বাংলার বাণী
ঢাকা: ১০ই জুন, রোববার, ২৫শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট গত পরশুদিন শিক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ কুদরত ই খুদা শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট পেশ করেছেন। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে গ্রহণ করার সময় বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে, কমিশনের সুপারিশ সমূহ কার্যকরী করার উদ্দেশ্যে একটি সেল গঠন করা হবে। জানা গেছে ছত্রিশটি অধ্যায়ে রিপোর্টটি বিভক্ত এবং চারশত পঞ্চাশ পৃষ্ঠা বিশিষ্ট। কমিশন শিক্ষা সম্পর্কে দুশত পঞ্চাশটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রবর্তনের উপর। গত পরশুদিন গণভবনে এক অনাড়ম্বর পরিবেশে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ড কুদরত-ই-খুদা কমিশনের রিপোর্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করেন। এ সময় শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রী অধ্যাপক ইউসুফ আলী ও উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া কমিশনের তেইশ জন সদস্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। গণভবনে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেছেন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ নার্সিং, কৃষি, বাঁশ-বেত প্রভৃতি বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য কমিশন সুপারিশ করেছেন। সুপারিশ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণি হতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা, নবম শ্রেণী থেকে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত চার বছর মাধ্যমিক শ্রেণীর শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করা হয়েছে। চেয়ারম্যান ডঃ খুদা আরো বলেছেন, যদি সুপারিশ অনুযায়ী একাদশ শ্রেণির পর্যায়ের পরীক্ষায় সাফল্য দেখা যায় তাহলে মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর চার বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা যেতে পারে। পরীক্ষায় অসুদপায় ও বিভিন্ন দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য পরীক্ষা পদ্ধতির পুনবিন্যাস করার গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। বিশ্বস্তসূত্রের এক খবরে প্রকাশ- শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে প্রাথমিক শিক্ষর জন্যে শিক্ষা বাজেটের শতকরা পয়ষট্টি ভাগ, মাধ্যমিক শিক্ষার জন্যে শতকরা বিশ ভাগ, উচ্চ শিক্ষার জন্য পনেরো ভাগ অর্থ ব্যয় করার জন্যে সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের মতে এই সকল সুপারিশ কার্যকরী করতে দশ থেকে পনেরো বছর সময় লাগবে।
শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টটি শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছে গিয়ে পৌঁছেছে। বহুদিন ধরে রিপোর্টটি সমাপ্ত করার দাবি দেওয়া আমরা লক্ষ্য করেছি। বিভিন্ন সময় বিভাগীয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অবিলম্বে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু অবিলম্বেই তা হয়নি। বেশ সময় লেগেছে। অবশ্য শিক্ষা কমিশনের হাতে যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল তা এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যা কিনা হঠাৎ করে সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাছাড়া গোটা জাতির যেহেতু শিক্ষায় মেরুদন্ড সেহেতু তাড়াহুড়া করে তা সম্পন্ন করাও যুক্তিযুক্ত নয়। কেননা আমরা জানি স্বাধীন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক গড়ে উঠবে যে শিক্ষার আলোকে তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত সুদুর চিন্তা ভাবনার ব্যাপার। এই রিপোর্টের বাস্তবতার উপরই নির্ভর করবে গোটা শিক্ষার্থীদের ভাগ্য। এতকালের পুঁথিগত বিদ্যার পরিবর্তে এবার শুরু হবে বৃত্তিমূলক বাস্তব জ্ঞান আহরণের যথার্থ শিক্ষণীয় কাজ। আমরা প্রথমেই আশা করেছিলাম-শিক্ষা কমিশন যে রিপোর্ট প্রদান করবেন তা যেমন বাস্তব বৃত্তিমূলক শিক্ষার দ্বার উন্মোচন করবে তেমনি জাতীয় শিক্ষার মান নির্ণয়ে সুদূরপ্রসারি পদক্ষেপ রেখে যাবে। ১৯৭২ সালের জুলাই মাসে প্রখ্যাত বৈজ্ঞানিক ও শিক্ষাবিদ ডঃ কুদরত-ই-খুদা নেতৃত্বে তেইশ সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ১৯৭৩ সালের মে মাসে কমিশন সরকারের কাছে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন। অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট সম্পূর্ণ পর্যালোচনা করার পর গত পরশুদিন তার চূড়ান্ত রিপোর্ট বঙ্গবন্ধুর কাছে পেশ করা হয়েছে। আমরা আশা করছি-অনতিবিলম্বে রিপোর্ট এর বিস্তারিত সুপারিশসমূহ দেশবাসীর সামনে প্রকাশ করা হবে। বিস্তারিত রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত রিপোর্ট এর সমস্ত সুপারিশ গুলো সম্পর্কে পুরোপুরি ধারণা করা সম্ভব নয়। তবু সুপারিশ কার্যকরী করতে দশ থেকে পনেরো বছর সময় লাগবে বলেছে বলে কথা বলা হয়েছে তা আরো কম সময়ে সম্ভব কিনা সেটা পর্যালোচনা হওয়া দরকার। স্বাধীনতার পূর্বে প্রায় দশ বছর আমাদের ছাত্র সমাজকে কুশিক্ষার বেড়াজালে আবদ্ধ থাকতে হয়েছে। কেরাণীকুল তৈরীর সেই শিক্ষার অবসানকল্পে ছাত্ররা সংগ্রাম করেছে। আজ তাই নতুন শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়নের যাতে দশ থেকে পনেরো বছরের পরিবর্তে কমিয়ে আনা যায় তার ব্যবস্থা করা দরকার। কেননা এমনিতেই অতীতে আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর তা দ্রুত পূরণ হলেই সমূহ শুভ হবে বলে আমরা মনে করি।
দিয়াগো গার্সিয়াঃ আলোচনা প্রস্তাব
দিয়াগো গার্সিয়ায় হাত বাড়াতে গিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা যুক্তরাজ্য কাউকেই খুব কম কাঠ-খড় পোড়াতে হচ্ছে না। বিশ্বজোড়া জনমতের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ উঠেছে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় বসবাসকারী শান্তিকামী মানুষের তরফ থেকে। দু’কোটি নব্বই লাখ ডলার ব্যয়ের পরিকল্পনা ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটা আগ্রাসণী এবং যুদ্ধবাজ নীতি বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখতে গিয়েই সারা দুনিয়ার ধিক্কার কুড়াতে হয়েছে। প্রতিবাদ এসেছে এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তর থেকে। দু’জন সিনেটর দিয়াগো গার্সিয়ায় নতুন করে ঘাঁটি নির্মাণের যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুরোধকে নিন্দা করেছিলেন সেই গোড়াতেই। সেখানকার সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন শান্তিকামী মানুষ পেন্টাগনের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনার বিরুদ্ধে তাদের বক্তব্য পেশ করে আসছিলেন এতদিন।
এই বিক্ষোভ এবং প্রতিবাদের মুখে কি সাম্রাজ্যবাদী শান্তি সময় হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? ভারত মহাসাগরীয় এলাকার রাষ্ট্রসমূহের ইচ্ছের বিরুদ্ধে কি ঘাঁটি নির্মাণের তারা বিরত থাকবে? গত ৪ঠা জুন ভারত মহাসাগরের দিয়াগো গার্সিয়া দ্বীপে ক্ষুদ্রাকৃতি মার্কিন সামরিক ঘাঁটি আধুনিক করে গড়ে তোলার জন্য পেন্টাগন দু’কোটি নব্বই লাখ ডলার বরাদ্দের যে আবেদন জানিয়েছিল প্রতিনিধি সভা তা প্রত্যাখ্যান করেন। এমনকি ওই একই বিলে দক্ষিণ ভিয়েতনামে সামরিক সাহায্য বাবদ ২৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার পাঠানোর উপরও প্রতিনিধি সভা প্রতিবন্ধকতা আরোপ করেছে।
ভারত মহাসাগর সম্পর্কে আমাদের নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট। বাংলাদেশ এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকার অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ এই এলাকাকে শান্তি এলাকা বলে ঘোষণা করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু সেই দাবীর প্রতি সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ কোন প্রকার কর্ণপাত করেনি। সম্প্রতি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শ্রী শরণ সিং বিশ্বের প্রধান প্রধান নৌশক্তি এবং ভারত মহাসাগরের উপকূলীয় দেশসমূহের সমন্বয়ে একটি সম্মেলন আহ্বানের প্রস্তাব করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন শরণ সিং এর এই প্রস্তাবের প্রতি ইতিমধ্যেই সম্মতিসূচক সাড়া প্রদান করেছে। ব্রিটেনও আগ্রহ দেখিয়েছে। তার এ প্রস্তাবের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনেও আর তাড়াহুড়া করছে না ব্রিটেন।
আমরা আমাদের পূর্বঘোষিত নীতির পুনরুল্লেখ করে উক্ত নীতি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের আলোচনাকে স্বাগত জানাই। পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ভারত মহাসাগরকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি সমূহের আগ্রাসণী আবর্তের বাইরে রাখার একটা বাস্তবসম্মত পথ খুঁজে পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। পাশাপাশি এই এলাকার জনসাধারণকে যুদ্ধবাজদের যে কোন প্রকার অশুভ পদক্ষেপ গ্রহণের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকতে হবে। ভিয়েতনামে প্রচন্ডভাবে মার খাবার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তাদের সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সা পূরণ করার জন্য কোন না কোন নতুন ঘাঁটি স্থাপনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবেই। এ থেকে তাদের বিরত করার জন্য শুধু ভারত উপমহাসাগরীয় এলাকার দেশসমূহই নয় বরং সমগ্র বিশ্বকে সোচ্চার হয়ে উঠতে হবে।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক