আকাশের দিকে এবং নিজেকে সমর্পণ করেছিলেন কারাগারের অবিচ্ছিন্ন নীরবতার কাছে।

২২ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট ভুট্টো মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসভবনে গমন করেন। সেখানে আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনা করার অভিমত প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি ৩৫ মিনিট অবস্থান করেন। পাকিস্তান সংকটের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাকিস্তানকে সহযােগিতা দিয়েছে তা ভুলবার নয়। অন্যান্য কথার মধ্যে ভুট্টো প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও প্রেসিডেন্ট থাকা সত্বেও অতি শীঘ্ন রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠা, শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক আবহাওয়া তৈরী করার কথা বলেন। ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটি চুক্তি করার কথা বলেন, যা পশ্চিম পাকিস্তানের স্থানীয় সমস্যার ক্ষেত্রে করতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে অবস্থার ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেবেন। প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো ফারল্যান্ডকে জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে জেলখানা হতে মুক্তি দিয়ে তাঁকে রেস্টহাউজে বন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। ফারল্যান্ড বলেন, তিনি খুবই আনন্দিত হবেন যথা সময়ে যদি এই শুভকাজ সম্পাদিত হয়।” | বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাকিস্তানে ক্ষমতার পট পরিবর্তন ঘটে। ইয়াহিয়া খান বন্দি হন। ভুট্টো ক্ষমতায় আসেন। একদিকে পরাশক্তির চাপ। অন্যদিকে বাংলাদেশে আটক ৯৩ হাজার সৈন্য। এ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়া ব্যতীত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর অন্যকোনাে উপায় ছিল না। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে যে কোনাে ধরনের একটি শিথিল সম্পর্ক রাখার পীড়াপীড়ি করলে বঙ্গবন্ধুর পরিস্কার উত্তর ছিল, দেশের মানুষের কাছে না গিয়ে তিনি কিছুই বলতে পারবেন না। ৮ জানুয়ারি গভীর রাতে পি. আই. এ. বিমানে যাত্রার প্রাক্কালে জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে হাত খরচের জন্য পঞ্চাশ হাজার ডলার এগিয়ে দিলে বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা চার্টার বিমানের ভাড়ার জন্য রেখে দিন। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারি লন্ডন থেকে ভারত হয়ে ফিরে আসেন তার স্বাধীন স্বপ্নের সােনার বাংলায় ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!