You dont have javascript enabled! Please enable it! জমিদারী প্রথা ও জামাত | - সংগ্রামের নোটবুক

জমিদারী প্রথা ও জামাত (জামাতের আসল চেহারা)

জমির মালিকানা নিয়ে জমিদারদের পক্ষে মওদুদির বই

জমিদারদের সুবিধা দেবার জন্য ইসলামিক অর্থনীতির অপব্যাখা 

পুরষ্কার হিসেবে জেল থেকে মুক্তি 

মুক্তি পেয়ে পুনরায় ডিগবাজি

নুরুল আমিন ও মওদুদী

শােষণের অন্যতম বিরাট হাতিয়ার হলাে জমিদারী-জায়গীরদারী প্রথা। এর মাধ্যমে সামন্তবাদ যুগে যুগে সাধারণ মানুষের উপর নিদারুণ শােষণ চালিয়েছে। কৃষক-মজুরের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফল তাদের থেকে কেড়ে নিয়ে সামন্তবাদীরা নিজেরা ভােগ করেছে। এককালে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এই কুপ্রথাটি প্রচলিত ছিলাে। এখনাে অনেক দেশে তা রয়েছে। পাকিস্তানও এই অভিশাপমুক্ত ছিলাে না। বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা কিরূপ অন্যায়ভাবে আমাদের সমাজজীবনে এই দুষ্টক্ষতটি চাপিয়ে দিয়েছিলাে তা কারাে অজানা নয়। আর তাই সূচনাকাল থেকেই উপমহাদেশের গণমনে জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছিলাে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকেই জমিদারী জায়গীরদারী প্রথার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ফলে শেষ পর্যন্ত এ প্রথা বিলােপ করতে হয়। ১৯৪৮ সালের শেষদিকে মওলানা মওদুদী ছিলেন কারাগারে। জেলজীবনে মওলানা ‘জমির মালিকানা সমস্যা’ (মাসআলায়ে মিলকিয়তে জমীন) শীর্ষক একখানা বই লেখেন। সম্ভবত তিনি দেশের জমিদার-জায়গীরদারদের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের আশা নিয়েই বইখানা লিখেছিলেন। কারণ এ সময় দেশের রাজনীতিতে জমিদার শ্রেণীর বেশ প্রভাব ছিলাে। মওলানা উক্ত গ্রন্থের একস্থানে লিখেছেন, “ইসলাম পরিমাণ ও সংখ্যাগত দিক থেকে কোনাে ধরনের মালিকানার উপরই সীমা নির্ধারণ করেনি।….টাকা-পয়সা, পশু, ব্যবহারিক দ্রব্যাদি, ঘরদরজা, বাহন— মােট কথা কোনাে জিনিসের ব্যাপারেই আইনত মালিকানার পরিমাণের কোনাে সীমা নেই। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র কৃষিজাত সম্পত্তিতে , কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার দরুন শরীয়তের ইচ্ছা হবে যে, এ ব্যাপারে মানুষের মালিকানা অধিকারকে দাবীদারদের প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হােক ?….” 

জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি উক্ত গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, “ইসলাম বলপূর্বক জমির মালিকদের মালিকানাস্বত্ব ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার দেয় না। শুধু তাই নয়, ইসলাম এরূপ আইন প্রণয়নেরও অনুমতি দেয় না যার মাধ্যমে কোনাে ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়ের নিজের মালিকানা স্বত্বকে সরকারের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য করা যাবে।”২ তিনি আরাে বলেছেন, “অনুরূপ ইসলাম আমাদের একথাও বলে না যে, তােমরা  সর্বাধিক এতাে একর জমির মালিক হতে পারাে। কেবলমাত্র একনায়ক ব্যক্তিই এ ধরনের আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু যিনি আল্লাহ ও রাসুলের অনুসারী, তিনি এ ধরনের কথাবার্তা চিন্তাও করতে পারেন না। অনুরূপ ইসলাম একথাও বলে না, যে নিজে জমিতে চাষবাস করে, কেবলমাত্র সেই তার মালিক হতে পারবে।” ৩ উপরােল্লিখিত কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মওলানা জমিদারজায়দীরদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য উক্ত গ্রন্থে কিরূপ আলােচনা করেছেন। পবিত্র ইসলামের নামে জমিদার-জোতদারদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তিনি ধনসম্পদ সম্পর্কে ইসলামের শাশ্বত নীতিরই বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন। পবিত্র কোরআনে ধন-সম্পদের মূলনীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে । “তিনি (আল্লাহ তায়ালা) সেই সত্তা যিনি পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সবই তােমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।”8

পবিত্র কোরআনের এই ঘােষণা ধর্ম, বর্ণ, গােত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এই বাণীর সারকথা হলাে, জীবিকা ও জীবনােপায় আল্লাহ তায়ালার প্রাকৃতিক কোষাগারের দান। তা থেকে প্রতিটি প্রাণীর উপকৃত হওয়ার সমান অধিকার রয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদীসে এ ধরনের আরাে অসংখ্য বাণী রয়েছে। এসব ভাষ্য থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, মানুষের প্রয়ােজন মিটানাের জন্যই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন। কোন জিনিসেই কারাে মালিকানা নির্দিষ্ট নেই। সকল বস্তুর উপর সব মানুষের যৌথ মালিকানা স্বত্ব রয়েছে। অবশ্য সামাজিক শান্তি-শৃংখলা বিধানের লক্ষ্যে ইসলামে বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হলেও তা শর্তহীন নয়। আর সে শর্তটি হলাে, ব্যক্তিমালিকানা কখনাে অন্যদের অধিকার ক্ষুণের কারণ হতে পারবে না। ব্যক্তি তার সম্পদ নিজের ন্যায়সঙ্গত প্রয়ােজনে ব্যবহার করবে; ন্যায়সঙ্গত প্রয়ােজনাতিরিক্ত সম্পদ অন্য যাদের প্রয়ােজন তাদের প্রদান করবে। কিন্তু কুক্ষিগত করে  রাখতে পারবে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : যারা সােনা-রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের আপনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ জানিয়ে দিন। সেদিন এসব ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে) তােমরা যা কিছু শুধু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলাে তাে সেসব সম্পদ। সুতরাং তােমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ ভােগ কর।”৫  পবিত্র কোরআনের এই বজ্রকঠোর ঘােষণা শুনে সেকালের মুসলমানরা দিশেহারা হয়ে পড়েন। তারা মহানবীর (সঃ) নিকট সম্পদ ব্যয়ের পরিমাণ জানতে চান। পবিত্র কোরআনের অপর এক আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে : “(হে মুহম্মদ!) তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে— কি পরিমাণ ব্যয় করবাে ? আপনি তাদের বলে দিন প্রয়ােজনের অতিরিক্ত ধন সম্পদ।”৬ ? অর্থ-সম্পদ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের উল্লিখিত ভাষ্যগুলােতে যেসব।  ইঙ্গিত রয়েছে তাতে পরিষ্কার বুঝা যায়, ধন-সম্পদে সীমাহীন ব্যক্তিমালিকানার অবকাশ ইসলামে নেই। সামাজিক শান্তি-শৃংখলার স্বার্থে ইসলামে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হলেও এর ছত্রচ্ছায়ায় শােষণ-বঞ্চনা ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তােলা ইসলাম অনুমােদন করে না। অথচ মওদুদী সাহেব পবিত্র কোরআনের এসব ভাষ্য উপেক্ষা করে সামন্তবাদী ও পুজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে নির্দ্বিধায় বলে ফেললেন, ‘ইসলাম পরিমাণ ও সংখ্যাগত দিক থেকে কোন ধরনের মালিকানার উপরই সীমা নির্ধারণ করেনি।’ এই সীমা নির্ধারণ দ্বারা তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন আমাদের বােধগম্য নয়। কারণ সম্পদ ও অর্থের মূল্যমান এবং তার চাহিদা স্থিতিশীল নয়, সদা পরিবর্তনশীল। কাজেই ব্যক্তিমালিকানার সংখ্যাগত ও পরিমাণগত সীমা নির্ধারণের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সীমা নির্ধারণ করার অর্থ এই নয় যে, সমাজের আর পাঁচজনকে বঞ্চিত করে গুটিকয়েক লােক ব্যক্তিমালিকানার ছত্রচ্ছায়ায় সব সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখবে। 

এক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন একটিমাত্র শব্দের মাধ্যমে সকল প্রকার শােষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছে। আর সে শব্দটি হচ্ছে ‘প্রয়ােজন’! যুগ ও সমাজের সার্বিক মূল্যায়নের বিচারে ব্যক্তিমানুষের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত মনে করা হবে, সেটাই হবে সঠিক প্রয়ােজন। পবিত্র কোরআনের ভাষায় এ ধরনের প্রয়ােজনাতিরিক্ত সব সম্পদ অন্য যাদের প্রয়ােজন তাদের দিয়ে দিতে হবে। এটাই ইসলাম অনুমােদিত অর্থ ব্যবস্থার সারকথা। ভূমি মালিকানার ব্যাপারে ইসলাম আরাে সােচ্চার। মানব জীবনে মৌলিক প্রয়ােজনীয় জিনিসগুলাে প্রকৃতিগতভাবেই আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে মানুষকে প্রদান করা হয়েছে। যেমন বায়ু, পানি, আলাে প্রভৃতি। এসবের উপর কারাে ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীর দাঁড় করানাে চলবে না। ভূমির অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষ তা বিনামূল্যে আল্লাহর তরফ থেকে লাভ করেছে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তিনি সকল সৃষ্ট জীবের  কল্যাণের জন্য ভূমি সৃষ্টি করেছেন।”৭

আল্লাহ তায়ালা সকল জীবের জন্য ভূমি সৃষ্টি করেছেন। আর এজন্যই তাতে সবার সমঅধিকার থাকতে হবে। প্রত্যেকের প্রয়ােজন মিটানাের উদ্দেশ্যে জমি সবার জন্য। সমভাবে অবারিত থাকবে। মহানবী (সঃ) প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা যা তার সত্যিকার স্থলবর্তীদের আমলে ধাপে ধাপে অগ্রগতি লাভ করে, তাতেও জীবন ধারণের এই প্রকৃতিজাত উৎসটির অবস্থা তাই ছিল। বস্তুত ইসলামের অর্থব্যবস্থার মূলনীতিটি এক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। আল্লাহ প্রদত্ত ভূমিতে সকল মানুষের যৌথ মালিকানা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত। কিন্তু কোন অবস্থায়ই এই ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীর সমাজের আর পাঁচজনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারবে না। যে যতটুকু আবাদ করতে পারবে বা যার যতটুকু প্রয়ােজন সে তাই আবাদ করবে। অতিরিক্ত ভূমি অন্যরা আবাদ করবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবে বিরাট বিরাট এলাকা অনাবাদী পড়ে ছিলাে। হযরত ওমর (রাঃ) অনাবাদী জমি আবাদের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সাধারণ  অনুমতি প্রদান করেন, অনাবাদী জমি কেউ আবাদ করলে তার মালিকানা স্বীকার করে নেয়া হবে। তবে জমি দখলের পর তিন বছর পর্যন্ত কেউ সে জমি অনাবাদী ফেলে রাখলে তা নিয়ে নেয়া হবে। হযরত বেলালেরও বেশ কিছু জমি অনাবাদী পড়ে ছিলাে। হযরত ওমর হযরত বেলালের প্রয়ােজনের পরিমাপ করে অতিরিক্ত জমি নিয়ে নেন। তিনি সে জমি অন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেন। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের আরাে বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। অর্থসম্পদ হােক আর ভূমিসম্পদ হােক, ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে প্রয়ােজনাতিরিক্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা ইসলাম অনুমােদন করে না। এটাই হচ্ছে ইসলামের অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি। কিন্তু মওলানা মওদুদী পাকিস্তানের জায়গীরদারজমিদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর ‘ভূমি মালিকানা সমস্যা’ পুস্তকে ইসলামের এই মূলনীতির সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেছেন, ইসলাম নাকি জমির মালিকদের মালিকানা স্বত্ব ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার দেয় না।’ তাঁর মতে, “যিনি আল্লাহ ও রাসুলের অনুসারী, তিনি এ ধরনের কথাবার্তা চিন্তাও করতে পারেন না।’ মওলানা মওদুদীর ইসলামের নামে এ ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে।।

সে যাই হােক, পুস্তকটি বের হওয়ার পর পাকিস্তানের জমিদারকুল তা লুফে নেয়। তারা হাজার হাজার কপি ছেপে পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। এই পুস্তকের পুরস্কার হিসেবে মওলানা মওদুদী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫০ সালের ২৮ মে মওলানা মওদুদীকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি সুর পাল্টে ফেলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখিত সকল ইসলামিক (?) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বেমালুম ভুলে যান। তিনি বিভিন্ন বিবৃতিতে পাকিস্তানের অধিকাংশ জমিদারীকে শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ বলে ঘােষণা করেন। জামাতে ইসলামীর মুখপত্র ‘তসনীমে’র ১৯৫৬ সালের ৭ মার্চ সংখ্যায় মওলানা এ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব প্রকাশ   করেন। তাতে তিনি বলেন, “একটি কমিশন নিয়ােগ করা হােক। দেশের সকল জমিদারী সম্পর্কে সে অনুসন্ধান করে বলবে, এসবের মধ্যে কোন্‌গুলাে ইসলামের মূলনীতির বিপরীত। মওলানার ব্যক্তিগত মতে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ জমিদারী ইসলামের মূলনীতি-বিরােধী। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ জমিদারীও ইসলামী বিধানের পরিপন্থী।”

জেলে থাকাকালে মওলানা জমিদারদের সপক্ষে ইসলামকে ব্যবহার করাই অধিক লাভজনক মনে করেছিলেন। তাই তিনি তা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে তিনি ভাবলেন, এখন জমিদারদের সপক্ষে ইসলামকে ব্যবহার করলে লাভের চাইতে ক্ষতিই হবে বেশী। তাই তিনি সুর পাল্টে ফেলেন। অবশ্য উভয় ক্ষেত্রে তিনি ইসলামকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। 

খােদার শরীয়তের দৃষ্টিতে হিন্দুস্তানী জাতীয়তাবাদ যতটুকু অভিশপ্ত, মুসলিম জাতীয়তাবাদও ততটুকু অভিশপ্ত । তিনি আরাে বলেছেন, “নিজেদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য ইসলামের নাম আপনাদের ব্যবহার করার অধিকার নেই। কেননা ইসলাম সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের শক্র। সেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হােক কিংবা নামসর্বস্ব মুসলিম জাতীয়তাবাদ হােক।”

মুসলিম জাতীয়তাবাদের সপক্ষেও তিনি নির্দ্বিধায় কলম চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেসব বুনিয়াদের উপর আমাদের জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত, দেড়শ’ বছরের পরাধীনতা সেগুলাে ঘুণের মত খেয়ে ফেলেছে। অভিজ্ঞতা বলছে এবং আমরাও এখন দিবালােকের মত বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি, যদি দীর্ঘদিন যাবৎ এ পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে, তাহলে হিন্দুস্তানে ইসলামী জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে শুকিয়ে স্বভাবজাত মৃত্যুবরণ করবে এবং নামমাত্র অস্তিত্বটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না।” মুসলিম জাতীয়তাবাদের সপক্ষে মওলানার এ ধরনের অসংখ্য উক্তি রয়েছে। বিগত অধ্যায়গুলােতেও কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আপনারাই বিচার করুন জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ও তাত্ত্বিক গুরু মওদুদী সাহেবের পবিত্র ইসলামের নামে এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা ধরে নেয়া যাবে।  মওদুদী সাহেব ও তাঁর দল জামাত পবিত্র ইসলামকে কিভাবে বিভিন্ন সময়ে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তার একটা চিত্র পাওয়া যাবে মওলানা কাউসার নিয়াজীর কয়েকটি ঐতিহাসিক চিঠিতে। পাকিস্তানের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আলেম, সাংবাদিক ও ভুট্টো মন্ত্রিসভার ধর্মমন্ত্রী মওলানা নিয়াজী একসময় জামাতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর জামাতের সাথে জড়িত ছিলেন। এক পর্যায়ে মওলানা মওদুদী ও জামাতের পবিত্র ধর্মের নামে প্রতারণা, ধর্মকে রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের  হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কারসাজি তাঁর নিকট ধরা পড়ে। তিনি জনাব মওদুদী ও জামাতকে এই ঘৃণ্য তৎপরতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত মওলানা নিয়াজী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত মওলানা কাউসার নিয়াজী মওদুদী সাহেবের সাথে একাধিকবার পত্রালাপ করেন। এসব চিঠি ষাটের দশকে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। সেসব চিঠির কিছু উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।

মওলানা নিয়াজী লিখেছেন, ‘প্রথমে আমরা নিজে সংসদে প্রার্থী হওয়া হারাম মনে করতাম; কিন্তু এখন বিরােধী দলগুলাের সাথে মিলিত হয়ে নিজেরাও প্রার্থীদের নিকট থেকে দরখাস্ত আহবান করছি। প্রথমে আমরা পার্টি টিকেট প্রথাকে অভিশপ্ত বলতাম; কিন্তু এখন আমরা সম্মিলিত জোটের সাথে অসৎ লােকদেরও টিকিট বিতরণ করছি। আমরা টাকার নােটে কায়দে আজমের ছবি ছাপানাের বিরােধী ছিলাম; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমাদের সদস্যরা কায়দে আজমের বােনের ছবিযুক্ত ভাউচার অলিগলিতে বিক্রি করেছে। প্রথমে আমরা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি থেকেও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে আমিরিয়াতি খেলাফতের ধারণা পেশ করেছিলাম; কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই তা গ্রহণ করেছি। প্রথমে আমরা (নারী পুরুষের) সম্মিলিত সভা-সমিতিতে যােগদান করতাম না। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই এ ধরনের সমাবেশে বক্তৃতা করছি, সভাপতিত্ব করছি। আমরা আগে আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করতাম। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলােকে সঙ্গে নেয়া অন্যায় মনে করতাম। কিন্তু এখন রাজনৈতিক দলগুলাের ঐক্যজোটকে শক্তিশালী করা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কর্তব্য মনে করি। প্রথমে আমরা মহিলাদের ভােটাধিকার প্রদানের বিরােধিতা করতাম; কিন্তু এখন মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি। প্রথমে আমরা ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বারণকরতাম; এখন তাদেরকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আহবান জানাচ্ছি। প্রথমে আমরা মিছিল বের করা ও শ্লোগান দেয়া ইসলামবিরােধী বলতাম, এখন আমরা নিজেরাই মিছিল বের করছি, শ্লোগান দিচ্ছি, নেতাদের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছি। প্রথমে আমরা মানব রচিত আইন-কানুনের মাধ্যমে পরিচালিত আদালতগুলােতে বিচার প্রার্থনা করা বিরাট পাপ কাজ মনে করতাম, এখন আমরা এসব আদালতকেই ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার রক্ষক সাব্যস্ত করছি। প্রথমে আমরা আইনজীবীদের শয়তানী সংঘের সদস্য মনে করতাম, এখন তাদেরকেই আমরা গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষক আখ্যায়িত করছি।’  মওদুদী সাহেবের নিকট লেখা পত্রে মওলানা নিয়াজী আরাে বলেন, “ইসলামের নামে এসব নিত্যপরিবর্তিত মতামতের মধ্যে কোন্‌টি সঠিক আর কোন্‌টি ভুল তা আমি বলতে চাই না। যা বলা হলাে এসব হচ্ছে জামাত সম্পর্কে অসংখ্য অভিযােগের মধ্যে সামান্য কিছুটা দৃষ্টান্ত মাত্র। আমি অত্যন্ত দুঃখ নিয়ে জামাতের ইতিহাসের দিকে কিছু ইঙ্গিত করলাম।

আমি বলতে চাই, সময়ের দোহাই দিয়ে এতসব পরস্পরবিরােধী অভিমতকে আমরা ইসলামী ও দ্বীনি বলে গ্রহণ ও বর্জন করছি। এখন বিচার্য বিষয় হলাে, গ্রহণ ও বর্জনের এই মহড়ার পর জামাতের স্বার্থান্বেষী সদস্য ছাড়া কে আমাদের এই ধর্মীয়  চিন্তাধারার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে ? জামাতের চারিত্রিক অবস্থা অধঃপতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমি একাধিকবার এসব ব্যাপারের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আপনি প্রত্যেক বারই এসব জানেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।১০ | মওলানা কাউসার নিয়াজীর লেখা চিঠির অংশবিশেষে জামাতের যে কদর্য চিত্র ভেসে উঠেছে, তা দেখার পর যেকোন লােক স্বীকার করবে, জামাত হচ্ছে সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধের একটি ইতিহাস। 

Source: জামাতের আসল চেহারা–মওলানা আবদুল আউয়াল