You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৮ই জানুয়ারী, মঙ্গলবার, ১৯৭৪, ২৩শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

পাল্টা হুমকি দুর্বলের আস্ফালন

দেশের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সম্পাদকীয় মন্তব্য করার মতো পরিবেশ বা অবকাশ আর আছে বলে কেউই স্বীকার করবেন না। তবু দেশের অন্যান্য জাতীয় সংবাদপত্রের চিরাচরিত নিয়ম অনুসারে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য করে আসছি। কার কথা কে শোনে! দিন দিন পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। বর্তমানে তা আরো মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গত সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে বলতে গেলে প্রতিদিনই আমরা আশা করেছি পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির। কিন্তু আশা দুরাশাই হয়েছে। এখন খুন, রাহাজানি, ছিনতাই, জখম, লুট একটা নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। আজকাল সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় সার্বিক সৌন্দর্য নির্ভর করে যেন নিত্যদিনের খুন-জখম-ছিনতাইয়ের খবরে। খবরের কাগজের পূর্ণতা লাভ হয় আইন-শৃঙ্খলার অবনতি দিয়ে। এহেন অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার সম্ভাবনাও আজ সুদূরপরাহত বলে মনে হচ্ছে। এবারের নতুন বছর শুরু হয়েছে খুন, আর ছিনতাইয়ের মধ্য দিয়ে। ঈদুল আযহার পূর্ব দিনেও ঢাকায় খুন-ছিনতাই হয়েছে। বেশ কিছুদিন বন্ধ থেকে আবার রাজধানীতে ব্যাংক লুট হয়েছে। ঈদুল আযহার কারণে দু’দিন সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ ছিল। এই দু’দিনে শুধু ঢাকা শহরেই ছ’জন খুন হয়েছে। আমরা এ বছরের শুরুতেই সম্ভাব্য খুন-জখম ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বৃদ্ধি পাবার আশংকা করেছিলাম। প্রকৃত প্রস্তাবে আমরা চুয়াত্তর সালের গত ছ’-সাত দিনে লক্ষ্য করেছি, দেশে খুন-জখম-ছিনতাই ধারণাতীত বেড়েছে এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা বাহিনীগুলোর যোগ্যতার ক্রম অবনতি লক্ষ্য করা গেছে। অনেকে ধারণা করেছিলেন যে, ইউনিয়ন পরিষদ ও মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচনের পরে দেশে খুন-জখমের পরিমাণ কমবে। কিন্তু মূলতঃ তা কমেনি। নির্বাচনে দাঁড়িয়ে বহু প্রার্থী নিহত হয়েছেন। নির্বাচিত হয়েও অনেককে মরতে হয়েছে। এমনকি নির্বাচিত হবার পর তাঁর স্ত্রী অপহৃত হয়েছে। দেশের কথা বলে দিলেও বিদেশে আজ আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি সম্পর্কে নানা প্রশ্ন উঠেছে। বিদেশী পত্র-পত্রিকায় তার দু’একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদও পরিবেশিত হচ্ছে।
বেশ কিছুদিন যাবত দেশের অভ্যন্তরে কয়েকটি বিরোধী শিবির সীমাহীন ন্যক্কারজনক প্রচারণা চালাচ্ছে। একটি শক্তিশালী স্থিতিশীল সরকারের নাকের উপর তারা প্রকাশ্য চ্যালেঞ্জ দিয়ে চলেছে। সশস্ত্র হুমকি প্রদান করছে। আর আমাদের সরকার ও তার বিভাগীয় মন্ত্রণালয় পুতুলের ন্যায় নিজেদেরকে বেঁচে আছি বা বর্তমান রয়েছি বলে দিব্বি ঘোষণা করে চলেছেন। কিছুদিন পূর্বে আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেব সশস্ত্র হুমকির জবাবে একটি সভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেছিলেন—কারো সশস্ত্র হুমকি আর সহ্য করা হবে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহেবের সে বক্তব্য যে শুধু অর্থহীনই না রীতিমতো দুর্বলের আস্ফালন তা আজ সবার চোখেই সুস্পষ্ট। সশস্ত্র হুমকি সহ্য করা হবে না অথচ গত সাত দিনে শুধু ঢাকাতেই নিহত হয়েছেন সাত জনের অধিক ব্যক্তি। ব্যাংক লুট হয়েছে একটি। ছিনতাই হয়েছে কয়েকটি। ঢাকার বাইরে সে ক্ষেত্রে আরো অনেক বেশী ঘটনা যে ঘটেছে সে কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী সাহেবও জানেন, আমরাও জানি। স্বরাষ্ট্র বিভাগ বা সরকারের কোনো দায়িত্বশীল ব্যক্তি দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে যে কোনো একটা হুমকি দিলেই সকল পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণে আসবে এমন বিশ্বাস করার কারণ আছে বলে আমরা মনে করি না। আর দেশবাসীও আজকাল অনর্থক আস্ফালন ভাবে সেটাকে। অতএব যদি সত্যিই কোনো বাস্তব পদক্ষেপ সরকার গ্রহণ না করে এহেন হুমকির শুধু পাল্টা হুমকিই দিয়ে চলেন তাহলে তা হাসির ব্যাপারেই হবে।
আমরা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রশ্নে সরকারের দুর্বলের আস্ফালন আর দেখতে রাজী নই, বোধকরি দেশবাসীও আর রাজী নয়। যদি কর্তৃপক্ষ মনে করেন যে, তাঁরা সত্যিই জনগণের রায়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত রয়েছেন তাহলে বাস্তব অর্থে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রশ্নটি পুনর্বিবেচনা করা হোক। তবে আমরা বিশ্বাস করি—মান্ধাতার আমলের চরিত্র—মেজাজ ও কাঠামো দিয়ে যে সকল আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ এককালে গঠিত হয়েছিল তার পুনর্বিন্যাস ছাড়া তাকে দিয়ে বর্তমান পরিস্থিতির মোকাবেলা আদৌ সম্ভব নয়।

নির্বানোত্তর ভাবনা

দীর্ঘ দশ বছর পর বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকার তথা স্থানীয় প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো বেশ উৎসাহ-উদ্দীপনা, মারামারি এবং হানাহানির মাধ্যমেই। নির্বাচনকালে ও তার পরবর্তীকালে দেশের বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু নির্বাচন প্রার্থী, নবনির্বাচিত ব্যক্তি ও তাদের সদস্য নিহত হয়েছেন, অপহৃত হয়েছেন। দেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচনে গোলযোগ হয়েছে সাড়ে চারশতটি কেন্দ্রে। ফলে প্রায় আড়াইশতটি ইউনিয়ন কাউন্সিলের ফলাফল ঘোষণা স্থগিত রাখা হয়েছে। পৌরসভাগুলোর মধ্যে ভোলার একজন প্রার্থী নিহত ও অপর একস্থানে অনুরূপ গোলযোগের জন্যে নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়। বাকীগুলোর নির্বাচন যথাসময়ে যথাযথভাবেই অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বাংলাদেশ যখন পাকিস্তানের কলোনী ছিল, তখন আইয়ুব শাসনতন্ত্র অনুযায়ী এদেশে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্র ভিত্তিক স্থানীয় প্রশাসনিক নির্বাচত অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে কিন্তু যেহেতু সেই নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণের পর্যায়টা ছিল অত্যন্ত সীমিত, সেহেতু জনগণ প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের সাথেও যেমন কোনো অংশগ্রহণ করতে পারেননি, পরন্তু তারা নিষ্পেষিত হয়েছিলেন তাদেরই ভোটে নির্বাচিত মৌলিকদের হাতে। এই নির্বাচন কিন্তু সেই নিষ্পেষণমূলক গ্রামীণ প্রশাসনিক কাঠামো তথা সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন করতে সক্ষম হয়েছে, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে। তদুপরি সংবিধান অনুযায়ী এবারকার স্থানীয় প্রশাসনযন্ত্রের হাতে যে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে—অতীতের তুলনায় তা বিরল। এমতাবস্থায় এবারকার নির্বাচনে দেশের সর্বত্র নবীন আর প্রবীণের সংমিশ্রণে স্থানীয় প্রশাসনের যে কাঠামো নতুন ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হলো, নবীনের কর্মোদ্দীপনা এবং প্রবীণের অভিজ্ঞতা দু’টোর সমন্বয় করে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লে একদিকে দেশের বর্তমান হতাশাগ্রস্ত জনগণের সামনে যেমন এক আলোর সন্ধান দেওয়া যেতে পারে, ঠিক তেমনিভাবে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তোলাটাও অস্বাভাবিক কিছু নয় বলেই আমরা মনে করি।

তেলাস্ত্রের বিরুদ্ধে মার্কিনী হুমকি

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস স্লেসিঞ্জার পেন্টাগন থেকে সম্প্রতি যে বক্তব্য প্রচার করেছেন, তা থেকে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুখোশটি অবশেষে খসে পড়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস স্লেসিঞ্জার হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরবদের তেল অস্ত্রের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করতে বাধ্য হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেছেন, শিল্পোন্নত বিশ্বের বৃহত্তর জনসাধারণ পঙ্গু হয়ে যেতে পারে, স্বাধীন দেশগুলোর সার্বভৌম ক্ষমতাকে এভাবে ব্যবহার করা উচিত নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের সব স্বাধীন দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিবেদিত-প্রাণ বলেও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস স্লেসিঞ্জার মন্তব্য প্রকাশ করেছেন। পক্ষান্তরে, মিসরের প্রভাবশালী দৈনিক আল-আহরাম পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ হাসনায়েন হেইকল বলেছেন যে, ইসরাইল ১৯৬৭ সালে যুদ্ধের আগের সীমান্তে সৈন্য প্রত্যাহার করুক যুক্তরাষ্ট্র তা চায় না। জনাব হেইকল আরো বলেছেন, আরবদের তেল উৎপাদন হ্রাস এবং তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশী লাভবান হয়েছে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
আরবদের তেলাস্ত্র প্রয়োগের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ প্রতিটি শিল্পোন্নত দেশই রীতিমতো কাবু হয়ে পড়েছে। তাই আমরা যখন মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে ইসরাইলী গোয়ার্তুমীকে দোষারোপ করছিলাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তখন তেমন কোন উচ্চবাচ্য করেনি। বরং ভেতরে ভেতরে ইসরাইলকে সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। মোদ্দা কথায়, মার্কিনী মদদের ফলেই ইসরাইল মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের প্রশ্নে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেয়ে যুদ্ধের প্রতিই বেশী মনোযোগী থেকেছে। আরবরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যে শেষ পর্যন্ত তেলাস্ত্র প্রয়োগ করতে বাধ্য হয়েছে। এই তেলাস্ত্রের আঘাতে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাবি খাওয়ার উপক্রম হয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আরবদের তেলাস্ত্র প্রয়োগ থেকে বিরত থাকার জন্যে নতুন পাঁয়তারা কষতে শুরু করেছে এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস স্লেসিঞ্জার আরবদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের হুমকি দিতেও দ্বিধা কিংবা সংকোচ বোধ করেনি। অর্থাৎ মধ্যপ্রাচ্য প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতোদিন যে অস্পষ্ট ও ধোঁয়াটে নীতি অনুসরণ করেছে, এই হুমকি সেই অস্পষ্টতাই দৃঢ় করলো। মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের দাবানল আবার ছড়িয়ে পড়ুক, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেমস স্লেসিঞ্জারের হুংকার থেকে সেই আভাসই সুস্পষ্ট হয়ে উঠলো।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে যতো উদ্যোগই নিক না কেন, তা যে নিতান্ত লোকদেখা নোপনা ছাড়া আর কিছু নয়, তাতে আমরা নিঃসন্দিহান। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অবশ্য আশংকা প্রকাশ করে বলেছেন যে, যুদ্ধ বাঁধার মতো ভয়াবহ অবস্থার হয়তো উদ্রেক হবে না। আমরাও বলি, যুদ্ধ সমস্যা সমাধানের পথ নয়—বরং শান্তির পথই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসরণ করা উচিত। হুমকি শুধুই উত্তেজনা বাড়ায়—সমস্যার সত্যিকার সমাধান করে না।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!