বিভ্রান্তিকর প্রশ্নের জবাব
[পঞ্চদশ অধ্যায়ে মূলত মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপ্রধান এ কে খন্দকার লিখিত বইয়ে জাতির সামনে যে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ব্যাখ্যা প্রদান করা হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়ার প্রয়াস নেয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ ও সত্যের মুখােমুখি বইটির সকল অধ্যায়গুলাে পর্যালােচনা করলে সচেতন পাঠক মাত্রই দেখতে পাবেন যে রাজনীতিবিদদের কারণেই বাংলাদেশ স্বাধীনতার পথে অগ্রসর হয়েছে। তাদের ত্যাগ তিতীক্ষা অবদানকে অবমূল্যায়ণ করে কিংবা ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা দিলে অল্প ক্ষয়ক্ষতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হতে এই ধরনের মন্তব্য বইটিকে অর্বাচীন বিতর্কের ভিতরে ঠেলে দিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে ২৫ মার্চের পরেও যিনি কর্মরত ছিলেন তিনি কি করে দুই। বার বর্ডার থেকে ফিরে এসে পাকিস্তান সরকারের অধীনে চাকরি করেছেন। তাকে পাকিস্তানিরা সন্দেহ করেনি কেন?]
সম্প্রতি প্রশ্ন উঠানাে হয়েছে, স্বাধীনতা ঘােষণা ছাড়াই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এ ধরনের একটি আচমকা-যুক্তিহীন ও ইতিহাস বিবর্জিত প্রশ্ন নিয়ে আলােচনার ইচ্ছা থাকলেও যেহেতু প্রশ্নটি উত্থাপিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন ডেপুটি চিফ অব স্টাফ এ কে খন্দকারের লিখিত বই থেকে, সেজন্য এর প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলাে উত্থাপন ঐতিহাসিক কারণেই জরুরি। তবে এ প্রসঙ্গে তার উত্থাপিত মৌলিক প্রশ্ন সম্পর্কে সবিনয়ে সংক্ষিপ্তভাবে ঐতিহাসিক ও প্রাসঙ্গিক বিষয় আলােচনার দাবি রাখে। কেননা এর ফলশ্রুতিতে দেশ ও জাতির ভ্রান্তি নিরসনে যেমন নতুন মাত্রা যােগ হবে তেমনি সবচেয়ে উপকৃত হতে পারি আমি স্বয়ং।
১. মার্কিন গােপন দলিলে লিখিত আছে, মুজিব ও ইয়াহিয়া খান ২৩ মার্চ একটি সম্ভাব্য সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল অবিলম্বে বাংলাদেশের প্রাদেশিক সরকার গঠিত হবে এবং কেন্দ্রের হাতে কেবল দেশ রক্ষা, বিদেশনীতি এবং অর্থ সীমিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে । কিসিঞ্জার সিআইএ’র প্রধান রিচার্ড হেলমসকে জিজ্ঞাসা করেন শেখ মুজিব গ্রেফতার হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? তিনি বলেন বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবের যে অত্যুঙ্গ জনপ্রিয়তা ও আবেগ রয়েছে তার ফলে গৃহযুদ্ধ শুরু হবে যার পরিসমাপ্তি ঘটবে স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাধ্যমে। কিসিঞ্জার বলেন, পরিস্থিতি যাই হােক আমরা পাকিস্তানের পক্ষে থাকব। মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা, স্টেটস ডিপার্টমেন্ট সকলেই অবগত ছিলেন, শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কোনাে ছাড় দেবেন না ।
২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে রাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী নিরীহ বাঙালির উপর যে আক্রমণ করবে এ কথা বঙ্গবন্ধুর অজানা ছিল না। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঐদিন রাজনৈতিক সমঝােতার ঘােষণা না দিয়েই ছদ্মবেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। যাওয়ার পূর্বে তিনি সামরিক বাহিনীকে আক্রমণের নির্দেশ দেন। এ বিষয়টি বঙ্গবন্ধু অবগত ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে গবেষণায় দেখা যায় বঙ্গবন্ধু বেশ কয়েকটি চ্যানেল প্রস্তুত করেছিলেন। এগুলাের মধ্যে ছিল ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ও অন্যান্য স্থানে রক্ষিত ওয়্যারলেস, গুলিস্তানস্থ টিএ্যভিটি ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি ও টেলিফোন অফিস হতে বঙ্গবন্ধুর প্রদত্ত ঘােষণী প্রেরণের ব্যবস্থা। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বিভিন্ন চ্যানেলে প্রদত্ত স্বাধীনতার ঘােষণা সমগ্র দেশে পেীছে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থার রিপাের্টে এই ঘােষণা বিস্তারিত উল্লেখ আছে। এমনকি ১৫ মার্চ মার্কিন গােপন নথির এক তথ্যে বলা হচ্ছে, মুজিব দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছেন। ২৬ মার্চ হেনরি কিসিঞ্জারের জবাবে সিআইএ প্রধান তাকে জানান যে, A clandestine radio broadcast has Mujibur Rahman declaring the independence of Bangladesh’.
২. গ্রেফতারের পূর্বে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎপ্রাপ্ত শেষ ব্যক্তি হিসেবে দাবিদার বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রয়াত আতাউস সামাদ তার বইতে লিখেছেন, সামরিক বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলাতে বঙ্গবন্ধু মাথা নিচু করে যাতে তিনি শুনতে পান সেভাবেই বললেন, “আই হ্যাভ গিডেন ইউ ইনডিপেন্ডেন্ট। নাউ গাে এন্ড প্রিজার্ভ ইট”। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বেলাল মােহাম্মদ বলেছেন, “২৫ মার্চ দিবাগত রাতে তারবার্তা আকারে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রামে যে মেসেজ পাঠিয়েছিলেন তার ভিত্তিতে চট্টগ্রাম শহরে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা মাইকিং করে প্রচার করা হয়। ঘােষণা সম্পর্কে সাইক্লোস্টাইল হ্যান্ডবিল বিতরণ করা হয়। ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণার আলােকে লিখিত বক্তব্য আগ্রাবাদ বেতারে প্রচার করেন। যা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। ৩. বইটিতে প্রশ্নাকারে বিশদভাবে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেনাবাহিনীকে নির্দেশনা না দেয়ার ফলে স্বাধীনতা যুদ্ধে সময়ক্ষেপণ হয়েছে এবং বহুলােকের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। বাঙালি সেনাকর্মকর্তাদের সুসংগঠিত করা হয়নি। আমি তখন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য। বঙ্গবন্ধু সব নেতাকে ৭ মার্চের পরেই এলাকায় যাওয়ার ও সর্বত্র সার্বিক প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। তখনই সারাদেশে ট্রেনিং শুরু হয় । থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। নিকটবর্তী ইপিআর বাহিনীর সঙ্গে যােগসূত্র স্থাপন করা হয়। মার্কিন গােপন দলিলে বলা হয়েছে ২৫ মার্চ ৫০০০ বাঙালি সৈন্য এবং তার বিপরীতে ২০ হাজার পাকিস্তানি নিয়মিত সৈন্য বাংলাদেশে অবস্থান করেছে।
তাছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদবাহিনী সব মিলিয়ে আরাে ১৩ হাজার আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ছিল। কিন্তু ইপিআর বাহিনীর যা ছিল মুক্তিযুদ্ধের অগ্রণী বাহিনী তার অধিকাংশ ইউনিটে কমান্ডিং অফিসার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকর্তরা। সে সেনাবাহিনীর মনােভাব সম্পর্কে ১৯৭২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তিবাহিনীর সেনাপ্রধান জেনারেল ওসমানী বলেছেন, “পাকিস্তান সামরিক বাহিনী যদি শুধু ছাত্র-যুবক, শ্রমিক ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তাদের আক্রমণ সীমাবদ্ধ রাখত তাহলে বাঙালি সেনা অফিসাররা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত কিনা সন্দেহ। যখন তাদের ওপর আক্রমণ শুরু হলাে তখন কেবল তারা রাতারাতি মুক্তিবাহিনী হিসেবে এগিয়ে এলেন।” একটানা ১৯৫১-১৯৬৯ অর্থাৎ ১৮ বছর ধরে পাকিস্তানে কর্মরত বিমান বাহিনীর চৌকস ও মেধাবী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসেবে এ, কে, খন্দকার বাংলাদেশে এসে অতি সহজে কর্মরত বাঙালি সেনাসদস্যগণের যে মনােভাব ছিল তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করেছেন কিনা তা আমার জানা নেই। কারণ ৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বের ঘটনাবলি সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা সীমিত হয়ে থাকবে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ । আগরতলা মামলার অভিজ্ঞতা তার চিন্তাচেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। সেসময় বাঙালি সেনা কর্মকর্তাদের উপর নানা ধরনের মানসিক চাপ ও পেশাগত অমর্যাদাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল এবং বাঙালি সেনা অফিসারদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল।
যার ফলে তারা নিজেরাই একে অন্যের সঙ্গে মন খুলে কথা বা সম্পর্ক রাখতে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেকারণে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক চটজলদি সিদ্ধান্ত ও নির্দেশ বিভিন্ন গ্রুপে ও কমান্ডে বিভক্ত বাঙালি সামরিক সেনা কর্মকর্তাদের প্রতি দেয়া যথার্থ হতাে কিনা তারও বিশ্লেষণ প্রয়ােজন। কেননা আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত সেনাবাহিনীর নিদারুণ-নির্যাতন তাদের মনে জ্বলজ্বল করছিল। তাছাড়া তারা পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করত কিনা সেটাও বিবেচ্য। চট্টগ্রামে ইপিআরের ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন সাফায়াত জামিল, মেজর শফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফসহ দু-চারজন ব্যতিক্রম ব্যতীত অধিকাংশ সেনাছাউনিতে বাঙালি সেনা কর্মকর্তা পাকিস্তানিদের দ্বারা আক্রান্ত না হওয়া পর্যন্ত তারা অস্ত্র তুলে নেননি। তারা নির্দেশ পেলেও একসাথে যুদ্ধে এগিয়ে এসে খন্দকার সাহেবের মতে ‘রাতারাতি দেশ স্বাধীন করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। একটি ক্ষুদ্র দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টি দেখা একরকম, যেমনটি দেখেছেন এ কে খন্দকার। কিন্তু সার্বিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের বিশ্লেষণ তার লিখিত পুস্তকে অনুপস্থিত থাকায় তার লেখা সম্পূর্ণ পটভূমিকে স্পর্শ করেনি। ৪. আহমেদ সালিম রচিত ‘ব্লড বিটেন ট্র্যাক’ পুস্তকে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে লিখেছেন, “জেনারেল টিক্কা খানকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের গ্রেফতার প্রসঙ্গে জিজ্ঞাসা করা হলে টিক্কা খান জবাব দেন, “আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, ‘স্যার, শুনুন শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন এবং আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘােষণা শুনি। আমি তার কণ্ঠের সঙ্গে পরিচিত ছিলাম তাই তাকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না। পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশ স্বাধীন করার অভিযােগে পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করার জন্য বঙ্গবন্ধুকে দেশদ্রোহী হিসেবে অভিযুক্ত করেছিলেন। ২৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত বেতার টিভির বক্তৃতায় তার প্রমাণ বিস্তৃত।
৫. স্বাধীনতা ঘােষিত না হলে কিসের ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়েছিল? এ প্রসঙ্গে তিনি শহীদ তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণা সম্বলিত বঙ্গবন্ধুর নিকট উত্থাপিত ‘এক টুকরাে কাগজে লেখা পাঠ করেননি বলে খন্দকার সাহেব এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা করেননি। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন সাহেবকে বলেছিলেন, এই চিরকুটে ঘােষণার দরকার হবে না। মনি, সিরাজুল আলম কলকাতা থেকে ঘুরে এসেছে। চিত্তরঞ্জন সুতারের সঙ্গে কথা বলে এসেছে। সে-ই তােদের ব্যবস্থা করে দেবে।” সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন করার পরিকল্পনা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু এক নম্বর আসামি ছিলেন। সে অভিজ্ঞতা তার মনে ক্রিয়াশীল ছিল। সেজন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে তার পরিকল্পনায় ছিল জনযুদ্ধ। ৭ মার্চ তিনি ঐ জনযুদ্ধের নির্দেশনা প্রদান করেন। ৬. জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যেমন জাতীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হয়েছে, তেমনি জাতিসংঘ স্বীকৃত একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামাের বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণকারী হিসেবে চিহ্নিত হলে জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সমুন্নত থাকে না। সেজন্য পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নিরীহ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করলে বঙ্গবন্ধু যথারীতি স্বাধীনতার ঘােষণা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
৭. তাজউদ্দীন আহমেদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ভারত সীমান্তে পেীছালেন। সেখানে পৌছে তারা আশ্চর্য হলেন, যখন দেখলেন অপরিচিত দুজন লােক তাদের স্যালুট দিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। তাদের পরিচয় তারা বি, এস, এফ.-এর লােক। তাদের ওপর ইনস্ট্রাকশন ছিল বি, এস, এফ.-এর প্রধান রুস্তমজীর নিকট নিয়ে যাওয়া। তিনি অস্থিরভাবে অপেক্ষা করছেন। রুস্তমজীর জীপে তারা উঠে বসলেন। রুস্তমজীর সঙ্গে দেখা হলে তিনি বললেন, কলকাতা না গিয়ে সােজা দিল্লী চলে যান, ইন্দিরাজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করুন। সাক্ষাতে কয়েকদিন বিলম্ব হয়। এর মধ্যে পিএন হাস্কার, কাউলসহ নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে দুজনের আলােচনা হয় । তেসরা এপ্রিল ইন্দিরা গান্ধী সরকার গঠনের কথা জিজ্ঞাসা করলে তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘােষণা করেছেন। সেই প্রেক্ষিতে তাকে প্রেসিডেন্ট করে ইতােমধ্যে সরকার গঠন করা হয়েছে। সেই আলােচনায় কয়েকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত: ক) সীমান্তের কাছাকাছি রণাঙ্গন নির্ধারণ। খ) ভারতে বসেই কূটনৈতিক তৎপরতা ও সরকারের কার্যপরিচালনার সুবিধাদি প্রদান। গ) অস্ত্র সাহায্য। ঘ) একটি শক্তিশালী বেতারযন্ত্র । ৮, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন বলেই তার ভিত্তিতে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম স্বাধীনতার খসড়া সনদ রচনা করেন যা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কর্তৃক অনুমােদিত হয়। মূলত ‘প্রােক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ হচ্ছে বাংলাদেশের প্রথম সাংবিধানিক দলিল। অন্যকথায় জেনেসিস অব দ্য কনস্টিটিউশন’। যা সংবিধানের ১৫০ অনুচ্ছেদে চতুর্থ তফসিলে বর্ণিত ও সাংবিধানিকভাবে অনুমােদিত। স্বাধীনতার সনদ আইনানুগভাবে অনুমােদন করেন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণ।
এই সনদের ভিত্তিতেই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আইনানুগ সরকার শপথ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। এই সরকারের অধীনেই জেনারেল ওসমানী সেনাপ্রধান ও এ কে খন্দকার উপসেনাপ্রধান। হিসেবে নিয়ােগ পান ও দায়িত্ব পালন করেন। ৯, ১৯৭২ সালে ১০ এপ্রিল গণপরিষদে উদ্বোধনী ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘২৫ মার্চ আমাদের আক্রমণ করল। তখন আমরা বুঝতে পারলাম যে আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। আমি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌছে দেয়া হােক যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেজন্য প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিয়েছিলাম। এই প্রেক্ষিতে ঐ দিন পার্লামেন্টের প্রস্তাবে একাংশে বলা হয়, “১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘােষণা করেছিলেন এবং যে ঘােষণা মুজিবনগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বীকৃত ও সমর্থিত হয়েছিল এই সঙ্গে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে। বাংলাদেশের সংবিধানেও মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রস্তাবনায় বিদ্যমান।
১০. তৃতীয় প্রশ্ন হলাে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে যে ঐতিহাসিক দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ দেন, যে ভাষণ পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে আখ্যায়িত । যে ভাষণে বিধৃত আছে মুক্তিযুদ্ধের ও রাজনৈতিক কৌশলগত দিক। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা ও মুক্তির নির্দেশনা । বিশাল ওই জনসভায় তৎসময়ে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। ভাষণের শেষে বঙ্গবন্ধু জয় পাকিস্তান’ উচ্চারণ করেছিলেন এ কথা এ কে খন্দকার সাহেব তার বইতে উল্লেখ করলেও আমার মতাে স্পর্শকাতর মানুষের কর্ণকুহরে সেদিন তা প্রবেশ করেনি।
এ সম্পর্কে এককালীন তথ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা পার্লামেন্টে বঙ্গবন্ধুর ভাষণে জয় পাকিস্তান নিয়ে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন কিন্তু তিনি আকাশ-পাতাল ঘেঁটেও সে চ্যালেঞ্জ প্রমাণ করতে পারেননি। সম্মানীয় আব্দুল করিম খন্দকার জিয়াউর রহমানের আমলে (১৯৭৬১৯৮২) পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত, এরশাদের শাসনকাল (১৯৮২-১৯৮৬) সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত, ১৯৯৮ ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ মনােনীত জাতীয় সংসদে সদস্য নির্বাচিত হয়, ১৯৮৬-১৯৯০ এবং ২০০৯-২০১৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ। সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী ছিলেন। তার মতাে অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞতা, দক্ষতা এবং বিদগ্ধবরেণ্য ব্যক্তি যদি তার বক্তব্যের সপক্ষে দলিল, প্রমাণপত্র উপস্থিত করতে পারেন তাহলে দেশ ও জাতি উপকৃত হবে। না হলে তিনি সংবিধান লঙ্ন ও ইতিহাসের চ্যালেঞ্জে একজন বিতর্কিত ব্যক্তি হিসেবেই চিহ্নিত হবেন। ১১. ‘১৯৭১ ভেতরে বাইরে’ বইটিতে এ. কে খন্দকার মুক্তিযুদ্ধের ভেতরটা যেমন গভীরভাবে দেখেননি তেমনি বাইরের ঘটনাবলি সম্পর্কে যথাযথভাবে আলােকপাত না করে বিতর্কিত ও ছন্নছাড়া স্মৃতিচারণমূলক বর্ননা দিয়েছেন, যা তার মতাে মানুষের কাছ থেকে আশা করা যায় না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ক্যানভাস বিশাল ও ব্যাপক যা সমগ্র বিশ্বকে আলােড়িত, আন্দোলিত করেছে। মার্কিন গােপন নথিদৃষ্টে দেখা যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দুই পরাশক্তির মধ্যে বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি এনে দিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি সেজন্য গােপনে যুদ্ধ বিমানসহ সামরিক অস্ত্র পাঠিয়েছে। চীনকে কিসিঞ্জার বলেছে, বাংলাদেশ সীমান্তে সৈন্য পাঠাও।
নিক্সন তাকে বারবার এ ব্যাপারে তাগাদা দিয়েছে। অন্যদিকে সােভিয়েত রাশিয়া চীনের সিয়াকিং সীমান্তে দশ লাখ সৈন্য মােতায়েন করে, যে কারণে চীন বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার সাহস পায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৭ম নৌবহর পাঠালে তার বিপরীতে সােভিয়েত ৬ষ্ঠ নৌবহর পাঠিয়ে তার মােকাবেলা করে । শ্রদ্ধাভাজন এ কে খন্দকার তখন মুক্তিযুদ্ধের উপসেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্বরত, এসব কথা তার অজানা ছিল তা কেউ বিশ্বাস করবে না। এ কথাও তার অজ্ঞাত ছিল না যে, মুজিবনগর সরকার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী কূটনৈতিক ও সামরিকভাবে বিভিন্ন চক্রান্ত মােকাবেলার কৌশল অবলম্বন করেছিলেন। বইটিতে বাইরের এই জীবন-মরণ ঘটনাবলি কেন উপেক্ষিত হয়েছে তা আমার বােধগম্য নয়। তবে বইটি পড়ে যে কারাে ধারণা হতে পারে এসব এড়িয়ে যাওয়া উদ্দেশ্যপ্রণােদিত। ১২. আমার একথাও বােধগম্য হয়নি যে, নিক্সন সরকার খন্দকার মােশতাককে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ভাঙন সৃষ্টি করার জন্য কীভাবে ষড়যন্ত্র করেছিলেন তার বইয়ের “ভেতরে” তা স্থান পায়নি। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্ত। বইতে রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে যে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে এটি। তাকে দোষারােপ করে লাভ নেই। ১৮ বছর একটানা পাকিস্তানে থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিশাল জটিল-কঠিন প্রেক্ষাপটের সঙ্গে তার যােগসূত্র ছিল হয়তাে সীমিত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিংহসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক নেতাকর্মী দীর্ঘ ২৩ বছর। জেলজুলুম, সংগ্রাম, লড়াই, আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানের মাধ্যমে স্বাধীনতার স্বর্ণদুয়ারে জাতিকে প্রস্তুত করেছিলেন সে প্রেক্ষিতে তাদের প্রতি প্রাপ্য মর্যাদা সম্মান প্রদর্শন তাে দূরে থাক তাদের অবমূল্যায়ন করার মিশন নিয়ে যেন তিনি বইটি লিখেছেন। এক্ষেত্রে প্রতীয়মান হবে তার দৃষ্টি ছিল ঘােলাটে। খণ্ডিত।
সংকীর্ণ বেড়াজালে আবদ্ধ। ১৩, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বন্দি শেখ মুজিবের মুক্তিই কেবল বাংলাদেশ সংকটের সমাধান সম্ভব এই মূলনীতিকে সামনে রেখে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, সােভিয়েত রাশিয়াসহ ১৮টি রাষ্ট্র সফর করেন। পাশাপাশি মুজিবনগর সরকার জনপ্রতিনিধিদের কয়েকটি দলকে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতার স্বীকৃতি, জনমত গঠন, অন্ত্র ও অর্থ সংগ্রহের জন্য প্রেরণ করেন। একই সাথে বিচারপতি আবু সাঈদের নেতৃত্বে ব্রিটেন, ইউরােপের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও পাকিস্তান বর্বর বাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নৃশংসতা তুলে ধরেন। তাঁর নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বীকৃতির জন্য জনপ্রতিনিধি ও বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করেন। প্রফেসর রেহমান সােবহান,
ড. এ আর মল্লিক প্রমুখ বুদ্ধিজীবী এবং প্রবাসী ছাত্র ও নাগরিকবৃন্দ যে অবদান রেখেছিলেন হয়তাে তিনি মনে করেছেন বইটিতে বিষয়গুলাে প্রাসঙ্গিক নয়। এমনকি স্বীকৃতি ব্যতিরেকে বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাস স্থাপন করতে দিয়েছিলেন ব্রিটেন এ কথা তার দৃষ্টি এড়িয়ে গিয়েছে। তাহলে মুক্তিযুদ্ধে “বাইরে কোনাে বিষয়গুলাে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরকারের প্রচেষ্টায় পাকিস্তানের কর্মরত কূটনৈতিকবৃন্দ যে অসহনীয় অনিশ্চয়তার মধ্যে মুজিবনগর সরকারে প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছিলেন সে বিষয়টি তিনি এড়িয়ে গেছেন। মুজিবনগর সরকারের এসব কর্মকাণ্ড প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পাশের কক্ষে অবস্থানকারী এ কে খন্দকার জানতেন কিনা সন্দেহ, তবে তার বইতে এর কোনাে কিছুরই উল্লেখ নেই। অবশ্য তাজউদ্দীন সাহেব জানতেন যে সামরিক যুদ্ধে বিজয়ী হওয়ার মৌলিক শর্ত হলাে কূটনৈতিক যুদ্ধে বিজয়ী হওয়া। ১৪, বইতে তিনি রাজনীতিবিদদের কর্মকাণ্ডের যথার্থ মূল্যায়ন করেননি। এর বিপরীতে তিনি অবমূল্যায়নের দিকে অগ্রসর হয়ে মুক্তিযুদ্ধকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছেন। তার মতাে বিদগ্ধ ও জ্ঞানী মানুষের পক্ষে এই ভ্রান্তি সহজে মুছে ফেলার নয়। তার অজানা থাকার কথা নয় যে, প্রতিবেশী দেশের বিন্নি সীমান্তে প্রায় কমপক্ষে ১২০টি যুব ক্যাম্প গড়ে উঠেছিল। অনেক ক্যাম্পেই যুদ্ধ করতে আসা টগবগে যুবকদের ট্রেনিং দেয়া হতাে। কখনাে বাংলাদেশ সেনা/ইপিআর বাহিনী অথবা ভারতীয় প্রশিক্ষক ক্যাম্পে ক্যাম্পে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দিতেন। বেশ কয়েকজন গণপরিষদ সদস্য গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিয়েছেন এবং রণাঙ্গনে অংশ নিয়েছেন। কিছু ব্যতিক্রম ব্যতীত জনপ্রতিনিধিরা মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তিমূলে সংগঠকের দুরূহ কাজ সম্পাদন করেছেন। ইতিহাস নাড়াচাড়া করলেই তিনি অনায়াসেই এই তথ্যগুলাে পেতে পারেন। যা তার বইতে উল্লিখিত তাে হয়নি, বরং বিভ্রান্তিকর নেতিবাচক বক্তব্য ছড়ানাে হয়েছে। একই সাথে হাজার হাজার যুবক যারা ট্রেনিং নিয়ে অথবা দেশের ভিতরে ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে জীবনকে বাজি রেখে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের দক্ষতা, দেশপ্রেম ও আত্মত্যাগের অত্যুজ্জল দৃষ্টান্ত তার বিবরণ যথার্থভাবে তুলে ধরা হয়নি। বরং তাদের মধ্যে বিভেদ ও কোন্দলের চিত্র অঙ্কন করা হয়েছে। স্বীকার করি যে, মে মাসের মধ্যে যেসব গেরিলাযােদ্ধা দেশের অভ্যন্তরে তৎপরতা চালিয়েছেন ও তাদের মধ্যে কমান্ডের যে হাল্কা দ্বন্দ্ব ছিল জুনজুলাই মাসের মধ্যেই তা ঐক্যবদ্ধভাবে পারস্পরিক সমন্বিত রূপ নেয়।
আগস্ট সেপ্টেম্বরে গেরিলা গ্রুপগুলাে সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন অঞ্চলমুক্ত করে। তিনি বৈমানিকের প্রথাগত চোখ দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের অসামান্য অবদানকে যথার্থ স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু মার্কিন গােপন নথিতে দেখা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সফরকালে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রশ্নের উত্তরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, বাংলাদেশ সরকার প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ পাচ্ছে, তারা নিজস্ব চ্যানেলে অস্ত্র জোগাড় করছে এবং বাংলাদেশের হাজার হাজার তরুণ গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন অঞ্চলে ও ক্যাম্পে অবরুদ্ধ করে ফেলছে।’ এসব সাফল্য উক্ত বইতে সচেতনভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে নাকি উদ্দেশ্য মূলকভাবে জনযুদ্ধকে একটি বাহিনীর যুদ্ধ হিসেবে তুলে ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূল শক্তির মধ্যে বিভাজন করার সচেতন অপপ্রয়াস নেয়া হয়েছে এ প্রশ্নটি অনেকে তুলে ধরেছেন। ১৫. বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। সেই ঘােষণার প্রেক্ষিতে ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম খসড়া স্বাধীনতার সনদ রচনা করেন যা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ কর্তৃক অনুমােদিত হয় এবং নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্যরা স্বাধীনতার সনদটি অনুমােদন করেন। তার ভিত্তিতে সরকার গঠিত হয়। সেই সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিকটি ছিল, জুলাই মাসে প্রথম সপ্তাহে ভারতের বাগডােগড়ায় অনুষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রথম গণপরিষদের অধিবেশন এবং সিদ্ধান্ত যেকোনাে মূল্যে স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে কোনাে বিভেদ নয় ভ্রান্তি নয় দ্বিধা নয়।
জীবন-মরণ যুদ্ধে স্বাধীন করতে হবে বাংলাদেশ। সেদিনের এই ছিল শপথ। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও গণপরিষদের সদস্যবৃন্দের কাছে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের উদাত্ত আহবান ছিল, “জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে শত্রুদের আমরা অবরুদ্ধ করে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে দেশে ফিরিয়ে আনবাে।’ প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল রাজনৈতিক যুদ্ধ এবং এর মূলভিত্তি ছিল আদর্শভিত্তিক জনযুদ্ধ। সেই মুক্তিযুদ্ধের কোনাে বিষয় নিয়ে অযথা বিতর্ক বা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত খণ্ডিত কথন স্বাধীন বাংলাদেশে গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। বিতর্ক অনেক সময় সত্যকে আবিষ্কার করে আবার কখনাে কখনাে তা ইতিহাস বিকৃতির সূত্র হয়ে দাঁড়ায় এবং যা অন্ধকারে ভ্রান্তি ছড়ায়। ১৬. বহুদিন থেকেই এ প্রশ্নটি ঘুরে ফিরে আসছে যে, বাংলাদেশ ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড গঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশ কমান্ড সমান মর্যাদাসম্পন্ন । রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে যৌথ বাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল অরােরা ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পক্ষে নিয়াজী স্বাক্ষর করেন। এ কে খন্দকার লিখেছেন, অনুষ্ঠানে মাত্র দুটি চেয়ার ও একটি টেবিল ছিল। একটি চেয়ারে জেনারেল নিয়াজী ও অন্যটিতে জেনারেল অরােরা বসলেন। বাংলাদেশ কমান্ডের আসনটি ছিল না কেন এ ব্যাপারে সেই সময় এ কে খন্দকার কি কোনাে প্রশ্ন তুলেছিলেন? লে. জেনারেল জেকবের বইয়ের ১২৪-১২৫ পৃষ্ঠায় মুদ্রিত ছবিতে দেখা যায় অন্য এক ব্যক্তি যথারীতি চেয়ারে বসে আছেন। কেন তিনি। অরােরার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন?
১৭. তেসরা ডিসেম্বর পাকিস্তান আক্রমণ শুরু করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ‘বােকাটা (ইয়াহিয়া খান) ঠিক কাজই করেছে যা আমি চাচ্ছিলাম’। পাকিস্তান আক্রমণের পরপরই ৪ ডিসেম্বর ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যৌথ কমান্ডের স্বাক্ষর আনুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়। যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এবং বাংলাদেশের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ। এই স্বাক্ষরের বিষয়টি ভারতীয় কর্নেল পি, দাস যিনি ফোর্ট উইলিয়াম থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সামরিক বিষয়ের লিয়াজো রাখতেন তিনি এ তথ্যটি তাজউদ্দীন আহমদের একান্ত সচিব ফারুক আজীজ খানকে জানিয়ে দিলেন। যা তার বই প্রিং-‘৭১-এ উল্লেখ রয়েছে। ১৮. যৌথ কমান্ডের অপারেশনের সম্পর্কিত দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল বি এন সরকার এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে লিয়াজো রাখার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন উপসেনাপ্রধান এ কে খন্দকার। অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে অনানুষ্ঠানিকভাবে যৌথ সামরিক নেতৃত্বের প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছিল। প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী যৌথ সামরিক নেতৃত্ব গঠনের ব্যপারে তীব্র আপত্তি তােলেন। জেনারেল ওসমানী বলেছিলেন, যদি এটা চাপিয়ে দেয়া হয় তিনি পদত্যাগ করবেন। তাজউদ্দীন আহমদের অনমনীয় সিদ্ধান্ত ছিল যৌথ সামরিক নেতৃত্বের মাধ্যমে রণক্ষেত্রের সমন্বয় সাধন হবে বাস্তবসম্মত।
জেনারেল ওসমানী পদত্যাগের হুমকি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ শক্তভাবে বলেন, লিখিত পদত্যাগপত্র দিলে তিনি তা গ্রহণ করবেন। প্রথাগতভাবে যে ওয়ার প্ল্যান বাংলাদেশ তৈরি করেছিল এবং সম্মুখ সমরের জন্য যে তিনটি ব্রিগেড (জেড, এস ও কে ব্রিগেড) গঠন করেছিলেন প্রধান সেনাপতি অক্টোবর মাসে নিজেই এসব ব্রিগেডের অসারত্ব উপলব্ধি করে তা ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে করে বিভিন্ন ফ্রন্টে ছড়িয়ে দেন। যৌথ কমান্ড গঠন করার ফলেই যুদ্ধ ত্বরান্বিত হয়। ডিসেম্বর ৭ তারিখ বেলা প্রায় তিনটার সময় ভারতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা পিএনব্যানার্জী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং একটি পত্র হস্তান্তর করেন। আনুষ্ঠানিকভাবে পত্রটি প্রেরণ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জানিয়ে। এই স্বীকৃতিদানের পূর্বে তিনি লােকসভায় বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গণতন্ত্র সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে। যার সঙ্গে ভারতের আদর্শের মিল রয়েছে। হাজার হাজার মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশকে মুক্ত ও স্বাধীন করার জন্য চরম আত্মত্যাগ করেছে। বাংলাদেশের জনগণের ঐক্য, অঙ্গীকার, সাহস এবং তাদের সংগ্রাম বিশ্ব গণমাধ্যমে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম।” ১৯, ১৪ ডিসেম্বর কর্নেল দাস বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিবকে জানান যে, মেজর জেনারেল জ্যাকব ঢাকার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণের দলিল হাতে। একান্ত সচিব ফারুক আজিজ অতি দ্রুত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে বিষয়টি অবগত করেন। তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষ থেকে জেনারেল অরােরাকে টেলিফোন করে ফারুক আজিজ বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই জেনারেল অরােরা ফোন ধরেন।
কর্নেল দাস যা বলেছিলেন তিনি তার উল্লেখ করে আরাে বলেন যে ২ ঘণ্টার মধ্যেই তিনি চূড়ান্তভাবে তাকে জানাবেন। প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি জানার পরও তার উদ্বিগ্নতা দূর হয়নি বলে একান্ত সচিবের মনে হয়েছে। সাড়ে ১২ টার সময় ঝলমলে রৌদের ভেতরে তিনি যখন পায়চারি করছিলেন তখন কর্নেল দাস এসে বললেন আজ বিকেলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করবেন। প্রধানমন্ত্রী কক্ষে ঢুকে সংবাদটি জানালে তিনি আত্মসংযম করেন। কিছুক্ষণ পর তিনি জিজ্ঞেস করেন, ওসমানী সাহেব কোথায়? তাকে জানানাে হলাে তিনি ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী চিফ অব স্টাফ লে. কর্নেল। আব্দুর রব ও লে, শেখ কামালকে নিয়ে কোলকাতার বাইরে সিলেট অঞ্চলে গিয়েছেন। ২০. ফারুক আজিজ ও নুরুল ইসলাম নিউমার্কেট ও অন্যত্র উপ-সেনাপ্রধানকে খোঁজ করলেন। সময় ফুরিয়ে যাচ্ছিল। সহসা খন্দকার সাহেব প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে জীপ নিয়ে ঢুকলেন। তাকে বলা হলাে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তিনি জেনারেল অরােরার সঙ্গে ঢাকা যাবেন। তিনি অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং মেজর ইসলাম ও ফারুক আজিজ খানের সঙ্গে দ্রুত লাঞ্চ শেষ করেন। কিন্তু উপসেনাপ্রধান ড্রেস পরার সময় পাননি অথচ বিষয়টি ছিল ঐতিহাসিক এবং মুক্তিযুদ্ধের সম্মানের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং ফারুক আজিজ ও নুরুল ইসলাম দুজনে তাকে দমদম এয়ারপােটে নামিয়ে দেয়। দমদম এয়ারপাের্টে জেনারেল অরােরা সহর্ষে তার সঙ্গে শেখহ্যান্ড করেন এবং তারা একই হেলিকাপ্টারে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। হেলিকাপ্টারের কাছে এ কে খন্দকার দাড়িয়ে ছিলেন আগে জেনারেল অরােরার ওঠার অপেক্ষায়। কিন্তু অরােরা বলেন, ‘বাংলাদেশ কমান্ড প্রথমে উঠবেন। তারপর তিনি উঠবেন’। তখনও ঢাকায় চলছিল আত্মসমর্পণের দলিল নিয়ে দরকষাকষি।। ২১. রাও ফরমান আলী চেয়ারে বসার পর তার হাতে একটি কাগজ দিয়ে ব্রিগেডিয়ার বকর বললেন, “এগুলাে আত্মসমর্পণের শর্ত।” ফরমান আলী সেটা পড়লেন এবং দেখলেন, যে বাহিনীর কাছে পাকিস্তান আর্মিকে আত্মসমর্পণ করতে হবে, সেখানে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
ব্রিগেডিয়ার বকরকে বললেন, “এটা আমার কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। আমরা আত্মসমর্পণ করছি না, আমরা আলােচনা করছি। ঘটনা যাই হােক না কেন, দয়া করে মুক্তিবাহিনী শব্দ দুটি মুছে ফেলুন। এ সময় পাইপ মুখে নিয়ে জেনারেল জ্যাকব প্রবেশ করলেন এবং বললেন, ‘আপনি এটা মেনে নিন অথবা ছেড়ে দিন।” তিনি বললেন, “এটা কমান্ডারের ব্যাপার, তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। নিয়াজী আত্মসমর্পণের শর্তাবলী অনুমােদন করে মাথা নাড়লেন। এডমিরাল শরীফ ও রাও ফরমান উঠে দাঁড়ালেন এবং বাইরে চলে এলেন। লক্ষ করলেন, ভারতীয়রা কিছু চেয়ার ও একটি টেবিলের খোঁজ করছে। তারা বুঝালেন, ভারতীয়রা কোনাে অনুষ্ঠান আয়ােজন করতে চাচ্ছে। দু’জনই নিয়াজীর কাছে গেলেন এবং তাঁকে বললেন, ভারতীয়রা একটি আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছে। দুজনেই নিয়াজীকে বললেন, “আপনার এতে যােগ দেয়া উচিত হবে না, আত্মসমর্পণ করা হয়ে গেছে। তারা আমাদের বন্দি হিসেবে নিতে পারে, আমাদের পেটাতে বা হত্যা করতে পারে। তাদের যা ইচ্ছা করুক। দয়া করে কোনাে অনুষ্ঠানে যােগ দেবেন না।” কিন্তু নিয়াজী তাদের কথা রাখতে পারেননি।
২২. বহুদিন থেকেই জেনে আসছি, বাংলাদেশ ভারত যৌথ সামরিক কমান্ড গঠিত হয়েছিল সমমর্যাদার ভিত্তিতে। রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আত্মসমর্পণের দলিলে যৌথবাহিনীর প্রধান হিসেবে জেনারেল অরােরা ও পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পক্ষে নিয়াজী স্বাক্ষর করেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে মিত্রবাহিনীর কো-কমান্ডার হিসেবে সসম্মানে চেয়ারে বসে অনুস্বাক্ষর দিতে পারতেন। ২৬৭ পৃষ্ঠার ১৬ নং ও এটার মধ্যে অনেক মিল আছে, যা সমীচীন নয় ছবিটি পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
২৩. বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধি হিসেবে কেন তিনি অরােরার পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। তার বক্তব্য মতে তিনি যেভাবে ঠেলাঠেলি করে দাঁড়িয়েছিলেন তা কি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের একজন উপ-সেনাপ্রধানের উপযােগী হতে পারে? তিনি উক্ত অনুষ্ঠানে মর্যাদাশীল আসন ও অবস্থান নিতে ব্যর্থ হলেন কেন? কেউ কি তাকে বাধা দিয়েছিল? না তিনি তার অবস্থান ও দায়িত্ব উপলব্ধি করতে অপারগ ছিলেন? আত্মসমর্পণের দলিলের ছবি দেখে যে কারাে মনে হতে পারে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ কমান্ড নয়, ভারতের কাছে পাকিস্তান কমান্ড সারেন্ডার করছে। কেননা মনে হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে যে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা জীবন দিয়েছে তার কোনাে প্রতিনিধি এই সারেন্ডারের দিনে উপস্থিত নেই। সে কারণেই এ বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি যশরাজ ফিল্মসের শুভে’ ছবিটি ভারতের বলিউডে মুক্তি পেয়েছে যেখানে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে উপস্থাপন করা হয়েছে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ হিসেবে। ‘গুন্ডে’ ছবিতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করা হয়েছে মর্মে ভারতের জনমতের চাপে পরিচালক ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সবিনয়ে একটি প্রশ্ন করতে চাই, এ কে খন্দকারের বইটিতে আত্মসমর্পণের বর্ণনায় স্বাধীন, সার্বভৌম রক্তাক্ত বাংলাদেশ হারিয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের হাজারাে মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও আত্মবলিদানের গর্বিত অহংকার ও মর্যাদা লুষ্ঠিত করার দায়ভার তিনি কি এড়াতে পারবেন? ১৯৪৭ সাল থেকে পূর্বাপর যে সকল রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং তাঁর নেতৃবৃন্দ যে চরম আত্মত্যাগ, নিপীড়ন, অত্যাচারের মুখােমুখি হয়েছেন, এমনকি ফাঁসিতে যেতেও দ্বিধা করেননি তাদের সেই অনন্যসাধারণ ভূমিকা তুলে না ধরে হঠাৎ করে ভােজবাজির মতাে মাঝখান থেকে লিখতে গিয়ে ইতিহাসের সত্য পাঠ থেকে যেমন নিজেকে আড়াল করেছেন, তেমনি লিখিত বইটি স্বাধীনতাবিরােধীদের হাতকে শক্তিশালী। করবে সন্দেহ নেই।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ