স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লিখলেন: কুরমাইল দি বেস্ট ক্যাম্প
একাদশ অধ্যায়ে জনযুদ্ধের মূল ভিত্তি হিসেবে গেরিলা যুদ্ধের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। দ্বাদশ অধ্যায়ে তারই একটি ছায়াচিত্র। অনেকেই বলে থাকেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ ও রাজনীতিবিদরা মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় না থেকে তারা নিজেরা বিলাস বৈভবের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় দিন কাটিয়েছেন। একথাটি উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হলেও একেবারে অসত্য নয়। এ সম্পর্কে ফারুক আজিজের স্প্রিং ৭১’ বইতে ও মুশতারী শফির বইটিতে যৎসামান্য উদাহরণ পাওয়া যায়। এগুলাে ছিল নগণ্য ঘটনা। কিন্তু স্বাধীনতা বিরােধীরা অতিসামান্য ব্যক্তিগত ঘটনাকে নিয়ে হৈ চৈ করে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির লক্ষ্যে এই ধরনের প্রচারণা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে জনপ্রতিনিধিরা ভারত সীমান্ত ব্যাপী প্রায় দু’শর মতাে যুৰ ক্যাম্প স্থাপন করেছিলেন। সেখানে যুবকদের আশ্রয় দেয়া হতাে, খাদ্য ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং অনেক ক্যাম্পে সশন্ত্রভাবে আগত তরুণদের ট্রেনিংও দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় গেরিলা যুদ্ধের কলা-কৌশল ও ট্যাকটিকেল দিক এবং আদর্শগত মটিভেশন চালানাে হয়েছে। এ ধরনের ক্যাম্পগুলাের মধ্যে এই অধ্যায়ে একটি মাত্র ক্যাম্পের উদাহরণ তুলৈ ধরা হয়েছে ।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ অনুষ্ঠান বৈদ্যনাথতলা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আজ থেকে, এ জায়গার নাম মুজিবনগর । প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাজধানী। বিশ্ব জেনে গেল স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করার লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে সরকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি ও সর্বাধিনায়ক। তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যবর্গ ছিলেন এম মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও এ. এইচ. এম, কামারুজ্জামান। পাকিস্তান জাতীয় সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণ-পরিষদ সম্মিলিতভাবে স্বাধীনতার সনদ প্রণীত ও গৃহীত হয় ১০ এপ্রিল। ১৭ এপ্রিল আনুষ্ঠানিক শপথ । স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য দেশকে পাকিস্তান সামরিক হানাদার মুক্ত করার লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করে। ১৮ এপ্রিল। এম, মনসুর আলীর সাথে কথা বললাম আমি ও সিরাজগঞ্জের সৈয়দ হায়দার আলী এম.পি,এ। দেশের ভেতরে প্রাথমিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গ্রুপগুলােকে নিয়ে প্রয়ােজনে দেশের ভেতরে থেকে অথবা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে এসে উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করব। হিলি আসার কারণ হলাে ৫ এপ্রিলে হিলি দিয়ে জনাব এম. মনসুর আলীর সঙ্গী হিসেবে কলকাতায় এসেছিলাম। আসলে প্রতিরােধ যুদ্ধে পাবনায় পাকিস্তান সেনাদের পরাজয়ের পর পাবনার ডি.সি, নূরুল কাদের খান এবং পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম, আমজাদ হােসেনের এমএনএ-র অনুরােধে বগুড়ায় আডিয়াবাজার ঘাটিতে যে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র পাওয়া গিয়েছিল তার থেকে কিছু অন্ত্র সংগ্রহ করে পাবনায় নিয়ে আসার বার্তা পাই।
সেই মােতাবেক আমি একটি ট্রাকে এস,এম, আমির আলী, জাহাঙ্গীর আলম মজনু, আবদুস সবুর, (জোড়দাহ) সুজাউদ্দিন, জানে আলম জানু, আবদুস সাত্তার, জয়নালসহ কয়েকজনকে নিয়ে বগুড়ায় গিয়ে গাজীউল হক, হাসান আলী খান, ডা. জাহিদুর রহমান, আমানুল্লাহ | ভাই প্রমুখের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাবনা মুক্ত হওয়ার খবর দিয়ে এবং বগুড়ার সার্বিক অবস্থা দেখে ফিরে আসছিলাম। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে বলা প্রয়ােজন যে, মার্চের শেষ সপ্তাহে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার নেতৃত্বে আবদুল মজিদ মােল্লা, গুলজার হােসেন, সামছুল হক টুকু ও এস এম আমির আলী, আমিনুল ইসলাম পটল সহকারে বেড়া থানার ওসির নিকট থেকে থানার সকল অস্ত্র ও স্থানীয় লােকজন যাদের নিকট অন্যান্য অস্ত্র ছিল তা নিয়ে নেয়া হয়। এবং সেই অস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং শুরু হয়। সেই ট্রেনিং অবস্থায় আরো অস্ত্র সংগ্রহের নিমিত্তে বগুড়ায় এসেছিলাম। বলাবাহুল্য, কিছু গুলি ব্যতীত বগুড়া থেকে অন্য কোনাে অস্ত্র সাহায্য পাইনি। তবে শুনেছি, বগুড়া শহর থেকে এক মাইল দূরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২৩ ব্রিগেডের এমুনেশন ডিপাে ছিল। সেখান থেকে উত্তর জনপদে গােলাবারুদ সরবরাহ করা হতাে। ১ এপ্রিল আড়িয়াবাজার পাকিস্তান সেনাদের ক্যাম্প দখলে আক্রমণ করা হয়। হাজার হাজার লােক সমবেত হল ক্যাম্পের চারপাশে। যার যা আছে তাই নিয়ে সবাই চলে এসেছে। বন্দুক, লাঠি, খুন্তি, বর্শা, কোচ। আকাশ কাঁপানাে জয়বাংলা স্লোগান। পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কারের ভেতরে। সুবিধাজনক পজিশনে। গােলাগুলিতে কাজ হচ্ছে না। প্রচণ্ড দখিনা বাতাস বইছে।
সাধারণ একটি মেয়ের অসাধারণ বুদ্ধিতে গ্রামের কতিপয় কিশােরী একসাথে হামাগুড়ি দিয়ে বাঙ্কারের কাছে গিয়ে কুলাতে রাখা মরিচের গুঁড়া ছড়িয়ে দিল। আর যায় কোথায়! কিছুক্ষণের ভেতরে দেখা গেল সাদা পতাকা হাতে তারা বেরিয়ে আসছে। মরিচের গুঁড়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে হেরে শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করল। চাইনিজ রাইফেলসহ ৫৮টি ট্রাক ভর্তি অস্ত্র পাওয়া গেল। সেই কিশােরী মেয়েরা এখন কোথায়? পাবনা ফেরার পথে চান্দাইকোনা দেখলাম একটি জীপ আসছে। জীপে দাড়িয়ে আছে বগুড়া জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সামাদ। জীপ থেমে গেল। আমি ট্রাক থেকে নেমে পড়লাম । জীপের কাছে যেতেই দেখলাম আমাদের প্রিয়নেতা এম, মনসুর আলী। মনসুর ভাই বললেন, আমার সাথে চলাে। জীপে ওঠো। বেদনাহত চিত্তে আমিরদের ছেড়ে দিয়ে জীপে উঠলাম। মনসুর ভাইকে সাথে নিয়ে প্রথমে বগুড়া, তারপর জয়পুরহাট । আবুল হাসনাত এম.পি এ সাহেবের বাড়িতে রাত কাটিয়ে পরের দিন সকালে ড, মফিজ উদ্দিন এম.এন.এ. সাহেবসহ একত্রে হিলি বর্ডার অতিক্রম করলাম। হিলি সীমান্তে এলে মনসুর ভাইকে বললাম, আমার ছেলেরা তাে এলাকায় রয়েছে, ওদের কাছে চলে যাই। তিনি বললেন, না। চলাে আমার সঙ্গে। ট্রেনে একই সাথে একই কক্ষে কলকাতা পৌছলাম।
এবং ড. মফিজ সাহেবের এক বন্ধুর বাসায় একই কামরায় মনসুর আলী ও আমি একত্রে ছিলাম। নানা অবস্থার মধ্যে কীভাবে সরকার গঠিত হল, সেখানে কার কী ভূমিকা ছিল এ সম্পর্কে তিনি বেদনার্ত চিত্তে অকপটে বলতেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের আড়ালে যুদ্ধ বইতে উল্লিখিত হয়েছে এসব তথ্য। ১৭ এপ্রিল গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে এম, মনসুর আলী ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলােচনা শেষে পাবনায় ফেরার জন্য চেনা পথ হিলি জয়পুরহাট বগুড়ার পথকে নিরাপদ মনে করে হিলিতে চলে এলাম। বর্ডার সিল। ওপারে পাকিস্তান বাহিনী দখল করে নিয়েছে। হিলিতে এসেই সংকটের আবর্তে জড়িয়ে গেলাম। বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনােয়ার প্রায় এক/দেড় শ সৈন্য ও অস্ত্রসহ একটি গুদাম ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন। বিষন্ন, ক্লান্ত সৈনিকদের নিয়ে তিনি মহাঅসুবিধায়। তাদের খাবার নেই। থাকার ব্যবস্থা নেই। রেশন নেই। এমতাবস্থায় সাধারণ সৈন্যরা ছিল বিমর্ষ, রণক্লান্ত এবং হতাশাজনিত উত্তেজনায় আকীর্ণ। এই অবস্থায় কী করা যায় এই ভেবে প্রথমে গেলাম বালুরঘাটে এস.ডি.ও এবং ডি,এস,পির সঙ্গে দেখা করতে, সহযােগিতা চাইতে। প্রশাসন থেকে কিছু অর্থ পাওয়া গেল। স্থানীয় এম,এল,এ কিছু টাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। চাল, ডাল, তৈজসপত্র দিয়ে সাহায্য করলেন রাধা বল্লভ বস্ত্রালয়ের মালিক। ইতােমধ্যেই বাংলাদেশ থেকে সীমান্তে তাড়িত ইপিআর, সেনা সদস্য ও পুলিশ আনসারদের সংগঠিত করার কাজ শুরু হলাে। এই উদ্দেশ্য নিয়ে বালুরঘাট জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার এবং স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সহায়তায় কামারপাড়ার কুরমাইল নামক শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমরা আশ্রয় খুঁজে পাই। মূলত সেই দুঃসময়ে ক্যাপ্টেন আনােয়ারের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আন্তরিক ও সৌহাদ্যপূর্ণ।
ক্যাম্প স্থাপনের পরপরই বানের জলের মতাে বগুড়া, দিনাজপুর, জয়পুরহাটের টগবগে তরুণেরা দলে দলে ক্যাম্পে ভিড় জমাতে থাকে। বলতে গেলে বেসরকারি পর্যায়ে সেটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম ক্যাম্প, যেখান থেকে একাধারে যুবকদের ট্রেনিং দেয়া হতাে এবং গেরিলা কায়দায় হিলি, জয়পুরহাট, বগুড়া ও ফুলবাড়ী এলাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশন চালানাে হতাে। স্বাভাবিকভাবেই কিছু সময় সামরিক নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন আনােয়ার।
সেদিনের কথা আজো ভুলবার নয়। আকাশে মেঘ ছিল না। দিনটি ছিল রৌদ্রকরােজ্জ্বল। ক্যাপ্টেন আনােয়ারের সঙ্গে একটি উইলি হুডখােলা জীপ। তিনি বললেন, একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আপনাকে আমার সাথে যেতে হবে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে মিটিংয়ে আপনার ভূমিকা হবে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, সেই সময় সৈয়দ হায়দার আলী তার ফ্যামিলিকে আনার জন্য অন্যত্র ছিলেন। বালুরঘাটের রাস্তা ধরে শহর থেকে বেশকিছু দূরে একটি নির্জন পরিত্যক্ত স্থান দেখে মনে হলাে কোনাে এক সময় যুদ্ধের জন্য ব্যবহৃত বিমানঘাটি। তার পাশেই একটা পরিত্যক্ত অথচ হঠাৎ করে ঘষে মেজে তােলা একটি দোতলা ভবন
যার ওপরে রক্ষিত ছিল বিমান ওঠানামার নির্দেশক যন্ত্রপাতি। আমরা সেখানে গিয়ে পৌছানাের পরপরই সাদা পােশাকে একজন চৌকস সুঠাম দেহের অধিকারী ব্যক্তি আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে বন অভ্যন্তরে নিয়ে গেলেন। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম খাপ খােলা তলােয়ারের মতাে সামরিক পােশাকে এক শিখকে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এগিয়ে এসে হাত বাড়ালেন। করমর্দন করলাম। ক্যাপ্টেন আনােয়ার তাকে যথারীতি স্যালুট দিলেন। এ পর্যায়ে নির্বাচিত এম,এন,এ হিসেবে যখন ক্যাপ্টেন আনােয়ার আমার নাম বললেন, তখন সাথে সাথে তিনি সামরিক ভঙ্গিতে সটান দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার না বসা পর্যন্ত চেয়ারে বসলেন না। আমরা এক টেবিলে বসলাম। তিনি বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে শুনতে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। জনগণের মনােভাব, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মন-মানসিকতা এবং সর্বোপরি তরুণদের যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি জানতে চাইলেন। এ সম্পর্কে ক্যাপ্টেন আনােয়ার সামরিক অবস্থা ও অসুবিধার এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। যে লােকটিকে নিয়ে আমি কথা বলছি তিনি আর কেউ নন, তিনি ছিলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের লে. জে. জগজিৎ সিং অরােরা। যুদ্ধরীতি ও পদ্ধতির প্রসঙ্গ আসতেই বিনম্র চিত্তে তিনি বললেন, “আপনাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কীভাবে আপনাদের দেশ স্বাধীন করতে হবে তা বলে গেছেন। দিয়ে গেছেন দিকনির্দেশনা। যে নির্দেশনা তিনি দিয়েছেন, সেই পথে আপনাদের অগ্রসর হতে হবে, শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে। শত্রুকে পরাস্ত করতে হবে। এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।” “আপনারা আপনাদের নেতার ৭ মার্চের ভাষণ যদি গভীরভাবে পাঠ, অনুধাবন এবং বিশ্লেষণ করেন তাহলেই আপনাদের যুদ্ধরীতি ও পদ্ধতি কী হবে তা নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। স্পষ্টতই তিনি গেরিলা যুদ্ধের কথাই বলে গেছেন। তিনি বলে গেছেন, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােল। বলেছেন, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা কর। বলেছেন, গেরিলা যুদ্ধের রণনীতি। ভাতে মারবাে।
পানিতে মারবাে। বলেছেন, স্বাধীনতার কথা। মুক্তির কথা। অগাধ শ্রদ্ধায় জেনারেল অরােরা বলেন, আপনারা এমন এক মহান নেতা পেয়েছেন যিনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে অসহযােগ আন্দোলনে এবং অসহযােগ আন্দোলনকে সশস্ত্রকরণের চুড়ান্ত পথ ও পদ্ধতির নির্দেশ করে গেছেন। জাতিকে প্রস্তুত করেছেন। তিনি বলেন, গেরিলা যুদ্ধের কিংবদীন্ত মাও, চে গুয়েভারা, জেনারেল গিয়াপ, কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রো যেভাবে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন আপনাদেরকে তেমনি নিজস্ব ভৌগােলিক বিশিষ্টতা, জনগণের ঐতিহ্যগত ও লালিত চেতনার সঙ্গে যুক্ত অর্থনৈতিক সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করেই নিজস্ব গেরিলা পদ্ধতির পথ ও কৌশল গ্রহণ করতে হবে। কারণ নিজস্ব ভৌগােলিক বিশিষ্টতায় রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মতবাদ অন্যদেশের প্রচলিত থিউরি থেকে ভিন্ন হতে বাধ্য। সেই বাধ্যতার ভিন্নতাকে স্বীকার করে নতুন পথে আপনাদের পদযাত্রা, যদিও দুরূহ ও প্রচণ্ড প্রতিবন্ধকতা; তবুও সামগ্রিক শ্রম, সাধনা এবং কমিটমেন্টের মাধ্যমে আপনাদের জাতি স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম। | সেদিন তার কথায় সত্যিই আমি অভিভূত হয়েছিলাম। বস্তুত গেরিলা যুদ্ধ
প্রত্যেক ঘরকে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে দুর্ভেদ্য করে গড়ে তুলবার সীমাহীন সাধনা। সরল সাধারণ নিরলস জীবন প্রাত্যহিকীর বিড়ম্বনা যেখানে ভিড় জমায়, তবু এরই নেপথ্যে গহন অন্তঃসলিলার মতাে সে এমন একধারা ফেনিল সশব্দতার ডেঙে পরা নয়, হাওয়ার প্রবল টানে আর উচ্ছাসের দাম্ভিকতায় সরল ঘােষণা নেই, নীবর নিঃশব্দ বিচিত্র সম্ভারের এই লক্ষ্যপূর্ণ একমুখিনতা; যুদ্ধরীতির ইতিহাসে এক অনন্য প্রক্রিয়া, সংগ্রামের ধারাপাতে অন্য নাম, অন্য নামতা। কোলাহল নেই, আড়ম্বর নেই, জমকালাে সম্ভার নেই, নেই আয়ােজনের অসীম ব্যাপকতা, শুধুই আকস্মিকতা। আক্রমণে শক্র হনন, ত্রাস সৃষ্টি, তারপর চটপট সরে পড়া, অন্যদিকে হানাদার বাহিনীর বৃথাই বিদ্রি রজনীর প্রতীক্ষা । গেরিলাদের ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না, তাদের কাছে পাওয়া যায় না, হাওয়ার সাথে মিশে থাকে তারা, জনতার অরণ্যে ওৎপাতা বাঘের মতাে লুকিয়ে থাকে তারা, বুঝবার উপায় নেই, ধরার সাধ্য নেই, সন্দেহের অবকাশ নেই অসতর্ক মুহুর্তে শিকারের উপর সহসা ঝাপিয়ে পড়া, মরণ ছােবল। এ এক যুদ্ধরীতির বিস্ময়, যা অতীতের ত্যাগ ও রক্তের অনুশীলনে গড়ে উঠেছে, বহু দেশপ্রেমিকের হৃদয়ের উত্তাপ আর যন্ত্রণা নিয়ে। গেরিলাযুদ্ধের ইতিহাস আর কাহিনী, রূপান্তর তার পটভূমিকা শতাব্দীর সীমানায় প্রসারিত।
২৩ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আনােয়ার তার সঙ্গীয় সেনা সদস্যদের নিয়ে গেরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করলেন। ইতােমধ্যেই পাঁচবিবি, বাংলাহিলি, দিনাজপুরের ফুলবাড়ি, বগুড়া থেকে শ’দুই তরুণ ক্যাম্পে এসে যােগ দিয়েছে। আমি ক্যাপ্টেন আনােয়ারকে বললাম, আগে মুক্তিযােদ্ধাদের রসদের ব্যবস্থা করতে হবে। সৌভাগ্যক্রমে ঐদিন হিলি স্টেশনে একটি মালবাহী ট্রেন এসে থামল। জানতে পারলাম উক্ত ট্রেনে পাকিস্তান বাহিনীর জন্য আটা-চাল-ডাল ফুলবাড়ীর দিকে যাচ্ছে। হিলি স্টেশনটি এমন যে, রেললাইনের এ পাশে ভারত ও অন্য পাশে বাংলাদেশ। ক্যাপ্টেন আনােয়ারের নেতৃত্বে অর্ধশত সৈন্য ও ছেলেদের নিয়ে কয়েকটি বগির সীল গালা ডেঙ্গে কয়েকশ বস্তা চাল-ডাল-আটা-গম নিয়ে আসা। হলাে। বলা বাহুল্য, ক্যাপ্টেন আনােয়ার অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে কিছু সৈন্যদের। আক্রমণ হলে পাল্টা আক্রমণের জন্য প্রস্তুত রাখলেন এবং আনীত বস্তাগুলাে ভারতীয় হিলি স্টেশনে জমা করা হলাে। নিজেরাও অংশ নিয়েছিলাম। যেহেতু আমি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এককালীন রাকসুর ভিপি ও শিক্ষক ছিলাম এবং নির্বাচিত এম.এন.এ সেহেতু ছাত্রদের যা বলা হতাে অবলীলাক্রমে বিনা আপত্তিতে তাই শুনত । ছেলেদের বললাম বস্তা মাথায় নেবে না। দুহাত পেছনে দিয়ে পিঠে করে বস্তা আনতে হবে। আমার সাধারণ জ্ঞানে অনুমিত হয়েছিল যে, পাক বাহিনীর। সৈন্যরা গুলি করলে পিঠে চাল-আটার বস্তায় লাগবে। শরীরে লাগবে না। এভাবে রসদের বিশেষ করে খাদ্যের এক বিরাট ভাণ্ডার আমরা গড়ে তুলতে সমর্থ হয়েছিলাম । পাশাপাশি ভারতীয় সীমান্ত বাহিনীর ঐ এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্নেল। মুখার্জির সঙ্গে আলাপ আলােচনা করে গােলাবারুদ ও বিস্ফোরক সংগ্রহ করা হয় । প্রথম দিকে ই.পি.আর, এর বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞগণ ছেলেদের বিস্ফোরক ট্রেনিং, গ্রেনেড ছােড়া এবং অস্ত্র চালানাের প্রশিক্ষণ প্রদান করে।
এপ্রিল মসের ২৬ তারিখে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী, মেজর সাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন নূরুন্নবী খান এবং তােফায়েল আহমদ ক্যাম্পে আকস্মিকভাবে এসে হাজির হলেন। মেজর সাফায়াত জামিল ক্যাম্পে অবস্থানরত ক্যাপ্টেন আনােয়ার ও আমাকে নিয়ে আমাদের অস্ত্র, গােলাবারুদ, রসদ, গুদাম ঘর পরিদর্শন করলেন। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ক্যাপ্টেন আনােয়ার তার সেনাবাহিনী, অস্ত্রশস্ত্র এবং যতদূর সম্ভব রসদ সামগ্রী নিয়ে তুরা পাহাড়ের অভিমুখে রওনা হয়ে গেলেন। ক্যাপ্টেন আনােয়ার ও তার সেনাবাহিনী চলে যাওয়ায় আমি যেন অসহায় হয়ে পড়লাম । কিন্তু আশ্চর্যের সঙ্গে দেখতে পেলাম, মে মাসের ৩য় সপ্তাহেই বিস্ফোরক, হ্যান্ড গ্রেনেড ও প্রাথমিক অস্ত্র চালানোর জন্য বিএসএফ থেকে একজন বিশেষজ্ঞ আসলেন। ক্যাপ্টেন আনােয়ার তার সেনাবাহিনী নিয়ে চলে যাওয়ার পর বেশ কিছু ই.পি.আর সদস্য কুরমাইল ক্যাম্পে এসে যােগদান করেন। এ সম্পর্কে সুবেদার মেজর রব হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও দলিলপত্র এর দশম খণ্ডে লিখেছেন, “Prof. Abu Sayeed M.N.A of Pabna opened two youth camps to train guerillas for future fight.” elpu urce আমি দুটি ক্যাম্প পরিচালনা করিনি। একটি ক্যাম্পের দুটি অংশ ছিল। একটি ছিল রিক্রুটিং ক্যাম্প এবং অন্যটি অপারেশন ক্যাম্প। সুবেদার মেজর রব সাহেব অপারেশন ক্যাম্পে আমাদের সক্রিয়ভাবে ট্রেনিং দেবার ক্ষেত্রে বেশকিছু দিন নিয়ােজিত ছিলেন। সে কারণে তিনি সম্ভবত একটি ক্যাম্পকে দুটি ক্যাম্প হিসেবে। মনে করেছেন। ঐ সময় ই.পি.আর-এর হাওয়ালদার মেজর বেল্লাল হােসেন ও জোয়ান ফেরদৌস ট্রেনিংয়ের কার্যক্রম চালিয়ে যান। মে মাসের শেষের দিকে বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যাপকভাবে ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীদের চাপ সৃষ্টি হয়। পাবনা এলাকা থেকে, বিশেষ করে আমার নির্বাচনী এলাকার মধ্যে সাঁথিয়া ও বেড়া থানা থেকে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক প্রশিক্ষণার্থী উপস্থিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই যারা বিভিন্ন এলাকায় ট্রেনিং নিচ্ছিলেন তারা প্রতিরােধ যুদ্ধে টিকতে না পেরে বিপর্যস্ত অবস্থায় ক্যাম্পে এসে হাজির হন।
এদের মধ্যে যাদের নাম এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না তাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং আশা করছি আগামীতে সে সমস্ত বীর সন্তানদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। যতদূর মনে পড়ে, এস এম আমির আলী, জাহাঙ্গীর আলম মজনু, আবদুস সাত্তার, আব্দুল লতিফ, আলাউদ্দিন, হারুন-অররশিদ হকু, বেলায়েত হােসেন, চাদ আলী, সুজা উদ্দিন, শহীদ আবদুল খালেক, আবদুল লতিফ তুষ্ট, শুকুর আলী, ফরহাদ হােসেন, মাস্টার মােজাহার, আবদুস সবুর, জানে আলম জানু, মােফাখখারুল ইসলাম, শাজাহান আলী, মতিউর রহমান লাল, ইসহাক আলী, আবদুর রশিদ , সাকের আলী, আসকার আলী প্রমুখ তরুণ প্রশিক্ষণার্থী এসে উপস্থিত হন। এদের সঙ্গে অনেকেই দেশের অভ্যন্তরে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন যাদেরকে কুরমাইল ক্যাম্প থেকে দীর্ঘ রাস্তা অতিক্রম করে, পাহাড়-জনপথ-জলপথ ভেঙ্গে রৌমারি থেকে পদ্ম-যমুনা বিধৌত এই এলাকায় অস্ত্র সরবরাহ করা হতাে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। এদের নেতৃত্বে ছিলেন যুদ্ধকালীন কমান্ডার এস এম আমির আলী।
সিরাজগঞ্জ এলাকার লতিফ মির্জার সঙ্গে একত্রে আমির আলীকে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। লতিফ মির্জা তিনবার ক্যাম্পে এসে অস্ত্র নিয়ে সেদিন প্রাথমিক ট্রেনিং নিয়েছেন। এখানে আরাে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, সাঁথিয়া উপজেলার নিজাম উদ্দিনের নেতৃত্বে ফজলু (তেঁতুলিয়া), সনটু (তেঁতুলিয়া), মুজিবর হাজি (বৃহস্পতিপুর), আবদুল কাদের, নূরুল ইসলাম, মুজিবর রহমান এরা তিনজনই বানিয়াবহু গ্রামে তরুণ-যুবক যুদ্ধে মুজিবর শহীদ হন। এছাড়া রেজাউল করিম, আলতাফ হােসেন, লােকমান হােসেন, আবদুল লতিফ, আবদুর রউফ, আফসার ও হাবিবুল্লাহ (আতাইকুলা), আফতাব ও ছালাম (গাঙ্গিয়াহাটি), কুদ্ছ, গলাকাটা শাজাহান, সাইফুল (কাবারিখােলা), ছালাম (মেহেদিনগর), মমতাজ আলী চতুর, আনছার আলী, আবু সােমা, মােহাম্মদ আলী, গােলাম মাের্শেদ, আবু হানিফ (শশদিয়া), ওহাব (খয়েরবাড়ি), সােহরাব (পিয়াদহ), জহরুল হক প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়ার প্রবল আগ্রহে শেষের দিকে ক্যাম্পে আসে সামছুল হক টুকু, আবু শামীম ও বাঘা। এদের মধ্যে সামছুল হক টুকু ও বাঘা মুজিব বাহিনীর ট্রেনিংয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আবু শামীম ডাক্তারী পড়তেন। সেজন্য ক্যাম্পে চিকিৎসা দিতেন। আবু শামীম কুরমাইল ক্যাম্পে বিস্ফোরক ট্রেনিং সম্পন্ন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসিকতা নিয়ে এসেছিলেন মাঝ বয়সের বৃশালিখার সােহরাব হােসেন। তিনি এসেই বললেন, মামা যুদ্ধে যে জয়লাভ করবে তার প্রমাণ কি? আমি তাকে রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করে বুঝানাের পর জিজ্ঞেস করলাম আর কি প্রমাণ চান?
সােহরাব মামা বললেন, অস্ত্র কত আছে দেখতে চাই। আমি অন্যত্র মাটির নিচে বিরাট বাঙ্কারে রাখা যেসব অস্ত্র ছিল তা দেখাতেই তিনি উল্লসিত হয়ে উঠলেন। অস্ত্র দেখে বললেন, এত অস্ত্র! তাহলে দেশ স্বাধীন হবে। তাকে পনের দিনের ট্রেনিং দিয়ে দুটি স্টেইনগান দিয়ে দেশের ভেতরে পাঠানাে হয়। তাকে দেশের ভেতরে পথ দেখিয়ে দেয় ক্যাম্পের সর্বক্ষণিক কর্মবীর তাহেজ উদ্দিন সরকার। যিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়েও পাকিস্তান বাহিনীর বিভিন্ন অবস্থান আমাদের এনে দিতেন। সেই মােতাবেক আমাদের গেরিলা বাহিনী আক্রমণ চালাত এবং পাকিস্তান বাহিনীর সমস্ত পরিকল্পনা ধ্বংস করে দিত। দেশে এসে সােহরাব মামা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের এক উৎসাহী যুবক হিসেবে কর্মতৎপরতা শুরু করেন। তার সাথে যােগ দেন আবদুল মজিদ মােল্লা। যমুনার বিস্তীর্ণ চরাঞ্চল থেকে শুরু করে চলনবিল, ফরিদপুরের ডেমরা হয়ে সােনাতলা বিল হয়ে সুজানগর গাজনা বিল পর্যন্ত ছিল এদের যুদ্ধ তৎপরতা। বিচ্ছিন্ন যুদ্ধে বহু মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়েছেন। শহীদ হয়েছেন অনেকেই সম্মুখ যুদ্ধে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা বেড়া ও সাঁথিয়া থানা আক্রমণ করে থানা দখল করে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন মিন্টু, জয়গুরু, আবদুল আওয়াল, আবদুল খালেক, নজরুল ইসলাম, টগর এদের অবদান ও আত্মত্যাগ আজও ইতিহাসে লিখিত হয়নি। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সর্বদা জড়িত ছিলেন আবদুল মজিদ মােল্লা, সাঁথিয়া পুটিপাড়ার আকবর মিয়া, ডা. মােজাফফর, আবদুস সােবহান, আমানুল্লাহ মাস্টার, আবদুর রহিম, আব্দুর রহমান, আবদুল হামিদ প্রমুখ। ধুলাউরির শহীদ ডা. আবদুল আওয়ালের বাড়িতে মুক্তিযোেদ্ধারা ২৭ নভেম্বর আশ্রয় গ্রহণ করে। ঐদিন রাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহায়তায় ঐ বাড়ি আক্রমণ করে এবং ডা. আবদুল আওয়াল, নয়ন খলিফা, গফুর খলিফা, ছামাদ খলিফা, জহরুল ফকির, আবু ফকির, রশিদ ফকির, তােরাব বিশ্বাস প্রমুখ তাদের আক্রমণে শাহাদাত্ত্বরণ করেন। শাহাদাত্ত্বরণ করেন ঐদিন ঐ সময় মুক্তিযােদ্ধা দারা-চাঁদ। দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয় ও স্থান পরিবর্তনে গােপনে সাহায্য করতেন নৌকার মাঝি এবং খেটে খাওয়া মানুষ। মুক্তিযুদ্ধে আমার মা সায়েদাতুন নেছার অবদানের কথা উল্লেখ না করলে আমার পাপ’ হবে। তিনি একদিকে যেমন মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতেন, অন্যদিকে তেমনি তার নিকট আমি যে সমস্ত অস্ত্র-শস্ত্র পাঠাতাম তা তিনি গোপনে সংরক্ষণ করতেন। ক্যাম্প থেকে আমার পাঠানাে চিঠি ও তালিকা মােতাবেক তিনি আমির আলী ও অন্যদের হাতে অস্ত্র ও গুলি তুলে দিতেন। মা কোনােদিন অভুক্ত বা আধপেটা খেয়েছেন, কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য মুড়ি বা চাল-ডাল কম পরিমাণ হলেও সংগ্রহ করে রাখতেন।
কখন যে আসবে ওরা। ওদের জন্য কোরান খতম দিতেন। নফল নামাজ পড়তেন। বিভিন্ন সময়ে গেরিলা যুদ্ধে কুরমাইল ক্যাম্প থেকে পাঠানাে বহু মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়েছেন। কুরমাইল ক্যাম্পের প্রাঙ্গণে ১১ শহীদকে কবর দেয়া হয়েছে। কুরমাইল ক্যাম্প থেকে প্রথম ব্যাচে গেরিলা দল পাঠানাে হয় খােকনের নেতৃত্বে। থােকন ও তার দল রাজাকার ও পাকিস্তান বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে এবং প্রায় গােটা দলসহ শহীদ হন। এরকম বেদনাময় বহু স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ক্যাম্প কুরমাইলকে জড়িয়ে আছে । | এই ক্যাম্পে প্রতিমাসে জননায়ক আবদুর রাজ্জাক আসতেন। বাছাই করে শিক্ষিত যুব ছেলেদের মুজিব বাহিনীর জন্য নিয়ে যেতেন। পরবর্তীকালে লক্ষ্য করেছি মুজিব বাহিনীর ছেলেরা দীর্ঘমেয়াদি গেরিলা যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিল। অনেক সময় স্থানীয় কমান্ড নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষ হয়, যা দুঃখজনক। এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করতে হয় রফিকুল ইসলাম বকুল, ইকবাল হােসেন, জহুরুল হক বিশু অর্থাৎ পাবনার অধিকাংশ ছাত্রলীগের ছেলেরা মুজিববাহিনীতে যােগদান করে। কেবল পাবনার লালু মুক্তিবাহিনী সংগঠিত করতে তৎপর ছিল। সেজন্য বকুলদের সঙ্গে লালুর এ নিয়ে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। ফলে একসময় লালু কেচুয়াডাঙ্গা ক্যাম্প থেকে কুরমাইল ক্যাম্পে চলে আসে।
কুরমাইল ক্যাম্পে ভারতীয় কংগ্রেস পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রী রাজেশ্বর রাও আগস্টের শেষ দিকে এসেছিলেন। তিনি বাংলাদেশ যে স্বাধীন হবেই এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র যে পরাজিত হবে, এ সম্পর্কে দৃঢ়তার সঙ্গে নাতিদীর্ঘ বক্তৃতা দেন। তাঁকে ক্যাম্প থেকে গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এর পূর্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী অধ্যাপক এনায়েতুর রহিম প্রায় দশদিন কুরমাইল ক্যাম্পে অবস্থান করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। এ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বই ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার এণ্ড দ্যা নিক্সন হােয়াইট হাউস ১৯৭১’ শীর্ষক বইতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উল্লেখ করেছেন। ড. এ আর মল্লিক আমাদের চাহিদা মোতাবেক তার সুযোগ্য পুত্র ফারুক মল্লিকের মাধ্যমে একটি পাওয়ারফুল বাইনােকুলার আমাকে প্রদান করেন। যার মাধ্যমে উচু টাওয়ার থেকে সাত কিলােমিটার পর্যন্ত শক্রদের অবস্থান জানতে পারতাম। কুরমাইল ক্যাম্প সম্পর্কে আমরা স্বাধীন হলাম গ্রন্থের লেখক এবং ক্যাম্পগুলাের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কো-অর্ডিনেটর কাজী সামসুজ্জামান লিখেছেন- “মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সব মুক্তিযুদ্ধ শিবির গড়ে তােলা হয়েছিল তার মধ্যে অন্যতম ছিল এই কুরমাইল ক্যাম্প। এই ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন পাবনা থেকে নির্বাচিত এমএনএ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ। এই ক্যাম্পটি দুভাগে বিভক্ত ছিল। একটি ছিল অপারেশন ক্যাম্প এবং অন্যটি যুব অভ্যর্থনা শিবির। প্রায় দুই হাজার (সাড়ে তিন হাজার) যুবক এখানে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। এদের মধ্যে থেকেই প্রাক্তন পুলিশ, ই.পি.আর, আনসার এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের সমস্বয়ে গড়ে তােলা হয়েছিল অপারেশন ক্যাম্প। এই অপারেশন ক্যাম্পের প্রধান কাজ ছিল পার্বতীপুরহিলি এলাকায় অভিযান চালিয়ে রেল চলাচল ব্যাহত করা এবং পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় (বাংলাদেশ) বসবাসরত জনসাধারণের জানমাল রক্ষা করা। আমরা যখন ঐ ক্যাম্পে পৌছলাম তখন দুপুর হয়ে গেছে। ঘুরে ঘুরে ক্যাম্পের খবরাখবর নিলাম।
ক্যাম্পের প্রশাসন বিশেষ করে ক্যাম্পের নিজস্ব হাসপাতাল সত্যিই আমাদের মুগ্ধ করেছিল। ক্যাম্পে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ আমাদেরকে ক্যাম্পের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানালেন। ঐ ক্যাম্পের অপারেশন টিমের অনেক কৃতিত্বের কাহিনী শােনানেল। ক্যাম্পের অসুবিধার কথা বলতে গিয়ে তিনি জানালেন যে ভারি অস্ত্র না পাওয়ার ফলে কেবল রাইফেল দিয়ে দুর্ধর্ষ পাক। সেনাদের মােকাবেলা করা তাদের পক্ষে কষ্টসাধ্য। তিনি ফিরে গিয়ে আমাকে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ভারী অস্ত্র দেয়া সম্পর্কে আলাপ করে এই বিষয় বিহিত করার জন্য অনুরোধ জানালেন।” তিনি আরাে লিখেছেন, “বেলা ৪টার দিকে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে আসছিলাম। একটু আগে বেশ বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তাঘাট পিচ্ছিল। ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে কয়েক গজ আসার পর দেখতে পেলাম ৮-৯ যুবক ক্যাম্পের দিকে আসছে। প্রত্যেকের কাছে রাইফেল। দলটিকে পথেই থামিয়ে তাদের সাথে আলাপ শুরু করলাম। শুরুতেই তারা জানালেন যে, ভাের ৫টার সময় তার অপারেশনে রেরিয়েছিল। গত রাতে ২জন লােক হিলি থেকে খবর নিয়ে আসে যে, বগুড়া থেকে পার্বতীপুর হয়ে ট্রেনে প্রচুর পাকিস্তান সেনা দিনাজপুর আসছে। যে দু যুবক খবর নিয়ে এসেছিল তারা ছিল রাজাকার বাহিনীর সদস্য। দিনে তারা পাক সেনাদের সাথে থাকা আর রাতে থাকত মুক্তিবাহিনীর সাথে । এই খবর পেয়ে তারা ভােরে রওনা হয়ে যায় এবং বেলা ১১টার দিকে তাদের মাইনের আঘাতে ট্রেনের দুটি বগি ধ্বংস করে ফিরছে। ছেলেদের কথা শুনে বুকটা আনন্দে ভরে উঠল। প্রত্যেকের হাতে দুটো করে টাকা দিয়ে মােটরসাইকেলে উঠতেই পেছনে তাকিয়ে দেখি ছেলেরা আমাদের দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞতার হাসি হাসছে। কারণ যতদূর মনে হলাে টাকাগুলাে পেয়ে তারা খুশি হয়েছে ভীষণভাবে।”
বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান জুন মাসে এক সপ্তাহব্যাপী উত্তরবঙ্গের ক্যাম্পগুলাে পরিদর্শন করে তদানীন্তন সরকারের নিকট একটি লিখিত রিপাের্ট দেন। সেখানে কুরমাইল ক্যাম্প সম্পর্কে বলা হয়েছে
On 13.6.71, “we visited what may be termed the best camp: Kurmail, Present strength 700. Of these about 400 participated in guard of honor and listened to the Ministers inspiring speech, drenched in heavy rain. Already 1000 have been sent for training (228+300+400). Trainer EPR. No ration. They procured rice from other side. Operations being conducted from here. Rifles 7-8 hundred. Captain explosives trainer. Major Trainer. Active work by Prof. Abu Sayeed, M.N.A camp in Charge.” FACTCT BASIC 079, “The total number of transit training camps including operation units of East Bengal forces will not be much larger than 40. In most of these the present strength is around 200, accommodation, restriction imposed by availability of ration etc. Including the trainees that have been sent for higher training the number will be larger, in one camp as much 1700 (Kurmail, Dinajpur). The total number of trainees available at the moment will be thus about 10,000 or so.”
মুজিবনগর সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান বাংলাদেশ সরকারকে এ সম্পর্কে রিপাের্ট করেন। রিপাের্টে বলেন, “আমি যে সব ক্যাম্প পরিদর্শন করেছি তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ ক্যাম্প হলাে কুরমাইল ক্যাম্প। ১৩ই জুন ক্যাম্পে অবস্থিত ৭০০ প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে প্রবল বৃষ্টির মধ্যেও ৪০০ ছেলে গার্ড অব অনারে অংশগ্রহণ করে। তারা মন্ত্রী মহােদয়ের উদ্দীপক ভাষণ শ্রবণ করেন। এ পর্যন্ত ঐ ক্যাম্প থেকে ৯২৮ জনকে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য পাঠানাে হয়েছে। এরা নিজেরাই রেশন সংগ্রহ করে। সরকার থেকে এদের রেশন দেয়া হয় না। এখানে বিস্ফোরক প্রশিক্ষণ দেয় ক্যাপ্টেন ও মেজর। অস্ত্র রয়েছে ৭০০-৮০০। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ সক্রিয়ভাবে ক্যাম্পটি পরিচালনা করেন।” অন্য রিপাের্টে বলা হয়েছে, “ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ট্রেনিং ক্যাম্প পশ্চিমবঙ্গে ৪০টির বেশি নয়। এসব ক্যাম্পে থাকা, খাওয়ার তেমন ব্যবস্থা নেই। প্রশিক্ষণার্থীও কম। কোথাও ৪০ জনের নিচে । উল্লেখ করা যেতে পারে, কুরমাইল ক্যাম্প থেকে কেবল ১৭০০ যুবককে এ পর্যন্ত ট্রেনিং দেয়া হয়েছে। সমগ্র পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত বরাবর স্থাপিত ক্যাম্পের প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা দশ হাজারের মতাে।” সার্বক্ষণিকভাবে ক্যাম্পটির পরিচালনায় থাকতেন ইলিয়াস, জয়পুরহাটের কাফেজ উদ্দিন, পাবনার ফেরু মিয়া, মফিজ উদ্দিন মাস্টার, আমজাদ হােসেন এবং সার্বক্ষণিক ট্রেনিং দিতেন ভারতের ক্যাপ্টেন ক্ষোধ, সুবেদার বিল্লাল ও ইব্রাহিম প্রমুখ। কুরমাইল ক্যাম্প। সামনে সবুজ চত্বর। শিমুল গাছে রক্ত-ফুল। বৃষ্টি ভেজা বট গাছের শিহরিত পত্রপল্লব। পুকুরে নিটোল জল। পাশে সারি সারি মুক্তিযােদ্ধাদের কবরের পাশে প্রার্থনারত বৃক্ষসারি। ডােরের পাখি কি তেমনি করে ডেকে ওঠে, কম্পিত শাখায় বাতাস দোলা দেয়! সামনে শালবন। বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেত। ভােরের স্নিগ্ধ আলােয় এখানে মনে হয়, রাত জাগা গেরিলারা দলে দলে ফিরে আসছে রণক্লান্ত, অথচ বিজয়ের প্রত্যয়ে উদ্ভাসিত। কখন যেন গলা ছেড়ে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠবে: জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু। শীত, বসন্ত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় উৎকর্ণ হয়ে আছে হৃদয়-স্মৃতি । আনন্দে। বেদনায় । রক্তক্ষরণে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ