You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতা ঘােষণা

নবম অধ্যায়ে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে যে অহেতুক বিতর্ক সৃষ্টি করে জাতিকে বিভাজিত করা হয়েছে সে সম্পর্কে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে শুধুমাত্র তথ্য, উপাত্ত ও প্রকাশিত রিপােটিং-এর সূত্র নিয়ে এই অহেতুক বিভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা করা হয়েছে। পাঠকদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই এক দশক পর উত্থাপিত এই বিতর্কের উৎস কোথায়? প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকান্ডের পর পার্লামেন্টে এক শােক সভায় জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘােষক হিসাবে শােক প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় ১৯৮১ সালে। উথাপন করেন প্রধানময়ি শাহ আজিজুর রহমান। শাহ আজিজুর রহমানের পরিচয় কী? যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যখন লক্ষ লক্ষ বাঙালি স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিচ্ছেন, যখন মুক্তিবাহিনী চরম বৈরী অবস্থার ভিতরে মরণপন। যুদ্ধে লিপ্ত, বাংলাদেশের স্বাধীনতার লাল সূর্য যখন উষালন্সে তখন তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক জান্তার পক্ষ হয়ে জাতিসংঘে গমন করেন। এই স্বাধীনতাবিরােধী চিহ্নিত ব্যক্তিকে জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। তিনি বাঙালি জাতিকে বিভক্ত করার জন্য অত্যন্ত কৌশলে স্বাধীনতার ঘােষক হিসাবে জিয়ার নাম সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন। সেই থেকেই এই বিতর্ক। বর্তমান অধ্যায়ে যে বিষয়গুলাে তুলে ধরা হয়েছে সেগুলাে হলাে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের প্রেরিত গােয়েন্দা সংস্থার রিপাের্ট, ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ কর্তৃক লিখিত লিপি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের ২৬ তারিখে হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার তথ্য, পাকিস্তানের তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল টিকা খানের সাক্ষাৎকার, পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিকের বক্তব্য এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বিন্নি চ্যানেলে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কিত বাণী। এগুলাে পর্যালােচনা করলে বিতর্কের অবকাশ থাকে না।

প্রকৃতঅর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জনযুদ্ধ। ৭ মার্চের পর থেকেই সমগ্র জাতি শত্রুর মােকাবেলার জন্য গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে প্রস্তুত হয়েছিল। পাকিস্তান সামরিক আক্রমণ করার সাথে সাথে জনগণ প্রতিরােধ গড়ে তােলে। সংগ্রামী ছাত্র-জনতা ২৫ মার্চ রাত থেকেই প্রতিরােধ যুক র করে। কেউ ২৭ মার্চ ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করেনি। যে কোনাে গবেষক সঠিকভাবে গবেষণা করলেই এই সত্যটি বেরিয়ে আসবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে কেউ কেউ বিতর্ক উত্থাপনের অপচেষ্টা করেছেন। হতে পারেন তারা বিজ্ঞ, জ্ঞানী, ইতিহাসবিদ। কিংবা কেউ করেছেন তথ্যের অভাবে বা উদ্দেশ্যপ্রণােদিতভাবে। স্বাধীনতা ঘােষণা নিয়ে যে বিভ্রান্তি ছড়ানাে হয়েছে আশা করব এ অধ্যায়ের তথ্য ও উপাত্ত বিশ্লেষণে তা নিরসিত হবে। প্রথমেই আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে একথা পাঠকদের সঙ্গে তুলে ধরতে চাই যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন বা করেননি কিংবা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন এসবই ইতিহাস-অন্তর্গত। যা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। এই অধ্যায়ে যে তথ্য তুলে ধরা হবে তাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বাধীনতার ঘােষণা সম্পর্কে তথ্যগত ধারণা পরিদৃষ্ট হবে। বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতার প্রথম ঘােষক কে তা নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করা হয়। স্বাধীনতার দশ বছর পর পার্লামেন্টে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শােক প্রস্তাবে তাকে স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কাজটি করেছিলেন, যিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জাতিসংঘে লবি করেছিলেন, চিহ্নিত স্বাধীনতাবিরােধী শাহ আজিজুর রহমান- যাকে মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমান প্রধানমন্ত্রী বানিয়েছিলেন।

একজন স্বাধীনতাবিরােধী প্রখ্যাত ব্যক্তি স্বাধীনতার ঘােষণা সম্পর্কে জাতিকে বিভ্রান্ত করবে এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণাটি তার দলের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে যারা তার ঘনিষ্ঠ সহযােগী তাদেরকে দিয়ে না যাওয়াতে যে ফাঁক সৃষ্টি হয় তারই ফলে এই সন্দেহের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্য অন্বেষার চাইতে, ব্যক্তি, দলীয় স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। বিএনপি সরকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার প্রথম ঘােষক হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়। যদিও জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে এই দাবি করেননি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের প্রদত্ত রায়ে (রিট পিটিশন নং ২৫৭৭/২০০৯/ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও অন্যান্য) স্বীকৃত হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেন যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে দেশ ও বিদেশের গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়। সে রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণাটি প্রথম প্রকাশ করেন লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ও সানডে টেলিগ্রাফের সাউথ এশিয়ান করেসপনডেন্ট, নিবেদিত সাংবাদিক ডেভিড লােসাক। সে সময়ের বহুল প্রশংসিত তথ্য সম্বলিত “পাকিস্তান ক্রাইসিস” বইটি তিনি সমাপ্ত করেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯৭১-এ। বইটিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, “শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা ক্ষীণ কণ্ঠস্বরে কোনাে এক গুপ্ত রেডিও হতে ইথার তরঙ্গে পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি প্রচারিত হয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযােগ অফিসার মেজর সিদ্দিকী সালিক তার বহুল আলােচিত ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে বঙ্গবন্ধুর এ স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারণা সম্পর্কে উল্লিখিত ডেভিড লােসাকের বইটি হতে উদ্ধৃতি দেন। টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টের মাধ্যমে ইংরেজিতে রচিত ঘােষণাটি দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায় ।

দৈনিক আজাদী পত্রিকা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার ঘােষণাটি পেয়ে যায়। টেলিপ্রিন্টারের পাওয়া ঘােষণাটি, বাংলায় অনুবাদ করে আগ্রাবাদ বেতার কেন্দ্র হতে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা প্রদান করেন ২৬ মার্চ দুপুরে। দুপুরের প্রথম ঘােষণার পর। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বেলাল মােহাম্মদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে প্রথম ঘােষণাটি পাঠ করেন “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র হতে বলছি।” তার পরপর কয়েকজন স্বাধীনতা যুদ্ধের কথা ঘােষণা দেন। ২৭ মার্চ বেলাল মােহাম্মদের অনুরােধে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন। অবশ্য ঐ সন্ধ্যায় প্রথমে তিনি নিজেকে অস্থায়ী সরকারের প্রধান হিসেবে স্বাধীনতা ঘােষণা দেন। তার ঘােষণা প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর ড. এ. আর মল্লিক সাথে সাথে টেলিফোনে জিয়াকে বলেন, এটা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক যুদ্ধ বা বিদ্রোহ নয়। এটা স্বাধীনতা যুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর ঘােষণা প্রচারিত হয়েছে তার নামেই আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করছি।’ এ. কে খানও অনুরূপ মতামত জিয়াকে জানান, বঙ্গবন্ধুর নামে ঘােষণা দিতে। মেজর জিয়া বিষয়টি তাৎক্ষণিক অনুধাবন করে ভাষণটি সংশােধন করেন এবং বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতেই স্বাধীনতার ঘােষণা বারবার প্রচারিত হয়। কালুরঘাট থেকে প্রচারিত টেপ এই কথাই রেকর্ড করেছিল। কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীনতার বৈধ ঘােষক। ওয়্যারলেস মারফত যে তিনি সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘােষণা বার্তা পাঠান তাও উল্লিখিত তথ্য হতে জানা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলাে তিনি কেন দলের নেতৃবৃন্দের শত অনুরােধ সত্ত্বেও তাদের কাছে স্বাধীনতার ঘােষণা লিখিত বা টেপ করে দিতে রাজি হননি।

দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে ঘােষণা সম্পর্কে পূর্বাভাস পর্যন্ত দেননি বা তাকে এ সম্পর্কে কোনাে কিছু জানালেন না। টেপ রেকর্ডারেও কোনাে নির্দেশ দিতে রাজি হলেন না। আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার আগে স্বাধীনতার ঘােষণা দেশবাসী ও বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে পৌছে দেবার কথা ছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল তাতে তিনি সাড়া দিলেন না। ২৫ মার্চ রাতে তার বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদ যে লিখিত স্বাধীনতার ঘােষণা খসড়াটি নিয়ে আসেন তাতেও স্বাক্ষরদানে অপারগতা জানালেন রাষ্ট্রদ্রোহিতা এড়ানাের জন্য। ব্যাপারটি বিস্ময়কর। সারাজীবন যে মানুষটি স্বাধীনতার কথা বলে এসেছেন যথাসময়ে তিনি স্বাধীনতা দেবেন না, বা দেননি এটা অবিশ্বাস্য।  অথচ সে রাতে পাকিস্তান বাহিনী যে ক্র্যাক ডাউন করবে তা তিনি জানতেন । চারদিক থেকেই তখন এ সম্পর্কে ভয়াবহ খবর আসছিল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গােপনে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলে এই আশঙ্কা প্রায়ই সকলে করছিল। বঙ্গবন্ধুকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বা স্বাধীনতা ঘােষণায় রাজি করাতে না পেরে তাজউদ্দীন। আহমেদ অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ চিত্তে ও ভগ্ন হৃদয়ে বাড়ি ফিরেন। ‘মুজিব ভাই’ ছাড়া তিনিও ঘর থেকে বের হবেন না একথা বলে তিনি সে রাতে বাসায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জোর না করলে এবং তাকে সে রাতে উঠিয়ে না নিলে

তাজউদ্দীন আহমেদ বন্দি হতেন ৰা সম্ভবত নিহত হতেন। ফলে সুযােগ্য নেতৃত্বের অভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঠেলে দেয়া হতাে এক অনিশ্চিত, দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ পরিণতির দিকে। সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় কঠিন ও জটিল হয়ে দাঁড়াত। উল্লেখ্য, গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর লেখা বই How Pakistan Got Dividedএর উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়েব সূত্রে উল্লিখিত হয়েছে যে এই চরম বাঙালি ও হিন্দু বিদ্বেষী যুদ্ধাপরাধী জেনারেল বঙ্গবন্ধুর যতটা না সমালােচক ছিলেন, তার চাইতেও কঠোর মনােভাব পােষণ করতেন তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তিনিও ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের প্রধান শত্রু। তাজউদ্দীন আহমদ সে রাতে ধরা পড়লে তাকে যে বাঁচিয়ে রাখা হতাে না, তা বলা বাহুল্য। বঙ্গবন্ধু যে ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘােষণা করেন এ সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিক্রেট ডকুমেন্ট যা দীর্ঘ পঁচিশ বছর পর সাধারণ্যে প্রকাশিত হয়েছে তা পর্যালােচনা করা যেতে পারে। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরী কিসিঞ্জার নিক্সন বরাবর ২৬ তারিখে একটি মেমােরেন্ডাম পাঠান। হেনরি কিসিঞ্জার ২৬ মার্চের বিকল তিনটায় জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে একটি মিটিং আহ্বান করেন। মিটিংয়ের বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনকে দমন করার জন্য অগ্রসর হয়েছে। আমাদের দূতাবাস বিশ্বাস করে সামরিক বাহিনী সম্ভবত অধিকতর শক্তি নিয়ে ঢাকা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরকে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থন হবে। কিন্তু দীর্ঘকাল ধরে তারা এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে সমর্থ হবেন না। এজন্য অবিলম্বে আমাদের জন্য দুটি সমস্যা দেখা দিয়েছে।

১. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি ও বেসরকারি নাগরিকদের নিরাপত্তা এবং ২. শান্তিরক্ষা প্রচেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে ভূমিকা থাকবে কীনা? উক্ত আলােচনা বৈঠকে মার্কিন নাগরিকদের নিরাপত্তা, যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক শান্তিরক্ষা ভূমিকা এবং পূর্ব পাকিস্তানে রক্তপাত বন্ধের বিষয়ে আলােচনা হয়, ২. পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেমনভাবে সাড়া দিতে পারে। আমাদের কনসাল জেনারেলকে ওয়াশিংটনে এ ধরনের বিষয়ে সুনির্দিষ্টভাবে নির্দেশ না চাওয়ার জন্য বলা হয়েছে। তাদের মতামত ছিল, বিষয়টি হয়তাে কয়েকদিনের জন্য অস্পষ্ট থাকবে। যদি সামরিক বাহিনী শহরগুলােতে প্রতিরােধ ভেঙ্গে তারা স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে পারে, অন্যথা আমাদের সম্পর্কে দুই অংশেই সাড়া থাকবে। উক্ত মিটিং হেনরী কিসিঞ্জারের এক প্রশ্নের জবাবে সিআই-এ প্রধান রিচার্ড হেলমস বলেন, শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন।’ হেনরী কিসিঞ্জার তাকে বলেন, ‘শেখ মুজিব কি জীবিত বা মৃত?’ সিআইএ প্রধান বলেন, তিনি বন্দি এবং জীবিত । কিসিঞ্জার হাফ ছেড়ে বলেন, জীবিত মুজিবের চেয়ে মৃত মুজিব আরাে ভয়ংকর। অন্য একটি সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহে মার্কিন সপ্তম নৌবহর ভারত মহাসাগরে টহল দিচ্ছিল। সিলােনের পাশ দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। সে সময় উক্ত নৌবহর থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতার মেসেজটি হাই-ফ্রিকোয়েন্সির মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছিল যা সপ্তম নৌবাহিনীর শক্তিশালী নেটওয়ার্কে ধরা পড়ে।

সে সময়ও বিশ্বব্যাপী মার্কিন ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল এবং পৃথিবীর যে কোনাে জায়গা থেকে তারা তাদের নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়্যার মেসেজ রিসিভ করতে সক্ষম ছিল, একথা সিআইএ প্রধান রিচার্ড হেলমস বহু ক্ষেত্রে উল্লেখ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর পাঠাননা মেসেজটি তারা রিসিভ করেন ২৬ মার্চ ১৪.৩০ মিনিটে। এটি প্রস্তুত করেন মেজর জন, বি, হান্ট এবং প্রকাশ করেন জন, জে, প্যাভেলি । যিনি ইউএস নেভীর ক্যাপ্টেন ছিলেন। হােয়াইট হাউসের সিসিয়েশন রুম এটি গ্রহণ করে ২৬ তারিখ ৩.৫৫ মিনিটে। রিপাের্টটি ছিল ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি অপারেশনাল ইন্টেলিজেন্স ডিভিটন ডি আই-২, ডি আই এ স্পট রিপাের্ট। বিষয়: সিভিল ওয়ার ইন পাকিস্তান। রেফারেন্স: ১, অদ্য শেখ মুজিবুর রহমান দেশটির দুই অংশের মধ্যে পূর্বাংশকে গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হিসেবে যখন ঘােষণা করেন তখন গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। রিপাের্ট পাওয়া যাচ্ছে ঢাকাতে এবং দেশটির পূর্বাংশে যেখানে ১০ হাজার আধা-সামরিক বাহিনী পুলিশ ও প্রাইভেট নাগরিকগণ যা সংখ্যা প্রায় ২৩ হাজার পশ্চিম পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু করে। সমুদ্র এবং আকাশ পথে সেনাবাহিনীকে নিয়ে আসা হচ্ছে এবং ইসলামাবাদের দৃঢ় ইচ্ছা অনুসারে পাকিস্তানের সামরিক আইন শক্তি প্রয়ােগে উক্ত পাকিস্তান ইউনিয়নের অখণ্ডতা রক্ষা করার জন্য সংকল্পবদ্ধ। সম্ভবত তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে কারণ তাদের পজেস্টিক সাপাের্টের অসুবিধা রয়েছে কিন্তু তা ব্যাপক জীবননাশ ও ক্ষতিসাধনের পূর্বে নয়।

২. ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ইঙ্গিত দিয়েছে পাকিস্তানের এই গৃহযুদ্ধ তাদের দিকে টেনে নেবে না। যদিও পূর্ব পাকিস্তান তাদের সাহায্য চায়। কিন্তু তাদের ইচ্ছা শেষ পর্যন্ত বজায় থাকবে না যদি বাঙালি জাতীয়তাবাদের জ্বর তাদের সীমান্ত অতিক্রম করে। ৩. শেখ মুজিবুর রহমান যদি ইচ্ছা করত তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযােগিতা করতে পারত কিন্তু পর-রাষ্ট্রের বিষয়ে তার কমই আগ্রহ ছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের নিষ্ঠুর দমন শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বৈপ্লবিক হুমকির পথে নিয়ে যেতে পারে যা হবে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। এই সংকট ও সমস্যাদি মার্কিনীদের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই দৃশ্যমান হবে। এবং উভয়পক্ষ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সুবিধা মতাে বলিরপাঠা হিসেবে দেখবে।  এই রিপাের্টটি তাদের নিজস্ব ১৬টি সংস্থা ছাড়াও কলম্বাে, কাবুল, কাঠমন্ডু, ব্যাংকক, রেঙ্গুন, তেহরান, রােম, ম্যানিলা, খার্তুম দূতাবাসে প্রেরণ করা হয়। | এই রিপাের্টকে কেউ বানােয়াট বা নিজস্ব ভাষ্য হিসেবে বিবেচনা করলে তা হবে পাগলামির তুল্য। কোনো কোনাে গ্রন্থে সে যে কারাে লিখিত হােক কিংবা উপসেনাপ্রধান বা সেক্টর কমান্ডার যা-ই লিখুন না কেন, বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন এ সম্পর্কে বিতর্কের আর কোনাে অবকাশ থাকে না। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদের কাছে তার আগ বাড়ানাে চিরকুটে কিছু লেখেননি কিংবা তাদের এ সম্পর্কে রেকর্ড করেননি। তার অর্থ এই নয় যে তিনি স্বাধীনতা ঘােষণা দেননি বা মেসেজ পাঠাননি। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য কমপক্ষে ৪টি ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেল প্রস্তুত করেছিলেন এবং ব্যবহার করেছিলেন। এখানে কয়েকটি চ্যানেল-এর কথা তুলে ধরা হলাে।

ক. বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে জড়িত বা সে সম্পর্কে যারা আলােকপাত করতে পারবেন তাদের অনেকে বেঁচে নেই বা ইতিহাসে তাদের নাম ও কর্ম উল্লিখিত হয়নি। আওয়ামী লীগ দলের নেতৃবৃন্দের অগােচরে বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তার প্রমাণ হলাে শহীদ ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হককে তিনি ট্রান্সমিটার জোগাড় করতে বলেছিলেন। ট্রান্সমিটার বানানাের পারদর্শিতার জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে তমঘা-এ-ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি খুলনা থেকে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছে সে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন ২৫ মার্চ মধ্যাহ্নে পাকিস্তান আর্মি ২৯ মার্চ সকালে নূরুল হককে তার মহাখালির ওয়্যারলেস কলােনির বাসভবন হতে চিরতরে তুলে নিয়ে যায়। তারা তাঁর পুরাে বাড়ি সার্চ করে ট্রান্সমিটারের সন্ধানে স্বাধীনতার ঘােষণাটি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশরূপে উল্লেখ করেন, তা আগেই রেকর্ড করা ছিল বলে সাংবাদিক লােসাক মনে করেন। ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন (২৫ ও ২৬ এপ্রিল ২০১৪) যে বঙ্গবন্ধুর মতােই ভরাট গলার অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক হয়তাে বঙ্গবন্ধুর হয়ে রেডিওতে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন, যা অসম্ভব নয়। কিন্তু টিক্কা খান বলেছেন, স্বাধীনতা ঘােষণার কণ্ঠস্বর ছিল বঙ্গবন্ধুর যা তিনি ভালােভাবেই জানেন। , লেখক স্বয়ং হাজী গােলাম মোরশেদের সঙ্গে এই বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলােচনা করেছিলেন ১৯৯২ সালে মার্চ মাসে। তিনি পরবর্তীকালে এ সম্পর্কে একটি বই লিখেছেন। সেদিন তিনি যে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন ২৫ মার্চ রাত ১২টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে একটি টেলিফোন আসে। ফোন কলটি রিসিভ করেন তার পার্সোনাল এইড হাজী গােলাম মােরশেদ। বঙ্গবন্ধুর সাথে সে রাতে তিনিও গ্রেফতার হন এবং পাকিস্তান আর্মি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ফোন কলটি ছিল এরূপবলদা গার্ডেন থেকে বলছি ।

মেসেজ পাঠানাে হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব? বঙ্গবন্ধু হাজী গােলাম মােরশেদের মাধ্যমে উত্তর দিলেন, ‘মেশিনটা ভেঙ্গে চলে যেতে বল।”  গ. আহমেদ সেলিম রচিত ‘Blood Beaten Track” পুস্তকে স্বাধীনতা ঘােষণা সম্পর্কে তিনি নিম্নলিখিত ঘটনা বর্ণনা করেন: এক সাংবাদিক টিক্কা খানকে জিজ্ঞাস করেছিলেন, “আপনি শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন কেন?” টিক্কা খান জবাব দিয়েছিলেন, “আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি তিন ব্যান্ড রেডিও নিয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলেছিল, ‘স্যার শুনুন। শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘােষণা করছেন এবং আমি নিজে রেডিওর এক বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে সেই স্বাধীনতার ঘােষণা শুনি। আমি তার কণ্ঠস্বর চিনি। তাই তাকে গ্রেফতার করা ছাড়া আর কোনাে বিকল্প ছিল না।” প্রায় একই রকম ঘটনার বিবরণ প্রকাশ করেন মুসা সাদিক তার লিখিত মুক্তিযুদ্ধ হৃদয়ে মম” পুস্তকে। ১৯৮৮ সালে ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত সার্ক রাষ্ট্রপ্রধানদের শীর্ষ সম্মেলন উপলক্ষে তিনি তখন সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সাথে ইসলামাবাদে অবস্থান করছিলেন। ঐ সময়ে তিনি জেনারেল টিক্কা খানের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তার নিমলিখিত প্রশ্ন ও উত্তর নিমরূপ।

প্রশ্ন: স্যার আপনি কেন ধানমণ্ডির বাসা থেকে ২৬ মার্চ শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করেছিলেন?

উত্তর: জেনারেল টিক্কা মেরে কড়নে দেড়তে হুয়ে এক ব্রি ব্যান্ড রেডিও লা কর দিয়া আওর কাঁহা স্যার, সুনিয়ে, শেখ সাব আজাদী কা এলান কর রাহে হেঁয়। আওর মাইনে খােদ শেখ সাব কো রেডিও পর এক ফ্রিকোয়েন্সীছে Independence কা এলান করতে হুয়া সুনা। জিসকো বাগাওয়াত কাঁহা যা সেকতা হেয়। ঢুকে ম্যায়ে শেখ সাব কি আওয়াজ আছি তো পেহছান তা থা। And I had no option but to arrest him” (আমার কো-অর্ডিনেশন অফিসার একটি প্রি ব্যান্ড রেডিও এনে বললাে স্যার শুনুন, শেখ সাহেব স্বাধীনতা ঘােষণা করছেন। আমি নিজে রেডিওতে শেখ সাহেবকে স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে শুনলাম, কারণ শেখ সাহেবের কণ্ঠস্বর আমি ভালাে করেই চিনতাম। যে ঘােষণা তখন দেশদ্রোহিতার শামিল ছিল। সেক্ষেত্রে শেখ সাহেবকে গ্রেফতার করা ছাড়া আমার আর কোনাে বিকল্প ছিল না।) ঘ, সিদ্দিকি সালিক তার বইতে লিখেছেন, ২৬ মার্চ নরকের দরজা খুলে দেয়া হলাে। যখন প্রথম গুলির শব্দ শােনা গেল তথন রেডিও পাকিস্তানের ওয়েব লেন্থের কাছাকাছি শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠ শােনা গেল । এটা যথাযথ হতে পারে এবং মনে হলাে এটি একটি পূর্ব রেকর্ড করা মেসেজ।

যেখানে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা করেছিলেন। সিদ্দিকি সালিক আরাে লিখেছেন, ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয় স্বাধীনতা ঘােষণার পূর্ণ বিবরণ দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, “This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh, wherever you are and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.” ও, বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ঘােষণা দিয়েছিলেন সে প্রসঙ্গে প্রখ্যাত সাংবাদিক আতাউস সামাদ এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “২৫ মার্চ রাত পাকিস্তান আর্মি আক্রমণের যে প্রস্তুতি গ্রহণ করছে সেই সংবাদ দেয়ার জন্য তিনি ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে দেখা করতে যান। এর আগেই তিনি সাংবাদিক হিসেবে জানতেন ভুট্টো সাহেব বলেছেন, ‘তুম উধার ম্যায় ইধার’ তথনই শেখ সাহেব পরিষ্কার হয়ে গেছেন সংগ্রাম করেই অধিকার আদায় করতে হবে। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করতে হবে। সেজন্য শেখ সাহেব বললেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে’ ঘটনাটি প্ল্যান মতােই অগ্রসর হল ।

যে কারণে চট্টগ্রাম, যশাের, ব্রাক্ষণবাড়িয়া দেশের সর্বত্র স্থানীয় কমিটির নিয়ন্ত্রণে ও সহযােগিতায় যে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠেছিল সামরিক বাহিনীর লােকজন তাদের সাহায্য নিয়ে প্রতি আক্রমণের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। আতাউস সামাদ এসব বিষয়ে সম্পূর্ণ অবগত ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আপনি একটা কিছু করুন। আমি যখন ঘুরছি দরজার দিকে , তখন উনি আমার দিকে ফিরে মাথা নিচু করে, উনি তাে বেশ লম্বা ছিলেন, তাই আমার দিকে মাথা নিচু করে বললেন, যাতে আমি শুনতে পাই। বললেন, “আই হ্যাভ গিভেন ইউ ইনডিপেনডেন্স। নাউ গাে অ্যান্ড প্রিজার্ভ ইট।” আমি তােমাদের। স্বাধীনতা দিচ্ছি, এখন যাও সেটা রক্ষা করাে।” এই কথাটির মধ্যে ব্যাপক তাৎপর্য ছিল। যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু কাগজের টুকরায় স্বাধীনতার কথা লেখেননি তাদের উপলব্ধি করা উচিত নিশ্চয়ই পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এমন একটি ব্যবস্থা করেছিলেন যার মাধ্যমে যথাসময়ে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারিত হবে। আতাউস সামাদ দেখা করেছিলেন রাত আটটায় রাত আটটায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেননি। তাহলে তিনি কি করে। বললেন, আমি স্বাধীনতা দিচ্ছি তােমরা তা রক্ষা করাে। এ কথার অর্থ হলাে এই যে, স্বাধীনতা ঘােষণা তিনি বিভিন্নভাবে বিভিন্ন চ্যানেলে আগেই প্রস্তুত করে। রেখেছিলেন এবং এমনও হতে পারে যেমনটি টিক্কা খান বলেছেন বা সিদ্দিকি সালিক বলেছেন, পূর্বেই টেপ করেছিলেন। চ, বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, তিনি চট্টগ্রামে স্বাধীনতা ঘােষণার বাণী পৌছে। দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু প্রেরিত স্বাধীনতার ঘােষণাটি চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ নেতারা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে প্রাপ্ত হন এবং চট্টগ্রামে অবস্থিত সশস্ত্র বাহিনীর কাছে তা পেীছে দেন। ঢাকার ইপিআর পিলখানা তখন বেলুচ রেজিমেন্ট দখল করে নিয়েছে। পিলখানার ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘােষণা পাঠানাের যে পরিকল্পনা ছিল তা বাতিল হয়ে যায়। সেজন্য তিনি চট্টগ্রামে ঘােষণাটি প্রেরণ করেন। এটার বাংলা অনুবাদ করেছিলেন ড. মঞ্জুলা আনোয়ার। তিনি একজন ছাত্রকে দিয়ে ঘােষণাটি প্রচার করার জন্য আগ্রাবাদ রেডিও স্টেশনে পাঠিয়েছিলেন।

কিন্তু ছাত্রটি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পায়নি। পরবর্তীতে আগ্রাবাদ থেকে প্রথম বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান। কালুরঘাট বেতার থেকে ২৬ মার্চ আবুল কাশেম সন্দীপ, যিনি ফটিকছড়ি কলেজের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা পাঠ করেন। তিনি প্রথমবার পাঠ করেন ৭টা ৩০ মিনিটে এবং দ্বিতীয়বার পাঠ করেন ৭টা ৪৫ মিনিটে। অবশ্য আব্দুল হান্নান পাঠ করেছিলেন বেলা ২টার সময়। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করেন ২৭ মার্চ ৭.৪৫ মিনিট কালুরঘাট বেতারকেন্দ্রের সম্প্রচার ক্ষমতা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। কিন্তু সম্প্রতি তথ্যে দেখা যাচ্ছে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা চট্টগ্রাম বন্দরে নােঙর করা একটি জাপানী জাহাজ ধারণ করে এবং পরবর্তীতে রেডিও অস্ট্রেলিয়া থেকে তা প্রচার করা হয় এবং তারপরে বিবিসি লন্ডন থেকে প্রচারিত হয়। পরবর্তীকালে জার্মান রেডিওর সঙ্গে জিয়াউর রহমান এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘তিনি ২৭ তারিখে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচার করেছিলেন।

কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সেই সংকটময় দিনে পাঁচ দিন পর্যন্ত সম্প্রচার চালু ছিল। বর্তমান জরিপে দেখা যাচ্ছে, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা সারাবিশ্বে সপ্রচারিত হয় এবং বঙ্গবন্ধুর অরিজিনাল মেসেজটি কলকাতায় ধারণ করা হয় যা কালুরঘাট থেকে ২৬ মার্চ প্রচারিত করা হয়েছিল। প্রকাশিত ইংরেজি পত্রিকাগুলাে পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে, কীভাবে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষিত হয়েছিল এবং তা কীভাবে বিশ্বের গণমাধ্যমে রিপাের্ট হয়েছিল।

স্বাধীনতার প্রশ্নে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, আওয়ামী লীগ পরিকল্পনা করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর ও ঢাকা বিমানবন্দর দখল করে আমাকে ও আমার সহকর্মীদের গ্রেফতার করবে যা আজ প্রমাণিত । কিন্তু শেখ মুজিব জানতেন না পাকিস্তান সেনাবাহিনী অত্যন্ত ক্ষীপ্র গতিতে অভিযান চালাতে সক্ষম।” ইয়াহিয়া খান বলেন, “তিনি শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এতে আগ্রহী ছিলেন না। শেখ মুজিব দুটি পার্লামেন্ট, দুটি সংবিধান ও ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। শেখ মুজিব তাকে বলেন, তাঁর হাতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা দিতে হবে যাতে পূর্বাংশের বিচ্ছিন্নতাকে তিনি বৈধতা দান করতে পারেন। যখন এটা করতে ব্যর্থ হলেন তখন তিনি ভায়ােলেন্সে চলে গেলেন যা আমি বাধাগ্রস্ত করি। আমি যখন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত নেতাদের শেখ মুজিবকে অখণ্ড পাকিস্তানের আওতায় পার্লামেন্টে কাজ করার প্রস্তাব দিয়ে তাদেরকে শেখ মুজিবের কাছে পাঠাই, শেখ মুজিব তাদের নিরাশ করেন। তারা ব্যর্থ হয়ে চলে আসেন।” ইয়াহিয়া খানকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “যখন এটা পরিষ্কার হয়ে গেল যে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের আওতায় থাকতে ইচ্ছুক না এবং অখও পাকিস্তানকে ভাঙার জন্য উগ্রপন্থীরা তৎপর হয়ে উঠেছে সেক্ষেত্রে আমাকেই শক্তি প্রয়ােগের দিকেই অগ্রসর হতে হয়। বহুদিন থেকেই আওয়ামী লীগ প্রত্যেকটি এলাকায় ট্রেনিং শুরু করেছিল, সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেছিল, অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করেছিল এবং বিভিন্ন স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে তা মজুদ করছিল।

জগন্নাথ হলে মর্টার ও রিকোয়েললেস রাইফেল জমা করেছিল। ২৫ মার্চ রাতে যা সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল। রাস্তায় ব্যারিকেড সরাতে ৩ ঘণ্টা সময় লেগেছিল। এগুলাে সবই ছিল পরিকল্পিত। আওয়ামী লীগ ফ্যাসিস্ট কায়দায় আক্রমণ করে ক্ষমতা দখল করতে চেয়েছিল এবং প্রতিপক্ষকে হত্যা করতে বদ্ধপরিকর ছিল যা আজ পরিষ্কার । সকল তথ্য উপাত্ত থেকে প্রমাণিত হয় যে, ২৬ মার্চ জিরাে আওয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা স্বাধীন প্রজাতন্ত্র ঘােষণা করবে। প্রথমেই চট্টগ্রাম ও ঢাকা দখলে নেবে। সে সময় পূর্ব পাকিস্তানে ১৬ ব্যাটেলিয়ান সৈন্যের মধ্যে ১২ ব্যাটেলিয়ান ছিল। যার অধিকাংশই ভারতের অনুপ্রবেশকারীদের প্রতিহত করার জন্য বিভিন্ন জায়গায় পাঠানাে হয়েছিল। ইপিআর, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সহায়ক শক্তিগুলাে মর্টার, রিকোয়েললেস রাইফেলস ও ভারি এবং হালকা মেশিনগান নিয়ে বাইরে চলে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে যখন সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গেল তখন। সেনাবাহিনীকে তিনি তাদের কর্তব্য পালনে নির্দেশ দেন এবং সরকারের কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠার আদেশ জারি করেন।” ইয়াহিয়া খানকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, বর্তমান সংকট আজ হােক বা। কাল হােক অখণ্ড বাংলাদেশের দিকে চলে যাবে কিনা? তার উত্তরে ইয়াহিয়া বলেন, “তারা দুইবার গণরায় দিয়েছে, ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জনের সময় বাংলা ভাগ হয়েছে এবং হিন্দুদের শােষণ থেকে অব্যাহতির জন্য ১৯৪৭ সালে প্রতিনিধি নির্বাচন করে ভারত বিভক্ত করেছে। ইয়াহিয়া খানের এই উক্তির মধ্যে প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত ছিল এবছর তারা আর একবার বিচ্ছিন্ন হবার চেষ্টা করবে। 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্য একটি সূত্র বলছে, বঙ্গবন্ধু একতরফা স্বাধীনতা ঘােষণা করায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ উত্থাপন করে গণমাধ্যমে ভাষণ দিয়েছেন।” ২৬ তারিখের মার্কিন গােপন নথি থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সৈন্য সংখ্যা বন্দর ও বিমানে সৈন্য প্রেরণ ও বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা সম্পর্কে যে তথ্য লিখিত আছে তা থেকে অবগত হওয়া যায়।“বাঙালি সশস্ত্রবাহিনী ও জনগণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যৌথভাবে প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। যদিও সম্মুখ যুদ্ধে পেরে উঠছিল না। তবে তাদের প্রেরণা জোগাচ্ছে শেখ মুজিব। জিয়াউর রহমানের বিদ্রোহ। চট্টগ্রামে যুদ্ধরত ইপিআর ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে এসে ভাষণ দেয়ার জন্য অনেকেই অনুরােধ করেন। কিন্তু যেহেতু তিনি যুদ্ধ কমাতে ছিলেন সেহেতু তিনি রণাঙ্গন ফেলে কালুরঘাটে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। বেতার কর্মীদের ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গমন করেন। প্রথম ভাষণে তিনি নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান ও সর্বাধিনায়ক উল্লেখ করে যে ঐতিহাসিক মহাভ্রাপ্তি করেছিলেন, পরক্ষণেই তিনি তা শুধরে নেন এবং মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রদান করেন। জিয়ার প্রথম ভাষণটি দ্রুত পরিবর্তন করে দ্বিতীয় ভাষণটি শুদ্ধরূপে দেয়ার ফলে ঐতিহাসিকভাবে কয়েকটি বিষয় থেকে জাতি নিষ্কৃতি পায়। সচেতন পাঠক মাত্রই অবগত আছেন ৭০ সালে নাইজেরিয়ার একটি প্রদেশ বায়াফ্রাকে স্বাধীন করার জন্য জেনারেল ওজুকু স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। জেনারেল ওজু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘােষণাকে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যায়িত করে কেন্দ্রীয় সরকার জেনারেল প্রেসিডেন্ট গাউন কঠোর হস্তে তা দমন করেন। এ সময় বায়াফ্রার বিদ্রোহী নেতা ওজুকু প্রতিবেশী দেশ আইভরিকোস্টে আশ্রয় নেন এই ভেবে যে সেখান থেকে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। কিন্তু পরবর্তীতে আইভরিকোস্টের সরকার তাকে এই শর্তে আশ্রয় দেয় যে, তিনি সেখান থেকে কোনাে সশস্ত্র গৃহযুদ্ধ পরিচালনা করতে পারবেন না।

এ সময় বায়াফ্রায় অবস্থানরত বিদ্রোহীরা ব্যাপক বিশৃঙ্খলা, লুটতরাজে লিপ্ত হয়। বিদ্রোহেদশ লাখ লােক নিহত হয়। চারদিকে দুর্ভিক্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এটা ছিল ‘সেনাবিদ্রোহ’। সেজন্য পৃথিবীর কোনাে দেশ তাদের সহযােগিতা করেননি। জিয়াউর রহমান সেনাবিদ্রোহ’-এর ঘােষণা দিয়েছিলেন। যার পরিণতি দাঁড়াত ইতিহাস নির্ধারিত বায়ার মতাে। জিয়াউর রহমান নিজেই বলেছেন সােয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র নামাতে যাওয়ার পথে যখন জানতে পারলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি সশস্ত্রবাহিনীকে আক্রমণ করেছে এবং তাকেও হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং ই পি আর সি-তে ব্যাপক বাঙালি সৈন্যদের হত্যা করেছে তখন তিনি তার অধিনায়ক রশিদ জানজুয়াকে বন্দি করেন। এবং তাকে হত্যা করেন। ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা সদস্যদের মার্চ-এপ্রিল মাসে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলির নির্দেশ দেয়া হয়। তাদের হাতে তেমন অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। তাদের একটি বিরাট অংশ পশ্চিম পাকিস্তানে গমন করে। আধুনিক, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ও জনবলের অপ্রতুলতা এই ইউনিটের পক্ষে প্রতিরোধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা ছিল কঠিন। ফলে পাক বাহিনীর হামলার আশংকায় জিয়াউর রহমান ২৬ মার্চ সকাল সাতটায় তার সঙ্গে থাকা মাত্র দু’শর মতাে সৈন্য নিয়ে পটিয়ায় গমন করেন এবং ঐ সময় ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন রফিকের ভাষ্যমতে জানা যায়, জিয়াউর রহমান ঐ সময় চট্টগ্রাম থেকে রিট্রিট না করে তার সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করলে বাংলাদেশের যুদ্ধইতিহাসের চিত্র হতাে ভিন্ন।

পরের দিন ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ ও বেতার কর্মীদের অনুরােধে কালুরঘাট বেতারে এসে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা দেন। জিয়াউর রহমানের এই ঘােষণাকে যারা অস্বীকার করতে চাই তাদের একটি কথা বিস্মৃত হওয়া উচিত নয় যে, যদিও তার ভাষণ দেবার বৈধ অধিকার ছিল না তবুও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার স্বাধীনতা ঘােষণাটিতে বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছিলেন সে কথাটি স্পষ্টভাবে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ আছে এবং থাকবে। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণার কোনাে সাংবিধানিক, আইনিক বৈধতা ছিল না ঠিক কিন্তু ঐতিহাসিক অনিবার্যতায় এক বিশেষ ক্রান্তিলগ্নে তিনি বঙ্গবন্ধুর পক্ষে তার স্বাধীনতা ঘােষণা ঐতিহাসিক সংশ্লিষ্টতায় সংলগ্ন রয়েছেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে মহান মুক্তিযুদ্ধে কতিপয় ব্যতিক্রম ব্যতীত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকিস্তান হানাদার বাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ার আগে তেমন কেউ স্বউদ্যোগে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। যখন আক্রান্ত হয়েছেন কেবল তখন মাত্র তারা বিদ্রোহ করেছেন। 

কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে স্বাধীনতা ঘােষণা প্রচার করেছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেমন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা ২৬ মার্চ পেয়েছিলেন তেমনি ব্রিটেনের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ অনুরূপ একটি ঘােষণার কথা দীর্ঘ ২৫ বছর পর হলেও স্বহস্তে স্বাক্ষরিত একটি লিপিতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, “২৬ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করেন।”

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!