You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ৪ঠা জানুয়ারী, শুক্রবার, ১৯৭৪, ১৯ই পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

চুয়াত্তরের ঈদ-উল-আযহা

আদিগন্ত আশা ও সম্ভাবনার আলোক ছড়িয়ে স্বাধীনতার রক্ত-সূর্য ওঠার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার জীর্ণ পর্ণকুটিরে প্রাণ চঞ্চল মানুষ এবার নিয়ে মোট তিনবার তাদের প্রাণপ্রিয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ঈদ-উল-আযহা পালন করতে যাচ্ছে। তাই সমগ্র মুসলিম বিশ্বসহ বাংলার মানুষও কতো না প্রাণ-চঞ্চল, কতো না ব্যস্ত মুখর।
এ ঈদের অপর নাম কোরবাণী ঈদ। কারণ, ঈদে মানুষ সমস্ত বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা মহান রাব্বুল আল আমীনের নির্দেশে সত্য ও ন্যায়ের পথে যে কোনো কোরবাণীও যে কতো অম্লান তারই এক পবিত্র প্রতীক হিসেবে পশু কোরবাণীর মাধ্যমে এক অমোঘ ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান করে থাকে। এবং হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর পুত্র কোরবাণীর বদলে দুম্বা কোরবাণীর এক মহান অনুষ্ঠান কাল থেকেই এই মহান রেওয়াজ মুসলিম জগতে চিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুতরাং, একে শুধুমাত্র এক নিছক নিষ্ঠুর পশু হত্যার অনুষ্ঠান ভাবলে কোরবাণীর আসল মর্মার্থই ঢাকা পড়ে যাবে।
এ কোরবাণী এক বার্ষিক অনুষ্ঠান। প্রতি বছরই এ ঈদ মানুষের, বিশেষ করে মুসলিম জগতের মানুষের কাছে এক স্বর্গীয়, নির্দেশ ও বার্তা বহন করে এসে ভ্রামন্ধ মানুষকে কর্তব্য-সজাগ করে তোলে। এ আগেও এসেছে, আজও এলো, ভবিষ্যতেও আসবে।
মহান আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশ : মানুষের মতোই সমস্যা ও বাঁধা কিম্বা দুঃখ থাকুক না কেন, এ ঈদ এলে কোরবাণী দিতেই হয় (অবশ্য সাধ্যমতো এ সক্ষমের জন্য ধর্মীয় নির্দেশ মোতাবেক) এবং শত দুঃখেও হাসতে হয়, আনন্দ করতে হয়, মহান আল্লাহ তা’য়ালার কাছে প্রার্থনা করতে হয়। গরীব দুঃখীকে সাহায্য করতে হয় ইত্যাদি।
মুসলিম বিশ্বের অপরাপর অঞ্চলের অবস্থা যাইহোক না কেন, সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে পবিত্র ঈদ-উল-আযহার এ সমাগমনী নুপুর-নিক্কন নিঃসন্দেহেই এক মিশ্র প্রতিক্রিয়া নিয়ে এসেছে।
একদিকে এ পবিত্র দিন উদযাপনের কঠিন ধর্মীয় নির্দেশ ও মানুষের বিপুল প্রাণ-আগ্রহ, অন্যদিকে সর্বহারা হবার এক সাগার বেদনাশ্রু ও অগ্নিমূল্যের প্রাণান্ত বাজারে সর্ব সমস্যার এক আসমুদ্র হিমাচল কন্টকময় পথ। সব মিলিয়ে এ অবাক নির্বাক কিংকর্তব্যবিমূঢ়াবস্থা।
কিন্তু প্রশ্ন, মানুষ ঈদ যে করবে, কিভাবে করবে? অতি-উষ্ণ বাজারের কোথায় মানুষ তার চামড়ার হাত রাখতে পারে? স্নেহবিগলিত পিতা এ অমোঘ দিনে তার প্রাণপ্রিয় শিশুদের নতুন জামা জুতো বা অন্য কোনো সৌখিন উপহার দিয়ে যে চিরন্তন পিতৃ-আনন্দ চরিতার্থ করবে তার সামর্থ্য কোথায়? যারা মধ্যবিত্তপন্ন তারা যে কোনো পশু কোরবাণী দিয়ে এ পবিত্র দিন উদযাপন করে স্বর্গীয় নির্দেশ প্রতিপালন করবে তারই বা সুযোগ কোথায়?
গতকাল কাগজে ছিল একটা ষাঁড়ের দাম দশ হাজার টাকা হাঁকা হয়েছে এবং ক্রেতা দর বলেছেন সাত হাজার পর্যন্ত। আবার, একটা খাসির দাম আড়াই হাজার পর্যন্ত দর হাঁকা হয়েছে, কিন্তু ক্রেতা বলেছেন বাইশ শ’ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু উভয় বিক্রেতাই অটল, ইস্পাত-কঠিন।
বাজারেও একই বিষাদ চিত্র। অসাধু ব্যবসায়ী, অতি মুনাফাখোর, চোরাচালানী, মওজুতদার আর ঘুষঘোরের সমবায় অত্যাচারে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত।
অবশ্য, কিছু সংখ্যক কালো অর্থ অধিকারী নিশ্চিন্তেই মহা জৌলুসে এ স্বর্গীয় নির্দেশ প্রতিপালনের সুযোগ পাবে, তা’ আমরা সবাই দেখতে পাচ্ছি। মরণ শুধু মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবী আর সৎ উপায়ে অর্থোপার্জনকারী ব্যক্তিদের। এক্ষেত্রে গরীবের তো কোনো প্রশ্নই আসেনা।
তাই এবারের পবিত্র ঈদ-উল-আযহাকে হৃদয় স্বাগতম জানাতে গিয়ে আমাদের বার বারই কবির সে বিখ্যাত পংক্তিটি মনে পড়ে যাচ্ছে :
‘জীবনে যাদের হয়, রোজ রোজা
ক্ষুধায় আসেনি নিঁদ
মুর্মূর্ষু সেই কৃষকের ঘরে
এসেছে কি আজ ঈদ?’

বাস্তবতার নিরিখে

নিউজিল্যান্ডের মহামান্য প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান ইরিক কার্ক চারদিনব্যাপী রাষ্ট্রীয় সফরে গত মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন। এদিন রাতে তাঁর সম্মানার্থে আয়োজিত এক নৈশ ভোজসভার ভাষণদানকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ পরিহার করতে হলে এসব এলাকার জনগণের আরো অর্থবহ, সুন্দর ও সুখী জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা পরিপূরণের দিকে নজর দিতে হবে। তিনি বলেছেন, কম উন্নত দেশগুলোর জন্যে উন্নতি ও সমৃদ্ধশালী দেশসমূহের বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ যেমন নগণ্য, তেমনি সরবরাহের ক্ষেত্রেও বিরাজ করছে এক অনিশ্চিত অবস্থা। বঙ্গবন্ধু উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, জাতিসংঘ ন্যূনতম সম্পদ সরবরাহের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দিয়েছিল আজো তা অর্জিত হয়নি, হতে পারেনি।
বস্তুতঃ উপরোক্ত বক্তব্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি অত্যন্ত বাস্তবতাপূর্ণ সত্যকে তুলে ধরেছেন। তাঁর এই বক্তব্য গত অক্টোবর মাসে আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে তিনি যে বক্তব্য রেখেছিলেন তারই পরিপূরক। সেই বক্তব্যে তিনি বলেছেন, বর্তমান বিশ্ব দু’টি প্রধান ভাগে বিভক্ত। একটি ধনীর অন্যটি দরিদ্রের। ধনী দেশগুলোর ধনের পাহাড় দিন দিন বাড়ছে। আর গরীব দেশগুলো অর্থনৈতিক যাঁতাকলে দিন দিন নিপিষ্ট হতে হতে তাদের গরীবির মাত্রা আরো বাড়িয়ে তুলছে। এ অবস্থার অবসান হওয়া উচিত। গতকালকের বক্তব্যেও তিনি একই সুরের অনুরণন তুলেছেন। ধনাঢ্য দেশগুলো প্রাচুর্যের সমারোহে দিন দিন কেবল গা ভাসিয়ে চলবে এবং বর্ণাঢ্য জীবন অহরহ তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকবে। অন্যদিকে উন্নয়নশীল তথা গরীব দেশগুলো ক্রমাগত ক্ষুধা, অশিক্ষা, রোগ, দারিদ্র কবলিত হয়ে ধুঁকবে এমনটি কখনও কাম্য হতে পারে না—চলতে দেওয়া যেতে পারে না। যদি এ অবস্থাকে সহজেই মেনে নেওয়া হয় বা এ অবস্থা সব সময়ই চলতে দেওয়া হয় তবে গরীব দেশগুলো নির্মমতার প্রতিবাদে একদিন বেপরোয়া হয়ে উঠতে বাধ্য হবে এবং সেই বেপরোয়াই জন্ম দেবে সংঘর্ষের। সেই সংঘর্ষ চিরন্তন ধনীর ও নির্ধনের মধ্যকার সংঘর্ষ। আর সেই সংঘর্ষের জন্যে সকল দায়িত্ব বর্তাবে ধনী দেশগুলোর উপর। কেননা, জাতিসংঘ নির্ধারিত ন্যূনতম লক্ষ্যমাত্রা মোতাবেক বৈদেশিক সাহায্যদান ও সম্পদ সরবরাহও ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যে করেননি।
অন্যদিকে উন্নত তথা ধনী দেশগুলোর পক্ষ থেকে উন্নয়নশীল তথা গরীব দেশগুলোর জন্যে প্রদত্ত সাহায্যের ক্ষেত্রে সব সময়ই উন্নত দেশগুলো কিছু না কিছু অলিখিত নিয়ম চালু করে থাকে বা শর্ত আরোপ করে থাকে। এই নিয়ম বা শর্ত অনেক ক্ষেত্রেই সাহায্যকারী উন্নয়নশীল গরীব দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ হস্তক্ষেপের সামিল হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই পক্ষেই এই হস্তক্ষেপের প্রতিবাদ সম্ভব হয়ে উঠেনা নিজের দেশের বুভুক্ষু রোগজর্জরিত ও অশিক্ষিত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে। দুঃসাহস করে যারা এর প্রতিবাদ করেন তাদেরও অনেক সময় ধনী দেশগুলোর প্রভাব বিস্তারকারী নেতৃত্ব ছলে-বলে-কৌশলে নিষ্পেষণের যাঁতাকলে আটকাতে তৎপর হয়। এর প্রমাণ আরবদের তেল নিয়ে পশ্চিমা ধনীক গোষ্ঠীর ছিনিমিনি খেলা এবং আরব দেশগুলোর পাল্টা প্রতিশোধের ব্যবস্থা। এতে করে আজ সবচাইতে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলো।
এই একই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে তাঁর পূর্ব প্রদত্ত ওয়াদার উল্লেখ করে এই কাজকে বাস্তবায়নের জন্যে মুক্তিযুদ্ধের ফলশ্রুতি হিসেবে বেরিয়ে আসা বিপুল তরুণ সৃজনী শক্তিকে কাজে লাগানোর কথা বলেছেন। আমরা তাঁর এই উক্তিকে অভিনন্দন জানাই।
অন্যদিকে ঐ একই ভোজ সভায় ভাষণদানকালে নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান ইরিক কার্ক বলেছেন যে, জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের এই ৮ম বৃহৎ রাষ্ট্রকে জাতিসংঘের সদস্য পদ না দেওয়া হলে জাতিসংঘই অপূর্ণ থেকে যাবে বলে তিনি মনে করেন। মিঃ কার্ক দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, তাঁর দেশ এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে। মিঃ কার্কের এই বক্তব্য বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় ভিত্তির উপর নির্ভর করে এগিয়ে যাবার ইঙ্গিতবাহী। বস্তুতঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা থেকেই নিউজিল্যান্ডের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছেন। মিঃ কার্ক তখন ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা। বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবেও তিনি তখন বাংলাদেশকে তাঁর দেশের সাহায্য দানের ব্যাপারে সরকারের সাথে সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে তিনি এদেশ সফর করেছিলেন। মত আর হৃদ্যতা বিনিময় করে গিয়েছিলেন এদেশের মানুষের সাথে।
গত বুধবার গণভবনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও সফররত নিউজিল্যান্ড প্রধানমন্ত্রী মিঃ নরম্যান কার্ক আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনায় মিলিত হন। তাঁদের এই আলোচনা ১০ মিনিটকাল স্থায়ী ছিল। আলোচনার পর মিঃ কার্ক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশের কৃষি উন্নয়ন কর্মসূচীর অধীনে চারাগাছ সংরক্ষণের জন্যে সাহায্য হিসেবে দেয়া ১১ খানা হেলিকপ্টার ছাড়াও এদেশের প্রথম যোজনায় তাঁর দেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণে সাহায্য দেবে।
বঙ্গবন্ধুর সাথে হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনার পর উপরোক্ত সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে নিউজিল্যান্ড ‍প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নে উন্নত দেশগুলোর সাহায্য করার যে নৈতিক কর্তব্য রয়েছে সেই কর্তব্য বোধেরই পরিচয় দিয়েছেন। বিশ্বের অপরাপর উন্নত দেশগুলোও যদি অপরাপর উন্নয়নশীল দেশগুলোর উন্নয়নের ক্ষেত্রে এহেন নৈতিক কর্তব্যবোধের পরিচয় দেয়, তবে ধনী আর নির্ধনের মধ্যে বর্তমান যুগ যে অবশ্যম্ভাবী সংঘর্ষের আশংকা দেখা দিয়েছে তা এড়ানো সম্ভব বলে বিশ্বের একটি অন্যতম উন্নয়নশীল দেশের জনগণ হিসেবে আমরা মনে করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!