You dont have javascript enabled! Please enable it! বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর - সংগ্রামের নোটবুক

নানাবিধ চক্রান্ত : বিদ্রোহী কণ্ঠস্বর

তৃতীয় অধ্যায়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের শাসকগণ কীভাবে চক্রান্ত ষড়যন্ত্র করেছে তার সার-সংক্ষেপ উল্লেখ করা হয়েছে। আগেই বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তান থেকে যখনই বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবি উঠেছে তখনই তারা বলেছে, ওরা হিন্দুস্তানের এজেন্ট। পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যার প্রশ্ন যখন উঠানাে হয়েছে তখনও তারা চিৎকার করে বলেছে, ‘ইসলাম গেল, ধর্ম গেল’। গণতন্ত্রের কথা যখন বলা হয়েছে তখনই শাসক গােষ্ঠী পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, মােহাম্মদ তােয়াহা, ওলি আহাদ, আবুল মনসুর আহমদ প্রমূখ নেতৃবৃন্দ যখনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছেন তখনই তাদেরকে বিশ্বাসঘাতক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কারাগারে পাঠানাে হয়েছে। বাঙালি নেতৃত্ব ও জনগণকে বিভক্ত করার জন্য তারা কখনও সেনাবাহিনী নামিয়েছে কখনও বা ৯২(ক) ধারা জারি করে নির্বাচিত মন্ত্রিসভাকে ভেঙে দেয়া হয়েছে। মন্ত্রিদের জেলে আটকানাে হয়েছে অথবা চক্রান্তমূলক মামলা দেয়া হয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, বাঙালি নেতৃত্ব একুশ দফার ভিত্তিতে যে ঐক্যবদ্ধ গণম্যান্ডেট পেয়েছিল তার সঙ্গে ক্ষমতার লােভে তাদের একাংশ বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। এই অধ্যায়ে লক্ষ্য করা যাবে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন-শােষণ চক্রান্ত প্রতিরােধে ছাত্র, যুবক এবং বিক্সি প্রগতিশীল সংগঠন গড়ে ওঠে।

তারা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের গণবিরােধী কর্মকান্ডকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে বিভিন্ন কর্মসুচী ও আন্দোলন গড়ে তােলে। যদিও আগে থেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হচ্ছিল কি এই সময় থেকেই তরুণ সমাজের মধ্যে তা ক্রমান্বয়ে দানা বাধতে থাকে। সংগ্রামী ছাত্র যুবসমাজ এবং রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পাটি, ন্যাপ আন্দোলন শুরু করে। কীভাবে কোন প্রেক্ষিতে এবং ঐতিহাসিক গতিধারায় বাংলাদেশের অ্যুদয় ঘটে এর ধারাবাহিক ঘটনাবলী উল্লেখ না করেই অনেকেই বাংলাদেশের অভ্যুদয়কে কেবল নয় মাসের স্বাধীনতার যুদ্ধের মধ্যে আটকে রাখতে চায়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের শব্দগুলাে জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের পরিবর্তে প্রতিস্থাপিত হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেবল নয় মাসের যুদ্ধে অর্জিত হয়নি। দীর্ঘ ২৩ বছর লড়াই সংগ্রাম ও জেল-জুলুম, গ্রেফতার, রক্তের এক ধারাবাহিক সংগ্রামের ইতিহাস। এই মূলসূত্র ধরেই পাঠককে অগ্রসর হতে হবে।

পাকিস্তানের কাঠামােগত কৌশল ও শাসক চক্রের ষড়যন্ত্র চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাংলার তরুণ নেতৃবৃন্দের মনে প্রতিবাদ ও প্রতিরােধের স্পৃহা জাগ্রত হয়। আমরা। দেখতে পাব এ সময় ছাত্র-তরুণদের মধ্যে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। প্রথমেই তারা উপলব্ধি করেছিলেন ব্রিটিশ শাসকদের অধীন থেকে মুক্ত হলেও প্রকৃতপক্ষে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানের অধীনে কলােনিতে পরিণত হয়েছে। সেজন্য তারা প্রথমেই জাগ্রত ছাত্রসমাজকে সংগঠিত করার কাজে উদ্যোগী হন। এর মধ্যে জাতিগত উপাদান মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করে আন্দোলিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্ব হতেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে বিতর্ক বিক্ষোভে পরিণত হয়। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু গণপরিষদে গৃহীত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলা উপেক্ষিত হয়। এমনকি পাকিস্তানের কোনাে প্রদেশের ভাষা উর্দু ছিল না। জিন্নাহ নিজেও উর্দুভাষী ছিলেন না। তার মাতৃভাষা ছিল গুজরাটি। কিন্তু উত্তর প্রদেশ থেকে আগত নেতৃবৃন্দ, বেসামরিকসামরিক বাহিনী শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এবং মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সিন্ধু প্রদেশে লােকায়ত উর্দু ভাষার প্রচলন ছিল। প্রাথমিক পর্যায়ে উর্দু ছিল মূলত সেনা ছাউনির ভাষা এবং তৎসঙ্গে আলীগড়, উত্তর প্রদেশের মুসলিম নবাব, অভিজাত ভূস্বামীদের ঘরােয়া ডাষা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু হলেও এর জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়। ফারসিতে। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বুদ্ধিমান, চতুর, চৌকস ও একরােখা । আলীগড় ‘আশরাফ’ শ্রেণীর অভিজাত্যে জিন্নাহ মাত্র সাড়ে সাত ভাগ মানুষের ভাষা গােটা জাতির উপর চাপিয়ে দেন। তার কথাই তখন আইন এবং কর্তৃত্ববাদী পরিচালিত রাষ্ট্র। ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ তিনি ঢাকা এসে ঘােষণা দেন, কেবল উর্দুই হবে রাষ্ট্রভাষা ।

তিনি হুমকির সুরে বলেন, রাষ্ট্রভাষা নিয়ে যে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করবে, তাহলে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু। এর পূর্বে ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভাষা সম্পর্কে সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, উর্দু ও ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও পরিষদের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হােক। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তীব্র ভাষায় এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন এবং বলেন পাকিস্তান অধিবাসীদের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য ও মুসলমানদের বিচ্ছিন্ন করাই এই প্রস্তাবের উদ্দেশে। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল মুসলিম সদস্য এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন, হিন্দু সদস্যগণ একযােগে প্রস্তাব সমর্থন করেন। পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিন ঘােষণা করেন যে, পূর্ব বাংলার অধিকাংশ অধিবাসীর মনােভাব হলাে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা যেতে পারে। পাকিস্তানের নেতারা হরহামেশাই ইসলাম ও মুসলিম ভ্রাতৃত্বের অজুহাতে উর্দু ভাষা প্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কেউ যুক্তিসঙ্গত কোনাে কথা বললে অথবা গণতন্ত্র চাইলে তাকে ইসলাম বিরােধী’, ‘পাকিস্তান-বিরােধী’, ‘ভারতের দালাল’, এমনকি কাফের’ বলতেও তারা কোনােরকম কুণ্ঠাবােধ করেননি। পূর্ব বাংলা যখনই তার ন্যায্য হিস্যার প্রশ্ন তুলেছে, তখনই ইসলাম গেল চিৎকারজুড়ে দিয়েছেন এবং নিপীড়ন-নির্যাতন চালিয়েছেন। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, কমরেড মণি সিংহসহ পূর্ব।

বাংলার নেতাদের তারা ভারতের দালাল’, ইসলামবিরােধী’ ইত্যাদি অভিধায় অভিহিত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি। অথচ পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন নেতাদের ব্যক্তি চরিত্র ছিল জঘন্য ও ইসলামবিরােধী। প্রথমত, পাকিস্তানের জাতির পিতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ব্যক্তি ইতিহাসের অনেক দুর্বলতা ছিল। জিন্নাহর দাদা ছিলেন কনভার্টেট’ মুসলিম। জিন্নাহর অন্যতম জীবনীকার এম.এইচ. সায়ীদ লিখেছেন, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পূর্ব পুরুষ চামড়ার ব্যবসায়ী এবং রাজকোটের খােজা পরিবারের। এ পরিবার পরে করাচীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। “ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এর লেখকদ্বয় জানিয়েছেন, মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ অত্যন্ত পানাসক্ত ছিলেন এবং শুক্রবারে জুমআর নামাজ কখনাে তিনি পড়েছেন এমন ইতিহাস জানা নেই । পবিত্র গ্রন্থ কোরআন ও সৃষ্টিকর্তার কোনাে স্থান জিন্নাহর পৃথিবীতে ছিল না। জীবনের শেষ তিনটি বছর তিনি বেঁচেছিলেন ইচ্ছাশক্তি, হুইস্কি আর সিগারেটের ওপর ভর করে । শূকরের মাংসও তিনি ভক্ষণ করতেন। এসব ঘটনা পাকিস্তানে প্রায় অজ্ঞাত ছিল। সাধারণ্যে প্রচার ছিল না। পাকিস্তানের ইতিহাস বিষয়ে অনুসন্ধিৎসু দু’জন গবেষক জানিয়েছেন, পাকিস্তানের সকল কিছুতেই এত বেশি অসঙ্গতি ও গোঁজামিল ছিল যে, তার টিকে থাকার কোনাে যুক্তিই তারা ধারণা করতে পারছিল না।

ভাষা প্রশ্নে বিশ্বাসঘাতকতা করেন খাজা নাজিম উদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দিনের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৮ দফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হওয়ার পর সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। এই সময় জিন্নাহর পূর্ব পাকিস্তানের সফরের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) তার সম্মানে এক নাগরিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি ঐ সভায় ভাষা আন্দোলনকারীদের সম্পর্কে জনগণকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন: আপনাদের মধ্যে কিছুসংখ্যক কমিউনিস্ট এবং বিদেশীদের সাহায্যপ্রাপ্ত এজেন্ট আছে এবং এদের সম্পর্কে সাবধান না হলে আপনারা বিপদগ্রস্ত হবেন। রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে তিনি তার সদম্ভ সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে বলেন, “একথা আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলে দেয়া দরকার যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, অন্যকোনাে ভাষা নয়। এ ব্যাপারে যদি কেউ আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে যে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু।” জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানে বক্তৃতায় জনগণ, বিশেষ করে ছাত্রদের দারুণভাবে হতাশ ও ক্ষুব্ধ করে। কারণ ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্রসমাজ পূর্ব বাংলা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করলেও জিন্নাহ সম্পর্কে তাদের যথেষ্ট মােহ ছিল। জিন্নাহর বক্তৃতা তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করলেও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় বিচ্ছিন্নভাবে, কোথাও কোথাও জিন্নাহর সম্মানে নির্মিত তােরণ ভেঙ্গে ফেলা হয়। কোথাও তাঁর ছবি ছিড়ে ফেলা হয়। ২৪ মার্চ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিশেষ সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে বলতে গিয়ে জিন্নাহ যখন পুনরায় ‘উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে’ ঘােষণা দেন, তখন হলে উপস্থিত বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্র এক সঙ্গে ‘না’ প্রতিবাদ ধ্বনি করেন। জিন্নাহ অল্প সময়ের জন্য থমকে থাকেন।

পরবর্তী পর্যায়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে তাঁর কথার সুর বদলে ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা। এদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জিন্নাহর একটি নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছাত্রদের সম্পাদিত ৮-দফা চুক্তি মানতে অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, ওটা জোরপূর্বক করা হয়েছে। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার রাজনৈতিক যুক্তি উত্থাপন করার প্রেক্ষিতে জিন্নাহ রাগত স্বরে বলেন, তিনি ছাত্রদের কাছে রাজনীতি শিক্ষা নিতে আসেননি। ছাত্ররা বিতর্কের এক পর্যায়ে ‘অবাধ্যের মতাে বলে বসে যে, তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, রানী কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত, সুতরাং ছাত্ররা ইচ্ছে করলে তাকে অপসারণের জন্যে ব্রিটেনের রাণীর কাছে তার অপসারণের আবেদন করতে পারেন। একথায় তুমুল হট্টগােল শুরু হয়। হৈ-চৈয়ের মধ্যেই মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে এলে ছাত্ররা কায়েদে আযমকে’ নামাজ পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এতে কায়েদে আযম আরাে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। ছাত্রদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যখন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছিল, তখন ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে স্থানীয় বিভিন্ন রকম সমস্যা দানা বাঁধে। পেশাগত স্বার্থ নিয়ে অন্যান্য সরকারি কর্মচারী, এমন কি বেতন ভাতা না পাওয়ায় পুলিশের মধ্যেও আন্দোলনসংগ্রাম গড়ে ওঠে। প্রকাশ্য রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করলে সরকার সেনাবাহিনীকে পুলিশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। সশস্ত্র পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে খও যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দুজন পুলিশ নিহত ও নয়জন আহত হয়।

খাজা নাজিম উদ্দিনের আমলে উর্দু ভাষাকে বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র জনসাধারণের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকেই যে রাষ্ট্রভাষা চায় তার জন্য মুসলিম লীগ সরকার কৌশলে একটি আদমশুমারী চালায়। একথা প্রকাশিত হয়ে পড়লে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মীরা ১৯৫১ সালের আদমশুমারী চলাকালে গণনাকারীদের কাছে জনগণ যাতে তাদের উর্দু ভাষার না জানার কথা স্বীকার করে সে কথা বলার জন্য দেশব্যাপী এক অভিযান চালায়। তারা যে এ ব্যাপারে সফলকাম হয়েছিল সেন্সস কমিশনারের মন্তব্য থেকে তা জানা যায়। মুসলিম লীগ সরকার ও খাজা নাজিম উদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বিরুদ্ধে যেসব কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল শামসুল হুদা চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান ও মাযহারুল হক কুদুসের নেতৃত্বে পরিচালিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল তার সহযােগী। এসব নতজানু ও বিশ্বাসঘাতক দালাল ছাত্র নেতাদের হাত থেকে দেশপ্রেমিক ও সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলার জন্য সংগঠনটির ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, নাঈম উদ্দিন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতাবৃন্দ নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমানের কাছে গিয়ে সংগঠনটির সাধারণ কর্মী ও

পরবর্তী পর্যায়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে তাঁর কথার সুর বদলে ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে অভিমত ব্যক্ত করে বলেন যে, আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সেই ভাষা। এদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে জিন্নাহর একটি নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ছাত্রদের সম্পাদিত ৮-দফা চুক্তি মানতে অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, ওটা জোরপূর্বক করা হয়েছে। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার রাজনৈতিক যুক্তি উত্থাপন করার প্রেক্ষিতে জিন্নাহ রাগত স্বরে বলেন, তিনি ছাত্রদের কাছে রাজনীতি শিক্ষা নিতে আসেননি। ছাত্ররা বিতর্কের এক পর্যায়ে ‘অবাধ্যের মতাে বলে বসে যে, তিনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল, রানী কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত, সুতরাং ছাত্ররা ইচ্ছে করলে তাকে অপসারণের জন্যে ব্রিটেনের রাণীর কাছে তার অপসারণের আবেদন করতে পারেন। একথায় তুমুল হট্টগােল শুরু হয়। হৈ-চৈয়ের মধ্যেই মাগরেবের নামাজের সময় হয়ে এলে ছাত্ররা কায়েদে আযমকে’ নামাজ পড়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। এতে কায়েদে আযম আরাে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন। ছাত্রদের অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন যখন রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নিচ্ছিল, তখন ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চলে স্থানীয় বিভিন্ন রকম সমস্যা দানা বাঁধে। পেশাগত স্বার্থ নিয়ে অন্যান্য সরকারি কর্মচারী, এমন কি বেতন ভাতা না পাওয়ায় পুলিশের মধ্যেও আন্দোলনসংগ্রাম গড়ে ওঠে। প্রকাশ্য রাজপথে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করলে সরকার সেনাবাহিনীকে পুলিশের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়।

সশস্ত্র পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে খও যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত দুজন পুলিশ নিহত ও নয়জন আহত হয়। খাজা নাজিম উদ্দিনের আমলে উর্দু ভাষাকে বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র জনসাধারণের উপর রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকেই যে রাষ্ট্রভাষা চায় তার জন্য মুসলিম লীগ সরকার কৌশলে একটি আদমশুমারী চালায়। একথা প্রকাশিত হয়ে পড়লে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ কর্মীরা ১৯৫১ সালের আদমশুমারী চলাকালে গণনাকারীদের কাছে জনগণ যাতে তাদের উর্দু ভাষার না জানার কথা স্বীকার করে সে কথা বলার জন্য দেশব্যাপী এক অভিযান চালায়। তারা যে এ ব্যাপারে সফলকাম হয়েছিল সেন্সস কমিশনারের মন্তব্য থেকে তা জানা যায়। মুসলিম লীগ সরকার ও খাজা নাজিম উদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বিরুদ্ধে যেসব কর্মসূচী গ্রহণ করেছিল শামসুল হুদা চৌধুরী, শাহ আজিজুর রহমান ও মাযহারুল হক কুদুসের নেতৃত্বে পরিচালিত নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ছিল তার সহযােগী। এসব নতজানু ও বিশ্বাসঘাতক দালাল ছাত্র নেতাদের হাত থেকে দেশপ্রেমিক ও সংগ্রামী ছাত্র সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলার জন্য সংগঠনটির ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমান, নাঈম উদ্দিন আহমদ, আবদুর রহমান চৌধুরী, অলি আহাদ, আজিজ আহমদ, আবদুল মতিন প্রমুখ নেতাবৃন্দ নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শাহ আজিজুর রহমানের কাছে গিয়ে সংগঠনটির সাধারণ কর্মী ও পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগের স্বেচ্ছাচারিতা, শাসন, শােষণ, নিপীড়ন, দুঃশাসন ও রাষ্ট্রভাষা বিরােধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য গঠিত হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ।

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনে মুসলিম ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বিপুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া মুসলিম ছাত্রলীগের বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ছাত্রছাত্রীদের কাছে যে আবেদন করা হয়েছিল, তাতেও ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে সাড়া পাওয়া যায়। ১৯৪৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পুরান ঢাকার আরমানিটোলার নিউ পিকচার্স সিনেমা হলের মিলনায়তনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠিত হয়। কারাগারে বন্দি থাকা। অবস্থায় ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক জনাব দবিরুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম সভাপতি এবং জনাব খালেক নেওয়াজ খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। | অন্যদিকে একদল তরুণ কর্মী ১৯৪৭-এর জুলাই মাসেই ঢাকায় গঠন করেন গণআজাদ লীগ। এর নেতৃত্বে ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখ। সংগঠনের ঘোষণায় উল্লেখ আছে যে, ‘আমরা স্থির করিয়াছি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা সংগ্রাম চালাইয়া যাইতে থাকিব। ১৯৫০ সালে এই সংগঠনের নাম বদলে হয় সিভিল লিবার্টিস লীগ। ১৯৪৭-এর ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বরের সম্মেলনে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। মুসলিম লীগ প্রশাসন ও নেতৃত্বের ভয়ানক বিরােধিতার মুখে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এর নেতা ছিলেন কামরুদ্দীন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ, নূরুদ্দীন আহমদ, আবদুল ওদুদ, হাজেরা মাহমুদ প্রমুখ। পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক বিকাশ এবং বিশেষভাবে পাকিস্তানের সকল অঞ্চলের স্বাধীন ভাষাগত, সাংস্কৃতিক বিকাশের অধিকারের দাবি এই সংগঠনের ঘােষণায় উল্লেখ করা হয় । ১৯৫১ সালের ২৭ ও ২৮ মার্চ ঢাকায় এক যুব-সম্মেলনের মাধ্যমে পূর্বপাকিস্তান যুবলীগ গঠিত হয়। এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের ঘটনাটির মধ্যে চমৎকারিত্ব রয়েছে। পাকিস্তানে তখন উত্তেজনাকর অস্বাভাবিক পরিস্থিতি চলছিল।

এই সময় ‘রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত ঘটনাটি ঘটে। মেজর জেনারেল আকবর খান অনেকের সঙ্গে ধরা পড়েন। মামলা চলে। এই মামলায় আসামি পক্ষের কৌশলীর দায়িত্ব নেন বিরােধী দলের নেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। | পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর খাজা নাজিম উদ্দিন, মওলানা আকরাম খাঁ ও নূরুল আমিনের নেতৃত্বে পরিচালিত মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক, স্বৈরতান্ত্রিক সাম্প্রদায়িক এবং কর্তৃত্ববাদী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য নতুন সংগঠন গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগকে রাজনৈতিকভাবে। প্রতিরােধ করে গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী অব্যাহতভাবে প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন।”

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন কাজী মােহম্মদ বশিরের (ঢাকা পৌরসভার মেয়র) পুরান ঢাকার কে.এম দাস লেনস্থ রােজ গার্ডেন’ বাসভবনের হল রুমে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল কর্মী, সমর্থক ও নেতৃবৃন্দ এবং পূর্ববঙ্গ মুসলিম লীগ কর্মী শিবির বা ওয়াকার্স ক্যাম্পের কর্মীদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ জুন সম্মেলনে প্রায় ৩০০ জন ডেলিগেট বা প্রতিনিধি যােগদান করেন । অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি মওলানা ভাসানী উপস্থিত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীদের সামনে লিখিত ভাষণ পাঠ করার পর সম্মেলনের মূল সভাপতি আতাউর রহমান খান সভাপতির আসন গ্রহণ করেন। এই সম্মেলনে গঠিত নতুন দলের নাম দেয়া হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ” অর্থাৎ “জনগণের মুসলিম লীগ”। | “আওয়ামী মুসলিম লীগের” ৪০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২৪ জুন বিকেলে ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানে অনুষ্ঠিত দলেন প্রথম জনসভায় সভাপতির ভাষণে মওলানা ভাসানী বলেন, “মাতৃভাষা মানুষের অস্তিত্বের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। সুতরাং যে জাতি মাতৃভাষার কদর জানে না, সে জাতি স্বীয় অস্তিত্বের বিকাশ ঘটাতে পারে না। আজ যারা মাতৃভাষা বাংলার বিরােধিতা করছে তারা শুধু বিশ্বাসঘাতকই নয়- তারা জাতীয় শক্র। বাংলা ভাষাকে বাদ দিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হতে পারে না, হতে দিব না। দরকার হলে বুকের রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার পূর্ণ মর্যাদা আদায় করব ইনশাল্লাহ।” এই একই। জনসভায় আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক জনাব শামসুল হক বলেন, “আজ বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে যারা ষড়যন্ত্ররত তারা সেদিন পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধেও গভীর ষড়যন্ত্র করেছিল।

কিন্তু একথা জেনে রাখা দরকার যে, পাকিস্তান অর্জনে রয়েছে বাংলার মুসলমানদের আত্মদানের গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা। তেমনি বাংলা ভাষাও মুসলিম শাসকবর্গের পৃষ্ঠপােষকতায় আজ মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত । বাংলা কোটি কোটি মানুষের মুখের ভাষা। এই ভাষা হরণের যে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে তা বাংলার মানুষ নস্যাৎ করবেই। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বুকের তাজা খুন ঢেলে দেব। এভাবে দেশের যেখানেই নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সাংগঠনিক সভা হতাে, সেখানেই নেতৃবৃন্দগণ বাংলা ভাষার জাতীয় দাবিতে সােচ্চার হতেন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হয়। এর সাথে সাথে দেশব্যাপী নবগঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ খাদ্যাভাব দেখা দেয়। খাদ্যদ্রব্যের মূল্য দারুণভাবে বেড়ে যায়। জনগণের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। দুর্ভিক্ষের জন্য সারাঢাকা শহরে বিক্ষোভ মিছিল হয়। বিক্ষোভ মিছিল শেষে আর্মানিটোলা ময়দানে এক বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “একজন অন্যজনকে খুন করলে ফাঁসি হয়। যে নূরুল আমিন দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে শত শত লােক খুন করছে। তার কি করা উচিত? তাকে এই মাঠের মধ্যে এনে গুলি করা উচিত।”

এই সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ঢাকায় ছিলেন। | প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য জনসমাবেশ থেকে একটি বিরাট মিছিল শােভাযাত্রা সহকারে গভর্নর হাউসের (বর্তমানে বাংলা একাডেমি) দিকে রওনা হয়। মিছিল ফুলবাড়ীয়া রেলগেটের কাছে এসে পৌছাল পুলিশ আক্রমণের শিকার হয়। পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, ইয়ার মােহাম্মদ খান, শামসুদ্দীন আহমদ, খন্দকার মােশতাক আহমদ ও আবদুল মতিনকে নির্মমভাবে লাঠিচার্জ করে। ফলে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পুলিশ পরে শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে। | ১৯৫৫ সালের ২১,২২ ও ২৩ অক্টোবর ঢাকার সদর ঘাটে অবস্থিত ‘রূপ মহল’ সিনেমা হলে তিনদিনব্যাপী দলের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে’ রূপান্তরিত করা হয় । মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ২৩ অক্টোবর কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দেয়ার সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে জনাব সােহরাওয়ার্দী বলেন, “অবিভক্ত ভারতে হিন্দু কংগ্রেসের সৃষ্টি হওয়ায় সেদিন পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবি করা হয়েছিল। যদি এখানে সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতি ঠিক একই ধরনের ব্যবহার করা হয়, কাউন্সিলার মহােদয়গণ কি আমার সাথে এই মর্মে একমত হবেন না যে, এখানেও সংখ্যালঘুরা বিভাগ পূর্ব ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের মতাে একই রকমের প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে ।” সংগ্রামী জননেতা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান কাউন্সিলারদের উদ্দেশে বলেন, দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার প্রয়ােগের সুযােগ সৃষ্টি করে দেয়া নৈতিক দায়িত্ব। এই নৈতিক দায়িত্বের অংশ হিসেবে আজকের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তরিত করা হলাে।”

আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগে পরিণত করতে সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করেন সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান। কারণ তিনি ছিলেন মওলানা ভাসানী ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মধ্যকার মতপার্থক্য দূর করার একমাত্র সেতুবন্ধন। তাছাড়া এ সময় তিনি ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক। সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবুর রহমান অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগেরও প্রথম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।  আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ মূলত ভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত কোনাে দল ছিল না। এটি ছিল মুসলিম লীগের বিভিন্ন মতের সাবেক সদস্যদের নিয়ে গঠিত মুসলিম লীগবিরােধী একটি প্ল্যাটফরম যার মধ্যে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরুদ্ধবাদী, ডানপন্থী, বামপন্থী, কেন্দ্রবাদী, জাতীয়তাবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী, মিশ্র মতাদর্শবাদী ব্যক্তিবর্গের সমাবেশ। শুধু নেতিবাচক প্রবণতাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের পেছনে প্রণােদনা শক্তি হিসেবে কাজ করেনি, যদিও তা মুসলিম লীগবিরােধী দলছুট গােষ্ঠীগুলাের ক্ষেত্রে সত্যি ছিল। এ কারণে আমরা লক্ষ্য করি যে, বহুবার এ দল থেকে অনেক নেতা পদত্যাগ বা তাদের বহিষ্কৃত করা হয়েছে। ‘অহং আদর্শের জন্য বিশাল আত্মত্যাগ ১৯৫০ সালে শেখ মুজিবকে নিরাপত্তা বন্দি হিসেবে ফরিদপুর কারাগারে আটকে রাখা হয়। জেল থেকেই তিনি এইচ, এস সােহরাওয়ার্দীকে ২১ ডিসেম্বর একটি পত্র লেখেন। চিঠিটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ফরিদপুর থেকে গােপালগঞ্জে যেতে ৬০টা ঘণ্টা সময় লাগে যা অত্যন্ত ক্লান্তিকর। তিনি আরাে লিখেছেন, আবদুস সালাম খান জেলে তার সঙ্গে দেখা করেছেন এবং হাইকোর্টে হেবিয়াস কর্পাস রুলে পিটিশন করবেন। এটি হলাে পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম মামলা যেখানে পুলিশ মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করে লাঠিচার্জ করে জনগণকে মারপিট ও ছত্রভঙ্গ করেছে। অনুগ্রহ করে আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি জানি যে মহৎ কর্মের জন্য যে মৃত্যুকে বেছে নেয় তাকে কদাচিৎ পরাজিত করা সম্ভব।

তিনি লেখেন “Great things are achieved through great sacrifices.” বিগত অক্টোবরে যখন আপনার সঙ্গে ঢাকা জেল গেটে দেখা হয়েছিল তখন আপনি কিছু বই দেয়ার জন্য অঙ্গীকার করেছিলেন। আপনার ভােলা উচিত নয় জেলে আমি একাকী এবং বই হলাে আমার একমাত্র সাথী।” আপনার স্নেহধন্য মুজিবুর ।” জাতীয় ঐক্যের জন্য এক ও অভিন্ন ভাষার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। তবে পাকিস্তানি শাসকদের যুক্তিগুলাে ছিল বাস্তবতা বিবর্জিত ও আক্রমণাত্মক। ভারতের দশ কোটি মুসলমানের ভাষা উর্দু ছিল না। পাকিস্তানের মাত্র ৭% লােকের মাতৃভাষা ছিল উর্দু। তাছাড়া উর্দুকে একমাত্র ইসলামী ভাষা বলারও কোনাে যৌক্তিকতা ছিল না। উর্দু মূলত একটি ভারতীয় ভাষা এবং উহার ৭৫% শব্দ সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষাজাত। সুতরাং পাকিস্তানি শাসকদের রাষ্ট্রভাষা-নীতির দ্বারা শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের গণতান্ত্রিক অধিকারকেই অস্বীকার করা হয়নি, তা ছিল মাতৃভাষা ও দেশপ্রেমের প্রতি প্রত্যক্ষ আঘাত। তবে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি শুধু আবেগের প্রশ্ন ছিল , এর সঙ্গে বাঙালির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক স্বার্থও জড়িত ছিল। কেবল উর্দু রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালিকে চাকরি তথা প্রশাসনে অংশগ্রহণের জন্য একটি বিদেশী ভাষা উৎপীড়ন’ হিসেবে চেপে বসত। ১৯৪৮-৫১ সময়কালে রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নটি ছাত্র-বুদ্ধিজীবী এবং ক্ষুদ্র রাজনৈতিক গােষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৫২ সালে বিরােধী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ প্রভৃতি সংগঠনের সমন্বয়ে একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সংগ্রাম পরিষদ একুশে ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠানের কর্মসূচী গ্রহণ করে। অন্যদিকে তৎকালীন পূর্ব-বাংলার নুরুল আমিন সরকার ঐ দিন ঢাকায় সকল প্রকার সমাবেশ শােভাযাত্রা নিষিদ্ধ করে। ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ঘটে।

রফিক, জব্বার, বরকত, সালাম প্রমুখ ছাত্র পুলিশের গুলিতে নিহত হয়। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে ঢাকা ও প্রদেশের বিভিন্ন স্থানে সরকারবিরােধী বিক্ষোডে জনসাধারণ ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এক গণবিস্ফোরণের রূপ লাভ করে। এই বিস্ফোরণ এতই প্রচণ্ড ছিল যে, তদানীন্তন পূর্ব বাংলার আইনসভা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৯৫৩ সালের মূলনীতি কমিটির রিপাের্টেও বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম সরকারি ভাষা হিসেবে মর্যাদাদানের সুপারিশ করা হয়। পরিশেষে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উর্দুর সঙ্গে বাংলাও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি লাভ করে। | পাকিস্তানের শাসকগণ মুসলিম সাংস্কৃতিক উন্নয়নের বাংলা ভাষা উপযুক্ত নয় মনে করেছেন। তাদের মতে বাংলাভাষা ও সাহিত্য ছিল মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে ছিল প্রথমে আরবী এবং পরে রােমান হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব। বাংলা সাহিত্যে ইসলামী তথা আরবী, উর্দু, ফারসি শব্দ ও বাকধারার ব্যাপক ব্যবহারের প্রতি উৎসাহদান। তাছাড়া রেডিও টেলিভিশনে পাকিস্তানের আদর্শবিরােধী’ রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নাটক পরিবেশনার উপরেও নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয়। কিন্তু পূর্ব বাংলার প্রধান সাংস্কৃতিক ও ছাত্র সংগঠনের কাছে সব পদক্ষেপকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি সর্বোপরি বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র বলে প্রতীয়মান হয়। ভাষা আন্দোলন পূর্ব বাংলায় বিরােধীদল তথা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথ প্রশস্ত করে। এর প্রভাবে ১৯৫১-৫৩ সালের মধ্যে গণতন্ত্রী দল, ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি অসাম্প্রদায়িক ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি ছিল একটি প্রধান ইস্যু এবং সরকারের ভাষানীতিই ছিল বিরােধী যুক্তফ্রন্টের কাছে শাসক দল মুসলিম লীগের পরাজয়ের অন্যতম কারণ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল জনজীবনের সংকটের প্রশ্নগুলাে, শাসনশশাষণের কজা হতে নিকৃতির দিক দর্শন। সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা যায় স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি। পূর্ব বাংলার জনগােষ্ঠীর কছে প্রায় অপরিচিত “উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লীগ নেতৃবৃন্দের বিভিন্ন উদ্যোগ এ বিরােধকে আরও ঘণীভূত করে তােলে।

পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সম্পদের অসম বণ্টন ভাষার প্রশ্নকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী কর্তৃক সৃষ্ট পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তােলে। বস্তুত, বাঙালিদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের রাজনৈতিক চক্রান্ত ও বাঙালি সংস্কৃতি ধ্বংসের ক্রমাগত পূর্বাংশে ব্যাপক অসন্তোষের সৃষ্টি করে এবং এ অঞ্চলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকে জাগ্রত করে, যা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রূপান্তরিত হয়। পার্ক ও হুইলারের মতে, ক্রমান্বয়ে পূর্ব পাকিস্তানিরা বুঝতে পারে যে, তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং উন্নয়ন পশ্চিম পাকিস্তানিদের ইচ্ছার অধীন হয়ে পড়েছে। পূর্ব বাংলাকে কেন্দ্রীয় সরকার একটি উপনিবেশ’ হিসেবে ব্যবহার করছে। ভাষাকে কেন্দ্র করে অর্থাৎ পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বাংলাকে পরিহার করে উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে জনপ্রিয় করার পদক্ষেপ গৃহীত হলে এ মনােভাব আরও পুঞ্জীভূত হয়। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকারের প্রতি এ অসন্তোষের পাশাপাশি প্রাদেশিক মুসলিম লীগ সরকারের দুর্নীতি এবং অদক্ষতা, নির্বিকার, নিপীড়ন পরিস্থিতিকে আরও ঘােলাটে করে তােলে।

১৯৫৫ সাল। ২১ সেপ্টেম্বর। করাচী। বুধবার বেলা ১০টা। শেখ মুজিব গণপরিষদে বলেন, “বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পাস করতে হবে।” বাংলা ভাষা সম্পর্কে তিনি আরাে বলেন, “আমাদের বাংলায় কথা বলতে দিতে হবে। আমরা ইংরেজি জানলেও বাংলায় কথা বলতে চাই, যদি তা অনুমতি না দেয়া হয়। তাহলে আমরা অধিবেশন বয়কট করব। এটাই হলাে আমাদের স্ট্যান্ড। ভাষা আন্দোলনের সময় থেকেই চিন্তা ও কর্ম উভয়বিধ ক্ষেত্রেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নবজাগ্রত বাঙালি জাতীয়তাবাদের লালনক্ষেত্রে পরিণত হয় এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের আদর্শিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেরণা ও মূল্যবােধকে শাণিত এবং বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাপ্তি প্রদান। বেরিয়ে এসেছিলেন পেশাজীবী, রাজনীতিবিদ, সরকারি আমলা এবং বেসরকারি কর্মচারী, ব্যবসায়ী ও শিল্পউদ্যোক্তারা। এরাই বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণীকে মানসিক চেতনার দিক থেকে স্ফীত করেছিলেন, যারা ৬০-এর দশকে এসে প্রত্যক্ষ করেন পাকিস্তানি শাসক মহল কীভাবে তাদের অর্থনৈতিক অকিাক্ষা ও প্রত্যাশাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে।

জেনারেল আইয়ুব চক্রের কাছে প্রত্যক্ষ হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। যারা ছিল ক্রমবর্ধমান সরকারবিরােধী আন্দোলনের সবচেয়ে সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক। ১৯৬২ সালের পর থেকেই ছাত্রদের সরকার বিরােধী বিক্ষোভের তীব্রতা বাড়তে থাকে। এ তীব্রতার ছাত্রবিক্ষোভের কারণগুলাে যেমন ছিল শিক্ষাসংক্রান্ত তেমনি রাজনৈতিকও। তাদের দাবিগুলােই তার প্রমাণ । তারা চেয়েছিল সর্বস্তরে শিক্ষার সুযােগ বৃদ্ধি, স্বৈরতন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৬১ বাতিল ঘােষণা, পূর্ব পাকিস্তানসহ অন্যান্য প্রদেশের জন্য পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্র, সকল নাগরিকের জন্য মৌলিক অধিকার, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি, ছাত্রসহ সকল রাজবন্দি মুক্তি ইত্যাদি। তখন শিক্ষা সংক্রান্ত অভিযােগগুলাে রাজনৈতিক অভিযােগ থেকে উদ্ভূত বলে মনে করা হতাে। কাজেই ছাত্রদের শিক্ষাসংক্রান্ত দাবিগুলাে বৃহত্তর আর্থ-রাজনৈতিক দাবিদাওয়ার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গিয়েছিল।  ছাত্রবিক্ষোভের মােকাবেলায় সরকার বেছে নিয়েছিল নির্মম অত্যাচার ও নিপীড়নের পথ। দীর্ঘকাল ধরে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখা, ব্যাপক ধরপাকড়, জেলজুলুম, বহিষ্কার, ডিগ্রি-ডিপ্লোমা প্রত্যাহার, আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশন (এন.এস.এফ) নামধারী সরকার সমর্থিত তথাকথিত ছাত্র সংগঠনের গুন্ডা বাহিনীর কর্তৃক ছাত্রদের উপর দৈহিক নির্যাতনের মাধ্যমে সরকার এসব আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসে হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে চার সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিশন নিয়ােগ করে।

হামিদুর রহমান ছিলেন পাকিস্তান সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপ্রতি এবং ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। যদিও এটি ছাত্র সমস্যা ও ছাত্রকল্যাণ কমিশন নামে অভিহিত হয়েছিল, তথাপি প্রকৃতপক্ষে এটি কোনাে শিক্ষা কমিশন ছিল না। এর প্রধান কাজ ছিল ছাত্র অসন্তোষের কারণ খুঁজে বের করে প্রতিকারের উপায় সম্বন্ধে সুপারিশ প্রদান করা । ১৯৬৫ সালে প্রদত্ত রিপাের্টে কমিশন উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে স্বেচ্ছাচারিতা বৃদ্ধির অভিযােগ”-এর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং উপসংহারে বলে যে, “১৯৬১ সালের অধ্যাদেশের অধীনে যে পরিবর্তন সাধন করা হয়েছিল তাতে বিরাজমান অবস্থায় আশানুরূপ উন্নতি সাধিত হয়নি বরং হতে বিপরীতে হয়েছে। তাদের প্রস্তাব ছিল, উপযুক্ত রক্ষাকবচসহ সিনেট ও সিন্ডিকেটকে পুনর্বহালকরণ যাতে করে ‘অবাঞ্ছিত’ ব্যক্তিবর্গ অনুপ্রবেশ করতে না পারে অথবা পারলেও কোনাে ক্ষতিসাধন করতে না পারে। অতি সীমিত মাত্রায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থায় নির্বাচন প্রথার সুপারিশ করা হয়। এর বেশি কিছু করতে কমিশন মােটেই প্রস্তুত ছিল না। কমিশন স্বীকার করে | যে, পূর্ব পাকিস্তানে ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসেবে একজন রাজনৈতিক গভর্নরের নিযুক্তিকে অত্যন্ত উত্তপ্ত একটি ইস্যুতে পরিণত করেছে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসংগঠনগুলাে সম্বন্ধে কমিশনের বিরূপ মনােভাব। বাঙালি ছাত্রদের কাছে এর প্রতিক্রিয়াশীল চেহারাই তুলে ধরেছিল। কাজেই শরিফ কমিশনের মতাে এ কমিশনকেও ছাত্ররা সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে ।

পাকিস্তানের উভয় অংশে তীব্র ছাত্রবিক্ষোভ ও গণআন্দোলনের মুখে ১৯৬৯ সালে আইয়ুব শাসনের মৃত্যুঘণ্টা বেজে উঠে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাঙালিদের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি নূতন রাজনৈতিক বিন্যাসের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল, কিন্তু আইয়ুবের উত্তরসূরিদের সেই সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার নৈতিক শক্তি ও সাহস | মােটেই ছিল না। ফলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান কালক্রমে এসে মিশে যায় একাত্তরে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের মাঝে।” | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট নামে নির্বাচন করে বিজয়ী হয়। এ বিজয় ছিল স্বৈরাচার ও | প্রতিক্রিয়াশীলতার বিরুদ্ধে গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতার বিজয় । এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্ট গঠনের আওয়াজ তােলেন।** যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরােধী ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক। কিন্তু ছাত্রদের চাপে তিনি যুক্তফ্রন্ট গঠনে সম্মত হন। এক্ষেত্রে শেরে বাংলা ফজলুল হক নতুন জটিলতা সৃষ্টি করেন। তার প্রস্তাব ছিল নেজামী ইসলামকে যুক্তফ্রন্টের অংশীদার করতে হবে। যদিও নেজামী ইসলাম যুক্তফ্রন্টের মূলনীতির সঙ্গে ভিন্নমত পােষণ করত। কমিউনিস্ট পার্টি আত্মগােপনে থাকলেও তাদের সিদ্ধান্ত ছিল যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী ও মুসলিম লীগের পরাজয়কে অবশ্যম্ভাবী করতে হবে। শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামী ইসলাম, গণতান্ত্রিক দল, খেলাফতে রব্বানী দলগুলাে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় । ঐতিহাসিক ২১ দফার প্রেক্ষিতে ১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে দেশব্যাপী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ। বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা ।

১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাবে স্বতন্ত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠার দাবির মধ্যে বাঙালি মুসলমানদের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নটি নিহিত ছিল। লাহাের প্রস্তাবের পৃথক সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ এবং সােহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিমের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা’ এ উভয় উদ্যোগের পেছনে এ ধারণাই কাজ করেছিল যে, বাঙালিরা কখনও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার হিস্যা পাবে না, কাজেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের গণতান্ত্রিক আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হতে পারে একমাত্র স্বায়ত্তশাসন লাভের মাধ্যমে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনী যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ১৯তম দফা অন্তর্ভুক্ত ছিল যা সংযােজিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ৬ দফায় । ২১ দফায় ১৯তম দফায় বলা হয়েছে: “ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুযায়ী পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন অর্জন করা এবং কেবল প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক বিষয়সমূহ ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে রেখে আর সকল বিষয় পূর্ব পাকিস্তানের বৈধ কর্তৃত্বাধীনে নিয়ে আসা হবে। এমনকি প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা করা হবে যাতে সামরিক বাহিনীর সদর দফতর পশ্চিম পাকিস্তানে এবং নৌবাহিনীর সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে থাকে। প্রতিরক্ষার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তােলার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিসমূহ প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং বর্তমান আনসার বাহিনীকে পুরাদস্তুর মিলিশিয়াতে পরিবর্তিত করা হবে।” পরবর্তী ১২ বছরে উত্থাপিত স্বায়ত্তশাসনের এ দাবিটি প্রতিষ্ঠিত না হওয়ায় এবং বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে সমগ্র পাকিস্তানের জনগণকে গণতন্ত্র থেকে বঞ্চিত রাখার দরুন ১৯৬৬ সালে এ দাবিটি আরও তীব্র ও চুড়ান্ত আকারে পুনরুজ্জীবিত হয়। পূর্ববঙ্গের সংসদের আসন সংখ্যা ছিল ৩০৯। পৃথক নির্বাচনী প্রথা চালু থাকায় অমুসলিম আসন ছিল ৭২টি।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৪৩, কৃষক শ্রমিক পার্টি ৪৮, নেজামী ইসলাম ২২, গণতন্ত্র পার্টি ১৩, খেলাফতে রব্বানী পার্টি ২, জাতীয় কংগ্রেস ২৫, তফসিলী ফেডারেশন ২৭, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট ১৩, কমিউনিস্ট পার্টি ৪ এবং মুসলিম লীগ ৯টি আসন লাভ করেন। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ময়মনসিংহে ছাত্রনেতা খালেক নেওয়াজ খানের কাছে বিপুল ভােটে পরাজিত হয়। নির্বাচনের পরেই পুনরায় রাজনৈতিক খেলা শুরু হয়। ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক প্রথমে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে পরে চাপে পড়ে তরুণতম সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই শেখ মুজিব পাকিস্তানের আমলাতন্ত্রের ঘৃণ্য রূপের প্রত্যক্ষ পরিচয় পেয়েছিলেন, যে আমলাতন্ত্র পূর্ব ও পশ্চিমের প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগ গােষ্ঠী ও কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে হাত মিলিয়ে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ভেঙ্গে দিয়েছিল। সে সময়ে পূর্বপাকিস্তানের আমলা চক্রই কেন্দ্রের সহযােগিতায় নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিলে বাঙালি-অবাঙালি কর্মচারীদের মধ্যে প্রচণ্ড দাঙ্গা বাধিয়ে দেয় । উদ্দেশ্য, যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে হেয় করা-এটিকে ভেঙ্গে দেয়ার অজুহাত সৃষ্টি করা। | ১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আতাউর রহমান খান। শেখ মুজিব লক্ষ্য করলেন যে কেন্দ্রের প্রশ্রয়ে লালিত-পালিত পূর্ব পাকিস্তানের আমলাতন্ত্র মন্ত্রীদের কোন পাত্তাই দিতে চান না। আমলাদের আচরণে লক্ষ্য করেছেন তারাই যেন নিজেরা এক একজন ‘সুলতান’। তাই শেখ মুজিব সিদ্ধান্ত নিলেন আমলাদের প্রভুত্ব ভেঙ্গে তাদের সেবক’ বানাতে হবে। ফলে তাকে কঠোরব্যবস্থা নিতে হয় যেন জনপ্রতিনিধিদের বা মন্ত্রীদের হেয় বা নাজেহাল করার সাহস পায়। শেখ মুজিব কেন্দ্রে সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদের কাছে শুনেছিলেন কীভাবে প্রতিরক্ষা দফতরের সেক্রেটারি তাকে এই দফতর-সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে অস্বীকার করেছিলেন। শুনে তিনি ক্ষুব্ধ হন। বিরক্ত হন।

কিন্তু আশ্চর্য হননি। কারণ তখনই তারা বুঝতে পেরেছিলেন যে করাচী-রাওয়ালপিন্ডির চোখে পূর্ব পাকিস্তান একটি অধিকৃত কলােনি মাত্র। শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম থেকেই জনসাধারণের রায়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধি। ও একজন মন্ত্রী হিসেবে যে অথরিটি বা ক্ষমতা তার প্রাপ্য তাই নিয়ে আমলাদের সঙ্গে দৈনন্দিন কাজকর্ম শুরু করলেন। আমলা যত বড় অফিসারই হােন না কেন-এমন কি চিফ সেক্রেটারি বা আই.জি.কে-ও দরকার হলে তিনি ছেড়ে কথা বলতেন না। শেখ মুজিব একজন নামমাত্র মন্ত্রী নন। তার প্রখর ব্যক্তিত্ব ও উদ্যোগী কর্মকাণ্ডের ফলেই অল্প দিনেই আমলারা তাকে যথাযথ সমীহ করে চলতে থাকেন। কিছুদিনের মধ্যেই শেখ মুজিব এসব জবরদস্ত আমলা গােষ্ঠীর মধ্যে সুপ্ত ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন-কিন্তু কোনাে দুর্ব্যবহারের দ্বারা নয়, তার ন্যায়নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, নির্ভীক সিদ্ধান্ত ও আইনানুগ দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা। এই অবস্থা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার লক্ষ্যে কেন্দ্রে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শুরু হয়। সেই চক্রান্তের সর্পিল পথ ধরে যুক্তফ্রন্টের গণরায়কে বানচাল করার পদক্ষেপ গৃহীত হয়। কেন্দ্রের চক্রান্তে যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। দলবাজি শুরু হয়। জনগণের ম্যান্ডেট উপেক্ষিত হয়। রাজনৈতিক কূটচাল যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় চিফ মিনিস্টার হিসেবে শেরেবাংলা ফজলুল হক এপ্রিল ৩০ তারিখে (১৯৫৪) কলকাতা সফরে যান। বৃদ্ধ হক সাহেব তার জীবনের প্রায় ষাট বছরের অজস্র স্মৃতিবিজড়িত কলকাতায় এসে, যাদের সঙ্গে দীর্ঘদিন সুখে-দুঃখে।

একসঙ্গে কাজ করেছিলেন, এমন অনেক বন্ধুস্থানীয় হিন্দু নেতাদের চোখের সামনে দেখতে পেয়ে আবেগভরে বলেছিলেন; “ভাইরা দেশভাগ হলেও আমি এখনও পর্যন্ত ‘পাকিস্তান’ ও হিন্দুস্থান’ এই কথা দুটিকে রপ্ত করে উঠতে পারিনি। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানে বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে সর্বত্র প্রবল প্রচার শুরু হয়ে যায় যে ফজলুল হক পূর্ব-বাংলাকে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে মিলিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করার জন্যই। কলকাতায় গিয়েছিলেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক সাহেব একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, “পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও ঐক্য আমি সর্ব শক্তি দিয়ে রক্ষা করব।” কিন্তু প্রচারের প্রবল বন্যায় তার বিবৃতিটি তলিয়ে যায়। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে এসে ১৫ মে মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক সাহেব তার মন্ত্রিসভা পরিবর্ধিত করলেন। দশ জন নতুন মন্ত্রী নিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান নিযুক্ত হলেন বাণিজ্য, শিল্প ও দুর্নীতি নিবারণ দফতরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। তখন তার বয়স মাত্র ৩৪ । তিনি হলেন এই ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট’ মন্ত্রিসভার সবচেয়ে কম বয়সের মন্ত্রী।

পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক টাইমস ও রয়টারের দুজন সংবাদদাতাকে হক সাহেবের কাছে পাঠালেন একটি ইন্টারভিউর জন্য। সাক্ষাৎকারের পরে এক সংবাদে প্রকাশিত হলাে যে পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হক বলেছেন যে, “পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা অর্জনই হবে আমার মন্ত্রিসভার প্রথম কাজ।” এই মিথ্যা খবরটি প্রকাশিত হবার পর আবার প্রতিক্রিয়াশীল মহল প্রবল আক্রমণ শুরু করে দিলাে জননেতা ফজলুল হক ও “যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে। করাচী ও ঢাকার মুসলিম লীগ মহল ও সংবাদপত্রগুলাে শেরে বাংলা ফজলুল হককে “বিশ্বাসঘাতক” “দেশের শত্রু” বলে আখ্যা দিল।

প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মহম্মদ আলি ফজলুল হককে করাচীতে তলব করলেন। মুখ্যমন্ত্রী হক সাহেব, শেখ মুজিবুর রহমান, ফরিদপুরের ইউনুস আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া), আতাউর রহমান খান প্রমুখ তার কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে করাচী গেলেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী হক সাহেব ও শেখ মুজিবকে নানা প্রলােভন দেখিয়ে ও পরে হুমকি দিয়ে যুক্তফ্রন্টের ও আওয়ামী লীগেরও ঐক্য ভাঙাতে চাইলেন। প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হককে বললেন যে, তাকে তিনি পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করবেন। শেখ মুজিবকে বললেন, “আপনাকে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য করব- শুধু আপনারা যুক্তফ্রন্ট সরকার থেকে বেরিয়ে এসে যুক্তফ্রন্টকে ভেঙ্গে দিন, কিন্তু হক সাহেব ও মুজিব দুজনেই ঘৃণাভরে মহম্মদ আলির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন। ঢাকায় পৌছে ফজলুল হক কে, এম, দাস লেনে তাঁর বাড়িতে হলে অন্তরীণ। কেন্দ্রীয় শাসক চক্র ফজলুল হককে বিশ্বাসঘাতক ও রাষ্ট্রদ্রোহী বলে পদচ্যুত করে । পূর্ব বঙ্গে ৯২-এ ধারা প্রয়ােগ করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয়। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার আলি মির্জাকে গভর্নর ও কুখ্যাত সিভিলিয়ান নিয়াজ মহম্মদ খানকে (এন.এম খান যিনি ভারত বিভাগের আগে একজন জবরদস্ত আই, সি, এস আমলা ছিলেন এবং জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন) চিফ সেক্রেটারি করে সেদিনই পূর্ব বাংলায় পাঠালেন। পূর্বপাকিস্তানের বিদায়ী গভর্নর চৌধুরী খালিকুজ্জামান (ইনি দেশ বিভাগের আগে ভারতের উত্তরপ্রদেশে খ্যাতনানা মুসলিম লীগ নেতা ছিলেন) যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা। ভেঙ্গে দেয়ার বিরােধিতা করেছিলেন বলে তাকেও বরখাস্ত করল। | পূর্ববঙ্গে ইস্কান্দার মির্জা ও এন, এম খানের দুঃশাসন শুরু হলাে। তারা নির্যাতন ও নিষ্পেষণের স্টিম রােলার চালান। ৩১ মে গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা ঢাকার এক সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন: “আমার শাসনের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করলে তা বরদাস্ত করা হবে না।’ শেখ মুজিবর রহমানসহ পূর্ব বাংলার বহু রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাকে মির্জাশাহী গ্রেফতার করল। পূর্ব পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করা হলাে। সারা পূর্ববাংলাই যেন গােলাম মােহম্মদ ও ইস্কান্দার মির্জার শাসনে একটি বন্দি-শিবিরে পরিণত হলাে। পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র সভা, শােভাযাত্রা অর্থাৎ ব্যক্তি স্বাধীনতার সমস্ত অধিকার নিষিদ্ধ করা হলাে। যুফ্রন্টের নেতারা, যাঁরা তখনও গ্রেফতার হননি- একটি ঘরােয়া বৈঠকে মিলিত হয়ে সর্বশেষ রাজনৈতিক অবস্থা পর্যালােচনা করার চেষ্টা করলে পুলিশ সেখানেও উপস্থিত হয়ে বৈঠকটি ভেঙ্গে দেয়।

সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকারের চূর্ণ করে সারা পূর্ব বাংলায় কায়েম হলাে পাঞ্জাবি সন্ত্রাসবাদের এক চরম নিপীড়ন। পূর্ব পাকিস্তানে উপর সাম্রাজ্যবাদী জুলুমবাজির চাবুক হাঁকিয়ে পাঞ্জাবি চিফ সেক্রেটারি হুঁশিয়ার জানালেন- “পূর্ব বাংলাকে আমি এমন শিক্ষা দিয়ে দেব যে, কোনােদিন যেন আর বাঙালিরা সে কথা ভুলতে না পারে।| যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়ার হাতিয়ার হিসেবে শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ডকে সামনে নিয়ে আসে। ১৯৫৮ সালে ২০ সেপ্টেম্বর। পূর্ব পাকিস্তানের বিধান সভায়। স্পিকার আব্দুল হাকিম আসন গ্রহণ করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই মুসলিম লীগ দলের হাশেম উদ্দিন আহমেদ প্রস্তাব তুললেন যে, আওয়ামী লীগের যে ছয়জন সদস্য পাবলিক প্রসিকিউটর পদে যোগদান করেছেন সংসদ থেকে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। কিন্তু ঐ সময় পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরােজ খান নূন অর্ডিনাল জারি করে নির্বাচন কমিশনের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে দেন। উথাপিত প্রস্তাব নিয়ে শ্ৰীমনােরঞ্জন ধর বক্তব্য রাখলেন। কিন্তু একদল কুদ্ধ সদস্য তাৎক্ষণিক এ বিষয়ে স্পিকারের কাছে রুলিং দাবি করলে পাল্টাপাল্টি ন্যাপের সদস্য দেওয়ান মাহবুব আলী স্পিকার আব্দুল হাকিমের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনেন। এসব নিয়ে পার্লামেন্টে ছােটখাটো দাঙ্গা-হাঙ্গামা বেধে যায়। স্পিকার আব্দুল হাকিম পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে সভাকক্ষ ছেড়ে দেন। তখন ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী স্পিকারের শূন্য আসনে উপবেশন করেন। দেওয়ান মাহবুব আলীর প্রস্তাবের পক্ষে কংগ্রেস সদস্য পিটার পল গােমেজ স্পিকার আব্দুল হাকিমকে বদ্ধ উন্মাদ’ ঘােষণা করে প্রস্তাব আনলে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। 

এ সময় কৃষক-শ্রমিক দলের ইউসুফ আলী চৌধুরী (মােহন মিয়া) উত্তেজিতভাবে স্পিকারের দিকে এগিয়ে গেলেন । কিন্তু সরকার পক্ষের সদস্যরা তাকে বাধা প্রদান করেন। ২১ সেপ্টেম্বর স্পিকার ডেপুটি স্পিকার না থাকায় প্যানেল সদস্য কৃষক-শ্রমিকপার্টির নেতা সৈয়দ আজিজুল হক সেদিন বিধানসভার মামুলি রীতিনীতি পালন করেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হলে পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে বিরােধী পক্ষ হট্টগােল শুরু করে। সংখ্যাশক্তির দিক থেকে তখন পরিষদে বিরােধী দল ছিল দুর্বল। সেজন্য তারা দৈহিক শক্তি প্রয়ােগ করে। ডেপুটি স্পিকারের সভাপতিত্বে হাউস শুরু হলে অপজিশন দলের হট্টগােল বেপরােয়া হয়ে দাঁড়ায় । জনাব ইউসুফ আলী চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক, আবদুল লতিফ বিশ্বাস, আবদুল মতিন, গােলাম সরােয়ার, মহম্মদ-উন-নবী চৌধুরী প্রমুখ বিরােধীদলীয় সদস্যরা সমস্বরে দাবি জানালেন যে শাহেদ আলী সাহেব কালবিলম্ব করে স্পিকারের আসন যেন ত্যাগ করেন। এমনকি কৃষক শ্রমিক পার্টির মুখ্যমন্ত্রী জনাব আবু হােসেন সরকার উত্তেজিত হয়ে ডেপুটি স্পিকারের উদ্দেশে চিৎকার করে বলেন: “আপনি যদি এই মুহূর্তে স্পিকারের চেয়ার না ছাড়েন তবে আপনাকে আমরা খুনই করে ফেলব”।

আমার দেখা রাজনীতির ৫০ বছর বইতে আবুল মনসুর আহমেদ লিখেছেন, “শুধু মৌখিক নয়, কায়িক। শুধু খালি-হাতে কায়িক নয়, সশস্ত্র কায়িক। পেপার ওয়েট, মাইকের মাথা, মাইকের ডাণ্ডা, চেয়ারের পায়া-হাতল ডেপুটি স্পিকারের দিকে মারা হইতে লাগিল। শান্তিভঙ্গের আশংকা করিয়া সরকার পক্ষ আগেই প্রচুর দেহরক্ষীর ব্যবস্থা করিয়াছিলেন। তারা ডেপুটি স্পিকারকে অস্ত্রবৃষ্টির ঝাপটা হইতে রক্ষা করিতে লাগিলেন। অপজিশনের কেউ কেউ মঞ্চের দিকে ছুটলেন। তাদের বাধা দিতে আমাদের পক্ষেরও স্বাস্থ্যবান শক্তিশালী দু-চারজন আগ বাড়িলেন।…. নিজ জায়গায় অটল-অচল বসিয়া-বসিয়া সিনেমায় ফ্রি স্টাইল বক্সিং বা স্টেডিয়ামে ফাউল ফুটবল দেখার মতাে এই মারাত্মক খেলা দেখিতে লাগিলাম।” বিরােধীদলীয় চক্রান্তকারীদের ইট-পাটকেলে ডেপুটি স্পিকার আহত হন । তিনি ছিলেন ডায়াবেটিস রােগী। আহত অবস্থায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরের দিন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শাহেদ আলী হত্যা ছিল একটি পরিকল্পিত চক্রান্তের পরিণতি। ইস্কান্দার মীর্জা কেএসপি সদস্যদের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ রাখতেন। তিনি তাদের উসকানি দেন যেভাবে হােক পার্লামেন্টে দাঙ্গা হতে হবে, যাতে কেএসপি ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সঙ্গে মুখ্য যােগাযােগ রেখেছেন মােহন মিয়া। তারা সেই ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে ইস্কান্দার মীর্জা ও আইয়ুব খানের বুপ্রিন্ট বাস্তবায়নে লাঠিয়াল হিসেবে কাজ করেছেন। জেনারেল আইয়ুব খান মার্কিন সিআইএ প্রধান এ্যালেন ড্যালেসের সঙ্গে একমত হন যে, পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্য গণতন্ত্রের পরিবর্তে সামরিক শাসন হবে উত্তম।’ প্রকৃত অর্থে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের বিপুল গণরায় বানচাল, বাঙালি জাতির অধিকার, শশাষণ বৈষম্যের অবসানে এবং স্বশাসনের দাবিকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে এটা ছিল এক গভীর চক্রান্ত। সেজন্য যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল সামরিক আমলে তা কার্যকর থাকেনি। শাহেদ আলী ছিলেন আওয়ামী লীগ দলের সদস্য।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বা অন্য কোনাে সদস্য চেয়ার ছুড়ে তাকে হত্যা করেছেন এমন প্রমাণ কেউ দেখাতে পারবেন না। আবুল মনসুর আহমেদ বলেছেন, “শাহেদ আলী নিহত হইলেন অপজিশনের ঢিল-পাটকেলে অথচ পূর্ব বাংলার দুশমনেরা তখনও বলিলেন ও আজও বলেন আওয়ামী লীগ শাহেদ আলীকে হত্যা করিয়াছে।” এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতির মানসিকতা ত্যাগ না করলে কখনাে কেউ দেশ ও জাতির নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবেন না। সংকীর্ণ মানসিকতা নিয়ে ইতিহাসে বিশালত্ব অর্জন করা যায় না।  পূর্ববঙ্গে যুক্তফ্রন্টের অভ্যুদয় এবং এই সংগঠনের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের গণসংহিত পশ্চিম-পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সামনে প্রচণ্ড বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল। তারা উপলব্ধি করেছিলেন যে যুক্তফ্রন্টের চ্যালেঞ্জ যদি রােধ করা সম্ভব না হয় তা হলে অদূর ভবিষ্যত হয় পূর্ব বঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে নয় তাে অবাঙালি শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে পূর্ববঙ্গে রক্তাক্ত বিদ্রোহ সৃষ্টি হবে। এই অবস্থায় পূর্ববঙ্গে নির্মম দমনীতির আশ্রয় নেয়া ছাড়াও যুক্তফ্রন্টের বিভিন্ন শরিকের মধ্যে ফাটল ধরার কূটনৈতিক তৎপরতাতেও লিপ্ত ছিলেন গভর্নর জেনারেল গােলাম মহম্মদ ও তার পাঞ্জাবি-গােষ্ঠী।

গণপরিষদে শেখ মুজিব

এই সময় পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন, সংখ্যাসাম্য, এক ইউনিট গঠন এবং বাংলাদেশের শশাষণ বৈষম্য সম্পর্কে পাকিস্তান গণপরিষদের বাংলাদেশের পক্ষে যারা ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অনন্যসাধারণ । তিনি তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের শাসন, শােষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলেন সােচ্চার। তিনি গণপরিষদে বলেন যে, বাস্তবক্ষেত্রে করাচী সরকারের কাছে পূর্ব বঙ্গের কণ্ঠস্বর পৌছে না এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের বক্তব্যেরও কোনাে গুরুত্ব নেই। এক হাজার মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সিদ্ধান্তে পূর্ব বঙ্গের ক্ষেত্রে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পূর্ব বঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং তার ফলে দুই ভূখণ্ডের জনসাধারণের পক্ষে পরস্পরকে জানা এবং পরস্পরের সমস্যা অনুধাবন করাও সম্ভব নয়। তিনি আরাে বলেন যে, শাসকগােষ্ঠী আমাদের উপর শক্তি প্রয়ােগ করছে কিন্তু জনগণ বেশিদিন এই শক্তি সহ্য করবে না । গভর্নর জেনারেল যা করবে তাই মেনে নিতে হবে এমনটি হতে পারে না। জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিকে যে ক্ষমতা দিয়েছে গভর্নর জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তিনি যা ইচ্ছা তাই করছেন। তিনি পাকিস্তানের সর্বেসর্বা। জনগণ চায় কি না চায় তার ধার ধারেন না। তিনি আমলাদের নিয়ােগ দেন। তাদের বরখাস্ত করেন। ইচ্ছামতাে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেন।’ পার্লামেন্টে এক বিতর্কে তিনি বলেন, “অর্থনীতির দিক দিয়েও পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অতি যুক্তিসঙ্গত। কারণ, পরস্পরের মধ্যে পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের অর্থনীতির ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। যােগাযােগের অভাব, উৎপাদনের ব্যবহার ভিন্ন প্রকৃতি এবং মূল্যমানের বিরাট পার্থক্যের ফলে এক অঞ্চলের পারম্পর্য রক্ষা করাও সম্ভব নয়।”

“পাকিস্তানের ফেডারেল রাজধানী ও পূর্ব বঙ্গের মধ্যে চৌদ্দ শ’ মাইলের ভারতীয় ভূখণ্ড অবস্থিত। স্থলপথে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে কোনাে সংযােগ নেই। বিমান বা স্থলপথে এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা করা অত্যন্ত কঠিন এবং ব্যয়সাধ্য। খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য অত্যাবশ্যক নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম পশ্চিম পাকিস্তানে পূর্ব বঙ্গের তুলনায় অনেক কম। প্রায় সমস্ত জিনিসই প্রথমে করাচীতে আমদানি করা হয় এবং তারপরে আবার রফতানি করা হয় পূর্ববঙ্গে। তার ফলে, পশ্চিম-পাকিস্তানের রপ্তানিকারকরা যে শুধু অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে তাই নয়-পশ্চিম-পাকিস্তান থেকে মাল রপ্তানি করার জন্যও অতিরিক্ত দাম ধার্য করে । সেজন্য বৈদেশিক জিনিসপত্র যে পূর্ববঙ্গের চাহিদার তুলনায় অনেক কম পাওয়া যায় তাই নয়, পূর্ব বঙ্গের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামেও বিক্রি হয়। “রাজনীতির দিক দিয়েও পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অনস্বীকার্য । বর্তমান যুগে সবদেশেই সরকারি কাজকর্ম জনসাধারণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ রেখে পরিচালিত করা হয়। তিন হাজার মাইল দূর থেকে পূর্ববঙ্গের জনসাধারণের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে সামান্য যােগাযােগ রাখাও সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় সরকারের উপরে অধিকতর দায়িত্ব ও কর্তৃত্ব অর্পণ করে তাই রাষ্ট্রের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পরে এই রাষ্ট্রে সমস্ত কাজকর্মে ইউনিটারি বা ঐকিক ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু তার ফলে বিভিন্ন প্রদেশের মধ্যে কতখানি ঐক্য স্থাপন করা হয়েছে। জোর জুলুম করে অথবা পিস্তল দেখিয়ে কোনাে দেশে ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব নয়।” যদিও পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের তুলনায় অনেক বেশি বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত তবুও কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব বঙ্গের বৈষয়িক উন্নয়নের জন্য এই টাকা খরচ করতে দিত না।

এই মূল্যবান ফরেন এক্সচেঞ্জের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তান তার নিজের শিল্প প্রসারের জন্য নির্লজ্জভাবে গ্রাস করত। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ হিসেব করে দেখিয়েছিলেন যে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান প্রতিবছরে গড়ে ৩৪ কোটি ১২ লাখ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তান নামক অগ্রাসী শােষণ যন্ত্রটির কাছে হারাচ্ছিল। অধ্যাপক আহমদ সখেদে মন্তব্য করেছিলেন : “পূর্ব-পাকিস্তানের উর্বর মাটিতে যে সােনা ফলে তা আমাদের বাধ্য হয়ে তুলে দিতে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে, কিন্তু প্রতিদানে আমরা কি পাচ্ছি? কিছুই না। এ ধরনের নির্মম শোষণের নজির বােধহয় পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কাজেই পূর্ববাংলার নিপীড়িত মানুষ স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকেই তাদের বাঁচার একমাত্র উপায় বলে মনে করে। পাকিস্তান গণপরিষদের পূর্ববঙ্গীয় সদস্য জনাব আবদুর রহমান খান করাচীতে ১৭ মার্চ অধিবেশনে গভীর হতাশার সঙ্গে বলেছিলেন : “আমাদের স্বাধীন ইসলামিক রাষ্ট্রে আমাদের সহধর্মী পশ্চিম পাকিস্তানি মুসলমানরা পূর্ব বাংলার দরিদ্র চাষীদের উপর যে নিষ্ঠুর শশাষণ চালাচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার এবং হিন্দু জমিদার ও মহাজনরা বােধহয় তার এক-চতুর্থাংশ অত্যাচারও আমাদের উপর করেনি।” ১৯৫৪ ও ১৯৫৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানে বিধ্বংসী বন্যার ফলে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারাল, গৃহহারা হলাে, দেশে প্রায় দুর্ভিক্ষ অবস্থা দেখা দিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোনাে পরিকল্পনাই গ্রহণ করল না।”

দেশের শিল্প প্রসারের উদ্দেশ্য নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ‘পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন সংস্থা গঠন করেন। এর চেয়ারম্যান, ডিরেক্টর, সেক্রেটারি, সবাই ছিলেন অবাঙালি। ৯০ অফিসারদের মধ্যে একজন এবং ৭০০ অধস্তন কর্মচারীর মধ্যে মাত্র ১২ জন ৭ জন কেরানী ও ৫ জন পিয়ন ছিলেন বাঙালি। গবেষণার কাজের জন্য উক্ত সংস্থায় ১৫০টি প্রদত্ত স্কলারশিপের মধ্যে বাঙালি ছিল মাত্র ২ জন। সংস্থার চাকরির জন্য ঢাকায় কখনও কোনাে ইন্টারভিউ নেয়া হতাে না, পূর্ব পাকিস্তান থেকে যারা চাকরি প্রার্থী তাদেরও ডাকা হতাে করাচীতে। কিন্তু এদের কোনাে ভ্রমণ-ভাতা দেয়া হতাে না-ফলে ঢাকা থেকে করাচী পর্যন্ত বিমান বা জাহাজ ভাড়া দিয়ে কজন বাঙালি ইন্টারভিউ দিতে পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে পারত তা সহজেই অনুমেয়। কর্তৃপক্ষ পূর্ব পাকিস্তান সরকারকে কথা দিয়েছিলেন যে পূর্ব বঙ্গে তাদের অফিসগুলােতে ওরা শতকরা পঁচাত্তরজন বাঙালি নিয়ােগ করবেন কিন্তু কার্যক্ষেত্রে উচ্চপদে দূরে থাকুক শ্রমিকের কাজেও তারা বাঙালি নেয়নি। গণপরিষদে এসব বিষয়ে শেখ মুজিবুর রহমান দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে তুলে ধরে বলেন, “মাননীয় কেন্দ্রীয় শিল্পমন্ত্রী যদি পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে ভালাে করে খোঁজ-খবর নেন তবে তিনি দেখতে পাবেন যে বিভিন্ন দফতরগুলােতে স্থানীয় মানুষ কোনাে কাজ-কর্ম, কোনাে সুযােগসুবিধা পান না। তিনি বলেন, অনারেবল স্পিকার মহােদয়, আমি কি সবিনয়ে একটি প্রশ্ন করতে পারি? প্রশ্নটি হচ্ছে-বাঙালিরা কি পাকিস্তানি নয়? আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট সদস্য জনাব জহির উদ্দিনও ঐ দিন প্রশ্ন তুলেছিলেন: “পূর্ব বাংলার মানুষ যদি প্রতিটি বিষয়ে এভাবে কেন্দ্রের বৈষম্যের শিকার হন তবে পাকিস্তানের ভেতরে পূর্ব পাকিস্তানের থাকার কোনাে যৌক্তিকতা আছে কি?”

কেন্দ্রীয় সরকার যে সব পারমিট বা কন্ট্রাক্ট বিতরণ করতেন তার প্রায় সবগুলােই পেতেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা। শেখ মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারেও প্রকট বৈষম্যের প্রতি করাচীর বড় কর্তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ২১ মার্চ, ১৯৫৬ সালে। গণ-পরিষদে বলেছিলেন: “বিদেশ থেকে কয়লা আমদানি করার পারমিট একজন বাঙালিও এখন পর্যন্ত পাননি। ঢাকায় কয়লা সংক্রান্ত যে সরকারি দফতর আছে তাদের পারমিট ইস্যু করার কোনাে এক্তিয়ার নেই। তাই যে সব উদ্যোগী বাঙালি কয়লার ব্যবসা করতে চান তাঁদের অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে করাচী গিয়ে প্রভাবশালী পশ্চিম পাকিস্তানিদের দরজায় দরজায় ধর্না দিয়ে বেড়াতে হবে। শেখ মুজিব আরও বলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের খবরের কাগজগুলাের পৃষ্ঠা সংখ্যা সাধারণত চার থেকে ছয়, বড় জোট আট, কিন্তু সেগুলাের জন্য পর্যাপ্ত নিউজপ্রিন্ট দিতে করাচীর বুক ফেটে যায় অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে বত্রিশ, ছত্রিশ এমনকি ছাপান্ন পৃষ্ঠার সংবাদপত্রের জন্য টন টন নিউজপিন্টের সরবরাহ দিতে করাচীর একটুও দেরি হয় না। দেশরক্ষার ব্যাপারে ডিফেন্স বা পরিস্থিতি বােধহয় আরও শােচনীয় ছিল। ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮- এই এগার বছরে প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় সব টাকাই খরচ হয়েছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে সুরক্ষিত করে তুলতে। প্রতিরক্ষা বিভাগের তিনটি শাখারই (আমি, এয়ার ফোর্স ও নেভি) সদর দফতর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সামরিক বাহিনীতে পূর্ব-পাকিস্তানিদের নেয়া হতাে না বললেই চলে-এগারাে বছরে মাত্র দু ব্যাটেলিয়ান বাঙালি সৈন্য সৃষ্টি হয়েছিল। অফিসার গ্রেডে বাঙালি ছিলেন শতকরা দুজনের বেশি নয়। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত দুজন পূর্ব পাকিস্তানি কোনাে মিলিটারি অফিসারকে মেজর জেনারেলের চেয়ে উচ্চতর কোনাে পদমর্যাদা দেয়া হয়নি। তাদের মধ্যে মেজর জেনারেল ওয়াসি উদ্দিন নামেই ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানি, তিনি প্রকৃতপক্ষে উর্দুভাষী, ঢাকার নবাব পরিবারের সন্তান।

অপরজন মেজর জেনারেল মজিদ। তিনি আয়ুব খানের চেয়েও সিনিয়র ছিলেন। কিন্তু জনাব মজিদের বিরুদ্ধে একটি অবিশ্বাস্য অভিযােগ এনে তাঁকে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য। করা হয়। তিনি নাকি ইরাকের বাদশাহ ফয়সলের পাকিস্তান সফরের সময় তাকে হত্যা করার এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানি আরেকজন উচ্চপদাধিকারী অফিসার সিলেটের কর্নেল উসমানীর যথাসময়ে জেনারেল হওয়া উচিত ছিল।” | গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দেন এবং অন্যান্য প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ যারা পূর্ববঙ্গের স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে যে সকল বক্তব্য রেখেছিলেন তারই সার-সংক্ষেপ করে শেখ মুজিবুর রহমান একটি পুস্তিকা আকারে পূর্ব-বাংলার প্রকৃতচিত্র লিখিতভাবে তুলে ধরেন। ঐ পুস্তিকাটি সংগঠন ও জনগণের জন্য প্রকাশ ও বিলি করেন। সেখানে বলা হয়, “বাস্তবক্ষেত্রে রাজধানী করাচী সরকারের কাছে পূর্ব বঙ্গের কণ্ঠস্বর পৌছে না এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে এই অঞ্চলের বক্তব্যেরও কোনাে গুরুত্ব নেই। এক হাজার মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারের সিদ্ধান্তে পূর্ব বঙ্গের ক্ষেত্রে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পূর্ব বঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন এবং তার ফলে দুই ভূখণ্ডের জনসাধারণের পক্ষে পরস্পরকে জানা এবং পরস্পরের সমস্যা অনুধাবন করাও সম্ভব নয়।” “অর্থনীতির দিক দিয়েও পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবি অতি যুক্তিসঙ্গত। কারণ, পরস্পরের মধ্যে পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের অর্থনীতির ভিত্তি সম্পূর্ণরূপে পৃথক। যােগাযােগের অভাব, উৎপাদনের ব্যবহার ভিন্ন প্রকৃতি এবং মূল্যমানের বিরাট পার্থক্যের ফলে এক অঞ্চলের পারস্পর্য রক্ষা করাও সম্ভব নয়।”

স্বায়ত্তশাসন, অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক বৈষম্যের চিত্র

বঙ্গের ইতিহাস এক শশাষণের ইতিহাস। এই অঞ্চলের জনসাধারণের আয় থেকে এবং বৈদেশিক সাহায্য থেকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে পশ্চিমপাকিস্তানের উন্নয়নমূলক কাজে। এই অর্থ থেকে পূর্ব বঙ্গের ভাগ্যে সামান্য অংশও জোটেনি। পাকিস্তান গঠনের পরে রাষ্ট্রের সমস্ত সামরিক সংগঠন স্থাপিত হয়েছে পশ্চিমাঞ্চলে। মিলিটারি কলেজ, প্রি-ক্যাডেট স্কুল এবং অর্ডিনান্স ফ্যাক্টরির সবই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পশ্চিম-পাকিস্তানে ও করাচীতে । এরূপ কাজে অথবা এরূপ সংগঠন তৈরির ব্যাপারে পূর্ব বঙ্গ কোনাে অংশই পায়নি । প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার ৬০-৭০ কোটি টাকা পূর্ব বঙ্গ থেকে সংগ্রহ করে কিন্তু তার প্রায় সবই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। এরূপ এবং অন্যান্য শােষণের ফলে পূর্ব বঙ্গের সর্বশ্রেণীর জনজীবন আজ এক শােচনীয় দারিদ্র্যের সম্মুখীন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান ভূখণ্ড দুইটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ভূখণ্ড হওয়ায় এবং একটি অর্থনৈতিক সংগঠন বা অঞ্চল না হওয়ায় পূর্ব-বঙ্গের পুঁজি পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়ে এই পূর্ব ভূখণ্ডের অর্থনীতিকে আজ এক চরম দুর্বিপাকের দিকে ঠেলে দিয়েছে।” | “পাকিস্তানের দুই ভূখণ্ডের মধ্যে ব্যবসা, বাণিজ্য ও আমদানির ক্ষেত্রে এমন পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে যে, তার ফলে পূর্ব বঙ্গের জনজীবন গুরুতরভাবে বিপন্ন হচ্ছে। পূর্ব বাংলা বহুবার এই অভিযােগ করেছে যে ব্যবসা-বাণিজ্যের লাইসেন্স এবং বৈদেশিক আমদানির সুযােগ পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের এমন পক্ষপাতিত্বের সঙ্গে দেয়া হচ্ছে যে তার ফলে আমদানির প্রায় অধিকাংশই যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে । এরূপ পক্ষপাতিত্বের জন্য পূর্ব বঙ্গের বাজারে জিনিসপত্র শুধু দুষ্প্রাপ্য নয়, অগ্নিমূল্যও বটে। বর্তমানে পূর্ব বঙ্গকে সমস্ত বৈদেশিক জিনিসপত্র আমদানি করতে হয় করাচী থেকে এবং তার ফলে প্রত্যেক জিনিসের জন্য পূর্ববঙ্গকে পঞ্চাশ শতাংশ বেশি দাম দিতে হয়। এভাবেও পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গের পুঁজি নিয়মিতভাবে শােষণ করে নিচ্ছে।”

“কেন্দ্রীয় সরকাররের কাজকর্মে কিভাবে পূর্ব বঙ্গকে বঞ্চিত করা হচ্ছে এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কুক্ষিগত কেন্দ্রীয় সরকারে নিযুক্ত কর্মচারীদের আঞ্চলিক পদ বণ্টনের তথ্যে তা অতি সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। | কেন্দ্রীয় সরকারের সিনিয়র গেজেটেড পােস্ট, কেন্দ্রীয় সেক্রেটারিয়েট-পশ্চিম পাকিস্তান ৬৯২, পূর্ববঙ্গ; ৪২, শিল্প উন্নয়ন করপােরেশন- পশ্চিম পাকিস্তান ১৩২, পূর্ববঙ্গ; ৩, রেডিও-পশ্চিম পাকিস্তান; ৯৮, পূর্ববঙ্গ ১৪; সাপ্লাই ও ডেভেলপমেন্ট পশ্চিম পাকিস্তান ১৬৪, পূর্ববঙ্গ ১৫; রেলওয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ১৫৮; পূর্ববঙ্গ ১৪; পােস্ট ও টেলিগ্রাফ-পশ্চিম পাকিস্তান ২৭৯, পূর্ববঙ্গ ৫০; কৃষি-অর্থনীতি করপােরেশন- পশ্চিম পাকিস্তান ৩৮, পূর্ববঙ্গ ১০; সার্ভে- পশ্চিম পাকিস্তান ৬৪; পূর্ববঙ্গ ২; বিমানবাহিনী পশ্চিম পাকিস্তান ১০২৫, পূর্ববঙ্গ ৭৫; শিক্ষা ক্ষেত্রে এবং মেডিক্যাল সংগঠনেও পূর্ববঙ্গের অবস্থা একই রকম শােচনীয়। যথা: নতুন কলেজপশ্চিম পাকিস্তান ১, পূর্ববঙ্গ ৩; মেডিক্যাল কলেজ- পশ্চিম পাকিস্তান ৬, পূর্ববঙ্গ ১; ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ-পশ্চিম পাকিস্তান ৩, পূর্ববঙ্গ ১; ইউনিভার্সিটি-পশ্চিম পাকিস্তান ৪, পূর্ববঙ্গ ২; কলেজ- পশ্চিম পাকিস্তান ৭৬, পূর্ববঙ্গ ৫৬; প্রাইমারী স্কুল-পশ্চিম পাকিস্তান ৬,২৪৬, পূর্ববঙ্গ ২২১৭; হাসপাতালের বেড সংখ্যা-পশ্চিম পাকিস্তান ১৭৬১৪, পূর্ববঙ্গ ৫৫৮৯; ডাক্তার-পশ্চিম পাকিস্তান ৮৫০০, পূর্ববঙ্গ ৩৩৯৩; মেটারনিটি হাসপাতাল- পশ্চিম পাকিস্তান ১১৮, পূর্ববঙ্গে ২২; কীভাবে পশ্চিম পাকিস্তান- পূর্ব বাংলাকে শােষণ করে একটি কলােনিতে পরিণত করেছে এই পুস্তিকায় সংক্ষিপ্তভাবে তার একটি নির্মম চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।” গণপরিষদে স্বাধীন বাংলা শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষোভের সঙ্গে বলতেন, পশ্চিম পাকিস্তান যে শুধু পূর্বপাকিস্তানের সম্পর্কে নগ্ন, নির্লজ্জ বৈষম্য নীতি অনুসরণ করে যাচ্ছে তাই নয়, তারা তাদের একই দেশের মানুষ শুধু মানুষ নয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিদের মানসিকতা, চিন্তাধারা, ভাষা, সংস্কৃতি, জীবনধারা বােঝার বিন্দুমাত্রা চেষ্টাও কখনও করে না। বাঙালিদের সম্পর্কে পাকিস্তানিদের বিচিত্র বিকৃত সব ধারণা। তারা মনে করত, যে মুসলমান সে আবার বাংলা ভাষা নিয়ে এত মাতামাতি করে কী করে! বাংলা ভাষা ও হরফ দুই-ই তাে সংস্কৃত ঘেঁষা। কাজেই সে তাে হিন্দু পণ্ডিতদের ভাষা! পশ্চিম পাকিস্তানিরা তাজ্জব বােধ করত যে রবীন্দ্রনাথের মতাে একজন অমুসলিম ভারতীয় কবিকে নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানি বাঙালি মুসলমানদের এত উচ্ছ্বাস কী করে সম্ভব! পশ্চিম পাকিস্তানে লাহাের, রাওয়ালপিন্ডি, করাচীতে অফিসার, ছাত্র এমন কি শিক্ষক, অধ্যাপক ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে প্রতিযােগিতা চলত-কে কত দামি আর হালফ্যাশনের স্যুট-বুট পরে ঘােরাফেরা করতে পারেন ।

ওদের মতে এটা হচ্ছে “ইজ্জতের সাওয়াল”। কাজেই ওরা যখন দেখতেন যে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন ধর্মের সামাজিক স্তরের বহু বাঙালি অতি সাধারণ পােশাক-পরিচ্ছদ পরেই দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে কোনাে সংকোচ বােধ করেন না, তখন ওরা বলতেন: “পূর্ব পাকিস্তানিরা ভীষণ পশ্চাৎপদ” । নিচু জাতের। পূর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বাঙালিদের সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অদ্ভুত মনােভাবের এবং ততােধিক অদ্ভুত নানা ধরনের কয়েকটি নজির তার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তুলে ধরেছেন। পাকিস্তানের প্রথম উজিরে আজম নবাবজাদা লিয়াকত আলি খান একবার ঢাকা সফরে এসে আতাউর রহমান খানকে ডেকে পাঠিয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে বলেন: কী চেঁচামেচিই না করেছেন আপনারা এই বাংলা ভাষা নিয়ে। এতে আপনাদের গৌরবের কি আছে? বাংলা ভাষা হিন্দু সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। অথচ এই ভাষা নিয়েই মারামারি করে আপনারা পাকিস্তানের মূল আদর্শটাই ধ্বংস দিচ্ছেন। আতাউর সাহেব যখন প্রধানমন্ত্রীর কথার প্রতিবাদ জানালেন, তখন প্রধানমন্ত্রী আরও রেগে গিয়ে বলে উঠলেন: “বুঝেছি আপনাদের মতলব, আপনারা স্বাধীন বাংলা করতে চান। আপনারা চান আলাদা হয়ে যেতে। | শেখ মুজিবুর রহমান ১৭ জানুয়ারি ১৯৫৬ গণপরিষদে অভিযােগ জানিয়েছিলেন যে পরিষদের কার্যবিবরণী সবই ইংরেজি ও উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয় । কিন্তু দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ভাষা বাংলার কোনাে স্থানই সেখানে নেই । ঢাকা বিমানবন্দরে যাবতীয় ঘােষণা করা হচ্ছিল শুধু ইংরেজি ও উর্দুতে।

আর পাকিস্তানি পাসপাের্টগুলােতে ইংরাজি, উর্দু ছাড়া ফরাসি ভাষাও ব্যবহার করা হচ্ছিল। সেখানে ছিল না শুধু বাংলার কোনাে চিহ্ন। শেখ মুজিবুর রহমান বার বার বলতে থাকেন যে জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দাবিয়ে রেখে পূর্ব-পাকিস্তানে প্রেসিডেন্ট শাসন চালিয়ে যাওয়া পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের চিরন্তন বৈষম্যেরই পরিচয় । অতএব অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে রাষ্ট্রপতি শাসন তুলে নিয়ে আওয়ামী লীগকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে ডাকা হােক।  শেখ মুজিব পশ্চিম পাকিস্তানের অচল, অনড়, ঘাের পক্ষপাতদৃষ্ট ও সহানুভূতিহীন রাষ্ট্র পরিচালকদের হুঁশিয়ারি জানিয়ে বললেন, “ভৌগােলিক দিক দিয়ে আমাদের দেশের একটি অংশ অপরটি থেকে বহু দূরে-হাজার মাইলের বেশি দূরে অবস্থিত। বাইরে গেলে দুটি পৃথক দেশেরই চেহারা এদের। কিন্তু তবুও পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি ন্যায়সঙ্গত ব্যবহার না করেন, তাদের অভাব অভিযােগের কোনাে প্রতিকার না করেন। তবে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের জাগ্রত সচেতন যুবশক্তি হতাশার চরম সীমায় উপনীত হয়ে দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে গেরিলাযুদ্ধ। পরিচালনা করবে। তখন প্রধান রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আওয়ামী লীগেরও কিছু করার থাকবে না। এখনও সময় আছে, আপনারা দেয়ালের লিখন পড়ার চেষ্টা অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রেসিডেন্ট রুল প্রত্যাহার করার দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশজুড়ে যে গণআন্দোলনের সূচনা করেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা তা উপেক্ষা করতে পারলেন না। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী ফিরােজ খান নূনের প্রধানমন্ত্রিত্ব নির্ভরশীল ছিল আওয়ামী লীগ সদস্যদের সমর্থনের উপর।

তিনি জানতেন যে চরম পন্থা হিসেবে শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ যদি কেন্দ্রে তার মন্ত্রিসভা থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয় তবে তার প্রাইম মিনিস্টারশিপ থাকবে না। কিন্তু সােহরাওয়ার্দীবিরােধী কুচক্রী প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা যথারীতি প্রথমে কৃষকশ্রমিক দলের একজন পান্ডা ফরিদপুরের ইউসুফ আলি চৌধুরীর (মােহন মিয়া) মাধ্যমে চেষ্টা চালালেন যে পূর্ব-পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বা তাদের থেকে কিছু লােককে ভাগিয়ে নিয়ে অন্য রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে একটি নতুন রাজনৈতিক জোট গঠন করে কোনাে মন্ত্রিসভা বসানাে যায় কি না। কিন্তু মির্জা সাহেবের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলাে-মােহন মিয়া তাকে রিপাের্ট দিলেন, “বড় পেরেশানী হলাম কিন্তু কাজ হাসিল করতে পারলাম না। এই সময় আওয়ামী লীগ আশান্বিত ছিলেন যে প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরােজ খান নুন নিজের স্বার্থেই তাদেরই আবার পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেবেন। কিন্তু কৃষক-শ্রমিক পার্টির নেতারা আশা করছিলেন যে তাদের মুরুব্বী প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা নতুন কোন প্যাচ কষে তাদেরই একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। প্রধানমন্ত্রী নূন সাহেব অবশ্য দেখাতে চাইলেন যে তিনি এ ব্যাপারে সম্পূর্ণই নিরপেক্ষ এবং তাই তিনি পূর্বপাকিস্তানের গভর্নর সুলতান উদ্দিন আহমদকে নির্দেশ দিলেন যে তিনি যেন প্রতিটি রাজনৈতিক দল ও গােষ্ঠীর সদস্যদের রাজভবনে ডেকে পাঠিয়ে কাদের প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে তা যাচাই করে দেখেন। এই “রাজনৈতিক যাচাই” অনুষ্ঠানের পর গভর্নর সুলতান উদ্দিন আহমদ রিপাের্ট দিলেন যে তাঁর মতে আওয়ামী লীগই পূর্ব-পাকিস্তানে একটি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে সক্ষম। ফলে ২৪ আগস্ট ১৯৫৭ সালে জনাব আতাউর রহমান খান আবার পূর্ব-পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। তিনি গঠন করলেন দেশ বিভাগের পরে এগার বছরের মধ্যে পূর্বপাকিস্তানের নবম মন্ত্রিসভা।” পক্ষপাতদৃষ্ট কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য অনেক কম টাকা বরাদ্দ করলেও একটা বড় অংশ প্রাদেশিক সরকার খরচ করতে পারে না।

এই অজুহাতে কেন্দ্রে তা ফিরে যেত। কেন এরকম হতাে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন যে, করাচীর ও ঢাকার অর্থ দফতরের অফিসাররা প্রায় সবাই অবাঙালি এবং তারা পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়ন সংক্রান্ত যে কোনাে আর্থিক প্রস্তাব নিয়ে ইচ্ছে করেই এত গড়িমসি করেন। এত কালহরণ করেন যে তারা এবিষয়ে পাকাপাকি কিছু করে উঠবার আগেই আর্থিক বছর হয়ে যায় এবং অব্যয়িত টাকা কেন্দ্রে ফেরত চলে যায়। আবার বহু উন্নয়ন প্রস্তাব করাচী শেষ মুহূর্তে নানা ফ্যাকরা তুলে, নানা অজুহাতে নাকচ করে দেয়। শেখ মুজিব জাতীয় পরিষদে এ বিষয়ে একটি স্মরণীয় বিবৃতিতে বললেন: “মাননীয় সদস্যগণ, আপনারা কি কখনও ভেবে দেখেছেন যে, কেন কেন্দ্রের আর্থিক বরাদ্দ পূর্ব পাকিস্তান সরকার সবটা খরচ করে উঠতে পারেন না। প্রাদেশিক সরকারকে সামান্য কিছু কিনতে হলেও পদে পদে করাচীতে সিভিল সাপলাইয়ের ডিরেক্টর জেনারেলের কাছে আসতে হয়, আর এই আসা-যাওয়া করতে করতে বরাদ্দ টাকাও ফিরে আসে করাচীতে, কিন্তু মজার ব্যাপার এই যে দোষটা পুরােপুরিই চাপান হয় পূর্ব-বাঙলার মন্ত্রীদের উপরে। আপনারা কি জানেন যে পূর্ব পাকিস্তানে সামান্য একটি পরিকল্পনা চালু করতে হলেও আমাদের কতকগুলাে বন্ধ দরজার মাথা খুঁড়তে হয়। যে কোনাে শিল্পের স্কিমের কথা-তা বড়ই হােক বা ছােটই হােক-ধরুন প্রথমে এটি যায় কেন্দ্রীয় অর্থ দফতরে, তারপর করাচীর ফিন্যান্স মিনিস্ট্রিতে, সেখান থেকে পরিকল্পনা বাের্ডে এর পরেও এক দফতরে এবং এত ঘােরাঘুরির পরেও বেশিরভাগ সময়ই স্কিমটি অনুমােদিত হয় না, বাতিল হয়ে যায় ।

কিন্তু যদি বা বাঙালিদের ভাগ্যক্রমে কোনাে পরিকল্পনা। অনুমােদিত হয়ও তবুও যতদিন করাচীর বড় কর্তারা তাদের সিদ্ধান্ত জানাবার সময় পান, ততদিনে আর্থিক বছর শেষ, ফলে কেন্দ্রের টাকাও কেন্দ্রে ফেরত।” পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৮ পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের জন্য কোনাে বৃহৎ শিল্পের পরিকল্পনা করেননি বললেই চলে। শহীদ সােহরাওয়ার্দী যখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী তখন তিনি দেশের পূর্বাঞ্চলে আটান্নটি নতুন শিল্প স্থাপনের জন্য বৈদেশিক অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করেছিলেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীরা ও সংবাদপত্রগুলাে এই ব্যাপারে সােহরাওয়ার্দী সাহেবকে তীব্র সমালােচনা করতে লাগলেন এবং সােহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পতনের পর পূর্ব। পাকিস্তানের শিল্পোন্নয়নের এই পরিকল্পনাটির ভাগ্যে কি হলাে তা বােধহয় আর না বললেও চলবে। পুরাে ব্যাপারটাই ধামাচাপা পড়ে গেল। বড় বড় পরিকল্পনার কথা ছেড়েই দেয়া যাক, পূর্ববঙ্গের জন্য ছােট ছােট প্রজেক্টও কেন্দ্রীয় সরকার নানা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে নাকচ করে দিত। এমন কি মালিক ফিরােজ খান নূনও জাতীয় পরিষদে একবার বলে ফেলেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সরকার জলের পাম্পের কিছু প্রয়ােজনীয় অংশ (প্রতিটির দাম তিন থেকে চার টাকার বেশি নয়) কিনতে পারেননি। কারণ? করাচীর সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট থেকে ঢাকা এ ব্যাপারে অনুমতি পায়নি।

পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক সরকার যে কোনাে উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পদে পদে আটকে যাচ্ছিলেন, কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের স্টোরস ও সাপ্লাই ডিপার্টমেন্টের মাধ্যম ছাড়া কোনাে যন্ত্রপাতি কেনার অধিকার তাদের ছিল  দেশের মঙ্গল চিন্তায় অধীর হয়ে জঙ্গী নায়ক জেনারেল মােহাম্মদ আইয়ুব খানও ২৮ আগস্ট ১৯৫৮ সালে তার দিনপঞ্জীতে লিখলেন: “রাজনীতিবিদদের হস্তক্ষেপের দরুন যে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছিল এবং যার ফলে জনসাধারণের হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং তারা প্রেসিডেন্টসহ রাজনীতিবিদদের উপর যে আস্থা হারিয়ে ফেলেছিল এ সম্বন্ধে হতাশাব্যঞ্জক সব সংবাদ আমি পাচ্ছিলাম। সাধারণ বিশ্বাসে এই দেখা যাচ্ছিল যে কঠোর ব্যবস্থা দ্বারা এসব অনিষ্টকর বস্তুকে নিমূল করার জন্য যে সাধুতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং দেশহিতৈষণা দরকার, তা এসব। লােকদের মধ্যে নেই। সাধারণ লােকদের মধ্যে এমনও বিশ্বাস জন্মাচ্ছে যে, সেনাবাহিনী এবং সেই সঙ্গে আমিও তাদেরকে এই অত্যাচারীদের হাত থেকে রক্ষা। করার জন্য যা করার তা করছিনে”।

সংখ্যাসাম্য ও এক ইউনিট শাসন এবং শােষণের নব কৌশল পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে গৃহবিবাদের সুযােগ নিয়ে ১৯৫৩ সালের অক্টোবর মাসে কুচক্রী গভর্নর জেনারেল গােলাম মহম্মদ দেশের গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। ১৯৫৫ সালের ১৫ এপ্রিল গােলাম মহম্মদ পাকিস্তানের উভয় খণ্ড থেকে ৪০ জন করে প্রতিনিধি নিয়ে দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠন করলেন। পূর্ববাংলা পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জনের বাসভূমি হওয়া সত্ত্বেও এই নতুন গণপরিষদের তার ভাগ্যে জুটল পশ্চিম পাকিস্তানের সমান সংখ্যক আসন। “প্যারিটি” বা সমতা প্রথার সূত্রপাত হলাে। পাকিস্তানের পশ্চিমা বিশেষ করে পাঞ্জাবি শাসকগােষ্ঠী ও আমলাতন্ত্রের একচ্ছত্র প্রভুত্ব কায়েম হওয়ার পথ নিষ্কণ্টক হয়ে গেল। শহীদ সােহরাওয়ার্দী “প্যারিটি” বা “সমতা” পরিকল্পনা মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু শেখ মুজিবকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে তাকে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল, যদিও তিনি ছিলেন মুজিবের রাজনৈতিক নেতা। শেখ মুজিবুর স্পষ্টই সােহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন: “আমরা কিছুতেই এই প্যারিটি ব্যবস্থা মেনে নিতে পারি না, কারণ এর একমাত্র উদ্দেশ্য সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পাকিস্তানিদের কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্ব অর্জন করতে দেয়া। কিন্তু সােহরাওয়ার্দী সাহেব শেখ মুজিবকে বােঝালেন যে প্যারিটি প্রস্তাব পূর্ব পাকিস্তান মেনে না নিলে রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলতেই থাকবে এবং সংবিধান রচনার কাজ বন্ধ হয়ে যাবে। সােহরাওয়ার্দী আরও যুক্তি দিলেন যে কৌশল হিসেবে সাময়িকভাবে হলেও “প্যারিটিকে মেনে নিলে কেন্দ্রীয় সামরিক ও বেসামরিক বিভাগের চাকরিতে এবং শিল্প ও অর্থ বাণিজ্য ইত্যাদি কেন্দ্রীয় বিষয়েও পূর্ব পাকিস্তান সমান অংশীদার হওয়ার দাবি জানাতে পারবে।

সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও প্রশাসন ও অন্যান্য ক্ষেত্রে পূর্ববঙ্গের ভাগ্যে এতদিন শুধু সামান্য অংশই জুটেছিল। তার নেতা সােহরাওয়ার্দীর চাপে শেখ মুজিব অত্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্যারিটি প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু শাসনতন্ত্র পাসের সময় শেখ মুজিব স্বাক্ষর করেননি এবং শেষ পর্যন্ত ওয়াকআউট করেন। পূর্ব পাকিস্তানকে কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে করাচীর আমলাতন্ত্র আরেকটি চক্রান্ত করলেন-এক ইউনিট প্রথার প্রবর্তন। পাঞ্জাবি স্বার্থক্রের বিরুদ্ধে যে শুধু পূর্ব পাকিস্তানই রুখে দাঁড়ানাের চেষ্টা করেছিল তাই নয়, পশ্চিমাঞ্চলেও পাঞ্জাবি আধিপত্যের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠেছিল। সিন্ধি, বেলুচি, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত-প্রদেশী পশ্চিম-পাকিস্তানের অপাঞ্জাবি সব রাজ্যের মানুষই পণ করলেন যে পাঞ্জাবিদের নিরঙ্কুশ আধিপত্য ও অবাধ শােষণ তারা প্রতিহত করবেন। কিন্তু পাঞ্জাবি গভর্নর জেনারেল গােলাম মােহম্মদ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ এই আন্দোলনের নাম দিলেন প্রাদেশিকতা। বললেন- “এ হলাে ইসলামবিরােধী সঙ্কীর্ণতা। পাকিস্তানকে যদি ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হয় তবে এ ধরনের স্বাতন্ত্রের বুলি ছাড়তে হবে অর্থাৎ সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাবের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিলুপ্ত করে পশ্চিম পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের পশ্চিম ভূখণ্ডে এক ইউনিট শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে। তিনি করলেনও তাই। লাহাের হৃলাে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজধানী। ১৯৫৫ সালের ১৪ অক্টোবর সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর সীমান্ত প্রদেশ ও পাঞ্জাব এক ইউনিটের অর্থাৎ পাঞ্জাবি চক্রের কবজায় এলাে। পাঞ্জাবি ভূস্বামী গােষ্ঠীর অন্যতম নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা খােলাখুলিভাবেই বললেন যে “এক ইউনিট হয়ে শুধু যে পাঞ্জাবিদেরই কপাল খুলে গেল তাই নয়, এখন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে আরও ভালােভাবে আরও শক্ত হাতে কেন্দ্রের হালটা ধরতে পারবে।” 

শেখ মুজিবুর রহমানও এক ইউনিট প্রথার প্রবল বিরােধী ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে প্যারিটির মতাে পূর্ব বাংলার বিরুদ্ধে এ আরেকটি ষড়যন্ত্র। ৩০ সেপ্টেম্বর, করাচী, গণপরিষদে শেখ মুজিব বলেন, “রাষ্ট্রযন্ত্র, অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, বা চাকরি দেশরক্ষায় সর্বক্ষেত্রে প্যারটি চাই। প্যারটি বলতে আমরা সর্বক্ষেত্রে সমতা চাই।” তারপরেও শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে সংখ্যাসাম্য এবং এক ইউনিটের বিরােধিতা করে বিভিন্ন জনসভায় ভাষণ দেন। তিনি বলেন, যদি তারা সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয়ভাবে সংখ্যাসাম্য না মানে তাহলে এটাকে আমরা ছুড়ে ফেলে দেব। তিনি বলেন, জনসংখ্যার ভিত্তিতেই পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারিত হবে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ