বাংলার বাণী
ঢাকা : ১০ই জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ২৫শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
দশই জানুয়ারী বিজয়ের পূর্ণতার দিন
আজ ঐতিহাসিক দশই জানুয়ারী। বাংলাদেশ তথা বাঙালী জাতির ইতিহাসে দশই জানুয়ারীর গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা মনে করি, ছাব্বিশে মার্চ ও ষোলই ডিসেম্বরের থেকে দশই জানুয়ারী মোটেই কম অর্থবহন করে না। বরং ষোলই ডিসেম্বরের বিজয়ের পরিপূর্ণ আনন্দ দশই জানুয়ারীর মধ্যেই যেন নিহত ছিলো। যদি আমাদের জীবনে বাহাত্তরের দশই জানুয়ারী কোনোদিন আর না আসতো তাহলে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বরের গুরুত্ব আমরা কোনোদিনই পরিমাপ করতে পারতাম না। ১৯৭২ সালের দশই জানুয়ারীতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে অর্থাৎ পঁচিশে মার্চের কাল রাতে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী সামরিক জান্তার হাতে গ্রেফতার হন। সেই থেকে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ও যুদ্ধোত্তর প্রায় একমাস বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানী কারাগারে বসে প্রতিটি মুহূর্তে মৃত্যুর দিন গুণেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পর এটাও জানা গিয়েছিল যে—পাকিস্তানী শাসকবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে নিহত করারও সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার সেদিন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। এদিকে বাংলাদেশের মাটিতে নতুন রক্তসূর্যের অভ্যুদয় হলেও বঙ্গবন্ধুর অভাবে যে সূর্য-রশ্মি কেমন যেন ম্লান-বিবর্ণ ছিল। যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষ বঙ্গবন্ধুর জীবনের আশঙ্কায় মহান প্রভুর কাছে হাত জোড় করে কেঁদেছে। গাঁয়ের মা-বোনেরা মানত করেছে—রোজা রেখেছে। স্বাধীনতার পর মসজিদে-মসজিদে-মন্দিরে-মন্দিরে বিশেষ মোনাজাত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জীবনরক্ষার জন্যে প্রতিটি কর্মী কান্নায় ভেঙে পড়েছে। যুদ্ধের অস্ত্র হাতে নিয়ে বঙ্গব্ন্ধুর ছবি স্পর্শ করে দেশের দামাল ছেলেরা সেদিন যুদ্ধ করেছে। শুধু বঙ্গবন্ধুর মানসপ্রতিমা সামনে রেখে জীবনের সকল মায়া-মহব্বত, দুঃখ-বেদনা বিসর্জন দিয়ে স্বাধীনতাপ্রিয় কোটি কোটি মানুষ সানন্দে শত্রুর মোকাবেলা করেছে। বাংলার মাটির ধোঁকা গন্ধে সজীব যে কোটি কোটি মানুষ তারা শুধু বঙ্গবন্ধুর নামের মহিমায় নিজেদেরকে পরিচয় করিয়েছে দেশে-বিদেশে। সুষ্ঠু একটি নাম ‘শেখ মুজিব’ সেদিন কোটি কোটি মানুষের জীবনকে উদ্বেলিত করেছিল শত্রু হননে। প্রিয় মাটির স্বাধীনতার সঙ্গে তাই শেখ মুজিব একটি অবিচ্ছেদ্য নাম—একটি সীমাহীন আবেগ।
তাই সেদিন দশই জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেলে বাংলার মানুষের প্রাণে যে কি আনন্দ-আবেগ মুর্ছায়িত হয়েছিল তা বর্ণনাতীত। আমরা বাঙালীরা বড় বেশী স্মৃতিভ্রম করি। আমরা অতীতকে যেন খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যাই। এই স্বভাবই হয়তো একদিন আমাদের সকল বীর্যের ইতিহাসকে ম্লান করে দেবে। একদিন আমরা যারা বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচিত পেয়েছি, বঙ্গবন্ধুর অভাবে নিজেকে পরিচয়হীন মনে করেছি, তাঁর প্রাণ রক্ষা হোক এ কারণে নামাজ-রোজা, পুজা-অর্চনা, ছাদকা-বলি ইত্যাদি দিয়েছি তাদের অনেকেই আমরা আজ স্মৃতি বিভ্রমে ভুগছি। যে সকল নেতাদের কোনো পরিচয় ছিল না বঙ্গবন্ধুর ছাড়া তারা স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের প্রশ্নে অনৈক্যের ধুম্রজাল সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নাম ভাঙিয়ে স্বেচ্ছাচারিতায় মেতেছেন। বাংলার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রিয় নেতাকে ছোট করে চলেছেন। দশই জানুয়ারীর গুরুত্ব অনুধাবন করার প্রয়োজনীয়তা তাদের নেই। অথচ আমরা জানি যদি বাংলাদেশের মানুষের মাঝে বাহাত্তরের দশই জানুয়ারী কোনোদিন আর না আসতো তাহলে হয়তো বা আমাদের গৌরবের ইতিহাস বিকৃত হয়ে আমাদেরকেই ব্যঙ্গ করতো। আমরা পিতৃহীন পরিচয়ে পরিচিত হোতাম।
ফাঁকিবাজদের আর ক্ষমা করা উচিত নয়
ঈদ উৎসব পালিত হয়েছিল গত শনিবার। অর্থাৎ আজ থেকে আরো পাঁচদিন আগে। কিন্তু বাংলাদেশ সচিবালয়ে তার রেশ এখনো কাটেনি—তার রেশ এখনো কাটেনি দেশে কোনো কোনো মিল কারখানায়। সচিবালয়ের শতকরা ৬০ ভাগ কর্মচারী এখনো অফিসে আসছেন না—বাকী যে ৪০ ভাগ এসেছেন, তাঁদের মধ্যেও শতকরা ৬০ ভাগের ঈদের বাসি কোলাকুলি আর কুশল বার্তা বিনিময় এখনো শেষ হয়নি। চট্টগ্রামের তিনটি জুট মিলের তথাকথিত শ্রমিকদের স্ব-ঘোষিত ছুটির মেয়াদও এখনো শেষ হয়নি। কাজেই তারাও কাজে যোগ দেননি। জুট মিল কর্পোরেশন সকল জুট মিল শ্রমিকের জন্যে যে ছুটি ঘোষণা করেছিলেন, তা মেনে নেননি ঐ তিনটি জুটমিলের শ্রমিকরা। তারা তাদের স্ব-ষোষিত ছুটি অনুযায়ী মেয়াদ আরো দু’দিন বাড়িয়েছেন। গতকালের ঢাকার দু’টি দৈনিকে বেরিয়েছে এই দু’টি খবর। এর আগে গত ডিসেম্বর মাসে আরেকটি দৈনিক পত্রিকায় সচিবালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্তব্যবিমুখতা, কাজে গাফিলতি, অফিসে হাজিরার ব্যাপারে নিয়মিত অনিয়ম পালন, কাজে ফাঁকি দেওয়া ইত্যাদি সম্পর্কেও একটি জরিপ রিপোর্ট বেরিয়েছিল। বাংলাদেশ সচিবালয় বা উপরোক্ত তিনটি জুটমিলের কথা দিলেও দেশের সর্বত্রই সকল সরকারী, আধা-সরকারী অফিসে প্রায় সকল শ্রেণীর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মধ্যে, বিভিন্ন মিল কারখানায় শ্রমিকদের মধ্যে এই কর্মবিমুখতা এবং কাজে ফাঁকি দেওয়া যেন একটা চিরাচরিত নিযম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জনৈক অর্থনীতিবিদ আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে এহেন কর্মবিমুখতা ও কাজে ফাঁকি দেওয়াটাকে একটা মারাত্মক ধরনের ক্যান্সারের বিস্তারের সাথে তুলনা করেছেন। তাঁর মতে, এর ফলে হানাদার বাহিনীর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত এবং প্রায় ভেঙে পড়া আমাদের অর্থনৈতিক জীবন, সামাজিক জীবন ও জাতীয় চরিত্র পরিপূর্ণ ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। আর কিছুদিন এ জাতীয় নৈরাজ্য ও অরাজকতা চললে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ব্যাপারেও যথার্থ প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াটা স্বাভাবিক। কেননা, আমাদের মতো এমন সশস্ত্র সংগ্রামের পর স্বাধীনতা লাভকারী বিশ্বের সকল জাতিকেই দিবারাত্র কঠোর পরিশ্রম করে দেশ গড়ারর কাজে আত্মনিয়োগ করতে হয়েছে। সেসব দেশের প্রতিটি মানুষই নিজ নিজ দায়িত্ব পালনের সব সময়ই তৎপর ছিলেন, এখনো আছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আণবিক বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত জাপান, জার্মানী বা পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোর কি অবস্থা হয়েছিল অথচ একমাত্র কঠোর পরিশ্রম আর কর্তব্য একাগ্রতার মাধ্যমে সেদেশের প্রতিটি মানুষই প্রমাণ করেছেন পরিশ্রমই সাফল্যের চাবিকাঠি। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ বিশ বছর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মতো দুনিয়ার সব শক্তিমান সমরবিদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকার পর মাত্র এক বছর আগে ভিয়েতনামীরা তাদের দেশ থেকে হানাদারদের হটিয়েছেন। সেই দেশের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে দিবারাত্র পরিশ্রম করে গত এক বছরে তাঁদের দেশকে যে স্থানে এনে দাঁড় করিয়েছেন, তুলনামূলক বিচারে আমরা গত দু’বছরে তার অর্ধেকটাও করতে পারিনি। এটা যে কত বড় দুর্ভাগ্যের, কত বড় আত্মশ্লাঘার কে তার হিসেব রাখছে? সর্বত্রই একটা নৈরাজ্যকর কর্মবিমুখতা যেন আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলছে।
অথচ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাহাত্তরের দশই জানুয়ারী পাকিস্তানীদের বন্দীশালা থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফেরার দিন থেকে এ যাবত কাল পর্যন্ত তাঁর প্রায় সকল বক্তৃতা-বিবৃতিতে কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে দেশকে গড়ে তোলার জন্যে সকলের প্রতি বিশেষ করে জনগণের টাকায় যাদের সংসার চলে অর্থাৎ সরকারী কর্মচারীদের প্রতি এবং মিল কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির জন্যে শ্রমিক সমাজের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কথাটা যেন কারো কানে ঢুকছে না।
তাই আজও পাঁচ দিনের বাসি ঈদের রেশ কাটিয়ে উঠতে পাচ্ছেন না সচিবালয়ের সেই সব রাশভারী, পায়া ভারী কর্মবিমুখ আমলারা—তথাকথিত শ্রমিকরা মানছেন না সরকার নির্ধারিত ছুটির দিন। গত দু’বছরে অনেক কিছু সহ্য করা হয়েছে—সরকারকে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের জন্যে গোটা দেশের মানুষের অনেক স্বার্থবিসর্জন দিতে হয়েছে। এখন আর নয়। কঠোরভাবে এসব ব্যাপার নিয়ে বিবেচনা করতে হবে। পাঁচ দিনের বাসি ছুটির রেশ যাদের এখনো কাটেনি—তাদের এই অনুপস্থিতির জন্যে কোনো কাগজী কৈফিয়ত তলব নয়—আর্থিকভাবে কৈফিয়ত তলব করতে হবে—তথা একদিন ওদের বেতন কাটার ব্যবস্থা করতে হবে—যেমন করেছেন পাটকল কর্পোরেশন তিনটি স্ব-ঘোষিত ছুটি ভোগকারী পাটকল শ্রমিকদের প্রশ্নে। ভবিষ্যতে যদি এতেও কাজ না হয়, তবে এ জাতীয় ফাঁকিবাজ কর্মচারীদের পত্রপাঠ বিদেয় করার ব্যবস্থা করার কথাও এখন থেকে বিবেচনা করে রাখতে হবে বলে আমরা মনে করি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক