You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৭শে জানুয়ারী, রবিবার, ১৯৭৪, ১৩ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

শান্তির বাস্তব শর্ত : বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী

গতকাল ছাব্বিশে জানুয়ারী ছিল ভারত প্রজাতন্ত্রের ২৪তম বার্ষিকী। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী তিনটি পৃথক বাণী প্রেরণ করেছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব মোহাম্মদ উল্লাহ ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি.পি. গিরির কাছে প্রেরিত বাণীতে বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বর্তমান মৈত্রী বন্ধন এবং সহযোগিতা আগামী বৎসরগুলোতে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রেরিত এক বাণীতে বলেছেন, আমাদের দু’টি দেশ দু’টি সরকারের মধ্যকার বর্তমান গভীর বন্ধুত্ব ও সমঝোতা উপমহাদেশে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি এবং আমাদের দু’টি জাতির কল্যাণ ও স্বার্থের জন্যে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হয়ে থাকবে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডঃ কামাল হোসেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের কাছে প্রেরিত এক অভিনন্দন বাণীতে বলেছেন, শান্তির আদর্শের ভিত্তিতে গড়ে উঠা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার বর্তমান বন্ধুত্ব ভবিষ্যতে আরো জোরদার হয়ে উঠবে।
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারতীয় জনগণের কল্যাণ ও শান্তির জন্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর মহান প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করেছেন। ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের মৈত্রী বন্ধনের নতুন মূল্যায়নের অবকাশ রয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা আজ এক পরীক্ষিত সত্যে পরিণত হয়েছে। ভারতে সমস্যা আছে, দারিদ্র্য আছে, এবং আরো নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা আছে। তবুও ভারত আজ শান্তির স্বার্থে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ভারতের নানাবিধ সমস্যা থাকা সত্ত্বেও ভারত বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে পরম বন্ধুর মতো সহযোগিতা ও সাহায্যের কল্যাণ হস্ত সম্প্রসারিত করেছিল। বাঙালী জাতির অস্তিত্ব মুছে দেয়ার জন্যে যখন পাক-হানাদার বাহিনী বাংলার নিরীহ মানুষের উপর পাশবিক শক্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তখন ভারত বাংলাদেশের কোটি কোটি বাস্তুহারাদের আশ্রয় দিয়েছিল। শরণার্থীদের মুখে জুগিয়েছিল দু’মুঠো অন্ন। মুক্তিসেনাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ভারতীয় জওয়ানরা পাকিস্তানী সামরিক জান্তার অক্টোপাশ থেকে বাঙালী জাতিকে মুক্ত করার জন্যে দৃপ্ত পদক্ষেপে এসেছিল এগিয়ে। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পরও ভারত বাংলাদেশের প্রতি সাহায্য ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। ভবিষ্যতেও ভারত এবং বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কারণ, দু’টি দেশই পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে শান্তির পথে ক্রম অগ্রসরমান। ভারত আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের মতোই জোটনিরপেক্ষ নীতি অনুসরণ করে। সাংস্কৃতিক দিক দিয়েও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ঐতিহ্যগত সুসম্পর্ক বিদ্যমান। উপমহাদেশে শান্তির বাস্তব পদক্ষেপ হিসেবে ভারত ও বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এক দুর্লভ দৃষ্টান্ত। আমাদের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রেরিত বাণী থেকে সেই সত্যই প্রতিভাত হয়ে উঠেছে। ভারতীয় প্রজাতন্ত্র দিবসে আমরা ভারতের জনগণের সার্বিক মঙ্গলা-মঙ্গল, সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করি। বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হোক।

ঘরের বিভীষণ ঠেকাও

আবার সেই ভয়াবহ আগুন। পাটের গুদামে দুঃসহ আগুনের তীব্র লেলিহান শিখা। আকাশ বাতাস জলসিয়ে আগুনের সর্বগ্রাসী ও মহা-বিধ্বংসী তান্ডবলীলা।
এবারও অকুস্থল বাংলাদেশের সেই অন্যতম বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র শিল্প এলাকা নারায়ণগঞ্জ শহর। শুধু গুদাম আলাদা।
এবারের শিকার খানপুরস্থ কুমুদীনি ওয়েল ফেয়ার ট্রাস্টের ২৮টি গুদামের মধ্যে সর্ববৃহৎ ৮টি গুদামের গুদামজাত পাট। ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৪ কোটি টাকা।
এবার নিয়ে গত ১৬ই অক্টোবর থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের পাটের গুদামে মোট সাত সাতটি ভয়ংকর অগ্নি তান্ডবলীলা ঘটে গেলো। সর্বমোট ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি টাকা।
ক্ষতির পরিমাণ যাই হোক, এসব অগ্নিকান্ডকে আর নিছক আকস্মিক দুর্ঘটনা বলে কিছুতেই পরিগণনা করা চলেনা। বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আজ এ কথা একেবারে সুস্পষ্ট যে, এসব অগ্নিকান্ড রীতিমতো বাংলা ও বাংলার স্বাধীনতাবিরোধী এক সংঘবদ্ধ দলের সুপরিকল্পিত সাবোটাজ বা নাশকতামূলক কাজ।
আমাদের সবচেয়ে আশ্চর্য লাগছে শুধু এই ভেবে যে, এমন অব্যাহত গতিতে একটার পর একটা পাটের গুদামে আগুন লাগছে, বা বাংলা ও বাঙালীর শত্রুরা এভাবে আগুন লাগিয়ে কোটি কোটি টাকার জাতীয় সম্পদ নষ্ট করে দিব্যি লোক-চক্ষুর আড়ালে নিজেদের নিরাপদ রেখে অন্যান্য নাশকতামূলক কাজ বা কর্মতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, প্রতিদিন বিভিন্ন সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় এসব সম্পর্কে কতো রকমের সংবাদ বা সম্পাদকীয় নিবন্ধও প্রকাশিত হচ্ছে। তবুও কেন সামান্য কয়েকজন দুষ্কৃতিকারী ও দেশের শত্রুকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি জাগ্রত জনতা কিছুতেই স্তব্ধ করতে পারছেনা?
তবে কি, আমরা আমাদের এ সব শত্রুকে সত্যিই চিহ্নিত করতে পারছিনা? তবে কি, এসব শত্রু আমাদেরি ঘরের বিভীষণ? তবে কি, আমাদের কর্তৃপক্ষের এসব নাশকতা বন্ধ করার ব্যাপারে গৃহীত পূর্ব সাবধানতা বা বিধিব্যবস্থা মোটেই পর্যাপ্ত বা যথাযোগ্য নয়? তবে কি, আমরা কবি কালিদাসের সেই প্রাথমিক নিবুর্দ্ধিতার অভিশাপ থেকে আজো মুক্ত নই? মনে হয়, সবই সত্যি। তা’ না হ’লে কখনোই এমনটি হয়না।
তাই, প্রথমেই আমাদের সজাগ হতে হবে আমাদের ঘরের বিভীষণকে চিহ্নিত করতে। ব্যক্তি স্বার্থ পরিহারে দানবীর হাতেমের মতো বিশাল-হৃদয় হতে হবে।
দেশের প্রত্যেকটি লোককে বুঝতে হবে, যারা আমাদের পাটের গুদামে বা কাপড়ের বাজারে আগুন লাগাচ্ছে, যারা লঞ্চ-ট্রেন-বাসে ডাকাতি করে আমাদের গরীব ও নিঃস্ব মানুষের সর্বস্ব লুটে নিচ্ছে, যারা আমাদের উৎপাদন-যন্ত্র বন্ধ রাখার ইন্ধন যোগাচ্ছে, তারা কিছুতেই আমাদের দেশের মানুষ নয়। এদের ধরতে ও ধরিয়ে দিতে হবে।
সবচেয়ে বড় কথা, এসব সাবোটাজ কোনো ব্যক্তি বিশেষের কোনো অলস ও অহেতুক পরিকল্পনা নয়, রীতিমতো সংঘবদ্ধ আন্তর্জাতিক ও দেশী চক্রান্তের সুপরিকল্পিত নাশকতামূলক কাজ।
সুতরাং একে সামান্য এক প্রশাসনিক গুরুত্ব দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলে চলবেনা, বরং সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও জাতীয় গুরুত্ব আরোপ করে একে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ করতে সরকার ও জনসাধারণকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রসঙ্গতঃ, পাটের গুদামে আগুন লাগার পেছনে কয়েকটি দুর্নীতি ও ব্যক্তি স্বার্থের কথা উল্লেখ করা যায়।
বিভিন্ন আগুন লাগার পেছনে আমরা প্রায়ই শুধুমাত্র বৈদেশিক চক্রান্তকেই বড় করে দেখি। অথচ, এর মধ্যে আমাদের নিজেদেরও অতি জানা শোনা লোকও যে কিভাবে সক্রিয় আছে, তা’ প্রায়ই বিস্মৃত হই।
ফলে, অদেখা, অদৃশ ‘মিঃ নোবডি’কে খুঁজতে গিয়ে আমরা ক’দিন হন্যে হয়ে পরে পথ-শ্রান্তির স্বাভাবিক কারণে পুরনো সমস্যা ভুলে আবার নতুন সমস্যায় কর্মভারাক্রান্ত হই। আর এভাবেই আমাদের কোনো সমস্যারই কোনো সুসমাধান হয়ে উঠছেনা। এক অনিশ্চিত অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে আমরা ধুকে ধুকে এগিয়ে চলেছি।
গত বছর আমাদের দেশে সংঘটিত বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের কথাই বলা যাক। অনেক ঘটা করে এসব অগ্নিকান্ডের উপযুক্ত তদন্ত ও ব্যবস্থার জন্য কঠোর সরকারী নির্দেশ হয়। অথচ সে তদন্তের ফলে কি পাওয়া গেছে, কিম্বা অপরাধীর কতটুকু শাস্তি হয়েছে। কিম্বা ভবিষ্যতের বিরুদ্ধে কতটুকু ব্যবসা নেয়া হয়েছে তা আজো দেশের মানুষ জানেনা।
কেউ কেউ মনে করেন, এসব অগ্নিকান্ডের পেছনে বিভিন্ন বীমা কোম্পানী, পাট সংস্থা, মিল, পুলিশ, দমকল বাহিনী ও অন্যান্য অসাধু মহলের ব্যক্তি স্বার্থ বিজড়িত অদৃশ্য কালো কুটিল হাতও আছে। সুতরাং বিদেশী চক্রান্তকে খোঁজার অহেতুক হৈ-চৈ না চালিয়ে আগে ঘরের বিভীষণকে চিহ্নিত করে এসব দুর্নীতি চিরতরে বন্ধ করার ব্যবস্থা নিতে অতন্দ্র প্রহরীরর মতো বেরিকেড, বেয়নেট আর বেড়াজাল নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
তা’ না হলে কোনো দিনও এ সমস্যার সমাধান সম্ভব হবেনা। কারণ, ইতিহাসই বলে বিভীষণ না হলে কোনোদিনও লক্ষণের পক্ষে রক্ষোপুরে প্রবেশ করে রাবণ হত্যা সম্ভব ছিলোনা। সুতরাং, দেশবাসী, আগে বিভীষণ ঠেকাও।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!