গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র পরিকল্পনা
ষষ্ঠ অধ্যায়ে ঢাকা সেনা ছাউনিতে রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান-এর রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচার চলছিল। বিচারের সময় বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিস্তরঙ্গ। শংকাহীন । ঐ মামলাকে শাসকগােষ্ঠী নাম দিয়েছিল আগরতলা মামলা। কারণ ছিল বাঙালি জনগণকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ভারত বিদ্বেষী হাতিয়ারকে কাজে লাগানাে, যাতে শেখ মুজিবের প্রতি জনগণের ঘৃণা জন্মায় এবং তা শাসককূলের অনুকূলে আসে। বিভিন্ন তথ্যে জানা যায়, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে ফাঁসি দেয়ার পরিকল্পনা হয়েছিল। কিন্তু ছাত্র-জনতা ছয়-দফা তথা বাংলার স্বার্থ ও স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যেই যে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং সর্বশেষে ফঁসি দেয়া হবে এ বিষয়টি উপলব্ধি করে উত্তাল আন্দোলন শুরু করে। সেদিন ছাত্ৰ-সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে জনগণ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানেও আন্দোলন তীব্র আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বিরাজমান কঠিন পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার লক্ষ্যে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। কিন্তু গােলটেবিল বৈঠকে পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ দেখলেন এই বৈঠক শেখ মুজিবের উপস্থিতি ব্যতীত অর্থহীন হবে। নানা কুট-কৌশলের মধ্যে পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসভায় শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন ডাকসুর ভিপি ও ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তােফায়েল আহমেদ। বঙ্গবন্ধু গোলটেবিল বৈঠকে যান ছয় দফা পেশ করেন। ছয়-দফা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের মন্তব্য ছিল এই প্রস্তাব হলাে পাকিস্তানকে দু’ভাগে বিভক্ত করা। আমার দেশের ধ্বংসের উপর আমি সভাপতিত্ব করতে পারি না। ছয়-দফা মেনে নিলে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা। নেই।’ এছাড়াও এই অধ্যায়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর কার্যক্রম এবং তিনি যে স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন সে সম্পর্কেও আলােকপাত করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের সঙ্গে তার যে যােগাযােগ ছিল তাও উল্লেখ করা হয়েছে।
ঢাকা সেনা ছাউনিতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে বন্দি শেখ মুজিব। বিচার চলছে। আগরতলা মামলা শুরুর প্রথম দিন। আদালতের কাঠগােড়ায় দাঁড়িয়ে শেখ মুজিব সংশ্লিষ্ট সবার উদ্দেশে শংকাহীন কণ্ঠে এমন এক সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন যা আদালতে উপস্থিত বিচারক, সরকারি গােয়েন্দা সংস্থার লােক এবং আইনজীবীসাংবাদিকদের স্তম্ভিত করে দেয়। এ বিষয়ে ওইদিন আদালত কক্ষে উপস্থিত বিশিষ্ট সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ লিখেছেন, ‘১৯৬৮ সালের ২০ জুন, সকাল ৯টায় মামলা শুরুর দিন ঢাকা শহর ও সামরিক এলাকায় উত্তেজনাকর উৎকণ্ঠাময় এক অস্থিরতা বিরাজ করছিল। সুস্পষ্ট বুঝতে পারা যাচ্ছিল যে, কুর্মিটোলাস্থ সামরিক বাহিনী আর জনগণের অবস্থান পৃথক সত্তায় অবস্থিত। তখন থেকে ডিএফআই (তিন বাহিনীর সংযুক্ত গােয়েন্দা সংস্থা) সামরিক বাহিনীর বাইরে কিছুটা প্রকাশ্য কিছুটা অপ্রকাশ্যভাবে মামলার প্রতিক্রিয়া জানা ও জনগণের মধ্যে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে উন্মুক্ত হতে থাকে। এদের প্রধান সহযােগী ছিল প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় গােয়েন্দা বিভাগ। জনাব মুস্তাফিজুর রহমান তখন অভিযুক্তদের ইন্টারােগেশনের কর্তৃত্ব করতেন বলে সংশ্লিষ্টগণ জানান। ট্রাইব্যুনাল কক্ষে প্রথমদিকে প্রবেশের সময় মনে হতাে একটি ভীতিকর নির্যাতন কক্ষে অথবা গ্যাস চেম্বারে প্রবেশ করছি।
ক্ষুদ্র কক্ষের বিচারকদের ডানপাশে ছিল নির্দিষ্ট কয়েকজন সাংবাদিকের জন্য চেয়ার ও টেবিল। তাদেরই বামপাশে গা ঘেঁষে বক্ষ সমান্তরাল বেড়ি দিয়ে অভিযুক্তদের (আসামি) জন্য স্থান করা হয়েছিল। উঁচু এজলাসের মুখােমুখি অতি কাছে ছিল দুই পক্ষের কৌসুলিদের বসার স্থান। তাদের পেছনে ছিল দর্শকদের জন্য নির্ধারিত চেয়ার। সাক্ষীর কাঠগড়া এজলাসের বাঁ হাতের কোণায়। নটা বাজার মিনিটপাঁচেক আগে বিচার কক্ষের ডানদিকের দরজা দিয়ে অভিযুক্তদের নির্দিষ্ট এলাকায় উপস্থিত করা শুরু হয়। সমগ্র কক্ষ নিস্তব্ধ । পিন পতনের শব্দও যেন শােনা যাবে। ন’টা প্রায় বাজে বাজে। বিচারকগণ পেছনের দরজা দিয়ে এজলাসে স্ব-স্ব আসন গ্রহণ করবেন। বিচারপতিগণ আগমনের পূর্বে উৎকণ্ঠিত আইনজীবীগণ এবং অতিকষ্টে অনুমতিপ্রাপ্ত অভিযুক্তদের মা-বাবা-সন্তান। ও আত্মীয়স্বজন দর্শকরূপে নির্বাক হয়ে পাশের দরজার দিকে তাকিয়ে আছেন। প্রথমেই অভিযুক্তদের অভিযােগের গুরুত্ব অনুযায়ী প্রদত্ত আসন নম্বর আগে থেকেই নির্ধারিত ছিল। প্রথম যিনি পাশের দরজা দিয়ে ট্রাইবুনাল কক্ষে প্রবেশ করলেনরাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে অভিযুক্ত এক নম্বর ব্যক্তি, দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান। ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত দীর্ঘকায় শংকাহীন মানুষটি দৃঢ় পদক্ষেপে নির্দিষ্ট আসনের দিকে এগিয়ে গেলেন। প্রবেশের পরেই তিনি সমগ্র কক্ষটির ওপর চোখ বুলিয়ে গেলেন । খালি উচু এজলাসের দিকে তাকালেন। মৃদু হাসি, বলিষ্ঠ মনােভাব ও অকুতােভয় মানুষটিকে দেখার সাথে সাথে দর্শক ও আইনজীবীদের মধ্যে একটি গুঞ্জন শােনা গেল।
তিনি যেন ভুলেই গেছেন যে ফাঁসি দেয়ার জন্য ষড়যন্ত্রের কোনাে মামলায় তাকে আনা হয়েছে। তার পাশেই ছিলেন দু’নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তি বিদ্রোহের প্রধান পরিকল্পনাকারী লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মােয়াজ্জেম হােসেন ও তৃতীয় ব্যক্তি তেজী স্টুয়ার্ট মুজিবুর রহমান এবং তার পরেই সুলতান উদ্দিন। শেখ মুজিব চিরাচরিত অভ্যাসমতাে পা বাড়িয়ে প্রথম সারির কোণায় প্রথম আসনে অতি স্বাভাবিকভাবে পা ক্রস করে বসলেন। তখন আমি তার পাশাপাশি হয়ে গেলাম। মাঝখানে কাঠ ও লােহার রডের বিভাজন মাত্র। আমি রিপাের্টারদের সারিতে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে বসা ছিলাম বলে আমার ও তার মধ্যে মাত্র হাত দুয়েক ব্যবধান ছিল। এমনটি ঘটবে তা আগে ভাবিনি। একবার তার মুখের দিকে চাইবার সাথে সাথে ঘােষণা হলে বিচারকগণ প্রবেশ করছেন। প্রধান বিচারপতি এসএ রহমানের আসন গ্রহণের সাথে সাথে দুপাশে দুজন বিচারপতি আসন অলঙ্কৃত করলেন। এখন বিচার শুরু। স্বাভাবিকভাবেই সরকারপক্ষ থেকে অভিযােগ উত্থাপিত হচ্ছে। মঞ্জুর কাদের দাড়িয়ে মৃদু ও স্বাভাবিক কষ্ঠে আনুষ্ঠানিক দিক ব্যাখ্যা করছেন। আমি এবং অন্য সমস্ত রিপাের্টারই ফাঁসির আসামি এক নম্বর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে সারাজীবনই মুজিব ভাই বলতাম । ফলে সবার মনেই একদিকে যেমন তার সম্পর্কে উৎকণ্ঠা, অপরদিকে তাঁর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য নানা প্রশ্ন জাগছিল। এমন কি এত সতর্কতার মধ্যেও কথা বলা যায় কিনা সেই ফাক আমরা স্ব-স্ব পদ্ধতিতে ভাবছিলাম। কিন্তু যমের মতাে জাদরেল কালাে গাউন পরিহিত তিনজন বিচারপতি এবং সতর্কতাদানকারী বহুসংখ্যক ডিএফআই এবং আইবির লােক ক্ষুদ্র কক্ষটিতে শ্যেনদৃষ্টিতে শেখ সাহেবের দিকে চেয়ে আছেন। ভাবলাম, ডানদিকে বাঁকা করলেই গর্দান যাবে। এমন সময় আকস্মিক ডাক, ফয়েজ, ফয়েজ, এই ফয়েজ! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পাথরের মূর্তির মতাে বিচারকদের দিকে চেয়ে রইলাম। একটু পরেই আমার ডান উরুতে শেখ সাহেব হাত বাড়িয়ে কিছু একটা দিয়ে খুঁচিয়ে দিলেন।
দেখলাম তার সেই বিখ্যাত পাইপের আঘাত। নিশ্চয়ই তিনি অভ্যাসের দাবিতে (তামাকহীন) পাইপ আনতে অনুমতি পেয়েছিলেন। সাধারণত কোর্টে এ সমস্ত অনুমতি দেয়া হয়। এবার কি করি! আমি দুই পক্ষের কৌঁসুলিদের সামান্য তর্ক-বিতর্ক ফাকে পূর্বের ন্যায় প্রস্তর মূর্তির মতাে অন্যদিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বললাম, ‘মুজিব ভাই, কথা বলা মানা । মাথা ঘােরাতে পারছি না। বের করে দেবে।’ তক্ষুণি উত্তর আসলাে যথেষ্ট উচ্চকণ্ঠে, ‘ফয়েজ, বাংলাদেশে থাকতে হলে শেখ মুজিবের সাথে কথা বলতে হবে।’ তার এই কথা ছিল রাজনৈতিক ও প্রতীক ধৰ্মী। স্তম্ভিত কোর্ট, সব আইনজীবী ও দর্শকগণসহ সরকারি অফিসাররা তার এই সুস্পষ্টভাবে উচ্চারিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। প্রধান বিচারপতি একবার ডানদিকে ঘাড় বাঁকা করে শেখ মুজিব ও অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দিকে তাকালেন। কিছুই বললেন না। কোনাে সতর্ক উচ্চারণ ছিল না। তিনি হয় তাে কোর্টের আভিজাত্য বােধ থেকে এই দৃষ্টিপাতকেই যথেষ্ট সতর্কতা প্রদান বলেই মনে করেছিলেন এবং বােধহয় নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন যে, শেখ মুজিব এমন কারাগার, ভয়ভীতি, শংকা ও ট্রাইব্যুনালের বিচারের মধ্যেও শেখ মুজিবই রয়ে গেছেন। তবে কিসের সমর্থনে শেখ মুজিবের এই মনােবল, তা তিনি এমন সুউচ্চ অবস্থান থেকে অনুমান করতে পারেননি। তখন তিনি জানতেন না যে, শেখ মুজিবের এই প্রতীকী উচ্চারণ একজনের জন্য নয়, সমগ্র দেশের জনগণের মধ্যে অগ্নি প্রজ্বলনের বাণীস্বরূপ।” উত্তাল আন্দোলনের মুখে কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার হয়। বিনা শর্তে শেখ মুজিবসহ অভিযুক্তদের ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেয়। ১৯৬৮ সালের জুনের তৃতীয় সপ্তাহে এই মামলার শুনানি শুরু হয় এবং ‘৬৯-এর ২৭ জানুয়ারি তা শেষ হয়, ‘রায় ঘােষণার আগেই শুরু হয় উত্তাল আন্দোলন।
দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য মামলা প্রত্যাহারের জন্য মওলানা ভাসানী দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তাতে কাজ না হওয়ার শুরু করেন জ্বালাও-পােড়াও আন্দোলন। নীতিগত বিরােধ থাকা সত্ত্বেও মুজিবের মুক্তির জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ নেন ভাসানী। ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব মুক্তি পান। এর আগেই আইয়ুব খান ঘােষণা করেছিলেন, তিনি পরবর্তী নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হবেন না এবং তাঁর আইনমন্ত্রী এস. এম. জাফর আভাস দিয়েছিলেন যে, পরবর্তী প্রেসিডেন্ট পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত করার ব্যাপারেও রাজনীতিবিদদের মতৈক্যে পেীছা উচিত। গােলটেবিল বসাসহ এ সবই ছিল পূর্ববাংলার আন্দোলনকে প্রশমিত করার কৌশল। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ওই দিনই রাতে শেখ মুজিব ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দীর্ঘ সময় তাদের মধ্যে আলােচনা হয়। তবে আলােচনাকালে ভাসানী মুজিবকে গােলটেবিলে যেতে বারণ করেন। ভাসানী মুজিবের সঙ্গে আলােচনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকা এসেছিলেন পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টো, কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন প্রমুখ। ভাসানী তাদের একই কথা বলেন যে, শােষক ও শাষিত টেবিলে আলােচনায় বসলে শােষকেরই জয় হয়। শােষিতের নয়, জালেমের সঙ্গে আর কোনাে আলােচনা নয়, জনগণ তাদের দাবি আন্দোলনের মাধ্যমেই আদায় করবে।
১৭ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ সালে ডেমােক্রেটিক এ্যাকশন কমিটির এক গােলটেবিল বৈঠক ডাকেন এবং এতে সভাপতিত্ব করেন নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান। তিনি উক্ত গােলটেবিল বৈঠকে তিনটি শর্ত আরােপ করেন। ১. জরুরি অবস্থা তুলে নিতে হবে, ২. ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করতে হবে, ৩, সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে। উক্ত গােলটেবিল বৈঠকটি ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘৬৯ সালে বৈঠকে বসে এবং ১০ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি হয়। এ সময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘােষণা দেন তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন না এবং ‘৬২ সালের সংবিধান বাতিল করবেন এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করা হবে। ১০ মার্চ নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান কনফারেন্সে দুটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ ফেডারেল পার্লামেন্ট সিস্টেম চালু হবে, ২. জনগণের প্রত্যক্ষ ভােটাধিকারের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে বিস্তারিত প্রস্তাব উপস্থাপন করেন। কিন্তু ১১ দফা দাবির সঙ্গে ছাত্রদের যে সব দাবি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যেমন: সেকুলার এডুকেশন, সায়েন্স ল্যাবরেটরি উন্নয়ন, কাগজের দাম কমানাে, জগন্নাথ কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করা, ছাত্র বন্দিদের মুক্তি এবং পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শেখ মুজিব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, দেশের অখণ্ডতার একমাত্র পথ হলাে ৬ দফা ফর্মুলা । আইয়ুব খান সরাসরি প্রশ্ন করেন, এই অখণ্ডতা কোন দেশের জন্য? প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলেন শেখ মুজিবের ৬ দফা পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলবে। আমি যদি ৬ দফা মেনে নেই তাহলে কায়েদ-এ-আযম যা করেছেন তা বাতিল করা হবে । ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ওয়ালি খান বলেন, এক ইউনিট এবং আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে আমাদের বিশেষভাবে বিবেচনা করতে হবে। জামায়েত-ই ওলামায়ে ইসলামের নেতা মওলানা মওদুদী দাবি করেন, সংবিধানের ইসলামের মূলনীতি অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টির ভাইস প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আলী বলেন, লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমুদ্দীনের সময় এ বিষয়গুলাে নিরসন হয়েছে। তিনি আরাে বলেন, ১৯৫৩ সালে মােহাম্মদ আলী বগুড়ায় যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তখন এই ফর্মুলাগুলাে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। কোনাে কিছু অর্জন ছাড়াই গােলটেবিল বৈঠক ভেঙ্গে যায়। ১৯৬৯ সালে প্রথম দিক থেকেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ভাবমূর্তি বিনিষ্ট হতে থাকে। তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পায় এবং স্বাস্থ্য ভেঙে যায়। গােলটেবিল বৈঠকে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে তার সমর্থক সামরিক এবং বেসামরিক পর্যায়ে প্রশ্ন ওঠে। তারপরেও তার মিলিটারি সেক্রেটারি মেজর জেনারেল মােহাম্মদ রফিক, তথ্য সচিব আলতাফ গওহর ও সৈয়দ ফিদা হাসান যিনি ছিলেন তার রাজনৈতিক সচিব তার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক এবং উর্ধ্বতন সামরিক কর্তৃপক্ষের বিপরীতে তাকে সমর্থন করেন। হােম সেক্রেটারি এ বি আওয়ান ১৯৬৯ সালে মার্চ মাসে ঢাকা এবং করাচী ঘুরে দেখেন কেউ আদেশ-নির্দেশ মানছেন না। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। কার্ফিউ জারি করা হলেও তা ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে সেক্রেটারিয়েট ঘেরাও হচ্ছে। হরতাল চলছে। এমনকি সুইপাররা তাদের দাবির পক্ষে স্লোগান দিয়ে বেড়াচ্ছে। অনেক জায়গায় বিদ্যুৎ বন্ধ হয়ে গেছে। কলকারখানা বন্ধ । এ সময় জাস্টিস পার্টির প্রধান মার্শাল মােঃ আজগার খান বলেন, “অবিলম্বে সরকার মরে যেতে হবে। কিন্তু তখন এটা ছিল “too little to late” আইয়ুব খান সেনাপ্রধান ও তিন বাহিনী প্রধান থেকে সক্রিয় সমর্থনের আশ্বাস পাননি। তখন তিনি উপলব্ধি করেন তাকে প্রেসিডেন্ট পদ হতে সরে যেতে হবে। আওয়ামী লীগের দাবি সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন, এই প্রস্তাব হলাে পাকিস্তানকে দু’ভাগে বিভক্ত করা । আমার দেশের ধ্বংসের উপর আমি সভাপতিত্ব করতে পারি না। ৬ দফা মেনে নিলে কেন্দ্রের কোনাে প্রয়ােজনীয়তা নেই।
এ সময় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান কতগুলাে বিকল্প চিন্তা করেন। ১. আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আংশিক সামরিক শাসন জারি, ২. সারাদেশে সামরিক শাসন জারি করে প্রধান সামরিক আইন শাসকের ভূমিকা পালন, ৩. জাতীয় পরিষদের স্পিকার আব্দুল জব্বার খানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, ৪, পদত্যাগ ও সামরিক বাহিনীর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর । প্রথম ও দ্বিতীয়টির বিকল্প বাস্তবসম্মত ছিল না, যেহেতু তিনি সামরিক বাহিনীতে নেই। তৃতীয় বিকল্প হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে যখন বলেন, আপনি স্পিকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছেন না কেন? আইয়ুব খান উত্তরে বললেন, “I don’t trust this Bastard” কেননা কোনাে বাঙালিকে তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দেখতে চান না। ২৩ ফেব্রুয়ারি। ‘৬৯। রেসকোর্স ময়দান। শেখ মুজিবকে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অবিস্মরণীয় গণসংবর্ধনা দেয়। ঐ সংবর্ধনায় ডাকসুর সহ-সভাপতি ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক তােফায়েল আহমেদ ছাত্র-জনগণের পক্ষে শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত করেন। ১১-দফা বাস্তবায়নে মুজিবকে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানানাে হয়। ছাত্রনেতারা ঘােষণা করেন, ১১- দফার দাবি পূরণের মধ্যেই শহীদের রক্ত ও নির্যাতিত শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত মেহনতি জনতার দাবি পূরণ হতে পারে। আপসের বিরুদ্ধে ছাত্রনেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের মাহবুবুল হক দুলন বলেন, সারাদেশের ছাত্রদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তিনি আজ জনতার মাঝে ফিরে এসেছেন। জনগণের একমাত্র দাবি ও কর্মসূচি হচ্ছে ১১দফা। যদি ১১-দফা ছাড়া অন্য কিছু (গােলটেবিলে) আলােচনা হয় তবে এদেশের মানুষ মেনে নেবে না। ছাত্রনেতারা রাজবন্দিদের মুক্তি দাবি করেন।
অন্য যে-সব রাজনৈতিক নেতা এবং কর্মীর বিরুদ্ধে হুলিয়া রয়েছে তা প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা। এই পূর্বশর্ত পূরণ করা ব্যতীত শেখ মুজিবকে আলােচনায় না যাওয়ার জন্য তিনি। অনুরােধ জানান।” ‘ছয় দফা’ দেয়ার পর শেখ মুজিব জেলে গেলে নামকরা আওয়ামী লীগ নেতা ৬ দফার বিরােধিতা করে পি.ডি. এমপন্থী (পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক মুভমেন্ট) চলে যায়। তখন এম.এ. আজিজ ছয় দফার পক্ষে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। সে সময় আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদিকা ছিলেন আমেনা বেগম। এদের দুর্বল ও অনভিজ্ঞ নেতৃত্বের কারণে তখনকার আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে ৬ দফাপন্থীদের খুবই নাজুক অবস্থা ছিল। ছাত্রলীগ কর্মী ও নেতাদের চাপে এবং এম,এ আজিজের বলিষ্ঠ ভূমিকায় আওয়ামী লীগের জেলা নেতৃবৃন্দ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ছয় দফাপন্থী’ আওয়ামী লীগের অবস্থাকে সুসংহত করেন। আগরতলা মামলার কথা স্মরণ করে আতাউস সামাদ বলেছেন, “একদিন আদালত প্রাঙ্গণে বসে আমরা তার কাছে আন্দোলনের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি বলেছিলেন, “দেখ, ওরা আমাদের কিছু করতে পারবে না। আমার অনেক লােকজন আছে। তাদের সঙ্গে আমার যােগাযোেগও আছে । তােমরা দেখবে অচিরেই তারা কাজে নেমে যাবে। এবার এমন আন্দোলন হবে যে, আমরা সবাই ছাড়া পেয়ে যাব। অন্যদিকে সরকারের অবস্থা কাহিল হয়ে উঠবে। এবার আমরা রাজপথের আন্দোলন করে দেশ স্বাধীন করব।”। আতাউস সামাদের সঙ্গে কথা বলে এটা স্পষ্ট হয় যে, শেখ মুজিব জেলখানায় বসে বাইরের আন্দোলন তীব্র করার কলাকৌশল নিয়ে ভাবতেন। কাকে দিয়ে কোন্ কাজটি হবে সেটিও ছিল তারা জানা।
সে সময় আগরতলা মামলার বিষয়ে সংবাদ সংগ্রহে আসা সাংবাদিকদের মধ্যে আতাউস সামাদ ছিলেন অন্যতম এবং তিনি। ছিলেন শেখ মুজিবেরও বিশ্বাসভাজন। আতাউস সামাদ বলেন, “একদিন (সম্ভবত শনিবার) শেখ সাহেব সাংবাদিক আতাউস সামাদকে বললেন, “তুমি টি-ব্রেকের সময় আমার সঙ্গে একটু দেখা করাে। আমি তখন শেখ সাহেবের পেছনেই বসা। টি-ব্রেকের সময় আতাউস সামাদ সাহেব এলে শেখ মুজিব তাঁকে বলেন, ‘মওলানা (আব্দুল হামিদ খান ভাসানী) সাহেবের সঙ্গে তাে তােমার ভালাে সম্পর্ক। তুমি তাকে ভক্তিও করাে। এখনাে যােগাযােগ আছে তাে? সামাদ সাহেব বললেন, হ্যা আছে’। | শেখ সাহেব তাকে বললেন, ‘তুমি সন্তোষে গিয়ে ওনাকে বললা, শেখ মুজিব বলছেন, আপনাকে আন্দোলনে নামতে । আপনি না নামলে আন্দোলন পূর্ণাঙ্গ হবে না। আর এ ব্যাপারে উনি কী বলেন আমাকে জানাবে। এরপর রােববারের ছুটির পরদিন অর্থাৎ সােমবার টি-ব্রেকের সময় আতাউস সামাদ সাহেব এলে শেখ সাহেব জানতে চাইলেন খবর কী? সামাদ সাহেব বললেন, খবর ভাললা। উনি কাগজে স্টেটমেন্ট দিয়ে দিয়েছেন, আন্দোলনেও নামবেন শিগরিই। মঙ্গলবারেই পল্টনে সভা করবেন। শুনে শেখ মুজিব আতাউস সামাদকে বললেন, তুমি খুব ভালাে কাজ করেছ, আন্দোলন এবার ভালােভাবেই জমবে।”
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আগে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আরাে কয়েকবার দেখা হয়েছে আতাউস সামাদের। স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, ‘মার্চের শুরুতে একদিন শেখ সাহেবের বাসায় যাই কিছু দরকারি কথা বলার জন্য। সেখানে গিয়ে দেখি একদিকে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তৈরি করছিলেন, বঙ্গবন্ধু সেই পতাকা উঠাবেন বলে। আমি ভেতরে যেতে চাইলে ছাত্ররা বললাে, “উনি এখন কারাে সঙ্গে দেখা করবেন না, বিকেলে মিটিং আছে। এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন।’ আমি আমার পরিচয় জানিয়ে বললাম, আপনারা আমার নামটা বলেন, উনি করলে আমি চলে যাব। পরে অভ্যর্থনাকারীকে দোতলায় পাঠানাে হলাে। বঙ্গবন্ধু আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেন। আমি কাছে যেতেই তিনি জানতে চাইলেন, “কিরে দেশের খবর কি?’ আমি তাকে জানালাম, সেনাবাহিনী গােপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে, যে কোনাে সময় আক্রমণ করে বসতে পারে। বিশেষ করে আপনি যদি স্বাধীনতা ঘােষণা করে দেন তাহলে ওরা আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু আমাদের কাছে তাে অত অ নেই যে ওদের আক্রমণ ঠেকাবাে। অনেক মানুষ মারা যাবে। তিনি তখন জানতে চাইলেন, তাহলে কি করা যাবে? আমি তাকে অনুরােধ করি আপনি বক্তৃতায় আমাদের যে স্বাধীন হতে হবে এবং এ জন্য যে প্রস্তুতির প্রয়ােজন সে বিষয়ে বলতে পারেন, কিন্তু সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন না । বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “দেখ ছাত্ররা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। আমি ঘােষণা না করলেও ওরা এগিয়ে যাবে। কারণ ওদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য আমিই উৎসাহিত করেছি।
গণঅভ্যুত্থানের পারিপার্শ্বকতা ১৯৬৯ সাল ফেব্রুয়ারি মাস । প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন। কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ১১ দফার ভিত্তিতে আন্দোলন দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনে শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তির দাবি মুখ্য হয়ে ওঠে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে। মামলার আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হক ১৫ ফেব্রুয়ারি ক্যান্টনমেন্টে সেনা-ঘাতকের হাতে শহীদ হন। এ অবস্থায় সারাবাংলায় বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠে। ১৭ ফেব্রুয়ারি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহরে পৌছে। এক পর্যায়ে দালালদের বাসা ঘেরাও করে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা। লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস। পদ্মা তীরে টিয়ার গ্যাসের ঝাঝালাে গন্ধ। ছাত্র জনতা প্রতিরােধ গড়ে তােলে। আহত হয় ছাত্র জনতা। এ নিয়ে জেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ড. জোহার বিতণ্ডা হয়। লাঠিচার্জে আহত ছাত্রদের নিজ গাড়িতে তুলে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করান। তার সাদা শার্ট ছিল ছাত্রদের তাজা রক্তে সিক্ত।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত। ঐদিন রাতেই বাংলা বিভাগ কর্তৃক আয়ােজিত “ভাষা ও সাহিত্য সপ্তাহ পালনের জন্য আয়ােজিত সভা প্রতিবাদ সভায় রূপান্তরিত হয় । সভা পুলিশী গুণ্ডামির বিরুদ্ধে ছিল বিক্ষুব্ধ। ছাত্ররা গভীর রাত পর্যন্ত মিটিং করে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ১৪৪ ধারা ভাঙার। ১৮ ফেব্রুয়ারি। শাহ্ মখদুম হলের আবাসিক শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের সিদ্ধান্তের কথাটি সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রােক্টর ড. জোহাকে তার বাসভবনে গিয়ে জানালে তিনি বের হয়ে আসেন। ড. জোহা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে আসেন তখন নাটোর রােডের দিকে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেছে। ড. জোহার সঙ্গে আরাে কতিপয় শিক্ষক ড. মযহারুল ইসলাম, ড, এম, আর সরকার, অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, ড. কাজী আবদুল মান্নান, ড. আবদুল খালেক, ড, কছিম উদ্দিন মােল্লা, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অধ্যাপক আবদুল রাজ্জাক, প্রফেসর জুলফিকার মতিন প্রমুখ বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের নাটোর রােড থেকে সরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা চালান। ছাত্ররা যখন ফিরে আসছিল ঠিক সেই মুহূর্তে বিশ্বাসঘাতক সৈনিকগণ গুলিবর্ষণ করে। ড. শামসুজ্জোহা শহীদ হন। সেদিনের ছাত্র নূরুল ইসলাম রাজশাহী শহরে নির্মমভাবে নিহত হন। আহত হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুল খালেক, ড. কছিম উদ্দিন মােল্লা, ড, কাজী আবদুল মান্নান প্রমুখ। ড. জোহার মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্তৃপক্ষ একযােগে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ঘােষণা করেন। যা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বাংলাদেশে। অচল হয়ে পড়ে দেশ। ড. জোহার সমগ্র জীবনটাই ছিল কমিটমেন্টের। সমকালীন ইতিহাসে তখন চূড়ান্ত পর্যায়ে চলছে পাকিস্তান রাষ্ট্রকে টিকিয়ে রাখার ব্লু-প্রিন্ট, অন্যদিকে বাঙালি জাতিসত্তার স্বশাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম । স্বাধীনতার অদম্য আকাক্ষা।
স্বাধীনতা সংগ্রামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ধূসর দূরবর্তী এখনাে, অথচ গৌৰরােজ্জ্বল ইতিহাস তার, ব্যাপ্তি অনুদঘাটিত। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে এদের অবদান, মেধা রক্ত-মননকে প্রতিমুহূর্তের অস্বীকৃতি, জাতীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ করে না, করে দুর্বল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-জনতার দাবি ছিল দিনটিকে জাতীয় শিক্ষক দিবস’ ঘােষণা করার। আজ ছাত্র-শিক্ষকের ক্রমাগত সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির অপুষ্টি সেই দাবিই পুনরায় অনিবার্যতা নিয়ে এসেছে। ছাত্র-শিক্ষকের সুপ্রীতি, মেধামনন ও জ্ঞান চর্চার ভুবনকে সুস্থিত করতে ব্যর্থ হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার। ড. জোহা যদি ঢাকায় প্রাণ দিতেন তাহলে তার মূল্যায়ন কীভাবে হতাে। গণমাধ্যমে কীর্তিত হতাে জয়ধ্বনি। বাণী আসত রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান থেকে । রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি অনায়াসলব্ধ হতাে। উত্তর জনপদে মতিহার চত্বরে শায়িত ড, জোহাকে প্রকৃত অর্থে এই প্রজন্মের সামনে উপস্থিত করা হয়নি আজও। বলা হয়নি। ছাত্রের জন্য শিক্ষকের আত্মবলিদানের অত্যুজ্জ্বল গৌরবগাথা। ইত্তেফাকের রিপাের্টে বলা হয়েছে, “ঐ দিন রাতে রাজধানী ঢাকা নগরীতে অকস্মাৎ সান্ধ্য আইনের কঠিন শৃঙ্খল এবং টহলদানকারী সামরিক বাহিনী সকল প্রতিরােধ ছিন্নভিন্ন করিয়া হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আকস্মিক জলােচ্ছ্বাসের মতাে পথে নামিয়া আসে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফাটিয়া পড়ে। গতকল্য রাজশাহীতে জনৈক অধ্যাপকের হত্যা এবং সান্ধ্য আইন জারির খবর এখানকার ছাত্র ও সর্বশ্রেণীর নাগরিকের মনে প্রবল অসন্তোষের সঞ্চার করে। তদুপরি সংবাদপত্রে আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি সম্পর্কে আশাবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরেও শেখ সাহেব গােলটেবিল বৈঠকে যােগদানের উদ্দেশ্যে গতকাল ঢাকা ত্যাগ না করায় ছাত্র জনমনে এই বিশ্বাস দানা বেঁধে উঠে যে, শেখ সাহেবের মুক্তির ব্যাপারে সরকার আন্তরিক নন। বর্তমান প্রচণ্ড গণজাগরণের পটভূমি উপরােক্ত দুইটি ঘটনা ছাত্র-জনতাকে ক্ষিপ্ত করে তােলে এবং তারা সান্ধ্য আইনের অনুশাসন উপেক্ষা করে দাবি দাওয়ার প্রতিধ্বনি করার জন্য অকস্মাৎ রাস্তায় নামিয়া আসে।”
“কোন রকম পূর্ব ঘােষণা বা পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়াই প্রায় একই সঙ্গে শহরের এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত এইভাবে ছাত্র-জনতাকে রাস্তায় বাহির হইতে দেখিয়া সকলেই বিস্মিত হয়। রাত্রি ৮টার পর হইতে মধ্য রাত্রি পার হইয়া যাওয়া পর্যন্ত শহরের বিভিন্ন স্থানে সমানে বিক্ষোভ চলিতে থাকে। সামরিক বাহিনীর গাড়ির শব্দ এবং বিক্ষিপ্তভাবে বন্দুকের গুলির আওয়াজ পরিবেশকে আতঙ্কগ্রস্ত করিয়া তােলে।” | পরদিন ঢাকায় কারফিউ থাকা সত্ত্বেও কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দেন। সরকারি নির্দেশে পুলিশ, ই, পি, আর, ও সৈন্যের সম্মিলিত বাহিনী তাদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। এতে ২০ জন নিহত হন। এছাড়া কুষ্টিয়া ও ননায়াখালীতে ৪ ব্যক্তি নিহত এবং বহু লােক আহত হন।
গণঅভ্যুত্থান
৬-দফা সম্পর্কে মওলানা ভাসানীর নেতিবাচক মনােভাব এবং চীনের পরামর্শে “ডােন্ট ডিস্টার্ব আইয়ুব’ এই নীতিতে আইয়ুববিরােধী আন্দোলনে তার ভূমিকা ছিল বললেই চলে। কিন্তু ১৯৬৮ সালের শেষে ও ১৯৬৯ সালের প্রথমে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের বিরুদ্ধে যখন পূর্ব পাকিস্তানে গণআন্দোলন উত্তাল হয়ে উঠল, আয়ুবশাহীর অবস্থা হয়ে উঠল টলমল, তখন মৌলানা ভাসানী তীব্র ভাষায় আইয়ুবের সমালােচনা শুরু করে দিলেন। মওলানা ভাসানী বুঝতে পেরেছিলেন যে ফিল্ড মার্শাল আইয়ুবের দিন ফুরিয়ে এসেছে। যখন আইয়ুব ক্ষমতার তুঙ্গে তখন ভাসানী তাকে পরােক্ষভাবে হলেও সমর্থন দিয়েছেন। আবার আইয়ুব যখন সিংহাসন টলমল তখন মওলানা ভাসানী দিনরাত দুর্বল আইয়ুবের বিরুদ্ধে অগ্নিগর্ভ ভাষণ দিতে লাগলেন। মওলানা যখন দেখলেন শেখ মুজিব যখন আগরতলা মামলা থেকে আন্দোলন করার আহ্বান জানান, তখন তিনিও বিবৃতি দিলেন: “শেখ মুজিব ও আগরতলা ষড়যন্ত্রের সব বন্দিকে মুক্ত কর অবিলম্বে, এই মুহূর্তে। নয় তাে পরিণাম হবে গুরুতর।”
আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহের সময় ছিয়াশি বছর বয়সে মওলানা ভাসানী | যেন সংগ্রামী মূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। আইয়ুব রাজত্বের অন্তিম দিনগুলােতে মওলানা ভাসানীর এই সংগ্রামী ভূমিকা আন্দোলনকে একধাপ এগিয়ে নেয়। ১৯৬৯ সালের মার্চ মাসে রাওয়ালপিন্ডিতে যখন প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের “রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স” চলছিল সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে সফররত মওলানা ভাসানী শাহিওয়াল নামে একটি জায়গায় ট্রেনের মধ্যে লাঞ্ছিত হলেন, শারীরিক আঘাত পেলেন। খবর পেয়ে শেখ মুজিব কঠোর ভাষায় দুষ্কৃতকারীদের নিন্দা করে বললেন, “আমি মৌলানা ভাসানীর মতাে সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতার উপর এই বর্বর আক্রমণের জন্যে যারা দায়ী তাদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। রাজনৈতিক দল বা নেতাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তা প্রকাশ করার পন্থা নেতাদের উপর কাপুরুষােচিত চোরাগােপ্তা আঘাত নয়।” ১৯৬৯ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বেরিয়ে আসার পর স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’র কর্মকাণ্ড ও সংগঠন এবং নিউক্লিয়াস’র ব্যাপারে শেখ মুজিবকে প্রাথমিকভাবে অবহিত করা হয়। ফলে নিউক্লিয়াস’র সাথে শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এ সময় সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরিফ একই ফোরামের সদস্য হিসেবে কাজ করতেন। এই ফোরামের দায়িত্ব ছিল বৈদেশিক সাহায্য, সমর্থন, ট্রেনিং ও অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা। | ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে আদর্শগত ভিন্নতা থাকলেও স্বাধীনতার প্রশ্নে নীতিগত অভিন্নতা ছিল । ছাত্রলীগ, বাঙালি জাতীয়তার প্রশ্নে উপনীত হয়ে শেখ মুজিবের নির্দেশে স্বাধীনতার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। যারা বলেন, বঙ্গবন্ধু সামরিক বাহিনীকে পূর্বাহ্নে নির্দেশ দেননি তাদের জবাব পাওয়া যাবে হাসান জহির, আব্দুল রহমান সিদ্দিকীর লিখিত বই থেকে এবং শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত গ্রন্থ থেকে। এখানে তিনটি বই থেকে প্রমাণ তুলে ধরা যেতে পারে।
জহির লিখেছেন, ২৫ মার্চ ৭১-এর পর ২০ বালুচ ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্টাল সেন্টার দখল করার পর তিনি গেলেন ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের বাসায়। একটি কক্ষে, বলা যেতে পারে অপারেশন রুম। সেই কক্ষের দেয়ালে পুরাে পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। কোথায় কোথায় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন, ইপিআর, পুলিশ প্রভৃতি মােতায়েন তা চিহ্নিত করা। দেখে মনে হচ্ছিল মজুমদারের কথা ছিল সম্পূর্ণ ইপিআর বা বাঙালি সৈন্যদের নিয়ন্ত্রণ করার । তার ভাষায়, ব্রিগেডিয়ার মজুমদার শেখ মুজিব সম্পর্কে কোথাও কোনাে মন্তব্য করেননি। কিন্তু যে সৈনিকটি বঙ্গবন্ধুকে লাঞ্ছিত করেন, আগরতলা মামলায় নিভৃতে ফেরার সময়, এই জঘন্য কাজটি করেছিল মােস্তাফিজুর রহমান। আর কোনাে সৈনিকের ছবি তিনি আলাদাভাবে দেননি। যেন এরূপ আচরণ বঙ্গবন্ধুর পাওনা ছিল এবং যে এই জঘন্য কাজটি করেছিল সে যথার্থ করেছিল, সাহসীও বটে। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের গ্রেফতার ও তার সম্পর্কে বিস্তারিত তিনি লিখেছেন। অন্য কোনাে জেনারেল এ সম্পর্কে তেমন লিখেননি। ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের কথা আমরা এখন বিস্মৃত, কিন্তু তিনিই ছিলেন তখন সিনিয়র বাঙালি অফিসার যিনি পাকিস্তানিরা আঘাত হানার আগেই আঘাত হানতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা তাকে গ্রেফতার করে যথেষ্ট নির্যাতন করেছে। তিনি মুখ খােলেননি। স্বাধীনতার পর পুরস্কৃত হওয়া দূরে থাকুক, কেউ তার কথা মনেও রাখেনি।
তবে মজুমদার যে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে যােগাযোেগ রাখছিলেন তা পাকিস্তানি গােয়েন্দাদের চোখ নিশ্চয় এড়িয়ে যায়নি। তারা তাকে সন্দেহ করেছে, জিয়াউর রহমানকে নয়, কারণ, সন্দেহ করলে ২৫ তারিখ রাতে সােয়াত’ থেকে অত্র খালাসের জন্য জিয়াকে পাঠানাে হতাে না।” ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের ভাষ্য অনুযায়ী-“সিদ্দিকী সাহেব ফিরে এসে আমাকে জানালেন, শেখ সাহেব বলেছেন, “ব্রিগেডিয়ার সাহেব খামােখা টেনশন করতেছেন। ওনাকে ধৈর্য ধরতে বলুন। আমরা রাজনীতিবিদরা আলাপ করতেছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আলাপ শেষ না হবে ততক্ষণ ধৈর্য ধরতে বলুন।* সময় আসলে আমি ওনাকে জানাব।’ ওসমানী সাহেব জিজ্ঞেস করেছিলেন সময় আসলে উনি কেমন করে জানবেন?’ বঙ্গবন্ধু বলেন, ঢাকায় রেডিও স্টেশনে বাংলার অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ হলে জানাবেন আলােচনা ব্যর্থ হয়েছে। আর আমি ওনার জন্য একটা মেসেজ রেকর্ড করে রাখব এবং সেটা জহুর আহমদ সাহেবের মাধ্যমে ওনাকে দেব। ২১ মার্চে ধারণকৃত ঐ মেসেজ শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর চিটাগাংয়ে ২৬ মার্চ প্রচার করা হয়। ঢাকায় তার সহপাঠী ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের বাসায় রাখা হয়। সেখান থেকে তিনি সরে পড়েন ও আবারও জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। সেই সময় হানাদার বাহিনী তাকে গ্রেফতার করে করাচী তারপর খারিয়ার রেস্ট হাউসে নিয়ে যায় । ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ছাড়াও ‘৭১-এর ফেব্রুয়ারি মাসেই স্বাধীনতার সংগ্রাম সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ধানমণ্ডির ৮ নম্বর রােডের বাড়িতে মেজর খালেদ মােশারফের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়-এ সম্পর্কে তার ভাই সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী রাশেদ মােশাররফ আমাকে বলেছিলেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দেবে না, আমাদের লড়াই করেই দেশ স্বাধীন করতে হবে। এ কথা খালেদ মােশাররফ রাশেদ মােশাররফকে বলেছিলেন। রাশেদ মােশাররফ এ কথা বলেছিলেন, জেনারেল ওসমানীকে সামনে রেখে সশস্ত্র যুদ্ধের মহড়া দিতে হবে। যাতে পাকিস্তানের গােয়েন্দা সংস্থার চোখ তার দিকে না যায় ।
‘৬৮ সালের ১৯ জুন মামলা শুরু হয়ে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কর্নেল শওকতসহ অন্য আসামিদের পরস্পরের মধ্যে কথা বলার সুযােগ তৈরি হয়। সে। সময় মামলা পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর অবস্থান কী ছিল এমন প্রশ্নের জবাবে কর্নেল শওকত বলেন, মামলা শুরুর পর আমরা একসঙ্গে কোটে যাওয়া আসা করতাম। আমাদের ১৩ জনকে একটা অফিসার্স মেসে রাখা হয়েছিল । সেখানেও আমরা মাঝে মধ্যে কথা বলতে পারতাম। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে বিকল্প উপায় নিয়েও ভাবতেন। সংশ্লিষ্টদের মনােভাব বুঝে তারপর নিজে সিদ্ধান্ত নিতেন। আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে ঢাকা সেনানিবাসে থাকার সময় এবং আদালতে আসা-যাওয়ার সময় পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে বিভিন্ন জনের মতামত জানতে চাইতেন তিনি। একদিন বঙ্গবন্ধু বললেন, “আচ্ছা এবার তাে ধরা পড়ে গেলি। এরপর দেশকে স্বাধীন করতে চাইলে ভবিষ্যতে কি করবি? তখন আমাদের একেকজন এক এক রকমভাবে নিজের ভাবনার কথা বললাম। কেউ
বললেন, দেশ স্বাধীন করতে হলে আন্দোলন অব্যাহত রাখতে হবে। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যে অনেক বাঙালি আছেন যারা আমাদের সাহায্য করবেন। কারণ তখন যারা গ্রেফতার হয়েছেন তাদের বাইরে আরও অন্তত তিন হাজার পাঁচ শ’ সদস্য রয়ে গেছেন। আবার অনেকে বললেন, এবার রাজনৈতিকভাবে এগােতে হবে। সহকর্মী, সমর্থক যারা আছেন তাদের সেভাবেই সমর্থন সহযােগিতা থাকবে। কর্নেল শওকত আলী বলেন, মামলা শেষ হয়ে যাওয়ার পর আমি শুনেছি আমাদের সৈনিক সংগঠনের বাইরে তাঁর নিজস্ব একটা পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রলীগের নেতাদের নিয়ে। দেশের স্বাধীনতা, গেরিলা যুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা এবং কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা যায় এসব বিষয়ে তিনি কথা বলতেন ছাত্রনেতাদের সঙ্গে।
পরে দেখা গেল বঙ্গবন্ধু আন্দোলনকে পুরােপুরি রাজনৈতিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যান। আমার মনে হয়েছে, তিনি নিজস্ব অন্য কোনাে সূত্রের (সাের্সের) মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ করে কোথায় গেলে কী রকম সাহায্য পাওয়া যাবে, বিশেষ করে যুদ্ধ বেধে গেলে কী করতে হবে, এসব ব্যাপারে একটা ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন। এ ব্যাপারে সেই সূত্রকে ব্যবহার করেছিলেন। তবে সেই সূত্রটিও গোপন রাখা হয়।’
নির্বাচনের নেপথ্যে স্বাধীনতার প্রচারণা
১৯৭০ সালের নির্বাচনে পূর্ব ও পশ্চিমের বৈষম্য এবং বাংলাদেশকে শােষণের চিত্র জনগণের কাছে তুলে ধরা হয়। এ সময় ৬ ও ১১ দফাভিত্তিক দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, অন্যথায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শ্লোগানটি জনগণের কাছে চলে আসে। ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’র পরিবর্তে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান সর্বত্র ধবনিত হতে থাকে। এ সময় ‘নিউক্লিয়াস’ ‘জয়বাংলা’ নামের একটি সাইক্লোস্টাইল পত্রিকা বের করে । এই পত্রিকায় নির্বাচনের ফলাফলের সাথে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের সফলতার ভাগ্য জড়িত থাকার ইঙ্গিত দেয়া হয়। এ সমস্ত বিষয়ের উপর প্রকাশ্যে বক্তৃতা দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়।
১৯৭০ সালের ১২ আগস্ট ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ’ গঠন করার প্রস্তাব পেশ করেন তৎকালীন প্রচার সম্পাদক স্বপন কুমার চৌধুরী। কেন্দ্রীয় কমিটিতে তখন সদস্য সংখ্যা ছিল ৪৫ জন। অনেক বাকবিতণ্ডার পর এই প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের বিপক্ষে ছাত্রলীগের ৮ জন প্রভাবশালী সদস্য ভােট দেয়। আবদুর রাজ্জাকের মারফত শেখ মুজিব এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন এজন্য যে, এ সময় সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে । কেননা জাতি রাষ্ট্র গঠনে জাতীয়তাবাদকে মূল শক্তি ধরে এগুতে হবে এবং এতদিন সেই ধারায় আন্দোলনে অগ্রসর হয়েছে। আমার অবশ্য মনে হয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেউ যেন বিভ্রান্ত করতে না পারে সেজন্য প্রাথমিকভাবে বঙ্গবন্ধু হয় এসব তাত্ত্বিকতার মধ্যে জড়াতে চাননি। প্রস্তাব গ্রহণের সময় তৎকালীন সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীসহ বিপক্ষের ৮ জন অনুপস্থিত ছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে সেই প্রস্তাব শেখ মুজিব ও আবদুর রাজ্জাকের অনুরোধে সংশােধন করতে হয়। শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলাদেশ’ গঠন করার প্রস্তাব নেয়া হয়। অবশ্য সেদিনের বিপক্ষে। ভােটদানকারী সদস্যরা প্রকৃতই স্বাধীনতার বিরােধী ছিলেন এমনটা বলা যায় না। এই আটজনের ভেতর সাতজনকেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে অংশগ্রহণ করতে দেখি।১৬ ‘৭০ সালে নির্বাচনী প্রচার জানুয়ারির মাসে শেষ সপ্তাহ থেকে মার্চ মাসের মধ্য সময় পর্যন্ত শেখ মুজিব। রাজশাহী, টাঙ্গাইল, সিলেট, খুলনা, যশাের, নােয়াখালী, নেত্রকোনা, কিশােরগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, পটুয়াখালী, ভােলা, ফরিদপুর, মাদারীপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, সুনামগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ, রংপুর ও দিনাজপুরের বিভিন্ন জনসভায় ভাষণদান করেন। এসব তার নির্বাচনী প্রচার অভিযান এবং সাংগঠনিক তৎপরতার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
তিনি সমগ্র পূর্ব বাংলাকে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে এবং নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ দফাভিত্তিক অধিকার অর্জনের স্বপক্ষে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে রূপান্তরিত করেন। এই শক্তি সাড়ে সাত কোটি মানুষের সমবেত শক্তি-এই শক্তি গণতান্ত্রিক চেতনার এক জাগ্রত শক্তি। ৭ ডিসেম্বর ‘৭০ সালে পাকিস্তানের প্রথম ও শেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভােটার সংখ্যা ছিল পূর্ব বাংলায় ৩,১২,১১,২২০ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ২,৫৭,৩০,২৮০। আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় জাতীয় পরিষদের ১৬৮টি আসনের মধ্যে ১৬০টি এবং প্রাদেশিক পরিষদে মােট ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর এতবড় পরাজয় সহ্য করার মানসিকতা ছিল না। ২ মার্চ ‘৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের বটতলায় লক্ষাধিক লােকের সামনে ছাত্র সংগ্রাম কমিটির সভায় আ স ম আবদুর রব কলাভবনের পশ্চিম প্রান্তের গাড়ি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পতাকাটি প্রদর্শন করেন। এই পতাকাই পরদিন (৩ মার্চ) পল্টন ময়দানে সাজাহান সিরাজের ‘স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ’এর জনসভায় উত্তোলন করা হয় । ঐ মঞ্চে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন। ( ২৩ মার্চ পাকিস্তানের প্রজাতন্ত্র দিবসে পাকিস্তানি পতাকার পরিবর্তে ‘জয়বাংলা বাহিনী আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের মাধ্যমে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যায় । ঐদিন জয়বাংলা বাহিনীকে ৪টি প্লাটুনে ভাগ করে ৪ জন প্লাটুন কমান্ডারকে দায়িত্ব দেয়া হয়। জয়বাংলা বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন আ স ম আবদুর রব, আবদুল কুদুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, সাজাহান সিরাজ, কামালউদ্দিন (পরে বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের অফিসার) ও মনিরুল হক (ঢাকা শহর ছাত্রলীগ সভাপতি)। পতাকা উত্তোলনের মুহূর্তে কামরুল আলম খান খসরুর হাতের ৭ এম, এম, রাইফেল থেকে ফাঁকা গুলি করে শব্দ করা হয়। খসরুর পাশে হাসানুল হক ইনু পতাকাটি হাতে নিয়ে ঊর্ধ্বে উঠে দাঁড়িয়ে ছিলেন।
এখান থেকেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা শেখ মুজিবের ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাড়িতে গিয়ে তার হাতে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তুলে দেয়। তার বাসায় ও গাড়িতে দুটি পতাকা ওড়ানাে হয় । এই ‘পতাকা’ই স্বাধীন বাংলাদেশের “প্রবাসী সরকার অনুমােদন করেন।
আওয়ামী লীগের সভা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ জানুয়ারি থেকে প্রকাশ্য রাজনীতি করায় ফরমান জারি করে। প্রথম সুযােগটি গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। সবদিক দিয়েই ১৯৭০ সালের ১১ জানুয়ারির আওয়ামী লীগের সভাটি ছিল দেখার মতাে এবং সুসংগঠিত। সভাবেশের ধরনও ছিল বেশ চমৎকার। সাংবাদিকতার ভাষায়-এটা ছিল একটা “বিশাল জনসভা। শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর প্রথম নির্বাচনী সভায় ভাষণ দিলেন। বললেন, বাঙালিরা ‘৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নিয়ে ভুল করেছে। আজো যদি কেউ একে বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করত তাহলে তিনি প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলতেন। ভাষণে তিনি বলেন, এই সভাতেই প্রথমবারের মতাে সিরাজুল আলম খান জয়বাংলা’ শ্লোগান নিজ মুখে উচ্চারণ করেন। এই ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানই বাঙালির পরিচয়কে সুনির্দিষ্টভাবে ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করার সুযােগ সৃষ্টি করে।
জামায়াতের সভা পণ্ড
পরের রােববার (১৮ জানুয়ারি) একই ময়দানে জামায়েতে ইসলামী তাদের প্রথম নির্বাচনী জনসভা করল । জামায়াত এ সভার গুরুত্ব উপলব্ধি করে একে সফল করে তােলার যাবতীয় চেষ্টা করল; কিন্তু চোখের পলকে এ সভাটি একটি হাতাহাতির যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হলাে। পঞ্চাশজনের মতাে আহত হলাে। আহতদের মাঝে পচিশ জনের অবস্থা গুরুতর ছিল। পার্টির আমীর মওলানা আবুল আলা মওদুদী শুধু জনসভায় বক্তৃতা করার জন্য লাহাের থেকে উড়ে এসেছিলেন; ব্যর্থ মনােরথ হয়ে তাকে মাঠ ত্যাগ করতে হলাে। এই খণ্ডযুদ্ধের পর থেকে জামায়াত একটি ক্ষুব্ধ ও | অক্ষম রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হলাে। একজন সিনিয়র মার্শাল অফিসার জনসভায় জামায়াতকে সরকারি ছত্রছায়া দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু জামায়াতের পক্ষ থেকে অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়। তাকে জামায়াতের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, ‘আমরা সবকিছুর ব্যবস্থা রেখেছি’। অফিসারের ধারণা হলাে, জামায়াত প্রমাণ করতে চাইছে। যে, যদি আওয়ামী লীগ কোনাে সাহায্য ছাড়াই সাফল্যজনকভাবে সভা করতে পারে তা হলে তারা কেন পারবে না। তাদের মতে, একটি দুর্বল দলই সরকারি ছত্রছায়া কামনা করে। এ বিষয়টি জামায়াত-ঘেঁষা একজন সাংবাদিকের কাছে উত্থাপন করলে তিনি বললেন, না, জামায়াত ছত্রছায়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়নি। সরকার বেড়ার উপর বসেছিল তার দল নিরপেক্ষ চরিত্র প্রতিষ্ঠিত করার জন্য।
১৭ জানুয়ারি নিউক্লিয়াস’-এর পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল যে, জামায়াতের আমির মওলানা মওদুদীকে ১৮ জানুয়ারি ঢাকার পল্টনে জনসভা করতে দেয়া হবে না। জনসভার মঞ্চ প্রায় দশ ফুট উঁচু এবং বিরাট আকারের। মঞ্চের নিচে তারা কয়েক হাজার তিন ফুটের গজারির লাঠি লুকিয়ে রেখেছিল। এক পর্যায়ে জামায়াতের জনৈক বস্তা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অশালীন ভাষায় বক্তব্য রাখলে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মী-সংগঠকরা তার প্রতিবাদ করে। পরে তা হাতাহাতি ও মারামারিতে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে গুলিস্তান এলাকার সাধারণ হকার, হােটেলের কর্মচারী ও ফকিরাপুলের স্থানীয় লােকেরা জামায়াতের কর্মীদের আক্রমণ করে। প্রথমে জামায়াত খুব সুশৃঙ্খলভাবে তা প্রতিহত করে। তাদের একজন নায়েব মঞ্চের মাইক থেকে বলতে থাকে, বদর বাহিনী পূর্ব দিক থেকে, সালেহীন বাহিনী’ পশ্চিম দিক থেকে আক্রমণ করুন। এমনিভাবে আরাে অনেক বাহিনীর নাম উচ্চারণ করেছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর জনতার প্রচণ্ড আক্রমণে তারা রণে ভঙ্গ দেয় । মিটিং পণ্ড হয়ে যায়। এতে জামায়াত কর্মী ও পথচারীসহ ৫০০ জন আহত হয় । ২৫ জানুয়ারি ডাকসু ও ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টনে বিরাট জনসমাবেশে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করা হয়, নির্বাচন বানচালের যে কোনাে চক্রান্ত এদেশের সংগ্রামী জনতা প্রতিহত করবে।”
পতাকা
২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র জনতার সভায় অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের মহাসমুদ্রে কলাভবনের পশ্চিমের গাড়ি বারান্দাকে মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের (সিরাজুল আলম খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী গঠিত হয়।) চার নেতা সভা শুরু করেন। এমন সময় তকালীন জগন্নাথ কলেজের সাধারণ সম্পাদক, নজরুল ইসলাম, ইকবাল হল থেকে প্রস্তাবিত স্বাধীন। বাংলাদেশের পতাকাসহ মিছিল নিয়ে সভাস্থলে উপস্থিত হন। তার কাছে থেকে ডাকসুর সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব ঐ পতাকা হাতে নিয়ে দর্শক শ্রোতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এই পতাকাই আজ হতে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা। প্রদর্শনের সময় লাখাে জনতা মুহুর্মুহু করতালি দিয়ে নতুন পতাকা’-কে স্বাগত জানায়। অন্যদিকে, এদিন পূর্ব বাংলার গভর্নর ডাইস এডমিরাল এস এম আহসান পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াকুব খান গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সন্ধ্যায় বেতারে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি ঘোষণা করা হয়। সাথে সাথে ছাত্রজনতা-শ্রমিক-কর্মচারী ও খেটে খাওয়া গরিব মানুষ কারফিউ ভেঙ্গে মিছিল বের করে। স্লোগান ওঠে, সান্ধ্য আইন মানি না-মানি না । ২ মার্চের স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রথম দিক-নির্দেশনা। এর পরের প্রধান কাজটি ছিল স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়ন এবং জাতীয় সঙ্গীত’ নির্ধারণ করা। কারণ পরদিন ৩ মার্চ পল্টনে নির্ধারিত জনসভা।
জাতীয় সঙ্গীত
স্বাধীনতার ইশতেহার প্রণয়নের গুরুত্বপূর্ণ কাজটি সম্পাদন করার জন্য সিরাজুল আলম খানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। সঙ্গে ছিলেন আব্দুর রাজ্জাক। সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আবদুর রউফকে নিয়ে কাজ শুরু হয়।
ইতােপূর্বে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ, ঢাকার বিভিন্ন কলেজে ছাত্রলীগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেশাত্মবােধক সঙ্গীত হিসেবে রবীন্দ্র, নজরুল, ডি এল রায় প্রমুখের লেখা বেশ ক’টি দেশাত্মবােধক গান গাওয়া হতাে। এগুলাের মধ্য থেকে তিনটি প্রাথমিক বিবেচনায় এলােঃ “আমার সােনর বাংলা……’ ‘ধন ধান্য পুষ্পে ভরা…’, এবং ‘চল চল চল, উধ্ব গগনে বাজে মাদল। বঙ্গবন্ধুর কাছে পরামর্শ চাওয়া হলে আমার সােনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে অনুমােদন করেন। সেসময় প্রতিটি অনুষ্ঠানে। সােনার বাংলা সঙ্গীতটি গীত হতাে।
স্বাধীন বাংলা প্রচারে আব্দুর রাজ্জাক
ষাটের দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের ডি.পি, থাকাকালীন তার সাথে পরিচয় হয়। তখনও সাধারণ ছাত্ররা জানত না স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের কথা । সিরাজুল আলম খান যেমনটি বলেছিলেন তিনিও বলতেন স্বাধীন বাংলার রূপকল্প। স্বাধীনতার জপমালা হাতে ছাত্রলীগকে সংগঠিত করার ক্ষেত্রে সমগ্র দেশে তার বিচরণ। ছয় দফা ঘােষণার পর শাসক চক্রের আক্রোশে বঙ্গবন্ধু কারাগারে। চক্রান্ত। অস্ত্রের ভাষায় ছয় দফাকে স্তব্ধ করে দেয়ার প্রিন্ট। একদিকে নির্যাতন-নিপীড়ন অন্যদিকে প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। নেতৃবৃন্দ জেলে। ছয়-দফা আর আট-দফাপন্থী। আট-দফা নিয়ে নবাবজাদ নসরুল্লাহ খান ও সালাম খান মাঠে। পাকিস্তান কাঠামােতে গোঁজামিলের স্বায়ত্তশাসন। আর ছয় দফা হলাে বাঙালির শােষণ, বঞ্চনা-বৈষম্যের সনদ। বাঙালিদের বাঁচার দাবি। ছয় দফা থেকে স্বাধীনতার স্বশাসন, এক-দফা ও স্বাধীনতা। এ দুঃসময়ে ছাত্রলীগ ছিল কাণ্ডারি । নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মণি, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ, মযহারুল হক বাকি, নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদুস মাখন এবং উত্তর জনপদে আবদুর রউফ, আবদুল জলিল, সরদার আমজাদ হােসেন, আবু সাইয়িদ, আয়েশ উদ্দিন প্রমুখ। সেই কাফেলায় তারা ছিলেন ক্লান্তিহীন, দূরন্ত অগ্রপথিক। দক্ষ সংগঠক। সেই থেকে তাদের অবিরত পথ চলা। শপথ ‘৭০ সালে নিখিল পাকিস্তানে নির্বাচন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ ও প্রাদেশিক পরিষদে ডজনখানেক বাদে সব আসনে বিজয়ী হয়। জনগণ ছয় দফার পক্ষে ম্যান্ডেড দিয়েছে। শুরু হয় চক্রান্ত ষড়যন্ত্র।
তেসরা জানুয়ারি ১৯৭১ রােববার আওয়ামী লীগের নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা রেসকোর্স ময়দানে প্রকাশ্যে জনতার সামনে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বঙ্গবন্ধু স্বয়ং। জনগণের সামনে প্রকাশ্যে এভাবে জনপ্রতিনিধিদের শপথ অনুষ্ঠান দেখার জন্যে এদিন রেসকোর্স ময়দানে জনতার সমুদ্র। ১২০ ফুট দীর্ঘ ও ১২ ফুট উঁচু বিরাট নৌকার অনুরূপ একটি মঞ্চ হয় । আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সকল সংসদ সদস্য এতে আরােহণ করেন। ‘আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালােবাসি’ রবীন্দ্র সঙ্গীত দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয় এবং ‘জয় বাংলা, বাংলার জয় একটি গানও সমবেত কণ্ঠে পরিবেশিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী জাহেদুর রহিম, আবদুল জব্বার, অজিত রায়, আবদুর রউফ ও আবদুল গনি বােখারী প্রমুখ এতে কণ্ঠ দেন। বঙ্গবন্ধু ৬ দফার প্রতীক স্বরূপ ৬টি কবুতর বিপুল করতালির মধ্য দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেন এবং নিজের কণ্ঠে মােট ৬টি স্লোগান দেন। এগুলাে ছিল। নিম্নরূপ: ১. নারায়ে তাকবীর- আল্লাহু আকবার, ২. পাকিস্তান-জিন্দাবাদ, ৩. আমার দেশ, তােমার দেশ-বাংলাদেশ বাংলাদেশ, ৪, জাগাে জাগাে- বাংলা জাগে, ৫. জয় বাংলা, ৬. জয় পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু সেদিন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতার দায়িত্ব পালন করেন, অন্যদিকে, তােমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ স্লোগানের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি হিসেবে একটি স্বাধীন ও নতুন দেশের স্বপ্নকেও জাতির সামনে দৃশ্যমান করেন। এদিনের সমাবেশে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণ ছিল প্রতীকী ও তাৎপর্যপূর্ণ। বিশ্লেষকদের অনেকেই এই ভেবে বিস্মিত হন যে, কি করে সেদিন তিনি এত আগে আন্দোলন ও নির্বাচনের সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে আরাে বলেন, ‘শুধু নির্বাচনে জয়লাভ করলেই দাবি আদায় হয় না।
দাবি আদায়ের জন্য আরাে সংগ্রাম করতে হবে। আগামী দিনের সংগ্রামে যে বাঙালি জাতিকে আরাে বুকের রক্ত দিতে হবে, তাঁর ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সম্ভবত তারই আভাস দিয়েছিলেন। তবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক নেতাও সেদিন এর তাৎপর্য সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি। এদিনই বঙ্গবন্ধু প্রথম তার দলীয় কর্মীদের প্রতিটি ইউনিয়ন ও মহল্লায় দুর্গ গড়ে তােলার কথা বলেছিলেন। ৭ মার্চের বহু পূর্বেই তিনি এ দুর্গ গড়ে তােলার অপরিহার্যতার কথা কর্মীদের কাছে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ষড়যন্ত্রের কারণে যদি আমার মৃত্যু ঘটে, তবু আপনারা নিরস্ত্র হবেন না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে তিনি তাদের জ্যান্ত কবর দেয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আমি যদি করি আমাকেও। বঙ্গবন্ধু কর্মী ও অনুসারীদের এদিন থেকে বাঁশের ও সুন্দরী কাঠের লাঠি তৈরিরও নির্দেশ দেন। আল্লাহর ধর্ম ইসলামের নামে যারা ধোকা দেয়ার চেষ্টা করছে, বঙ্গবন্ধু সে সম্বন্ধে বলেন, তাদের শাস্তি হচ্ছে, চাবুকের বাড়ি। তিনি বলেন, ইসলাম গেল, ইসলাম গেল’ বলে যারা চিকার তুলেছিল, জনগণ এবার এ পরগাছাদের একেবারে সাফ করে দিয়েছে। ইসলামপন্থীদের ছাড়াও তিনি চরম বামপন্থীদেরও সমালােচনা করেন। কিন্তু ভূমিহীন ও বস্তিবাসীর প্রসঙ্গ তুলে তিনি নিজেই চরমপন্থা গ্রহণের আভাস দেন। তিনি বলেন, রাস্তার পাশে ও বস্তিতে যারা শােচনীয় জীবন যাপন করছে তাদের জমি ভুড়িঅলারা কেড়ে নিয়েছে। এদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে। উঁড়িঅলাদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে বাস্তুহারা ও বস্তিবাসীদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করে দেয়া হবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে ভূমি রাজস্ব বলতে আর কিছু থাকবে না।
আমলাদের কথা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় আমি কারাগার থেকে অনেক সরকারি আমলার খেলা দেখেছি। শপথ অনুষ্ঠানের পর রাজ্জাক ভাই হাত টিপে আমাকে বললেন, ‘কাজ হয়েছে । মাঠে নেমে পড়তে হবে। তখন আমি পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য। মঞ্চে ছিলাম । মার্চ মাস থেকে স্লোগান ছড়িয়ে পড়েছিল বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ৩ মার্চ ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ঘােষণায় স্বাধীন বাংলার প্রত্যয় ঘােষিত হলাে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা এবং সর্বাধিনায়ক হিসেবে লাখাে জনতার সামনে ঘােষণা করা হলাে। বাঙালি জাতি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে পাকিস্তান সামরিক জান্তা তাদের ক্ষমতা দেবে না, লড়াই সংগ্রাম করে তাদের মুক্তি স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ