বাংলার বাণী
ঢাকা : ৭ই জানুয়ারী, সোমবার, ১৯৭৪, ২২শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড মৈত্রী সুদৃঢ় হোক
সম্প্রতি নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান ইরিক কার্ক বাংলাদেশে চার দিনের এক সরকারী সফর শেষে তাঁর দেশে ফিরে গেছেন। আমাদের দেশে অবস্থানকালে মিঃ কার্ক ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম সফর করেছেন। তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে। ইশতেহারে বাংলাদেশকে নিউজিল্যান্ড সম্ভাব্য সকল প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করবে বলে বলা হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে নিউজিল্যান্ড সকল প্রকার সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান ইরিক কার্কের দীর্ঘ আলাপ-আলোচনার শেষে যুক্ত ইশতেহার ঘোষিত হয়েছে। উভয় দেশের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও উভয় দেশের অগ্রগতির ব্যাপারে উভয় দেশের সাহায্য ও সহযোগিতা যে একান্ত অপরিহার্য এ কথা যুক্ত ইশতেহারে সুস্পষ্টভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীদ্বয় দু’দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ব্যাপক ভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক বিষয় এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীরও পর্যালোচনা করেছেন। আন্তর্জাতিক বিষয়াদির মধ্যে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী আরবদের ন্যায়সঙ্গত দাবীর প্রশ্নে ঐক্যমত পোষণ করেছেন। এবং তাদের আশা জেনেভায় অনুষ্ঠিত মধ্যপ্রাচ্য শান্তি সম্মেলন ঐ এলাকার স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এশিয়া তথা বিশ্বশান্তির স্বপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে ভারত মহাসাগরকে শান্তি এলাকায় পরিণত করার প্রশ্নেও জোরালো অভিমত পোষণ করেছেন। আমাদের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনায় নিউজিল্যান্ড বহুবিধ সাহায্য করতে সক্ষম। এ কারণে যুক্ত ইশতেহারে বিশেষভাবে বলা হয়েছে যে, আমাদের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনার অধীনে যে সকল উন্নয়নমুখী কর্মসূচী রয়েছে তার মধ্যে বনশিল্প, ডেয়ারী ও পশু পালনের প্রকল্পগুলোতে নিউজিল্যান্ডের সাহায্য ও সহযোগিতা অপরিহার্য। এছাড়া দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ব্যাপারেও উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী ঐক্যমত পোষণ করেছেন।
নিউজিল্যান্ডের পররাষ্ট্রনীতি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর অগ্রগতিতে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদানের স্বপক্ষে হেতু আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করেছেন। তিনি উন্নত ও উন্নয়নকামী দেশগুলোর মধ্যকার ব্যবধান হ্রাসের জন্যে মিঃ কার্কের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকার কথা উল্লেখ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর উন্নয়নে নিউজিল্যান্ডের সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের প্রতি জোর দেন। ভারত উপমহাদেশের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নে ও এই উপমহাদেশের দেশগুলো যাতে করে নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলে তাদের জনগণের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কল্যাণে শক্তি নিয়োজিত করতে পারে তার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার গঠনমূলক ও প্রগতিশীল নীতির কথাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্যাখ্যা করেছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি দিল্লী চুক্তি অনুযায়ী পাকিস্তানের সঙ্গে ত্রিমুখী লোক বিনিময়ে নিউজিল্যান্ড সরকারের উদার সাহায্যের কথা আন্তরিকতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। বিশ্বশান্তির প্রশ্নে নিউজিল্যান্ড ও বাংলাদেশ ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার ব্যাপারেও একমত। তাই ভারত মহাসাগর এলাকাকে শান্তি এলাকায় পরিণত করার উপর উভয় প্রধানমন্ত্রী সবিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান ইরিক কার্ক ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে সাংবাদিক সম্মেলনে এক ভাষণদান করেছিলেন। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে তাঁর দেশ বাংলাদেশকেই অকুণ্ঠ সমর্থন করবে। অতীতের মতো তারা ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত দাবীর স্বপক্ষে সমর্থন যুগিযে যাবে। এদিকে মিঃ কার্কের ঢাকা ত্যাগ করার পূর্বে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর সম্মানে এক ভোজসভায় আয়োজন করেছিলেন। ভোজসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন-‘মিঃ কার্ক বাংলাদেশের পরম বন্ধু। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় তিনি বর্বর পাক বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে যেভাবে সে আর হয়ে উঠেছিলেন তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে আমরা স্মরণ করি। বাংলাদেশ নিউজিল্যান্ডের কাছ থেকে শুধু বৈষয়িক সাহায্যই চায় না বরং আন্তরিক বোঝাপড়া, বন্ধুত্ব এবং স্থায়ী শান্তির জন্যে সহযোগিতার সুদৃঢ় হতে চায়।’
নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান ইরিক কার্কের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে আমাদের ধারণা। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই মর্মান্তিক দিনের বন্ধু নিউজিল্যান্ড যেভাবে সেদিন আমাদের মরণপণ সংগ্রামের স্বপক্ষে এবং পাকিস্তানী জান্তা কর্তৃক সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চারিত ছিলেন—আজ আর একবার সে কথা আমাদেরকে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়। মিঃ কার্ক এই সফরে এসে বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে সাহায্য জোগানোর আশ্বাস প্রদান করেছেন। বিশেষ করে আমাদের প্রথম পাঁচসালা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ব্যাপারে তাদের সহযোগিতার আশ্বাস সবিশেষ অর্থবহ। বনশিল্প পশু ও পশুপালন সম্পর্কিত প্রকল্পে নিউজিল্যান্ড উল্লেখ পরিমাণ বৈষয়িক ও কারিগরির সাহায্য প্রদান করতে পারে। বঙ্গবন্ধুর অভিমতের সঙ্গে আমরাও একমত পোষণ করে বলবো বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড মৈত্রী আরো সুদৃঢ় হোক, পারস্পরিক সম্পর্ক আরো উদার ও শান্তির স্বপক্ষে জোরদার হোক।
বিশেষ আইন প্রণয়নের উদ্যোগ
সংবাদে প্রকাশ, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী একশ্রেণীর সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও সমাজবিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের বিধান সম্বলিত একটি নয়া আইন শীঘ্রই প্রণীত হতে যাচ্ছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে সরকার এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে সরকার ঘোষণারও সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রস্তাবিত বিশেষ আইনে জেলা সদরগুলোকে বিশেষ আদালত গঠন এবং সে আদালতে অভিযুক্তদের সংক্ষিপ্ত বিচারের ব্যবস্থা রাখা হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। জাতীয় সংসদের আসন্ন শীতকালীন অধিবেশনের মধ্যেই প্রস্তাবিত আইনটি বিল আকারে উত্থাপিত হতে পারে।
জানা গেছে, রাষ্ট্রবিরোধী সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও সমাজবিরোধীদের জন্যে অপরাধের মাত্রা অনুসারে এ আইনে পাঁচ বছরের কারাদন্ড থেকে মৃত্যুদন্ড অবধি বিভিন্ন শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে।
প্রকাশ, দেশের স্বাধীনতাবিরোধী, সশস্ত্র দুষ্কৃতিকারী ও সমাজবিরোধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিদানের জন্যে প্রচলিত ‘সি আর পি পি’ পর্যাপ্ত নয় বলে প্রস্তাবিত বিশেষ আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
স্বাধীনতাবিরোধী, সমাজবিরোধী ও দৃষ্কৃতিকারীদের দমন করার জন্যে প্রচলিত আইন যে যথেষ্ট নয় তা আর বিস্তারিত বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না। প্রচলিত যে আইন তা বৃটিশ আমল থেকে আরম্ভ করে পাকিস্তানী আমল পেরিয়ে এখনো পর্যন্ত একটু ঘষামাজা করেই কাজ চালানো হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ আইনে ফাঁক রয়েছে যথেষ্ট। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, একজন নির্দোষীকে ছেড়ে দেবার জন্যে যদি দশজন দোষী ব্যক্তিকে ছেড়ে দিতে হয় তাতেও আপত্তি নেই এ প্রচলিত আইন ব্যবস্থায়। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে, নির্দোষী ব্যক্তির অজুহাত দেখিয়ে আইনে যে জটিলতা সৃষ্টি করা হয়েছে তাতে অনেক ক্ষেত্রে নির্দোষী ব্যক্তিই আইনের শিকার হয়ে পড়ে। এ কথা তো অস্বীকার করার উপায় নেই যে, লোকবল ও অর্থবল থাকলে অনেক সময়ে আইনকে বুড়ো আঙ্গুলও দেখানো সম্ভব হয় আমাদের দেশে। এমনি হাজারো ঘটনার জন্ম এদেশে অতীতে হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। প্রচলিত আইন ও যে বিচার পদ্ধতি তাতে যে কোনো ফরিয়াদীর পক্ষে আর্থিক সঙ্গতি ছাড়া বিচার প্রার্থনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং আদালতের নাম শুনলে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই ভয় পান। আইন ও বিচার ব্যবস্থার জটিলতার জন্যেই যে কোনো মানুষকে একবার আদালতের আশ্রয় নিলে স্বল্প সময়ে বা সহজে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। মাসের পর মাস আদালত ভবনের সম্মুখে অবস্থিত বট গাছের পাতা গুণতে হয় বিচার প্রার্থীদের। তাছাড়া প্রচলিত আইন একজন থানার দারোগাই সর্বেসর্বা। তাঁর রিপোর্ট না হলে কোনো মামলাই এগুতে পারে না। আর তিনি যদি একটু এদিক-ওদিক করেন তাহলে রাতের অন্ধকার দিনের আলোতেও রূপান্তরিত হতে পারে। এমতাবস্থায় দারোগার রিপোর্ট পাওয়া গেলো না বলেও অনেক মামলা বছরের পর বছর ধরে ঝুলতে থাকে। এতে একদিকে যেমন মামলার রায় প্রকাশিত হয়ে বিলম্ব হয় অন্যদিকে মামলার সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তি-বিশেষজ্ঞরাও দিনের পর দিন নাজেহাল হয়।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ যে, থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি লুট, বাজার লুট, ব্যাংক লুট, রাজনৈতিক গুপ্ত হত্যা, খুন, ডাকাতি, রাহাজানি, নারী নির্যাতন সহ কালোবাজারী, মুনাফাখোরী, মওজুতদারী, ভেজালকারী ও সমাজবিরোধীদের দমন করার জন্যে প্রচলিত আইন যথেষ্ট নয়। একজন ভেজালকারী যে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনে সর্বনাশ ডেকে আনছে তার জন্যে শাস্তির ব্যবস্থাস্বরূপ রয়েছে মাত্র কয়েকটি টাকা। এমতাবস্থায় একবার অপরাধ প্রমাণিত হবার পর জরিমানার টাকা দিয়েই আসামী খালাস পায় (অনেক ক্ষেত্রে বিচার পদ্ধতির জটিলতার জন্যে তাও হয় না।)। তারপর আবার অপরাধে লিপ্ত হয়। অথচ এক্ষেত্রে প্রয়োজন হলো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা।
উল্লেখ্য যে, ‘বাংলার বাণী’তে ইতিপূর্বে উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে অনেকবারই প্রচলিত আইনের ক্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের ও দশের বৃহত্তর স্বার্থেই প্রচলিত আইনের সংশোধন ও বিশেষ আইন প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক