শরণার্থী সমস্যায় জটিলতা বাড়ছে
প্রায় তিরিশ লক্ষ শরণার্থী পূর্বঞ্চলের রাজ্যগুলােতে এসে গেছেন। এ স্রোতের বিরাম নেই। আরও আসবেন। পশ্চিম বাংলার উপর চাপ সবচেয়ে বেশী। রাজ্য সরকার দিশাহারা। অন্যান্য রাজ্যে শরণার্থী পাঠানাের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। কেন্দ্রীয় এবং আন্তর্জাতিক সাহায্যে আর্থিক ভার কিছুটা লাঘব হবে। কিন্তু ওটা সাময়িক। এতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। বাংলাদেশের শরণার্থীরা যে পর্যন্ত স্বদেশে ফিরে না যাচ্ছেন সে পর্যন্ত উদ্বেগজনক অবস্থা কাটবে না। কেন্দ্রীয় সরকার অনুকূল পরিবেশের আশায় বসে আছেন। বাংলাদেশে এই অনুকূল পরিবেশ কবে আসবে এবং কে তা সৃষ্টি করবে—কেউ জানেন না। রকম সকম দেখে মনে হচ্ছে সবাই অন্ধকাবে পথ খুঁজছেন। শরণার্থীদের ফিরে যাবার পরিবেশ সৃষ্টির ইচ্ছা ইয়াহিয়ার নেই। যারা তাদের মেরে তাড়িয়েছে তারা তাদের ফেরত নেবে না। আর নিতে চাইলেও আতঙ্কিত মানুষগুলাে নরঘাতকদের বিশ্বাস করবেন না। সর্বস্ব খুইয়ে জান নিয়ে যারা চলে এসেছেন জান দেবার জন্য তারা অবশ্যই বাঘের গুহায় পা দেবেন না। শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনের সুযােগ সৃষ্টি করতে পারেন একমাত্র বাংলাদেশ সরকার। তারা এখন জীবন-মরণ সংগ্রামে লিপ্ত। এ লড়াই দীর্ঘস্থায়ী হবে। বাইরের সাহায্য ছাড়া মুক্তিযােদ্ধারা চূড়ান্ত আঘাত করতে পারবেন না ইয়াহিয়ার সৈন্যদলের উপর। গেরিলা লড়াইয়ের দশ বছর লাগলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।
লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে বুকে ধরে কেন্দ্রীয় সরকার এবং পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলাে কতদিন অপেক্ষা করবেন? যেসব বৃহৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে নয়াদিল্লী ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখছেন তারাই কি বলতে পারেন বাংলাদেশের শরণার্থীরা ভারতে কতদিন থাকবেন? বন্যার স্রোত কবে বন্ধ হবে? ইয়াহিয়ার উপর কঠিন চাপ সৃষ্টি করলে যে সমস্যার সমাধান দুদিনে হত সে-চাপ সৃষ্টিতে তারা নারাজ। এদিকে তাড়া খাওয়া মানুষগুলাের জন্য ওদের মৌখিক দরদের অন্ত নেই। ওষুধের ঝাপি নিয়ে আসবেন রাষ্ট্রসঙ্। আসবেন অন্যান্য সেবাব্রতী বৈদেশিক সংস্থা। তাদের করণীয় কাজ তারা করবেন। আসল সমস্যা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আজ প্রায় চব্বিশ বছর পার হয়ে গেছে। প্যালেস্টাইনের আরব শরণার্থীরা মরুভূমির মরীচিকা রাষ্ট্রসঙ্ঘ সেখানে অসহায় এবং নীরব দর্শক। আরব রাষ্ট্রগুলাের মতিগতি রহস্যজনক। ওরা ইস্রাইলী বর্বরতার নিন্দায় শতমুখ। প্রমাণ হিসাবে যখন তখন তারা তুলে ধরে আরব শরণার্থীর দীর্ঘ তালিকা। কিন্তু ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনীর দ্বারা বিতাড়িত শরণার্থীদের সম্পর্কে তাদের মুখে টু শব্দ নেই। পাক বর্বরতার নিন্দা করতেও তারা অনিচ্ছুক। নীতিবােধের এই দ্বৈত প্রক্রিয়ায় আরব রাষ্ট্রগুলাে হারাতে বসেছে ভারতের আস্থা। হারিয়েছে বাংলাদেশের শ্রদ্ধা। দুর্গতের কান্না অভিশাপ হিসাবে জমা হচ্ছে তাদের মাথায়। ইস্রাইলী নির্যাতনে ভবিষ্যতে যদি আরব দুনিয়ায় ওঠে মরা কান্না তবে তা আগের মত ধাক্কা দেবে না ভারতের জনগণের দরদী মনে। ধর্মীয় গোঁড়ার দল যদি প্রতিবাদের তরঙ্গ তুলতে চায় তবে তাদের স্পষ্টই বলা হবে ঘরের কাছে ইয়াহিয়া খানকে ঢিট করতে যাদের ছিল অনিচ্ছা তাদের মানবিক আন্তরিকতায় বিশ্বাস নেই কারও।
ভারতের মাটিতে বহিরাগত শরণার্থী সমস্যা দৈব-দুর্বিপাক নয়। ওটা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতার স্বাভাবিক পরিণাম। গত পঁচিশে মার্চের পরই স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল শরণার্থীর প্লাবণের আশঙ্কা। নয়াদিল্লী প্রস্তুত ছিলেন না তার জন্য। প্রস্তুত না থাকাটা অপরিনামদর্শিতা। কেন্দ্রের দেখি কি হয় নীতি’ দেবে না কোন সুস্পষ্ট পথের সন্ধান। নীতিগতভাবে ভারতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর অবস্থান সাময়িক। কিন্তু কার্যতঃ ওটা হবে দীর্ঘস্থায়ী। বছরের পর বছরও চলতে পারে। নয়াদিল্লী হয় ভাবছেন, বৃহৎ শক্তিগুলাে আন্ত র্জাতিক চাপের দ্বারা নতজানু করবেন ইয়াহিয়া খানকে। তারপর আনবেন বাংলাদেশে শরণার্থী পত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ। এটা অলীক কল্পনা। বাংলাদেশের সমস্যা রাজনৈতিক এবং তার হতে হবে রাজনৈতিক সমাধান। স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তান—এ দুয়ের বিপদে রাজনৈতিক সমাধান আপাততঃ অদৃশ্য। মুক্তিযােদ্ধাদের চূড়ান্ত বিজয় সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ। বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাে দিচ্ছে না তাদের সরকারকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। ভারতও অবস্থা বিশ্লেষণে কঠোর সাধনায় ধ্যানস্থ। এই ধ্যানভঙ্গ কবে হবে তাও অজানা। অথচ কূটনৈতিক স্বীকৃতি না পেলে স্বাধীন বাংলাদেশ পাবে না কোন বৈদেশিক অস্ত্র সাহায্য।
এ সাহায্য ছাড়া সে সহজে নির্মূল করতে পারবে না পাক-সৈন্যদের। তার সম্ভাবনা দেখা না দিলে অধিকাংশ শরণার্থী ফিরবেন না স্বদেশে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে শরণার্থী সমস্যা। বর্ষা প্রায় আগত। বৃষ্টির জলে ভাসবে ত্রান শিবিরগুলাে। খাদ্য, বস্ত্র এবং ওষুধের সমস্যার ক্রমবর্ধমান জটিলতা কমবে না। নয়াদিল্লী শুধুই বলে যাচ্ছেন—শরণার্থীর ভীড় সাময়িক। বাংলাদেশের পরিবেশ সৃষ্টি হবে কবে? কারা করবেন তার সৃষ্টি? সৃষ্টির পথ লড়াইএ, না মুজিবর-ইয়াহিয়ার ভেঙ্গে যাওয়া আলােচনার পুনরারম্ভে। স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠায়, না পাক-বাংলা কনফেডারেশনে? এ প্রশ্নগুলাে বাস্তবসম্মত উত্তরের উপরই নির্ভর করছে শরণার্থী সমস্যার ভবিষ্যৎ প্রকৃতি। এক্ষেত্রে ‘দেখি কি হয় নীতি’ অচল।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১২ মে ১৯৭১