You dont have javascript enabled! Please enable it!

ত্রিভুজ ষড়যন্ত্র- মার্কিন-মােশতাক-মওদুদ

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে জাতীয়ভাবে যে যড়যন্ত্র চক্রান্ত হয়েছিল তাকে বলা যেতে পারে ত্রিভূজ ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্র জাতীয় হলেও আন্তর্জাতিক যােগসূত্র ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি। তারা অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিকভাবে স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছে। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল খন্দকার মােশতাক, ব্যারিস্টার মওদুদ ও মাহবুব আলম চাষী এবং তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখ। মােশতাকের নির্দেশে জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোলকাতার প্রতিনিধিদের সঙ্গে যােগযােগ করে নানাভাবে সমঝােতার প্রস্তাব দেন। এর পাশাপাশি নথিপত্র ঘেটে দেখা যায়, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকে বহির্বিশ্ব প্রচার অনুষদের সদস্যপদ থেকে অব্যাহতি দেন। কারণ হিসেবে দেখা যায় ব্যারিস্টার মওদুদ ব্যক্তিগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কমন্সসভার সদস্যদের সঙ্গে যোগাযােগ করতেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে আড়ালে রেখেই এ কার্যক্রম চলতাে। যুদ্ধরত একটি দেশে আন্তর্জাতিক প্রচারের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতে হবে এটা কোনাে ক্রমেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আরাে পর্যবেক্ষণ করেন যে, মাহবুব আলম চাষী ও জনাব মওদুদ আহমদ একত্রে কাজ করতেন এবং মােশতাকের সঙ্গে তাদের যােগযােগ ছিল ষড়যন্ত্রমূলক। বিষয়টি আমাকে বিস্মিত করেছে। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এ ধরণের কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে তা ধারণা করা কঠিন। তবে এই বইয়ের পরিশিষ্টে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী বরাবর যে পত্র লিখেছেন সেটা পড়ে যে কারাে মনে হতে পারে পত্রটি যেন তার ঐ সব কর্মের সাফাই। ষড়যন্ত্রের আর একটি দিক হলাে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র আকস্মিকভাবে ধর্মঘট দু’দিন বন্ধ থাকার ঘটনা, যা এই অধ্যায়ে তুলে ধরা হয়েছে।

এককালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনায়েতুর রহিম যিনি যুক্তরাষ্ট্রের স্টাডিলীভ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করেছিলেন, তিনি জুলাই ‘৭১-এর শেষের দিকে আকস্মিকভাবে বালুরঘাট কুমাইল ক্যাম্পে আগমন করেন। তিনি প্রায় দশবারােটি দিন ক্যাম্পে অবস্থান করেন। ক্যাম্প ইনচার্জের দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এমএনএ । জনাব অধ্যাপক এনায়েতুর রহমান কলকাতা থেকে শুনে এসেছিলেন স্বাধীনতা চাও না বঙ্গবন্ধু চাও’ এই ধরনের একটি লিফলেট মুক্তিযুদ্ধদের ভেতরে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে বিভক্তি দেখা দিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় থাকায় তিনি উক্ত ষড়যন্ত্রের বিষয়টি খােলাখুলি আলােচনা করেন। বলেন এ সম্পর্কে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে কোনাে বিভ্রান্তি বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে কিনা? তার কথার প্রেক্ষিতে আমি এবং আমার সঙ্গে শাহাজাদপুর থেকে নির্বাচিত এমপিএ আব্দুর রহমান তীব্র ক্ষোভের সাথে বলি, ‘ঐসব ষড়যন্ত্র-ফড়যন্ত্র বুঝি না এবং এ নিয়ে যারা রণাঙ্গনে আছেন তাদের মধ্যে কোনাে প্রতিক্রিয়া নেই। কলকাতায় কী চক্রান্ত হচ্ছে তার ধার আমরা ধারি না। আমরা যুদ্ধ করছি দেশ স্বাধীনের জন্য, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে। এসব কথার ধার ধারি না। এখানে প্রায় তিন হাজার গেরিলা আছে তারা ট্রেনিং নিচ্ছে, যুদ্ধ করছে। জীবন দিচ্ছে। আমি ক্যাম্পের পুকুর পাড়ের কয়েকটি কবর দেখালাম এবং মােনাজাত করলাম । মােনাজাত শেষে তাকে আরাে বললাম, মুজিবনগরের মােশতাক চক্রের ষড়যন্ত্র বা আমলারা ওখানে বসে বস্তায় বস্তায় যে কাগজ নষ্ট করে যে ধরনের নির্দেশনামা জারি করেছে তার তােয়াক্কা আমরা করি। মুজিবনগর সরকারের অধীনে ও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা যুদ্ধ করছি এবং দেশে স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আমাদেরকে কেউ নিরস্ত্র করতে পারবে না। তিনি অন্য সাধারণ মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গেও কথা বলেন। তার লিখিত বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার এন্ড দি নিক্সন হােয়াই হাউস ১৯৭১’ বইতে এ সম্পর্কে লিখেছেন।

বাংলাদেশ সরকারের জন্য যে-দ্বটি সবচেয়ে বেশি দুর্ভাবনা সৃষ্টি করে সেটি হচ্ছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের পক্ষ হয়ে তার সমর্থকগণ মার্কিনীদের সাথে আলাদাভাবে যােগাযােগ স্থাপনের প্রক্রিয়া। মুজিবনগর সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে এই ঘটনা জানাজানি হবার পর খন্দকার মােশতাককে তার কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয়। এ বক্তব্য কেবিনেট সচিব হােসেন তৌফিক ইমাম ও খন্দকার আসাদুজ্জামানের। এ প্রসঙ্গে হােসেন তৌফিক ইমাম বলেন, “বাংলাদেশ থেকে যে প্রতিনিধিদল বিদেশে যাবার কথা ছিল, তার নেতৃত্ব দেয়ার কথা স্বাভাবিকভাবেই তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদের। এরা রওনা হবার কিছুদিন আগেই আমরা বিভিন্ন গােপন সূত্রে খবর পেলাম খন্দকার মােশতাক এবং প্রতিনিধি আমাদের এখান থেকে যাচ্ছেন তারা পাকিস্তান থেকে যে দল যাবে তার নেতৃত্ব দেবেন শাহ আজিজুর রহমান। তাদের সঙ্গে ওখানে গিয়ে মিলিত হবেন এবং একটি আপােস ফর্মুলা করে একটা মিত্রসংঘ জাতীয় কিছু করবেন। এটি কিন্তু তখনই একবারে মূলােচ্ছেদ করা হয়। খন্দকার মােশতাককে আর যেতে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ থেকে কোনাে প্রতিনিধিদল গেলেও এবং মীমাংসার আর কোনাে প্রশ্ন ওঠেনি। কারণ আমরা জানতাম যে এখানে যুদ্ধ ছাড়া এবং সম্পূর্ণ স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না।’

খন্দকার মােশতাকের অনুপস্থিতিতে ভিন্নভাবে এ বিষয়টি কখনাে মন্ত্রিপরিষদে আলাপ হয়নি। আমরা জানি, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে শুনেছি । অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে শুনেছি এরকম ষড়যন্ত্র হতে যাচ্ছিল, এবং এটিকে এভাবে ঠেকানাে হলাে। কিন্তু এ সম্পর্কে প্রকাশ্যে আলােচনা কখনাে হয়নি।’ মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের দলিল থেকে জানা যায় যে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য কাজী জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন দূতাবাসের সাথে যােগাযােগ করেন এবং প্রস্তাব করেন যে, যেহেত পাক-ভারত যুদ্ধের পরিণতিতে বহু মানুষ মারা যাবে, ক্ষয়ক্ষতি হবে, তিনি খন্দকার মােশতাকের পক্ষ হয়ে পাকিস্তানের সাথে আলােচনার জন্যে একটি সমঝােতা প্রস্তাব পেশ করতে চান। এ প্রস্তাবের মধ্যে অবশ্য একটি দিক ছিল যে, যে সমাধান হােক না কেন শেখ মুজিবকে অবশ্যই এর সঙ্গে জড়িত রাখতে হবে। এ ধরনের একটি আলােচনার প্রস্তাব মার্কিনীদের হাত হয়ে ইয়াহিয়া পর্যন্ত পৌঁছেছিল এবং তিনি আলােচনা করতে রাজি হয়েছিলেন। পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দিল্লীতে যখন এই বিষয়ে আলােচনা হয়। তখন তিনি বলেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশের ব্যাপারে কোনাে আপােস করা হবে। এক পর্যায়ে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে দূতাবাসের এক কর্মকর্তার আলাপ হয় এবং সেখানে খন্দকার মােশতাক বলেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উচিত পাকিস্তানের উপর তাদের প্রভাব খাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করা।’ আমীর-উল ইসলাম তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে খন্দকার মােশতাক তাকে বলেছিলেন, “হয় স্বাধীনতা, হয় শেখ মুজিব, দুটোর একটা বেছে নিতে হবে।

তিনি এটা শুনে খুব মর্মাহত হন। এ সম্পর্কে একটি লিফলেট বিলি করা হয়েছিল। সেদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়ানাের জন্য এটা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেছিলেন তারা সবাই ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। এই লিফলেটের মাধ্যমে এটাও প্রমাণিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী একটি চক্র সরকার ও দলের অভ্যন্তরে সক্রিয় ছিল। “মােশতাক সাহেব তার পরিবার নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। দেখা করা করার জন্য সেখানে গিয়ে আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলাে। সেখানে আরাে কিছু লােক তার সাথে গল্প গুজবে ব্যস্ত ছিলেন। সবাই চলে যাবার পর আমার ডাক পড়ল। মােশতাক ম্যাকব্রাইডের লেখা মতামত না পড়েই একটা মন্তব্য করেন। তার এই বক্তব্য আমি কোনােদিন ভুলতে পারব না। তিনি বলেন, “You must decide, whether you want Sheikh Mujib or Independence. You can’t have both,” আমি এ কথা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। সাথে সাথে উত্তর দিলাম, “We want both, Sheikh without Independence or Independence without Sheikh, both are incomplete.” দলিল মতে মার্কিনীদের সাথে আলাপকালে কাইয়ুম বলেছিলেন মুক্তিবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ বামদের হাতে চলে যাচ্ছে এবং যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে বামরাই ক্ষমতায় আসতে পারে। এমন ভাবনা অনেকেরই ছিল এবং মুজিব বাহিনীর একটা অংশ বাম ভাবনা প্রভাবিত ছিল। তাছাড়া চীনাপন্থী বামরাও বিভিন্ন স্থানে সক্রিয় ছিল। যদিও তারা প্রতিপক্ষ অবস্থায় ছিল না, দীর্ঘ যুদ্ধ হলে কে ক্ষমতায় থাকবে এটা নিয়ে দুর্ভাবনা হতে পারে ডানপন্থীদের। মার্কিনীরা বামদের ব্যাপারে খুবই স্পর্শকাতর ছিল। বাম শক্তি সম্পর্কে মার্কিন সরকারি মহলে যথেষ্ট দুর্ভাবনার কারণ ছিল। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মােশতাকের সাথে আলাপের পর অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর সাথেও আলাপ করতে আগ্রহী হয়। তবে তাজউদ্দীন আহমদ মার্কিনীদের সাথে যােগাযােগ করতে রাজি হন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম যােগাযােগের ক্ষেত্রে কৌশল গ্রহণ করে বলেন, মার্কিন পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে আলােচনার জন্য তাকে ভারত সরকারের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করতে হবে। মার্কিন দলিলেও এ সম্পর্কে শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে কোনাে সমঝােতা বা আলাপ প্রস্তাবের উল্লেখ নেই।” ভারত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে পাকিস্তানের সরকারের সঙ্গে সমঝােতার প্রয়ােজন হবে না। রাজনৈতিক সমঝােতার বিষয়টি পাকিস্তানকে জানানাের জন্য রাষ্ট্রদূত যােসেফ ফারল্যান্ডকে ওয়াশিংটন বলেছিল, তিনি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে কথাটি উত্থাপন করেন। আশ্চর্যজনকভাবে সত্য যে, কথাটি উত্থাপিত হলে ইয়াহিয়া খানের প্রতিক্রিয়া ছিল ইতিবাচক এবং তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে তার সরকারের বৈঠকের ব্যবস্থা করার জন্য অনুরােধ করেন। এমনকি তিনি ফারল্যান্ডের অনুরােধ গ্রহণপূর্বক মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে গােপনে আলােচনায় সম্মত হন। কিন্তু মুজিবনগর সরকারের দৃঢ় স্টান্ড হিল যে কোনাে আলােচনা হােক না কেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শর্তহীনভাবে মুক্তি দিতে হবে। স্বাধীনতা মেনে নিতে হবে। ২৩ সেপ্টেম্বর জহুরুল কাইয়ুম একজন সংবাদ বাহককে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল এর কাছে প্রেরণ করে বলেন, ভারত সরকার এই যােগাযােগ সম্পর্কে জেনেছে এবং এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।

২০ অক্টোবর বাংলাদেশের কূটনীতিবিদ হােসেন আলী কলকাতার মার্কিন কনসালের কাছে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উপরে শেখ মুজিবের মুক্তি ও অবিলম্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিষয়টি উত্থাপন করেন। এরপর বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক যােগাযোেগ স্থগিত হয়ে যায়।” | ২৭ সেপ্টেম্বর জো সিসকো সরাসরি ভারতের মি, জ্যায়ের সঙ্গে প্রস্তাব করেন ভারত ও বাংলাদেশের প্রতিনিধির সঙ্গে শর্তহীনভাবে আলােচনা করা । যা নেতিবাচক সাড়া পায়। ২৮ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলকাতাস্থ কনসালের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং বলেন, এসব আলােচনা ফলপ্রসূ হবে না যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের আকাক্ষা অনুসারে প্রভাব বিস্তার না করে, মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে এবং যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গে জড়িত। ১৬ অক্টোবর জহুরুল কাইয়ুম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কনসাল জেনারেলের সঙ্গে বৈঠকে অস্বীকৃতি জানান এই বলে যে, ভারত এতে আপত্তি দিয়েছে। এভাবে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধান আলােচনা ভেস্তে যায়। মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিযুক্ত প্রতিনিধি দুজনের বক্তব্যের ব্যবধান থেকে এটা উপলব্ধি হয় যে, সরকারের অভ্যন্তরীণ বিরােধ বেশ প্রকট। প্রধানমন্ত্রী যেখানে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের সব সম্ভাবনাকে বাতিল করে শুধু যুদ্ধের মাধ্যমে সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, সেখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অন্তরায় ছিল।

মুজিবগনর সরকার সামরিক বিজয়ের উপর গুরুত্ব দেন। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বলেন, “Freedom fighteras would give a befitting reply on the battle field to Gen. Yaya Khan’s audacity”. বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সহযােগিতার বিষয়ে জনাব জহিরুল কাইয়ুম মার্কিন কনসালকে বলেন যে, “He and many others is the Awami League would walkout from the Bangladesh Government rather than ‘Sellout to India.’ Furthermore in his anti-Indian vituperation he added, ‘We do not want the Indian army in our country any more than we want the Pak army.”” ভারতে অবস্থান করে এবং ভারত সরকারের সার্বিক সহযােগিতা পাবার পরেও আওয়ামী লীগের একজন নির্বাচিত প্রতিনিধির এ ধরনের বক্তব্য অন্তর্দলীয় কোন্দলকে উস্কে দেয়া ছাড়াও শত্রুপক্ষকে অনেক ক্ষেত্রে উৎসাহিত করেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে কারও কোনাে সংশয় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু। এ সত্ত্বেও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা খন্দকার মােশতাক বা তাঁর প্রতিনিধি কেন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যােগাযােগ রাখতেন তা অনুমেয়। যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের সাথেও যােগাযােগ রক্ষা করতেন। জহিরুল কাইয়ুম কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের এক দূতাবাস কর্মকর্তাকে দেয়া বক্তব্যে এমন ধারণা পাওয়া যায়।” কাইয়ুম বলেন যে, পাকিস্তানের সাথে একটা আপােসরফা করার ব্যাপারে মােশতাকের প্রতিনিধি হিসেবে কাইউম যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ১৯৭১ সালের ১৯ আগস্ট মার্কিন দূতাবাস কর্মকর্তার সাথে অন্য এক বৈঠকে কাইয়ুম বলেন যে, “Mujib’s life is more valuable than independence.কিন্তু তখন বাংলাদেশের জনগণ শেখ মুজিবের মুক্তি ও স্বাধীনতা এই দুটো আদায়ের ব্যাপারেই বদ্ধপরিকর ছিলেন। জহিরুল কাইয়ুম এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিকে বলেন যে, “If Mujib is alive there is hope for compromise, if he is killed there is no hope.” বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদ ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ কলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশন অফিসে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের রাজনৈতিক কর্মকর্তা পলােয়ফের সাথে ৯০ মিনিটব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকের সময় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হােসেন আলীকে ঘরের বাইরে রাখা হয়। বৈঠককালে মােশতাক যুক্তরাষ্ট্রকে পাকিস্তানের প্রতি চাপ সৃষ্টি করতে বলেন। আলােচনার এক পর্যায়ে তিনি আরও বলেন যে, “I know Yahya, I know him to be a good man and I think he knows that I am a good man.” * uit খানের প্রতি মােশতাকের এ উচ্চ ধারণা স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ক্ষেত্রকে জটিল করে তােলে। 

১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর মােশতাকের প্রতিনিধি জহিরুল কাইয়ুম আকস্মিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল অফিসের এক কর্মকর্তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ সাক্ষাতে ভারত সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় কীভাবে কাজ করছে সে সম্পর্কে ধারণা দেয়া। হয়। তখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি ডি.পি, ধরের সাথে মােশতাকের আলাপআলােচনার প্রসঙ্গও স্থান পায়। যুক্তরাষ্ট্রের সাথে মােশতাকের যােগাযােগকে ডি.পি, ধর। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বাঘাতকতা বলে উল্লেখ করেন। কিন্তু মােশতাক সব অভিযােগ। অস্বীকার করেন বলে কাইয়ুমের সাক্ষ্যে পাওয়া যায়। জহিরুল কাইয়ুমের উদ্ধৃতি দিয়ে মার্কিন কনসাল অফিস উল্লেখ করে যে, “He (Zahirul Qaiyum) and his group in Awami League did not intend to be dictated to by GOI (Government of India) and in addition he had threatened to walkout on BDG (Bangladesh Government) along with some 43 supporters and go to pakistan rather than Sell out’ to India.” মুজিবনগর সরকারের মধ্যে একাধিক অন্তর্দ্বন্দ্ব ছিল এবং সেটার আন্তর্জাতিক মাত্রাও ছিল। খন্দকার মােশতাক পাকিস্তানের সাথে শর্ত সাপেক্ষে সমঝােতা করতে চেয়েছিলেন এমন প্রামাণ্য দলিল হেনরি কিসিঞ্জারের। লিখিত বইতে পরিস্ফুট। জহিরুল কাইয়ুম মার্কিনীদের বলেন, তিনি মােশতাকের প্রতিনিধি হিসেবে দেখা করতে এসেছেন। তিনি পাকিস্তানদের সাথে আলােচনার বিষয়টি জহিরুল কাইয়ুম সম্ভবত উপস্থিত করেন এবং সেভাবেই মার্কিনীরা ইয়াহিয়া খানকে জানায়। তিনি যে মােশতাক সমর্থিত একজন, এটা প্রমাণিত ।

কিন্তু অপর সমর্থক মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী ও খন্দকার মােশতাক কখনাে শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে স্বাধীনতার কথা বলেছেন, তেমন উল্লেখ নেই। প্রস্তাবের বিষয়বস্তু যাই থাকুক, যােগাযােগ যে করা হয় এবং সেটা যে। মুজিবনগর সরকারকে না জানিয়ে করা হয়, সেটার প্রমাণ মার্কিন দলিলে রয়েছে। যেটা মুজিবনগর সরকারের ভেতরের দ্বন্দ্বের বিষয়টি প্রমাণ করে এবং কেউ যদি। মনে করে, একে ষড়যন্ত্রের বিবরণ হিসেবেও দেখা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের যে অন্তর্দ্বন্দ্ব, এটা ভারত সরকারের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, পরিকল্পনা ও কৌশলের বাইরে ছিল না। যারা ভারতীয় রাষ্ট্রের মূলধারার সাথে ছিল তারাই এই দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হয়। যেমন এন,কে, ঝায়ের পরামর্শে কিসিঞ্জারকে বাংলাদেশ প্রতিনিধির সঙ্গে যােগাযােগ করার অনুমতি দিয়েছিলেন। এটা প্রকাশ হয়ে পড়লে ভারত সরকারের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বলা হয় যা কিছু আলােচনা হােক না কেন তা ভারত সরকার কে জানিয়ে বা তার সম্মতি নিয়ে করতে হবে। জহিরুল কাইয়ুমের এ বক্তব্যে আরও পরিষ্কার হয় যে, তারা মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকারের সংশ্লিষ্টতার বিরােধী ছিলেন। কিন্তু ভারতের সহায়তা ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার আকাক্ষা তখন পর্যন্ত ছিল অবাস্তব। ভারতের সাথে পাকিস্তানের বৈরী সম্পর্কের প্রেক্ষাপটে আদর্শগত মিল থাকায় মুজিবনগর সরকার ভারতের সাহায্য কামনা করে। কিন্তু খন্দকার মােশতাক, কাইয়ুম ও অন্যান্য কিছু নেতা ভারতে অবস্থান করে ভারতীয় সহায়তার বিরােধিতা করেন। এটা প্রকারান্তরে বাংলাদেশ বিরােধিতার শামিল বলে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে মনে করা হয়। এ সব কারণে সরকারের অভ্যন্তরে বিরােধ চরম আকার ধারণ করে।

খন্দকার মােশতাক যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তিনি কয়েকবার যুক্তরাষ্ট্র গমনের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু মার্কিন সরকার তাকে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রটোকল দিতে অস্বীকৃতি জানায়। যুক্তরাষ্ট্র খন্দকার মােশতাককে লন্ডন বা প্যারিসে গিয়ে পাকিস্তানের সাথে কথা বলার জন্য পরামর্শ দেয়। মােশতাক পাকিস্তানের সাথে যােগাযােগ রক্ষার জন্য শেখ মুজিবের মুক্তি চাইতেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে। খন্দকার মােশতাকের পাকিস্তান সম্পৃক্ততার বিষয়টি মুজিবনগর সরকারের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে মােশতাক জনাব মাহবুবুল আলম চাষীকে নিয়ােগ দেন। এ নিয়োেগ মােশতাকের পছন্দের। কিন্তু মাহবুবুল আলম পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত বাঙালি অফিসারদের মধ্যে কট্টর পাকিস্তানপন্থী ছিলেন।” পাকিস্তানের সাথে যােগাযােগের ক্ষেত্রে মােশতাক মাহবুবুল আলম চাষীকে সূত্র হিসেবে ব্যবহার করতেন। এজন্য পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী তাকে এ পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আব্দুল ফতেহকে পররাষ্ট্র সচিব নিয়ােগ দেন। খন্দকার মােশতাক অত্যন্ত চতুরতায় তার মিশনকে সফল করতে অনুগত ব্যক্তিদেরকে তিনি মুজিবনগর সরকারের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ােগে অনেকটা সফলকামও হন। কুমিল্লা অঞ্চল থেকে নির্বাচিত এম,এন,এ. তাহের উদ্দিন ঠাকুরের নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। তিনি তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। এ মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টা ছিলেন আব্দুল মান্নান এম,এন,এ.।” ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম দিকে আব্দুল মান্নান সরকারি কাজে কলকাতার বাইরে গেলে তাহের উদ্দিন ঠাকুর বেতার কেন্দ্রের সামগ্রিক অবস্থা পর্যালােচনার জন্য একটি বৈঠক ডাকেন।

তাহের ঠাকুর বেতার স্টুডিওতেই অবস্থান করতেন। আব্দুল মান্নান কলকাতায় ফিরে এসে তার এ কর্মকাণ্ড পছন্দ করেননি। তখন ঠাকুর পার্ক সার্কাসে বাংলাদেশ হাইকমিশন ভবনে মােশতাকের কাছে গিয়ে আশ্রয় নেন। এর কিছুদিন পরই বেতারকর্মীরা বিভিন্ন দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। ৩ দিনের এ ধর্মঘট এক গােপন মহলের প্রচেষ্টায় হয়েছিল বলে এম.আর, আকতার মুকুল উল্লেখ করেছেন। এই “গােপন মহল” কারা তা সহজেই বােধগম্য । তাহের উদ্দিন ঠাকুর স্টুডিও থেকে চলে গিয়ে পার্ক সার্কাসে অবস্থান নিলেও তিনি সুকৌশলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেন। যেখানে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ নিজেদের জীবন দিয়ে দেশ রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছিল সেখানে ধর্মঘট করার মতাে অনভিপ্রেত ও হঠকারী কর্মকাণ্ড মুক্তিযুদ্ধকেই বিপদগ্রস্ত করার নামান্তর। | উপযুক্ত কারণে তাজউদ্দীন আহমদ ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম সমগ্ৰ পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে ১৬ ডিসেম্বরের পরে খন্দকার মোশতাককে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে আব্দুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেন। এতে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তুঙ্গে ওঠে। এ প্রসঙ্গে নূরুল কাদেরের একটি মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য, “এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মাহবুবুল আলম চাষী ও মন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমদের অনেক কাজই প্রশ্নাতীত ছিল না। এমনকি তাদের কর্মকাণ্ড স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব ফেলার মতাে অবস্থায়ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সচিবের অনাকাক্ষিত কর্মকাণ্ড প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায়নি। বিচক্ষণ ও রাজনৈতিক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সময়মতাে যথােপযুক্ত ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছেন। তা না হলে বাংলাদেশের ইতিহাস হয়তাে বর্তমানে অন্যভাবে লেখা হতাে।”

২৩ জুন ‘৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন বরাবর একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করেন। উক্ত টেলিগ্রামে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের বিষয়ে গভীরভাবে আহত ও মর্মাহত। টেলিগ্রামে তিনি উল্লেখ করেন, পাকিস্তানে এই অস্ত্র ও ত্রাণকার্য সরবরাহ গণহত্যার উদ্দেশ্যেই ব্যবহৃত হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আবেদন জানাচ্ছি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই এই গণহত্যার গণউদ্দেশ্য এবং মূল্যবান সম্পদ ধ্বংস করা থেকে বিরত থাকার আবেদন জানাচ্ছি।” | এর অভ্যন্তরে যেসব বিষয়াদি ছিল কোনােটাই তকালীন প্রধান বাস্তবতার বাইরে ছিল না। সেই বাস্তবতা ছিল পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে পরাজিত করা, সেটা ঢাকা দখল করা হােক অথবা স্বাধীন দেশ ফিরে পাওয়া হােকদুটোই ছিল একই বাস্তবতার দুই দিক। এতে ভারত সরকার সফল হয়েছিল এবং মুজিবনগর সরকারের রাজনীতির এই উদ্দেশ্য সফল হয়।” ব্যারিস্টার মওদুদ আউট ষড়যন্ত্র শুধু এ পর্যায়ে থেমে থাকেনি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বহির্বিশ্ব প্রচার উপ-বিভাগের সদস্য ছিলেন। ইতােপূর্বে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কমনসভার সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন।

তার যােগাযােগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন অবগত ছিলেন না। যুদ্ধরত একটি দেশে আন্তর্জাতিক প্রচারের বিষয় প্রধানমন্ত্রীর অজ্ঞাতে হবে এটা কোনােক্রমেই গ্রহণযােগ্য হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন তার প্রেরিত চিঠিপত্রে বিদেশনীতি ও কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত হন। প্রধানমন্ত্রী পর্যবেক্ষণ করেন যে, মাহবুবুল আলম চাষীর সঙ্গে মওদুদ একত্রে কাজ করছেন এবং একই সঙ্গে কলকাতা মিশনের প্রধান হােসেন আলীর দিকেও হাত বাড়িছেন। কিন্তু ব্যারিস্টার মওদুদকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনাে সরকারি পদ ও দায়িত্ব দেয়া হয়নি। পররাষ্ট্রসচিব থেকে জানানাে হয়েছে উক্ত মন্ত্রণালয়ে তাকে যথাযথভাবেই স্থান দেয়া যাচ্ছে না। একথা শুনে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে জুলাই মাসের শেষের দিকে দেখা করেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার কাজের প্রশংসা করেন এবং বলেন, ভিন্ন কোয়ার্টার থেকে অফিসিয়ালি তাকে দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা আছে। তিনি খন্দকার মােশতাক তাকে স্বেচ্ছামূলকভাবে কাজ করার পূর্বে যেমনটি করেছেন তেমনভাবেই করার জন্য বলেন। আগস্ট মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তাকে যৎসামান্য সম্মানি দেন। ব্যারিস্টার মওদুদ লিখেছেন, “অবস্থা এমনভাবে দাঁড়ায় যে, মানসিকভাবে আমি অপমানবােধ করতে থাকি এবং উপলব্ধি করতে পারি আমাকে কার্যকরভাবে কাজ করতে দেয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমি পুনরায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে দেখা করি এবং তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। তার সঙ্গে আমি বিষয়টি আলােচনা করি একপর্যায়ে তিনি সবকথা না শুনে বলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। কিন্তু যতদূর জানা যায় প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করেননি।” ব্যারিস্টার মওদুদের এসব বক্তব্যে হলাে সাফাই গাওয়ার মতাে। প্রকৃতপক্ষে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের নিকট নিশ্চয়ই এমন কোনাে কার্যপ্রমাণ ছিল যে ব্যারিস্টার মওদুদ নেপথ্যে মাহবুবুল আলম চাষী ও খন্দকর মােশতাকের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করছেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে হয়তাে প্রতীয়মান হয়েছে বাংলাদেশকে নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ষড়যন্ত্র করে চলেছে সম্ভবত মােশতাক চক্রের সঙ্গে তার যােগসূত্র ছিল। সেজন্য তাকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রাখেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!