You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১১ই জানুয়ারী, শুক্রবার, ১৯৭৪, ২৬শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

পঞ্চম বছরে বাংলার বাণী

বাংলার বাণী আজ পঞ্চম বছরে পা দিয়েছে। আজ এগারোই জানুয়ারী বাংলার বাণীর চতুর্থ বছর শেষ। দেখতে দেখতে চারটি বছর গড়িয়ে গেলো। চারটি বছর অনেক দিন—অনেক দিনের অনেক অনেক ঘটনা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে-অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক তথা জীবনের প্রতিটি স্তরে এই চারটি বছর যেমন তাৎপর্যপূর্ণ, তেমনি ভবিষ্যত বাংলার রূপ নির্ধারকও বটে। আজ থেকে চারটি বছর আগে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল। জন্মলগ্নে বাঙলার বাণীর লক্ষ্য ছিল দু’টি। নিকট লক্ষ্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন এবং তার পরবর্তী লক্ষ্য স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে একটি শোষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা তথা সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়া। নিকট লক্ষ্যটি অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম। একটি রক্তাক্ত এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। এ স্বাধীনতাকে সুসংহত করা এবং মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি লাভে আমাদের অবিরাম সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। এই সংগ্রামে বাংলার বাণী সেই মেহনতি মানুষের কণ্ঠস্বর, তার বান্ধব এবং তার সংগ্রামী সাথী।
স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখেই বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি হিসেবে প্রণয়ন করেন ঐতিহাসিক ৬-দফা কর্মসূচী। এই কর্মসূচী সাধারণ্যে প্রকাশিত হবার পরপরই আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী শাসকগোষ্ঠী। অস্ত্রের ভাষায় ওরা একটা কষতে চাইলো। কিন্তু আন্দোলন চলতে থাকলো পর্যায়ক্রমে। অথচ সেই আন্দোলন আর তাতে সাফল্যের কথা তথা বাংলার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন যেন সঠিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল না—বিধৃত হচ্ছিলো এদেশের তৎকালীন সংবাদপত্রের পাতায়। ওরা ভয় পাচ্ছিল হায়েনার রক্তচক্ষু ভ্রুকুটিকে। কিন্তু ইতিহাসের অমোঘ নিয়েম সংগ্রাম পিছিয়ে পড়েনি। ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে আইয়ুব গেলো—ইয়াহিয়া এলো। কিন্তু ঐ গণঅভ্যুত্থান আর তার সাফল্যকে সামনে রেখে চূড়ান্ত সংগ্রামে—সব চাইতে বিপদজনক লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। আর তার জন্যে যেমন চাই দেশের জনগণের সংগ্রামী চেতনার আরো বলিষ্ঠ প্রকাশ্য তেমনি চাই সর্বত্র তার প্রতিফলনও। সেই সংগ্রামী লক্ষ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যেই বাংলার বাণীর প্রথম আত্মপ্রকাশ।
অতঃপর যুদ্ধ সুরের সঙ্গে অসুরের, প্রগতিশীলতার সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলতার, জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে গণবিরোধী দুশমনদের। সত্তরের জানুয়ারী থেকে একাত্তরের মার্চ। সুদীর্ঘ পনেরটি মাস আমাদের বুঝতে হয়েছে ঔপনিবেশিক চক্রান্ত, সুবিধাবাদী আপোষকামী রাজনীতিক ও অতি বিপ্লবী হঠকারী বালসুলভতার বিরুদ্ধে। স্তরানুক্রমিকভাবে লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে রাজনৈতিক আন্দোলন। প্রতিক্রিয়াশীলদের চরম আঘাত আসে একাত্তরের পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত্রে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গোলার আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় বাংলার বাণীর কার্যালয়। সমস্ত আক্রোশ নিয়ে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের উপর। বাংলার বাণী পরিবারের একজন সংগ্রামী সদস্যকে হায়েনার দল নৃশংসভাবে হত্যা করে। কিছুদিন বন্ধ থাকবার পর বাংলাদেশের মুক্ত এলাকা থেকে জনগণের ইচ্ছের প্রতিধ্বনি করে বাংলার বাণী পুনরায় প্রকাশিত হতে থাকে। এ প্রকাশনা অব্যাহত থাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণ বিজয় অর্জন পর্যন্ত।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাপ্তাহিক বাংলার বাণী তার দূর লক্ষ্য অর্জনের সুমহান ব্রত নিয়ে দৈনিক আকারে প্রকাশিত হয় বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারীতে। সেই লক্ষ্য আমাদের জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা তথা মুজিববাদের মাধ্যমে শোষণহীন সোনার বাংলা গড়ে তোলা। অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও বাংলার বাণী সকল ভয়-ভীতি-হামলার মোকাবেলা করে জনগণের সংগ্রামী আন্দোলনে শরীক থাকবে। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রান্ত এবং অতি বিপ্লবী হঠকারী মহল থেকে বাংলার বাণীর উপর হামলা হয়েছে। জনগণের কণ্ঠস্বরকে স্তব্ধ করে দেওয়ার নানা ষড়যন্ত্র চলছে। আমরা আমাদের এই প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জনগণের সহযোগিতা-আন্তরিকতা ও আশীর্বাদকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি সেই ত্রিশ লক্ষ শহীদানকে যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তাঁর আদর্শকে বাস্তবায়িত করার সংগ্রামে শরীক হয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে আমরা ঘোষণা করছি জনগণের সংগ্রামে আমরা ছিলাম, আমরা আছি, ভবিষ্যতেও আমরা জনগণের সঙ্গেই থাকবো।

আরো তিনটি থানা ও বিশেষ পুলিশ প্রসঙ্গে

রাজধানী ঢাকা নগরীর শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যাপারে অধিকতর সুবিধার জন্য রাজধানীতে আরো তিনটি থানা স্থাপিত হচ্ছে। নগরীতে জনসংখ্যার আধিক্য এবং ক্রমবর্ধমান অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতেই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে। ঐ খবরে আরো বলা হয়েছে যে, নতুন তিনটি থানা প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে রাজধানীর জন্যে বিশেষ নগর পুলিশ বাহিনী গঠিত হবে এবং এই বাহিনীর জন্য একজন ডিআইজিও নিযুক্ত করা হবে। তেজগাঁও, রমনা ও লালবাগ থানার বর্তমান পরিধিকে খন্ডিত করে এই গঠিতব্য থানা তিনটির এলাকা নিধারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। তেজগাঁও থানার আওতা থেকে ডেমরা, শ্যামপুর ও পোস্তগোলা, রমনা থানার আওতা থেকে মতিঝিল, কমলাপুর ও গুলিস্তান এবং লালবাগ থানার আওতা থেকে ধানমন্ডি এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে প্রস্তাবিত থানা তিনটি গঠনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলেও এই খবরে উল্লেখ করা হয়।
রাজধানী ঢাকা নগরীতে বর্তমানে যে ক্রমবর্ধমান হারে গুপ্তহত্যা, ব্যাংক লুট, ডাকাতি, রাহাজানি, রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য খুন-খারাবি হতে শুরু করেছে তার প্রেক্ষিতে এই তিনটি থানা গঠনের প্রস্তাব এবং তার সাথে সাথে নগর পুলিশ বাহিনী গঠনের প্রস্তাবও যথার্থই সুবিবেচনাপ্রসূত এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। কেননা অতিরিক্ত এই তিনটি থানা প্রতিষ্ঠিত হলে একদিকে ঐ তিনটি বিরাট থানার পরিধি যেমন কমবে, অন্যদিকে পুলিশের সংখ্যা ও শক্তিও বাড়বে। আর তাতে করে রাজধানী নগরীতে বর্তমান ক্রমবর্ধমান সমাজবিরোধী ও অপরাধমূলক তৎপরতা দমনের প্রশ্নে জনমনেও বেশ স্বস্তি আসতে পারে।
কিন্তু এতদসত্ত্বেও কিছু কথা থেকে যায়। কিছু প্রশ্ন আপনা আপনিই এসে যায়। প্রশ্নগুলো আসে দেশের বর্তমান পুলিশ বাহিনীর শক্তি, সক্ষমতা ও কর্মতৎপরতা প্রসঙ্গে। প্রশ্ন আসে দুর্বৃত্ত, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের মোকাবেলায় পুলিশদের ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে। এ কথা অনস্বীকার্য যে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে কোনো দেশ স্বাধীন হলে সেদেশের সবকিছুই প্রাথমিক অবস্থায় বিশৃঙ্খল থাকে—অসংগঠিত থাকে। আমাদের দেশেরও সেই অবস্থা ছিল—আমাদের পুলিশ বাহিনীর প্রশ্নেও সে কথা সর্বাংশে প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু দেশের অন্যান্য বিষয়ের মতো পুলিশ বাহিনীও সর্বাত্মক তো মোটেই নয়—তবুও কিছুটা সংগঠিত। একদিকে যেমন তারা সংগঠিত হচ্ছেন, অন্যদিকে তার সাথে পাল্লা দিয়ে অবনতি ঘটছে আইন ও শৃঙ্খলা পরিস্থিতির-স্থিতিহীনতা বিরাজ করছে রাজনৈতিক জীবনে। কিন্তু আমাদের পুলিশের বর্তমানে যে শক্তি রয়েছে, তা পুরোপুরি সংগঠিত হলেও রাজনৈতিক স্থিতিহীনতাজনিত এবং রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য উস্কানিপ্রসূত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিরোধে তা প্রতুল নয়—হতেও পারেনা। এর কারণও বহুবিধ।
প্রথমতঃ বর্তমানে আমাদের যে পুলিশ শক্তি রয়েছে অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, এদের শতকরা ৬০ ভাগই পাকিস্তানী আমলের উপনিবেশবাদী শাসনের যন্ত্র হিসেবেই ট্রেনিং পেয়েছেন। স্বাধীন দেশের পুলিশের কর্তব্য সম্পর্কে এরা ওয়াকিবহাল—হন সেই মানসিকতাও নেই। তাই এদের অনেকেই জনগণের সেবক হতে পারেননি। অন্যদিকে তার পরিবর্তে সেই সাবেক মানসিকতা নিয়ে কাজ করছেন। যাতে করে আজও পুলিশের এক টাকা পর্যন্তও ঘুষ খাবার অপবাদ ঘোচেনি বরং অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয়তঃ এই সাবেক পুলিশদের শতকরা ৮০ ভাগই রয়েছেন যারা জীবনে কোনোদিন লাঠি ছাড়া ৩০৩ রাইফেল পর্যন্তও কাঁধে নেননি। আবার যারা রাইফেল কাঁধে নিয়েছেন তাদের মধ্যে শতকরা ২০ জনও কোনোদিন সেই রাইফেলের ট্রিগার টিপেছেন কিনা সন্দেহ। এমতাবস্থায় এরা কিভাবে স্টেনগান, এস.এল, আর.এস, এম.জি বহনকারী দুর্বৃত্তদের হামলার মুখোমুখি হবেন—মোকাবেলা করবেন সে ব্যাপারেও প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কাজেই আজ সময় এসেছে আমাদের পুলিশ বিভাগকে এ সব প্রশ্নের আলোকেই সংগঠিত করার। এমতাবস্থায় থানার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে পুলিশ বিভাগকেও ঐভাবে সংগঠিত করলে যে উদ্দেশ্যে এগুলো করা সেই উদ্দেশ্য সফল হতে পারে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তাছাড়া পুলিশ বাহিনীকে একদিকে জনসাধারণের নিরাপত্তাবিধান করার সঙ্গে সঙ্গে অন্যদিকে আস্থাভাজনও হতে হবে।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!