You dont have javascript enabled! Please enable it!

জন্মেই জটিলতা

দশম অধ্যায়ে সরকার গঠনে জনেই জটিলতার যে আবর্ত সৃষ্টি হয়েছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিশেষ করে গণপরিষদের সদস্যবৃন্দের নানা মতভেদ থাকলেও তা নিরসন করতে সমর্থ হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ও জাতীয় সংসদের হুইপ ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করে অতিদ্রুত দিল্লীতে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে সরকার গঠন এবং ভারতের মাটিতে আশ্রয়, যুদ্ধ পরিচালনা ও অন্যান্য বিষয়ে সহযােগিতার আশ্বাস পান। ১০ এপ্রিল ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম স্বাধীনতার সনদ রচনা করেন এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কর্তৃক তা অনুমােদিত হয়। সংগ্রামের ধারাবহিকতায় হাইকমান্ড’ গঠিত হয়েছিল। সে অনুসারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, তার অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ হাইকমান্ড নেতাদের নিয়ে ১০ তারিখে গঠিত সরকার ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার শপথ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের চার নেতৃত্ব বাংলাদেশ সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিরােধিতা করে বিপ্লবী পরিষদ গঠনের পক্ষে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যান। যুদ্ধের শেষ পর্যন্ত এই বিরােধীতার অবসান হয়নি। এই চার যুবনেতা মুজিব বাহিনী গঠন করেন যা ছিল উন্নত ট্রেনিং ও অন্ত্রেসজ্জিত গেরিলা বাহিনী। এই অধ্যায়ের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে যুদ্ধকালীন সময়ে গণপরিষদের অধিবেশন। এই অধিবেশন এমন একটি সময়ে অনুষ্ঠিত হয় যখন মার্কিন চক্রান্ত একটি পর্যায়ে চলে এসেছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের ভেতরে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে যে স্বাধীনতা চাও না বঙ্গবন্ধুকে চাও’।

এর মূল হােতা খন্দকার মােশতাকচক্র । উক্ত অধিবেশনে শপথ গ্রহণ করা হয়, বিভ্রান্তি নয়, ঐক্য মুজিব বাহিনীর মধ্যেও প্রশিক্ষণ ও সিলেবাস নিয়ে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। সেখানে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে যে সমস্ত বক্তব্য দেয়া হতাে তা নিয়ে ভারত সরকারের আপত্তি ছিল। এমনকি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ নিয়ে অনেক সময় সেনাবাহিনীর অধিনায়কদের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। আমরা লক্ষ্য করব, মুজিব বাহিনীর প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ সদস্য জাসদে ও গণবাহিনীতে যােগদান করেন। একটি যুদ্ধ বিধস্ত দেশে যেখানে প্রয়ােজন ছিল শৃংখলাবদ্ধভাবে সরকারকে সার্বিক সহযােগিতা করা তার বিপরীতে তারা যে সমস্ত হটকারী ও নাশকতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করে তার ফলে প্রতিবিপ্লবীদের হাত শক্তিশালী হয় । নয়াদিল্লী ৩ এপ্রিল, ১৯৭১। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাসভবনের তার সরকারী বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দেখা করতে গেলেন। তাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রথম প্রশ্নটি ছিল, ‘হয়ার ইজ শেখ মুজিব? তাজউদ্দীন সাহেব নিজেও জানতেন না বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোথায়! তারপরেও অত্যন্ত কৌশলে জবাব দিলেন, বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে সরকার গঠিত হয়েছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছি। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ যে আকস্মিকভাবে কথাটি বলেছেন এমনটি নয়। এর পূর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা হওয়ার আগেই ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, বিএসএফ-এর প্রধান রুস্তমজী, এবং মুখ্য সচিব জাদরেল বুরােক্রাট পি, এন, হাস্কারের সঙ্গে সরকার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে আলােচনা হয়েছিল। পি, এন হাস্কার সরকার গঠনের ওপর জোর দিয়েছিলেন। | বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সরকার গঠন ছিল একটি অতি আবশ্যকীয় শর্ত।

সে লক্ষ্যে তাজউদ্দীন আহমদ শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন না। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামকে বিষয়টি অবহিত করলে তার মানসপটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রেক্ষিতে সরকার গঠনের বিষয়টি উদিত হয়। কিন্তু কীভাবে সরকার গঠনের প্রাথমিক সনদ রচনা করা যায় তা ভাবতে গিয়ে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘােষণাপত্রের আলােকে বাংলাদেশের সরকার গঠনের শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি রচনায় হাত দেন। বিষয়টি আরাে জরুরি হয়ে পড়ে দিল্লী থেকে যখন তারা কলকাতায় ফিরে আসেন। পরিস্থিতি ছিল জটিল। হাজার হাজার শরণার্থী সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছে। তাদের আশ্রয়, খাদ্য বলতে কিছু নেই। ছিন্নমূল মানুষেরা তাদের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে হন্যে হয়ে খুঁজছিল। তরুণেরা এসেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার উন্মাদনা নিয়ে। তারা চায় অস্ত্র । চারদিকে এক জটিল অবস্থা। জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত। সরকার গঠনের বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বিভক্তি। সরকার গঠনে ভিন্নমত থাকলে স্বাধীনতার প্রশ্নে ছিল আপােসহীন ও একমত। স্বাধীনতা ঘােষিত হলেও স্বাধীনতাকে বাস্তবে রূপায়ণের আবশ্যকীয় শর্তসরকার গঠন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রকাশ্য ঘােষণা না থাকলেও সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ‘হাইকমান্ড” গঠিত হয়েছিল।

৮ এপ্রিল দিল্লী হতে তাজউদ্দীন আহমদ কলকাতায় ফিরে এলে ভবানীপুর এলাকার রাজেন্দ্র রােডের এক বাড়িতে তাকে ছেকে ধরা হয়। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম দিল্লীযাত্রা ও তৎপরবর্তী ঘটনাসমূহের আনুপর্বিক কর্মধারার খুঁটিনাটি বর্ণনা-উপস্থিত যুবনেতা এবং বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত আওয়ামী নেতৃত্বের কাছে অগ্রহণযােগ্য না হলেও আপত্তির মূল পয়েন্টটি ছিল তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের বিষয়টি বলতে গেলে ঐ বৈঠক আপত্তি, অভিযােগ এবং পারস্পরিক অবস্থানের টানাটানি ভেতরেই পরিসমাপ্তি ঘটে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীনকে খন্দকার মােশতাক কোননাক্রমেই মেনে নেয়নি। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম কর্তৃক খসড়াকৃত ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার সনদ বিখ্যাত আইনজীবী অশােক সেন দেখলেন এবং যা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কর্তৃক অনুমােদিত হয়। বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের চার নেতৃত্বে শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও তােফায়েল আহমেদ বাংলাদেশ সরকার গঠনের ক্ষেত্রে বিরােধিতা করে বিপ্লবী পরিষদ গঠনের পক্ষে অব্যাহত প্রয়াস চালিয়ে যান। ১০ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের প্রস্তাবিত বেতার ভাষণ যুবনেতাদের তীব্র চাপের সম্মুখীন হয়। আনুষ্ঠানিক সরকার গঠন, নির্দেশাবলী, সামরিক জোন ও কমান্ড গঠন সম্পর্কিত ভাষণটি আলাপ আলােচনার মাধ্যমে প্রচারিত হওয়া উচিত বলে তারা দাবি তােলেন। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পূর্ব পরিকল্পনা মােতাবেক ঐ চার যুবনেতার দ্বারা, গেরিলাবাহিনীর সদস্য রিকুট এবং মুজিববাহিনী গঠনের ক্ষমতা। সম্প্রসারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বাধা দেয়া সত্ত্বেও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি তা অনুমােদন করেন। ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার সনদ অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে উপস্থিত করা হয়। অন্যদিকে সামরিক অধিনায়কগণ যার যার অবস্থানে ক্ষুদে নৃপতি বনে যান। তাদের মধ্যে এ বােধটি কাজ করছিল এভাবে যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে এড়িয়ে তারাই যুদ্ধ ও সরকার পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবেন। বিশেষ করে মেজর জিয়াউর রহমানের মনােভাব ছিল বিপ্লবী পরিষদ গঠন করা।

যদিও খালেদ মােশাররফের মতামত ছিল ভিন্ন। যুদ্ধের প্রাথমিক উন্মাদনা ক্রমশ হ্রাস পেলে তারা এ বাস্তবতা উপলব্ধি করেন যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বে আইনানুগ সরকার গঠন জরুরি এবং তাদের নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য পােষণ করেই স্বাধীনতার লক্ষ্যে যুদ্ধ করতে হবে। | ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সরকার গঠিত হয় এবং ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের মুক্তাঞ্চলে এই সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে শপথ গ্রহণ করে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বৈদ্যনাথতলার নতুন নামকরণ করেন মুজিবনগর। শপথ অনুষ্ঠানের পরপরই অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে এই স্থানটিকে বাংলাদেশ সরকারের রাজধানী মুজিবনগর হিসেবে উল্লেখ করায় মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী এই সরকার মুজিবনগর সরকার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে সরকার পরিচালিত হতে থাকে কলকাতার থিয়েটার রােডের এক বাড়ি থেকে। যেহেতু পাকিস্তান সরকার প্রথম থেকেই বলে আসছিল ভারত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সহযােগিতা করছে, সেটাকে আড়াল করার জন্য এই সরকারের কর্মকাণ্ড ও নথিপত্র মুজিবনগর সরকারের নামেই পরিচালিত হতে থাকে। বাংলাদেশ সরকার নিজেকে কখনই প্রবাসী হিসেবে স্বীকার করেনি। শপথ অনুষ্ঠানের পরে ভারত সরকারের স্বীকৃতি চেয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্বপ্রথম যে পত্র এবং সংশ্লিষ্ট আইনানুগ দলিলাদি প্রেরণ করেন তার ঠিকানা ছিল মুজিবনগর। বাংলাদেশে মাটিতে বসে প্রতিবেশী ভারতীয় কূটনীতিকদের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতা প্রাপ্তির বিষয়টি চূড়ান্ত করা দুরূহ ছিল বলেই বঙ্গবন্ধু বৃটেনে এসংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা পূর্বেই সম্পন্ন করেন।

তার ফলশ্রুতিতে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করা সহজ হয়।ঢাকা থেকে প্রেরিত মার্কিন টপ সিক্রেট টেলিগ্রামে উল্লিখিত হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। দিল্লীতে ৪ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকারি বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎ হয়। ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম সাক্ষাৎকারে একথা বলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র এবং অন্যান্য সামরিক উপকরণ, সহযােগিতা এবং সংশ্লিষ্ট সাহায্যাদি প্রয়ােজন। পিএন, হাকসার, কে, রুস্তমজী ও গােলক মজুমদার প্রমুখ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিবর্গ সরকার গঠন প্রসঙ্গে তাজউদ্দীনের কাছে জানতে চান। সেজন্য তাজউদ্দীন সরকার গঠনের বিষয়ে পূর্বেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনার পর তাজউদ্দীন আহমেদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক প্রয়ােজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভব করেন। কারণ ইন্দিরা গান্ধীর কাছে তিনি নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন এবং ২৬ মার্চেই শেখ মুজিব হাইকমান্ডারদের নিয়ে সরকার গঠন করেছিলেন বলে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়েছিলেন। এই অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আনুষ্ঠানিক ঘোষণায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। ১০ এপ্রিল ১৯৭১ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্যগণ মুজিবনগরে গৃহীত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে বলা হয় “বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশে জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রধান করেন।

উক্ত ঘােষণায় আরাে বলা হয় “বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে,” “বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতােপূর্বে ঘােষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমােদন করা হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি থাকবেন, এবং রাষ্ট্রপতি প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং অন্যান্য মন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। নির্বাহী, আইন প্রণয়ন, করারােপ, অর্থব্যয়ন এবং বাংলাদেশের জনগণকে একটি নিয়মতান্ত্রিক ও ন্যায়ানুগ সরকার প্রদানের লক্ষ্যে প্রয়ােজনীয় অন্য সকল কার্য সম্পাদন করতে পারবেন। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার ঘােষণায় জাতিসংঘ সনদ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি প্রদান করা হয়। এই ঘােষণাকে কার্যকর করার জন্য ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ অনুষ্ঠিত হয়।  মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করলে কয়েকটি মূল বিষয় বেরিয়ে আসবে। এক. স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে কার্যক্রম | গ্রহণ; দুই. গেরিলা বাহিনী গড়ে তােলা ও সামরিক বাহিনীকে জোরদার করা;  তিন, কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি করা এবং পাকিস্তানে কর্তব্যরত কূটনীতিকদের বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্যে নিয়ে আসা; চার, জনগণের সরকার গঠনে কাঠামােতে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের আস্থা গ্রহণ এবং দায়িত্ব প্রদান; পাঁচ, সকল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক চক্রান্ত মােকাবেলা করে বন্দি মুজিবের মুক্তি ত্বরান্বিত করা। এই লক্ষ্যে জল, স্থল ও অন্তরীক্ষ অবরােধ করে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শােষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী সমৃদ্ধ, সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শশাষণহীন সমাজ কায়েমে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।”

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জনাব তাজউদ্দীন আহমদের প্রথম সরকারি নির্দেশের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁর প্রথম সরকারি নির্দেশ হলাে: | ‘স্বাধীন বাংলাদেশ আর তার সাড়ে সাত কোটি সন্তান আজ চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়ােজিত। এ সংগ্রামের সফলতার ওপর নির্ভর করছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির, আপনার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। আমাদের সংগ্রামে জয়লাভ করতেই হবে। এবং আমরা যে জয়লাভ করব তা অবধারিত। মনে রাখবেন আমরা এ যুদ্ধ চাইনি। বাঙালির মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরােধের মীমাংসা করতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি, শশাষকশ্রেণী ও রক্তপিপাসু পশুশক্তির মুখপাত্র ইয়াহিয়া-হামিদ-টিক্কা সে পথে না বাড়িয়ে বাঙালির পাট বেচা টাকায় গড়ে তােলা সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে আমাদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে। তারা নির্বিচারে খুন করছে আমাদের সন্তানদের, মা-বাপদের; ইজ্জত নষ্ট করছে মাবােনদের, আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম । তাই আমরা আজ পাল্টা হামলায় নিয়ােজিত হয়েছি। গঠন করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। এ সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হলাে বাংলাদেশকে শত্রু কবল হতে মুক্ত করা। বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামে ধর্ম, মত, শ্রেণী বা দল নেই। বাংলার মাটি, পানি ও আলাে বাতাসে লালিত-পালিত প্রতিটি মানুষের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি। আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের সেইভাবেই গ্রহণ করেছে। তাই তারা যখন কোথাও গুলি চালায়, শহর পােড়ায় বা গ্রাম ধ্বংস করে, তখন তারা আমাদের ধর্ম দেখে না, মতাদর্শ দেখে না-বাঙালি হিসেবেই আমাদেরকে মারে।

জুন-জুলাই মাসে বাংলাদেশ প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের বিষয়টি মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন প্রশাসনের তরফ হতে স্পষ্টতই প্রচারিত হতে থাকে। তাদের ভাষায় রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোেয় সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসন । রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে নীতিগত প্রেক্ষিতে ৬ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারদফা প্রস্তাব পেশ করেন। জাতির উদ্দেশে এক বেতার ভাষণে ১. বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আটক জনপ্রতিনিধিদের মুক্তি, ২. পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর প্রত্যাবর্তন ৩. স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি, ৪. বাংলাদেশ হতে অপহৃত সম্পদ ফেরত এবং পূর্ণ ক্ষতিপূরণ । মার্কিনীদের প্রস্তাবিত রাজনৈতিক ফর্মুলা নাকচ হয়ে যায়।

গণপরিষদের যুদ্ধকালীন অধিবেশন

১৯৭১ সালের ২০ জুন কলকাতায় ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের যুগ্মসচিব অশােক রায় যথাশীঘ্র বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে অনুরােধ করেন এবং অনাপত্তি না থাকলে ২৯ জুন নাগাদ মেঘালয় রাজ্যের তুরায় এই অধিবেশনের আয়ােজন করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। সময়ের স্বল্পতা ও যােগাযােগের অসুবিধার কথা বিবেচনা করে গণপরিষদের এই অধিবেশন ৬ ও ৭ জুলাই শিলিগুড়ির বাগডােগরায় অনুষ্ঠানের তারিখ ধার্য হয় । দেশের অভ্যন্তরে সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার উদ্দেশ্যে গৃহীত ব্যবস্থাদির ফললাভের আগেই নানা কারণে সন্দেহ, বিভক্তি, বিভ্রান্ত ও বিক্ষুব্ধ জনপ্রতিনিধিদের সম্মুখীন হওয়া প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তথা মন্ত্রিসভার জন্য সুখপ্রদ ছিল না। জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত প্রায় ৩১০ জন প্রতিনিধির এই অধিবেশনে নীতিগত, ব্যক্তিগত, পারস্পরিক, আঞ্চলিক অভিযােগ ও অপপ্রচারের স্রোতধারাই ছিল অধিক প্রবল। যুদ্ধ পরিচালনায় ত্রুটি-বিচ্যুতিও নিঃসন্দেহে ছিল সমালােচনার যােগ্য। এসব অভাব-অভিযোেগ ও ত্রুটি-বিচ্যুতিকে অবলম্বন করে কয়েকটি গ্রুপ উপদলীয় স্বার্থ উদ্ধারের জন্য মন্ত্রিসভার ব্যর্থতাকে সামনে এনেছিল, যার টার্গেট ছিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী । লক্ষ্য ছিল তাদের পদত্যাগ। আওয়ামী লীগের ভেতরে একটি গ্রুপ যারা মােশতাকের সঙ্গে ছিল এবং মােশতাক চক্রের বাইরে মিজান চৌধুরী, জহরুল ইসলামের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের যােগ্যতা এবং তার ক্ষমতা গ্রহণের বৈধতা নিয়ে নানা ধরনের প্রচারণা চলতে থাকে। কর্নেল ওসমানীর বিরুদ্ধেও জিয়ার নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর একাংশ এই মর্মে প্রচারণা চালাতে থাকে যে, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনায় তিনি অদক্ষ ও অক্ষম।

প্রচারণা ছিল মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে ভারতের মৌলিক অনীহা। কূটনৈতিক স্বীকৃতির প্রশ্নে তাদের নানা অজুহাত এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত ভারতের স্বীকৃতি লাভ করবে কিনা তা-ও ছিল সন্দেহজনক আলােচ্য বিষয়। এসবের পেছনে খন্দকার মােশতাক চক্র সূক্ষ্মভাবে প্রচার চালাচ্ছিল। প্রচার চালানাে হয় যে স্বাধীনতা চাও না বঙ্গবন্ধুকে চাও?’ ৬ জুলাই গণপরিষদে বিভিন্ন বক্তা জ্বালাময়ী বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, অস্ত্র সংকট, শরণার্থী সমস্যা এবং ভারতের স্বীকৃতি প্রদান সম্পর্কিত বিষয়গুলাে ব্যাপকভাবে তুলে ধরেন। দিনাজপুরের সর্বজনাব আব্দুর রহিম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মােজাফফর হােসেন, আমজাদ হােসেন, মােতাহার হােসেন তালুকদার, শাহ মাহাতাব এম,এন,পি, আবেদ আলী, শামসুল হক চৌধুরী, সিদ্দিকি হােসেন, আবুল হােসেন, তফিজ উদ্দিন আহমেদ, আব্দুল হাদি, আব্দুর রব বগা মিয়া, তালেব আলী, খােরশেদ আলম, হাসান আলী, ময়েজ উদ্দিন প্রমুখ জনপ্রতিনিধির একজোট হয়ে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার বাইরে মিজান চৌধুরী গণপরিষদের অধিবেশনে সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের পদত্যাগ দাবি করেন এই বলে যে, সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক প্রধানমন্ত্রী হলে গঠনতন্ত্র মােতাবেক তিনি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পদে বহাল থাকতে পারেন না এবং মুক্তিযুদ্ধ ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে বিষয়গত ও বস্তুগত দুর্বলতার প্রশ্ন উত্থাপন করেন।

এ সময়ে মঞ্চে হট্টগােল দেখা দেয় কিন্তু পরিষদ সদস্যদের হস্তক্ষেপে তা প্রশমিত হয়। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়ার পূর্বে গণপরিষদ সদস্যদের মতামত, সরকারের প্রতি তাদের আস্থা পরীক্ষা ও স্বাধীনতা অর্জন বিষয়ে তাদের প্রকৃত মনােভাব অবগত হওয়া ছিল জরুরি। ইন্দিরা গান্ধীর আসন্ন বিদেশ সফর, বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের অভ্যন্তরে নড়বড়ে অবস্থা, সেনাকাঠামােয় অস্তদ্বন্দ্ব, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক উপ-নির্বাচন ও রিফিউজি প্রত্যাবর্তনের পদক্ষেপ এবং আওয়ামী নেতৃত্বের উপদলীয় কোন্দল, কতিপয় গণপরিষদ সদস্যের পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তন ও আত্মসমর্পণ ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশয় সৃষ্টি করেছিল। এ খবরও ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তান হতে ‘৭০-এর নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান হতে যাচ্ছে। ভারত সরকারের কাছে এমনও প্রমাণ ছিল যে, সামরিক বাহিনীর, এমনকি জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের কতিপয় সদস্য পূর্ব। পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনে আগ্রহী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনফেডারেশন গঠনের কূটনৈতিক তৎপরতা তখনও অব্যাহত ছিল। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কার্যকর সামরিক ও রাজনৈতিক সর্বোপরি কূটনৈতিক সাহায্য প্রদানের ক্ষেত্রে ভারতকে সর্বদিক নতুন করে ঝালাই করে নিতে হয়। জাতীয় পরিষদের ১১০ জন ও প্রাদেশিক পরিষদের আনুমানিক ২০০ জন সংসদ সদস্য সেদিন গণপরিষদ অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। শপথ নেয়া হয়, শত্রুকে জলে, স্থলে ও অন্তরীক্ষে চিরদিনের মতাে পরাস্ত করেই স্বাধীনতা সমুন্নত রাখতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আত্মসমালােচনা করে বলেন, “আমরা যদি ভুল করে করে থাকি তবে দেশ স্বাধীন হলে আপনারা আমাদের বিচার করবেন এবং আপনাদের রায় মাথা পেতে নেব।’

‘পূর্ণ স্বাধীনতা ব্যতীত কোন কিছুই গ্রহণযােগ্য নয়।’ অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, আপনাদেরকে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যদি আমাদের নীতি ও আদর্শ থেকে কোনদিন বিচ্যুতি দেখেন, আপনারা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করবেন। কিন্তু বাংলার এই সংকট মুহূর্তে, জাতির স্বাধীনতার এই ক্রান্তিলগ্নে যেখানে শত শহীদের রক্তে ইতিহাস লেখা হয়েছে, আর যেখানে হাজার হাজার সৈনিক বন প্রান্তরে ইতিহাস লিখে চলেছে, সেই মুহূর্তে আর একবার আপনারা আস্থা স্থাপন করুন। তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু গ্রেফার হওয়ার মুহুর্তে স্বাধীনতা ঘােষণা দিয়েছেন। আমরা জানতাম বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেফার হন, তবে স্বাধীনতা ঘােষণা তিনি করেই যাবেন। আর এই স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম করে যেতে হবে। বিভিন্ন প্রচারণার জবাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দৃঢ়ভাবে ঘােষণা করেন, ভারত সরকার মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য করার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিংয়ের জন্য যে সব ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে তার ফল সঞ্চারের জন্য ৩-৪ মাস সময় প্রয়ােজন, এর জন্য অধৈর্য হয়ে পড়লে চলবে না। তার স্পষ্ট বক্তব্য ছিল ডিসেম্বরের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। গণপরিষদে প্রকাশ্যে আলােচনা ও পরবর্তীতে স্থির হয় সাবেক নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটি নয়, বরং সাবেক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিকেই অতঃপর দলের বৈধ নেতৃত্ব হিসেবে গণ্য করা হবে।

বিভ্রান্তি ও অনৈক্য সৃষ্টির নানা প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান এবং মন্ত্রিসভার সমর্থনে সর্বসম্মত আস্থা জ্ঞাপনের মাধ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের দৃঢ় প্রত্যয় উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। সার্বিক অর্থে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণপরিষদ অধিবেশনের তাৎপর্য ও গুরুত্ব ঐতিহাসিক। এই অধিবেশনের এক সপ্তাহের মধ্যে সেক্টর কমান্ডারগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুষ্ঠানিক আনুগত্য ও শপথ গ্রহণ করেন। শুরু হয় নব উদ্যমে যুদ্ধজয়ের গৌরবগাথা। অনেকেই বলে থাকেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের একটি গােপন চুক্তি হয় । কথাটি গুজব ও অসত্য। সে সম্পর্কে আলােকপাত করা প্রয়ােজন। অক্টোবর মাস ছিল বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাস। ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীনকে দিল্লী ডেকে পাঠান এবং একটি চুক্তি সম্পাদনের কথা বলেন। হাকসার তখন উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন বলেন, ভারতের নির্দেশে যে কোনাে প্রকার চুক্তি সম্পাদন করতে আমরা সম্মত। কিন্তু সারাবিশ্বের মানুষই বলবে, যেহেতু ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সর্বতােভাবে সাহায্য করছে এই চুক্তিটা। সেই কারণে চাপ প্রয়ােগ করে করিয়ে নিয়েছে। তাজউদ্দীনের এই কথার পর। হাকসার স্বীকার করেন যে, না কোন চুক্তি ভারতের বুকে সম্পাদন হতে পারে না। ইন্দিরা গান্ধী বললেন, ঠিক আছে স্বাধীনতার পরে চুক্তি সম্পাদিত হবে । সফরের কথা উল্লেখ করে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, এই সফরে শান্তিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করবেন। কিন্তু যদি আলােচনায় সুফল পাওয়া না যায় তখন ফিরে এসেই পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। চূড়ান্ত ব্যবস্থা গ্রহণের পক্ষে ইন্দিরা গান্ধী এই প্রথম সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখলেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে এই আলােচনার কথা তাজউদ্দীন শুধু কামরুজ্জামানকে বলেছিলেন, অন্যান্য কোনাে প্রধান সদস্যের কাছে পর্যন্ত প্রকাশ করেননি । সংগত কারণে একথা গােপন রাখার প্রয়ােজন ছিল।

দিল্লীতে তাজউদ্দীন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইন্দিরা গান্ধীর কাছে ‘র’-এর সমর্থনপুষ্ট হয়ে মুজিব বাহিনী যে উৎপাতের সৃষ্টি করেছে, তার উল্লেখ করেন। ইন্দিরা গান্ধী এই অবস্থায় দ্রুত সমাধানের জন্য ডি.পি ধরকে আদেশ দেন। ডি.পি.ধর মুজিব বাহিনীকে বাংলাদেশের কমান্ডের আওতায় আনার জন্য মেজর জেনারেল বিএন সরকারকে নিয়ােগ করেন। এই উদ্দেশ্যে কলকাতায় এক বৈঠকের আয়ােজন করা হয়। সেই বৈঠকে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাজউদ্দীন ও জেনারেল, ওসমানী যােগদান করেন কিন্তু মুজিব বাহিনীর পক্ষে তােফায়েল সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, শেখ ফজলুল হক মনি আমন্ত্রণ পত্র পাওয়া সত্ত্বেও উপস্থিত ছিলেন না এবং ভারতের সামরিক বাহিনীর পক্ষে মেজর জেনারেল সরকার এবং ব্রিগেডিয়ার উজ্জ্বল গুপ্ত উপস্থিত ছিলেন।  দিল্লীতে দু’দিন ডি.পি ধরের সঙ্গে কয়েক দফা আলােচনা করার পর তাজউদ্দীন কলকাতায় ফিরে আসেন। তাজউদ্দীন তখনও গভীরভাবে চিন্তা করছেন মুক্তিযােদ্ধাদের (মুজিব বাহিনীসহ) একটি জাতীয় কমান্ড ব্যবস্থার অধীনে আনতে হবে এবং যুদ্ধের পর মুক্তিযােদ্ধাদের নিরস্ত্রীকরণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলাে পর্যবেক্ষণ করে সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা আবশ্যক হবে।  ২০ অক্টোবর কলকাতায় আওয়ামী লীগ কার্যকরী কমিটির বৈঠক শুরু হয়। ২০-২০ অক্টোবর বৈঠক চলার পর ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি আমন্ত্রণে দিল্লী যাওয়ার কারণে সভা মুলতবি করা হয়। ২৭ ও ২৮ তারিখে মুলতবি সভা শুরু হয়। আওয়ামী লীগ কার্যকরী পরিষদের সভা ঘন ঘন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত বলে অনেকেই বক্তব্য রাখলেন। এই সভায় আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত এবং উপদলীয় সংঘাত সম্পর্কে অনেকেই আলােচনা করেন। তাছাড়া মুজিব বাহিনী গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলােচনা হয়।

তাজউদ্দীন বলেন বাংলাদেশ সরকার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এই মুজিব বাহিনীর নেতারা স্বাধীনতা যুদ্ধের চরম ক্ষতি করেছে। তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আপনারা সবাই অবহিত আছেন । ক্রমাগত এই কয়টি মাস এরা যেভাবে আমার বিরুদ্ধাচরণ করেছে তাতে ঘন ঘন কার্যকরী পরিষদের সভার আয়ােজন করা আমার বিরুদ্ধাচরণ করেছে তাতে ঘন ঘন কার্যকরী পরিষদের সভার আয়ােজন করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এরপর যারা বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলরদের মধ্যে তাজউদ্দীনের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করেছিলেন, তারা নিচুপ হয়ে যান, সভায় তাজউদ্দীনের কার্যক্রমের উপর কোনাে সমালােচনা না করে, তাকে সমর্থন করেন। ২৭ এবং ২৮ অক্টোবরের আলােচনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সরকারের উপর আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণ কতদূর সম্প্রসারিত করা যায়, তা নির্ধারণের দায়িত্ব কামরুজ্জামানের এক উপকমিটির হাতে অর্পিত হয়।

মুজিব বাহিনী

অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীনে সমগ্র বাঙালি জাতি ও মুক্তিবাহিনীর অকুতােভয় যােদ্ধারা যখন জীবনবাজি রেখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কামান আর মেশিন গানের মুখােমুখি যুদ্ধে রত; তখন গেরিলা যুদ্ধের বিশেষজ্ঞ জেনারেল ওবান অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের অজ্ঞাতে উত্তর ভারতের দেরাদুনের কাছাকাছি তানদুয়ায় গড়ে তুলতে থাকে মুজিব বাহিনী।

যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তাদান সংক্রান্ত বিষয়ে ভারত সরকার তিনিটি কমিটি গঠন করে। একটি রাজনৈতিক এবং অপর দুটি সামরিক। ভারত সরকার এবং অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে সেতুবন্ধের কাজ করে রাজনৈতিক কমিটি। এ কমিটির প্রধান করা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্লানিং কমিশনের চেয়ারম্যান ডি. পি ধরকে। অপরদিকে যুদ্ধ প্রস্তুতি সংক্রান্ত যুদ্ধ-কাউন্সিলের প্রধান করা হয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশকে। ডি. পি ধরকে যুদ্ধ কাউন্সিলেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জেনারেল মানেকশ সেনাবাহিনী উপপ্রধানকে চেয়ারম্যান করে আরেকটি কমিটি তৈরি করেন। সেটা যুগ্ম গােয়েন্দা কমিটি প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিনটি শাখার গােয়েন্দা বিভাগ সমন্বয়ে গঠিত হয় এই কমিটি। কিন্তু জেনারেল শ্যাম মানেকশই থাকেন চূড়ান্ত নির্দেশদানের অধিকর্তা। যুগা গােয়েন্দা কমিটি যুদ্ধ প্রস্তুতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী তরুণদের নিয়ে মুজিবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। জেনারেল শ্যাম মানেকশ নিজেই থাকেন এর সরাসরি তত্ত্বাবধানে। তাজউদ্দীন আহমদ হঠাৎ করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়ে বসায় বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের চার যুবনেতা। তাদের বিক্ষুব্ধতার সুযােগ নেয়া হলাে। যদিও তাদের সঙ্গে যােগাযোগ ছিল আগে থেকেই, অন্যভাবে। জেনারেল উবান তার যাবতীয় নিষ্ঠা প্রয়ােগে গড়ে তুলতে থাকেন মুজিব বাহিনী এবং তিনি এর গঠন প্রক্রিয়া এবং কার্যক্রমের জন্য দায়ী থাকেন সরাসরি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশর কাছে।

যেহেতু মেজর জেনারেল উবান মুজিব বাহিনীর ব্যাপারে দায়ী ছিলেন সরাসরি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেকশ এবং ‘র’-র ডিরেক্টর আর, এন কাওয়ের কাছে । অবশ্যি জেনারেল উবান তাকে ‘র’-এর ডিরেক্টর হিসেবে উলেখ করেননি তার ফ্যানটমস অব টিটাগাং ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ” বইয়ের কোথাও। জাবাবদিহি মাত্র দুজনের কাছে করতে হতাে বলেই তিনি নির্দ্বিধায় ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড-অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরােরার অজ্ঞাতে তার বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেদের পাঠাতে শুরু করেন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে । এতে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডে তৈরি হয়ে যায় দ্বৈত অধিনায়কত্ব। জেনারেল অরােরার কাছে সেটা গ্রহণযােগ্য হবার কথা নয় । তিনি সেনাবাহিনী সদর দফতরে চাপ প্রয়ােগ শুরু করেন মুজিব বাহিনীকে তার অধিনায়কত্বে ছেড়ে দিতে। তার অনবরত চাপে ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশনস লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে কে সিং মুজিব বাহিনীর তাৎপর্য সম্পর্কে তাকে অবহিত করেন। অপরদিকে তাজউদ্দীন আহমদ যখন মুজিব বাহিনীর অস্তিত্বের কথা জানতে পারেন, তখন তিনিও জেনারেল শ্যাম মানেকশকে অনুরােধ জানান এই বাহিনীকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীনে ছেড়ে দিতে । জেনারেল মানেকশ তাকে জানান যে, সেনাবাহিনীর বিশেষ দায়িত্ব সম্পাদনে তৈরি করা হয়েছে এই বাহিনী। কিন্তু কী সে দায়িত্ব সে সম্পর্কে তাজউদ্দীন আহমদকে তিনি কী বলেছিলেন, তা জানা যায় না। মুজিব বাহিনী সংগঠক জেনারেল উবান তার “ফ্যানটমস অব চিটাগাং ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ” গ্রন্থেও সে বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করেননি। মুজিবের রাজনীতির নামে সে বাহিনী পরিচালিত হবে উগ্র স্বাধীনতা বিরােধী সৈনিক বামপন্থী নির্মূলে। তবে মুজিব বাহিনী তৈরি করে ‘র’ যা করতে চেয়েছিল, কার্যক্ষেত্রে ঘটে যায় উল্টোটি। কারণ, খােদ মুজিব বাহিনীর ভেতরেই সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও বামপন্থী চিন্তাধারার অনুবর্তী ছিল শতকরা আশিভাগ | মুজিব বাহিনী কাদের নিয়ে গঠিত হয়, কী উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়, এ সবই এসেছে জেনারেল উবানের “ফ্যানটমস অব চিটাগং: ফিপথ আর্মি ইন বাংলাদেশ গ্রন্থে।

আব্দুর রাজ্জাক সাক্ষাৎকারে বলেন: “জায়গা মতাে যেয়ে দেখি যে, শেখ ফজলুল হক মণি ও তােফায়েল আহমেদ। সে জায়গাটা কলকাতায়; ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রােড; যেখানে চিত্তরঞ্জন সুতার বঙ্গবন্ধু রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। তিনি ভারত সরকারের সঙ্গে আলাপ করলেন। সেই আলাপের প্রেক্ষিতে একজন অফিসার আসেন। জেনারেল উবানই এসেছিলেন। সাক্ষাৎকারটি ঘটে ১৯৭১ সালের মে মাসের গােড়ার দিকে এবং চূড়ান্ত হয়ে যায় মুজিব বাহিনী তৈরির প্রক্রিয়া। আব্দুর রাজ্জাকের সাক্ষাৎকারেই আমরা দেখতে পাব চিত্তরঞ্জন সুতার এই চারজনকে তাজউদ্দীন আহমদের প্রধানমন্ত্রী হবার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঐক্যবদ্ধ করেন। যুবনেতা চতুষ্টয় মনে করতেন- যেহেতু আওয়ামী লীগের ভেতর ছাত্রলীগের তরুণরাই যােদ্ধা। আর তাদের নেতৃত্বে আছেন তারাই,-সেহেতু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব। দেবার কথা তাদেরই । মাঝখান দিয়ে প্রবাসী সরকার গঠন করে তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী হয়ে নেতৃত্ব নিজের হাতে তুলে নেবেন, এ তাদের মােটেই কাম্য ছিল। যুবনেতা চতুষ্টয় চিত্তরঞ্জন সুতারের এই আশ্বাসের প্রেক্ষিতেই তাজউদ্দীন। আহমদের প্রধানমন্ত্রিত্বের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব তােলেন। তাদের প্রস্তাব অনুযায়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করবে যুদ্ধ কাউন্সিল। কেননা, তাদের মতে, মুক্তিবাহিনীতে ঢুকে যাচ্ছে এমন সব লােক, যারা যুদ্ধে। অনাগ্রহী এবং পাকিস্তানপন্থী । অপরদিকে জেনারেল উবানের ভাষ্য অনুযায়ী বামপন্থী ও নকশালপন্থী নৈরাজ্যিকরা। বিকল্প হিসেবে নিজেদের নেতৃত্বে একটি সমান্তরাল বাহিনী গড়ে তােলার প্রচেষ্টায় নামলেন।

জেনারেল উবানের সঙ্গে চার যুব নেতার সাক্ষাতের দু’সপ্তাহের মাথায় মুজিব বাহিনীর প্রথম দলটি ভারতীয় মিলিটারি একাডেমি শহর দেরাদুন থেকে দেড় কিলােমিটার দূরে পাহাড় শীর্ষের শহর তানদুয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। প্রশিক্ষণ শুরু হয় ১৯৭১ সালের মে মাসের ২১ তারিখে। আরেকটি ট্রেনিং ক্যাম্প খােলা হয় মেঘালয়ের তুরার কাছাকাছি হাফলংয়ে। মাত্র একটি দলের ট্রেনিং শেষে এ ক্যাম্পটি তুলে দেয়া হয়। তানদুয়ার ট্রেনিং ক্যাম্পের মূল পরিকল্পক ও পরিচালক ছিলেন মেজর জেনারেল উবান। প্রথম দলটি, যার সংখ্যা ছিল ২৫০, তাদের ট্রেনিং দেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসাররা। ট্রেনিং শেষে এদের ভেতর থেকে ৮জনকে করা হয় প্রশিক্ষকা পরে প্রশিক্ষকের সংখ্যা বাড়ানােনা হয়। করা হয় বায়ান্নো। এরাই হাজারাে মুজিব বাহিনী সদস্যকে প্রশিক্ষণ দান করেন। ট্রেনিং প্রদান বন্ধ হয়ে যায় ২০ নভেম্বর, ১৯৭১। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের পরিচালনায় ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন ব্রিগেডিয়ার । আর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রধান হাসানুল হক ইনুর উর্বর্তন ছিলেন একজন ভারতীয় কর্নেল। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে অন্য অজয় অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর মালহােত্রা। মুজিব বাহিনীর অপারেশন পরিচালনার জন্য চ যুবনেতা বাংলাদেশকে চারটি সেক্টরে ভাগ করে নেন। বৃহত্তর রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, দিনাজপুর নিয়ে উত্তরাঞ্চলীয় সেক্টর, এর দায়িত্বে ছিলেন সিরাজুল আলম খান। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হলেন মনিরুল ইসলাম ওরফে মার্শাল মনি। বৃহত্তর খুলনা, যশাের, কুষ্টিয়া,ফরিদপুর, বরিশাল এবং পটুয়াখালী নিয়ে দক্ষিণাঞ্চলীয় সেক্টর, এর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি ছিলেন তােফায়েল আহমেদ। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম কুমিলা, নােয়াখালী, সিলেট এবং ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেক্টর। শেখ ফজলুল হক মণি ছিলেন এই সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি।

সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন আ স ম আবদুর রব ও আবদুল কুদ্দস মাখন। আর কেন্দ্রীয় সেক্টর ছিল বৃহত্তর ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা জেলার কিছু অংশ নিয়ে। সদর দফতর ছিল মেঘালয়ের ডালুতে। এই সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন আবদুর রাজ্জাক। সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ছিলেন সৈয়দ আহমদ। চার যুব নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, আবদুর রাজ্জাক ও ততাফায়েল আহমেদের ওপর ছিল মুজিব বাহিনীর কর্মী সংগ্রহের দায়িত্ব। ছাত্রলীগ কর্মী এবং শেখ মুজিবের কট্টর অনুসারী ছাড়া বাইরের কাউকে মুজিব বাহিনীতে নেয়ার ব্যাপারে তারা ছিলেন বিরােধী। মুজিব বাহিনীর জন্য ভারত সরকার প্রদত্ত অস্ত্রশস্ত্র এবং ব্যয় নির্বাহে আর্থিক সহায়তার সমন্বয় বিধান করতেন জেনারেল উবান। তার মাধ্যমেই অস্ত্রশস্ত্র এবং বাজেট অনুযায়ী অর্থ সরাসরি পেতেন চার। যুবনেতা । চার যুবনেতা পেতেন জেনারেলের মর্যাদা। যাতায়াতের জন্য প্রয়ােজনে পেতেন হেলিকপ্টার। তানদুয়ার ভারতীয় সেনা কর্তৃপক্ষ। প্রশিক্ষণে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বক্তব্যে না দিতে ভারতীয় কর্নেল নিয়ােগ করেন। প্রশিক্ষকরা দাবি তােলেন যে, সরাসরি দিল্লী থেকে নির্দেশ না আসা পর্যন্ত তারা সামরিক প্রশিক্ষণ দানের পাশাপাশি রাজনৈতিক বক্তৃতাও চালিয়ে যাবেন। কিন্তু কর্নেলের অনবরত চাপ অব্যাহত থাকে। প্রশিক্ষকরা বলেন, দিল্লী থেকে রাজনৈতিক বক্তৃতা প্রদানের অনুমতি যতদিন না আসছে ততদিন ট্রেনিং বন্ধ থাকবে। এ খবর দিল্লীতে পৌছাতে তানদুয়ায় ছুটে এলেন জেনারেল উবান। চার যুবনেতাও এলেন তার সঙ্গে। অচলাবস্থার নিরসন ঘটল। ট্রেনিং প্রদান আবার শুরু হয়। রাজনৈতিক বক্তৃতাও চলতে থাকে।

প্রশিক্ষকরা প্রশিক্ষণদান বন্ধ রাখেন মাত্র তিনদিন। ২০ নভেম্বর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়া হলেও প্রশিক্ষকদের ১ ডিসেম্বর আগে তানদুয়া থেকে ছাড়া হয় না। ১৩ আগস্ট মাসে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করা শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে নামার কোনাে পরিকল্পনা তাদের ছিল না। দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনা নিয়ে তারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আবদুর রাজ্জাক ও হাসানুল হক ইনু ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তারা ধাপে ধাপে এগোবার পরিকল্পনা নেন। এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি থানায় একজন কমান্ডারের অধীনে দশজন ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনী সদস্যের সমন্বয়ে একটি কমান্ড গঠন করা হয়। এছাড়া ছিল একজন রাজনৈতিক কমান্ডার। রাজনৈতিক মটিভেশন দানই ছিল তার কাজ। একই পদ্ধতিতে গঠন করা হয় জেলা কমান্ড। জেলাতেও ছিল রাজনৈতিক কমান্ডার।

থানা কমান্ড ও জেলা কমান্ড গঠিত হলেও যুদ্ধ বলতে যা বােঝায়, তা করেনি মুজিব বাহিনীর সদস্যরা। আবদুর রাজ্জাক বলেন, “আমরা জনগণের সঙ্গে মিলে। যুদ্ধ করছি। কিছু কিছু রাজাকারও খতম হচ্ছে। কিন্তু মূল জায়গাটা মানে পাকিস্তান আর্মির সামনে না পড়লে যুদ্ধ করছি না। দু’চার জায়গায় সামনে পড়ে গেছি, যুদ্ধ হয়েছে। আমরা তাে লড়াই শুরুই করিনি। পাঁচ বছরের প্রথম বছর কী করব, তৃতীয় এবং চতুর্থ বছরে কী করব, তারপর সরকার তৈরি করব-এই ছিল আমাদের সামগ্রিক পরিকল্পনা । আমরা যদি সফল হতাম তাহলে কোন আগাছা থাকতাে না। সমাজদেহ থেকে আগাছা উপড়ে ফেলতাম। প্রতিবিপ্লবীদের থাকতে হতাে না। হয়। মটিভেট হয়ে এদিকে আসতে হতাে, নইলে নিশ্চিহ্ন হতে হতাে।” এরই মধ্যে উগ্র চীনপন্থীদের স্বউদ্যেগে ট্রেনিং চলছিল। যুবনেতারা অভিযােগ করেন, কিছু এলাকা তরুণরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল। ইস্ট পাকিস্তান কমিউনিস্ট পাটি এম এল-এর এক গ্রুপের নেতা ছিলেন মােহাম্মদ তােয়াহা। তার তাত্ত্বিক দিক ছিল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এ যুদ্ধ ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও সােভিয়েত সাম্রাজ্যবাদের দ্বারা পরিচালিত। এই গ্রুপ রাঙ্গামাটি, নােয়াখালী জেলা হতে দশ হাজার লাল গেরিলা সংগ্রহ করেন যারা কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মাধ্যমে একটি এলাকা মুক্ত করবে। মুজিব বাহিনীর চার নেতা জেনারেল বলেন, আমাদের দেশের রুশপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিকে আমরা জানি এবং বুঝি। এরা শুধু কাগজেই আছে।

এবং আবার সক্রিয় করা হয়েছে। কিন্তু চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি কেন? জেনারেল ওবান অবাক হয়ে গেলেন। মুখ থেকে কোনাে কথা বের হলাে না। কিন্তু তিনি নিশ্চিত ও দেশের প্রশাসনে এমন কাউকে পাওয়া যাবে না, যিনি বাংলাদেশে চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করবেন। যুবনেতাদের। মতামত মিঃ আর এন কাওকে বলতে তিনি ওবানকে অবাক করে দিয়ে জানান যে, মওলানা ভাসানীর নকশালীরা বাস্তবিকই ট্রেনিং পাচ্ছে কোথাও কোথাও। মি. কাও বললেন: “বাংলাদেশ অস্থায়ী সরকারের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করিনি। তারা ভাসানীর অনুসারীদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি বড় রকমের শক্তি বলে মনে করেন। তাদের পরামর্শ আমরা উপেক্ষা করি কীভাবে । আপনার যুব নেতাদের গিয়ে বলুন, এদেরকে তারা যদি পছন্দ নাও করেন তবু সহ্য করতে হবে। আমরা তাদেরকে (মুজিব বাহিনী) সামগ্রিক পরিকল্পনার একটি অঙ্গ হিসেবে সমর্থন দেব-স্বতন্ত্র রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষ নয়। আমাদের সঙ্গে তারা একমত না হলে আমাদের করার কিছুই থাকবে না। এতে তারা যেখানে খুশি যেতে পারে অথবা যা। খুশি বলতে পারে, তাতে আমাদের কিছু আসবে যাবে না। কর্তৃপক্ষ তাদেরই সাহায্য করছে যারা বাংলাদেশের মুক্তির জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আর এদের সুপারিশ করেছে তাদেরই অস্থায়ী সরকার। জেনারেল ওবানের সামনে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ছিল তা হলাে, মুজিব বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর দায়িত্ব নির্ধারণ সম্পর্কিত। তিনি লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরােরার সঙ্গে কথাও বলেন। তিনি জানান, মুক্তিবাহিনী সীমান্তের বিশ মাইল পর্যন্ত আক্রমণ হানার দায়িত্বে থাকবে আর মুজিব বাহিনী যাবে অভ্যন্তরে।

যুব নেতারা এটাই চাইছিলেন। কিন্তু জেনারেল অরােরা চাইছিলেন তারা তার অধিনায়কত্বে থাকবে। অন্যদিকে যুবনেতারা এই প্রশ্নে তার সাথে একমত ছিলেন না। আরেকটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ছিল। সেটা বাংলাদেশের ভেতরে অনুপ্রবেশের পদ্ধতি সংক্রান্ত। মুজিব বাহিনীর ছেলেরা যে সকল এলাকা দিয়ে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করত যে সব পথ দিয়ে যাতায়াত করত এবং তাদের আস্তানা ও পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চান লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরােরা। সীমান্তে তাদের অনুপ্রবেশ এলাকা সম্পর্কে জানতে দেয়ার কোনো আপত্তি ছিল না যুবনেতাদের। কেননা, সেখানে অস্থানরত সেনাবাহিনী ইউনিটকে তাদের অনুপ্রবেশ অনুমতি দানের জন্য আগেভাগেই জানান দেয়া যেত। কিন্তু তাদের অনুপ্রবেশ করিডর, আস্তানা এবং পরিকল্পনা কোনাে কিছুই প্রকাশ করতে রাজি ছিলেন না তারা। কেননা, মুক্তিবাহিনী নেতাদের মধ্যে কিছু ব্যক্তির বিশ্বস্ততা সম্পর্কে তারা সন্দেহ পােষণ করতেন এবং তারা ছিল তাদের রাজনৈতিক শত্রু। সেনাবাহিনী স্থাপনাকেও ওইসব তথ্য তারা দিতে চান না। কারণ, মুক্তিবাহিনী তাদের অধিনায়কত্বে রয়েছে। তারা নিশ্চয়ই মুক্তিবাহিনীর কাছে সকল তথ্য পাচার করে দেবে।  বড় ধরনের ঝামেলা কাটিয়ে একটি আপােসমূলক সমাধান হলাে। মুজিব বাহিনীর নেতারা শুধু তাদের অনুপ্রবেশ এলাকা সম্পর্কে স্থানীয় সেনা ইউনিট কমান্ডারকে জানাবেন এবং তিনি তাদেরকে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দেবেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল কে, কে সিং (ডাইরেক্টর অব মিলিটারি অপারেশন্স) সেনাবাহিনী প্রধানের পক্ষ থেকে মুজিব বাহিনীর অধিনায়কত্ব ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে একটি স্পষ্ট নােট পাঠালেন জেনারেল অরােরার কাছে। এই বাহিনীর ওপর কী ধরনের কাজের অর্পিত দায়িত্ব, তাও উল্লেখ করলেন। নােট প্রদান সত্ত্বেও বিতর্ক অব্যাহত থাকে।”  জুলাই মাসে পেড়ালী গ্রামে আবদুল হকের চৈনিক গ্রুপ নেমে পড়ে শ্রেণী শত্রু খতমের নামে সাধারণ মানুষ হত্যায়। তাদের হত্যাকাণ্ড রােধের আবেদন নিয়ে ছুটে আসে স্থানীয় অধিবাসীরা। তাই মুক্তি ও মুজিববাহিনী যৌথ প্রতিরােধ বাহিনীকে নামতে হয় শ্রেণীশত্রু খতমকারীদের বিরুদ্ধে। অক্টোবর মাসে সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষায় তাদের উৎখাতে সফল অভিযান চালানাে হয়। তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদেরকে এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য করা হয়।”

আবদুর রাজ্জাক বরাবরই সিরাজুল আলম খান ও শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বাভিলাষী দ্বন্দ্বের মাঝে দাড়িয়ে মুজিব বাহিনী এবং ছাত্রলীগের পরস্পর বিরােধী দুই গ্রুপের ভেতর সেতুবন হিসেবে কাজ করে এসেছেন। পল্টন ময়দানে সিরাজুল আলম খান গ্রুপের সম্মেলনে মুজিব বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ যােগ দেয়। পল্টনসম্মেলনে মুজিব বাহিনীর বেশিরভাগ অংশ কেন যােগদান করল? আবদুর রাজ্জাককেই আবার স্মরণ করতে হয়: “তখন এমন অবস্থা হয়েছে, যুদ্ধ ফেরতা তরুণদের রক্ত টগবগ করছে। আর সেভাবে তাে বিপ্লবী সরকার হয়নি- একটা সাধারণ পার্লামেন্টারি সরকার সেখানেও কিছু গােলমাল শুরু হয়েছে। তখন ওই ছেলেদেরকে বােঝানাে সহজ হয়েছে যে, এদেরকে দিয়ে হবে না। ছেলেরা কিন্তু অত্যন্ত সাচা মনে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সমাজ বিপ্লব করার জন্য তৈরি হয়েছিল।১২ ভারত সরকার শেখ মুজিব ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্ভাব্য যে কোনাে প্রতিরােধ আন্দোলনে এবং জনগণ যদি সামরিক স্বৈরতন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয় তবে ভারত যোগ্য প্রতিবেশীর ভূমিকা পালন করবে বলে আশ্বস্ত করে। ১৯৭০এর আগস্টে যে ট্রেনিং শুরু হওয়ার কথা ছিল তারই সূত্র ধরে ‘৭১-এ বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট-বি, এল, এফ’কে ভারত যাবার আগেই কার্যকর করা হয়। বি,এল,এফ মুজিব বাহিনী নামে পরিবর্তিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে মেজর জেনারেল সুজন সিং ওবানের সহায়তায় ‘জনযুদ্ধের কৌশল অবলম্বন করে বি.এল.এফ সদস্যদের ‘গেরিলা ট্রেনিং দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ‘মাউন্টেন বাহিনী” নামে আরাে একটি বিশেষ বাহিনী জেনারেল ওবানের নেতৃত্বে গঠন করা হয়। তারা মিজোরামের দেমাগ্রীতে অবস্থান নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।”

মুজিব বাহিনীর অন্যতম নেতা জনাব আব্দুর রাজ্জাক পশ্চিমবাংলার বালুরঘাটে স্থাপিত কুরমাইল ক্যাম্পে আসতেন মুজিব বাহিনীর সদস্য রিক্রুটদের নেয়ার জন্য। তিনি কখনাে একটি বা দুটি ট্রাক নিয়ে আসতেন। কুরমাইল ক্যাম্পে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের রিকুট করার জন্য স্থায়ীভাবে থাকতে দিয়েছিলাম বগুড়ার মুস্তাফিজুর রহমান পটল যিনি ৭ নভেম্বর ৭৫ সালে এম.পি হােস্টেলে শহীদ হন। আর একজন ছিলেন বগুড়া ছাত্রলীগের সভাপতি আব্দুস সামাদ যিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুষ্কৃতদের হাতে নিহত হন। আব্দুর রাজ্জাক মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ইত্যাদি নিয়ে লেখকের সঙ্গে কথা বলতেন। তিনি স্বল্প সময় অবস্থান করতেন। একবার আমাকে বললেন যে, যেভাবে মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে দেশ স্বাধীন হলেও, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আরেকটি সামাজিক বিপ্লব অনিবার্য হয়ে পড়বে। সে লক্ষ্যে বাছাই করে মুজিব বাহিনী গঠন করা হচ্ছে। তবে লেখকের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে সে সময় মুক্তিবাহিনী ও মুজিব বাহিনীর মধ্যে এক অপ্রকাশিত দ্বন্দ্ব ছিল। কোথাও কোথাও মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের কাছে থেকে মুজিব বাহিনীর সদস্যরা অস্ত্র কেড়ে নিচ্ছে- এসব সংবাদ আসছিল। মুজিব বাহিনীর হাতে ছিল উন্নত ধরনের অস্ত্র। তাদের সেভাবেই প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে আমরা লক্ষ্য করব সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুজিব বাহিনীর প্রায় ৬০ ভাগ সদস্য জাসদে ও গণবাহিনীতে যােগদান করে। যেখানে সময়ের প্রয়ােজনে ঐক্যবদ্ধ স্থিতিশীলতা ও শৃংখলাবদ্ধ সহযােগিতা দরকার তার বিপরীতে তাদের হঠকারী সিদ্ধান্ত প্রতিবিপ্লবী শক্তির হাতকে শক্তিশালী করে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!