বাংলার বাণী
ঢাকা : ৩রা জানুয়ারী, বৃহস্পতিবার, ১৯৭৪, ১৮ই পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
নয়া আমদানী নীতি প্রসঙ্গে
গত পরশু মঙ্গলবার সরকার নতুন বছরের চলতি মৌসুমের নয়া আমদানী নীতি ঘোষণা করেছেন। মোট বরাদ্দ টাকা ৩২৩ কোটি ৪৮ লাখ। অর্থাৎ, গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বর মৌসুমের চেয়ে এবারের বরাদ্দ ২০৮ কোট ৪৮ লাখ টাকা বেশী।
দেশ স্বাধীন হবার পর এ নিয়ে বাংলাদেশ সরকার মোট পাঁচটি আমদানী নীতি যে প্রণয়ন করলেন এবং এটি হবে পঞ্চম নীতি।
সরকার বিঘোষিত এ পঞ্চম আমদানী নীতির কিছু বৈশিষ্ট্য, কিছু গুণ এবং কিছু অস্পষ্টতাও আছে। তবে গুণাগুণ যা অভাব-অস্পষ্টতা সম্পর্কে কিছু বলার আগে এ সম্পর্কে সরকারের নিজস্ব প্রত্যাশা ও বিশ্লেষণ সম্পর্কে কিছু বলা যাক :
নীতি ঘোষণা কালে আমাদের বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য মন্ত্রী বেশ উৎসাহের সঙ্গেই বলেছেন, এ আমদানী নীতির মূল লক্ষ্য উৎপাদন বৃদ্ধি। আমরাও সর্বান্তকরণে কামনা করি যেন তার এ প্রত্যাশা সম্পূর্ণ ফলপ্রসূ হবে আমাদের জাতীয় সুখ, সমৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
কৃষি ও শিল্পের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে দেশে আমদানী অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। সেজন্যে, আমদানী ব্যবস্থা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও এক উৎপাদনীমুখী বাণিজ্য আমদানী নীতি প্রণীত হয়েছে বলে মন্ত্রী মহোদয় জানিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে অতি প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের যথেষ্ট আমদানীকারক ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মন্ত্রী বলেছেন, বিগত ১৯৭৩ সালের জুলাই-ডিসেম্বর মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিলো ২১৫ কোটি টাকা। তার মধ্যে ১৫ কোটি টাকা ছিলো আমাদের নিজস্ব নগদ বৈদেশিক মুদ্রা, বাজার বাণিজ্যে ছিল ১৮ কোটি টাকা এবং বৈদেশিক ঋণ/সাহায্যের খাতে ধরা হয়েছিলো ১০২ কোটি টাকা।
তবে, বৈদেশিক সাহায্যের সম্পূর্ণ অংক সময় মতো এসে না পৌঁছুনোতে এবং কয়েকটি আমদানী দ্রব্যের অত্যাধিক মূল্য বৃদ্ধিতে আরো এক কোটি নগদ টাকা সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে খরচ করতে হয়েছে। বিশ্ব বাজারে দ্রব্যের অগ্নিমূল্য হওয়ায় অনেকটা আমদানীও সরকারকে সঙ্কুচিত করতে হয়েছিল।
অবশ্য, সরকার আশা করছেন, এবারের আমদানী লক্ষ্যমাত্রা বর্তমানের তীব্র মূল্য বৃদ্ধি সত্ত্বেও পুরোপুরি বজায় রাখা সম্ভব হবে।
এবারের নীতিতে মোট ৩২৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বরাদ্দে শিল্পখাতে দেয়া হয়েছে মোট ২৪১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, এবং বাণিজ্যিক আমদানীতে দেওয়া হয়েছে ৮১ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
সরকার বলেছেন—মূলতঃ বিভিন্ন বেসরকারী-রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকার পরিচালিত শিল্প সমূহের কাঁচামাল ও যন্ত্রাংশ আমদানীর জন্যেই শিল্প আমদানী করা হবে।
এবার আমাদের বক্তব্যকে পাশাপাশি রেখে কিছু আলোচনা করা যাক।
সরকার বিঘোষিত এ নয়া আমদানী নীতির যে অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, তা’ হচ্ছে খাদ্য ও খাদ্যদ্রব্যকে পরিধি-বহির্ভূত রেখে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে একে ভিন্নভাবে ব্যবস্থা করার সিদ্ধান্ত।
নিঃসন্দেহেই এটি একটি প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। কারণ, বেঁচে থাকার জন্যে প্রাণীজগতের চিরাচরিত নিয়মানুসারে খাদ্য আমাদের একটি একান্ত অপরিহার্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় বস্তু। আবার এক্ষেত্রে অসাধু ও মুনাফাখোরদের চক্রান্তেও কোনো অন্ত নাই। যে জন্য সাধারণ মানুষের জীবন এখন নাভিশ্বাস।
সুতরাং, এমন একটি অপরিহার্য জিনিসকে সরকার নিজস্ব ভিন্ন তত্ত্বাবধানে রেখে ও পরিধি বহির্ভূত করে সত্যিই যথেষ্ট দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন। এর ফলে খাদ্য রাজ্যের অনেক দুর্নীতি, টালবাহানা ও সমস্যাও এড়ানো সম্ভব হবে বলে আশা করা যায়।
কিন্তু আমাদের বক্তব্য শুধু খাদ্য নয়, তেল সহ আমাদের অন্যান্য সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও একটি তালিকা তৈরি করে তা’ ভিন্নভাবে খাদ্যের মতো সরাসরি সরকারী তত্ত্বাবধান ও ব্যবস্থাপনায় রাখতে হবে। তা’ না হলে স্বার্থান্বেষী ও মুনাফাখোরদের অভিশাপ থেকে দেশের জর্জরিত মানুষকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না।
বিভিন্ন শিল্পে প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশের বরাদ্দ কাঁচামালের বরাদ্দের সঙ্গে মিলিয়ে দেখানো হয়েছে। অথচ, টিক যন্ত্রাংশের জন্যে কি বরাদ্দ তা স্পষ্ট উল্লেখিত হয়নি। এটা আলোচন্য নীতির একটি দুর্বলতা বলে অনুমিত হয়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন শিল্পের শতকরা ৮৫ ভাগ রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকার পরিচালিত এবং বাকী ১৫ ভাগ বেসরকারী। গত যুদ্ধেও পাক হার্মাদদের হাতে এসব শিল্প সমূহ বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এটা সর্বজনবিদিত। তাদের অনেকেরই বা প্রায় সবেরই বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নানাভাবে চুরি হয়েছে বা বিকল হয়ে পড়ে আছে। তার উপর যে সামান্য বা অপর্যাপ্ত পরিমাণ খুচরা যন্ত্রাংশ গতবার দেশে আমদানী করা হয়েছিল তারও অনেক বিকল ও বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে। এসব খুচরা যন্ত্রাংশের অভাবে আমরা প্রায় রোজই আমাদের শিল্প উৎপাদন ব্যাহত থাকবার নিত্য নতুন খবর পাই। বিশেষ করে, রাষ্ট্রায়ত্ত বা সরকার পরিচালিত শিল্প সমূহের তুলনামূলকভাবে বেশী কাঁচামালের প্রয়োজন। সুতরাং, এর বরাদ্দ আরো বেশী হওয়া উচিত। কিন্তু ঠিক বরাদ্দ আমাদের জানবার উপায় নেই।
এ প্রসঙ্গে বহু বিতর্কিত টিসিবি সম্পর্কে দু’চার কথা না বললেই নয়। টিসিবি ঠিক কি ধরনের সংস্থা তা’ আজও জনসাধারণের কাছে পরিষ্কার নয়। এবং আলোচ্য নীতিতেও এ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট উল্লেখ হয়নি।
টিসিবি কি সরকারী পণ্যের হ্যান্ডলিং এজেন্ট? না, ইনডেন্টিং এজেন্ট? তা’ পরিষ্কার জানবার উপায় নেই। যদি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি বিদেশ থেকে আমদানী করে তা’ টিসিবি’র মাধ্যমেই আবার অসাধু ও মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বা বেসরকারী খাতে তুলে দেয়া হয়-তবে টিসিবি থাকার প্রয়োজন কী? সরাসরি বেসরকারী পর্যায়ে এসব আমদানীর লাইসেন্স দিলেই তো তাতে বেশী পাওয়া যায়। এতে টিসিবি কর্তাদের দিল বেহলানো খরচ ব্যবসায়ীরা অনায়াসে বাঁচিয়ে তা দ্রব্যমূল্য থেকে বাদ দিয়ে দ্রব্যমূল্য কমাতে পারে। এবং জনসাধারণের কম মূল্যে দ্রব্যাদি পেতে পারে। আবার, সরকারও বিদেশ থেকে মাল আমদানীর নানান ঝামেলা ও অর্থদন্ড থেকে অব্যাহতি পেতে পারে, আর্থিক বৈদেশিক মুদ্রা অপচয় বন্ধ হতে পারে।
সুতরাং, বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা মনে করি যে, টিসিবি’র হাতে মানুষের বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানী সম্পর্কে এতো অবাধ ও ব্যাপক ক্ষমতা দেয়ায় তা’ দেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিরই প্রধান সহায়ক হয়েছে এবং এতে দেশের দ্রুত শিল্পায়ন বা শিল্পোৎসাহ দারুণভাবে বিধ্বস্ত হচ্ছে।
আমরা মনে করি, খাদ্য বা শিল্পদ্রব্য আমদানীর যে কোনো বড় বড় ডিল সরকারের প্রত্যক্ষ ব্যবস্থাপনায় সম্পাদিত হওয়া উচিত এবং মাঝারি ধরণের ডিল সংশ্লিষ্ট সেক্টর কর্পোরেশনের মাধ্যমে হওয়া উচিত।
আর, যে সব ছোট ছোট ভোগ্য পণ্য দ্রব্যের ডিল আছে, সেগুলো বেসরকারী পর্যায়ে লাইসেন্সকৃত ব্যক্তিদের দায়িত্ব রাখা যেতে পারে।
তেল, তুলা ইত্যাদি প্রথম পক্ষের এলুমিনিয়াম, ফসফেট, আয়রণ স্তর প্রভৃতি দ্বিতীয় পক্ষের এবং টায়ার, টিউব, বই ইত্যাদি তৃতীয় পক্ষের তত্ত্বাবধানে রাখা যেতে পারে।
আবার, টিসিবিকে যদি একান্তই জিইয়ে রাখা অপরিহার্য হয় তবে তার একমাত্র এমন সব দ্রব্য আমদানীর ক্ষমতা থাকা উচিত যা’ কেবলমাত্র সরকারী তত্ত্বাবধানের মাধ্যমেই বিতরিত হবে।
আবার, যে পাওয়ারপাম্প ও টিলার নিয়ে দেশের কৃষকদের মধ্যে ও সংবাদপত্রে এতে হৈ চৈ হচ্ছে, সে সম্পর্কেও এ নীতিতে সম্পূর্ণ এড়ানোমূলক ভূমিকা পালিত হয়েছে। শুধু বলা হয়েছে ‘পর্যাপ্ত বরাদ্দ আছে’। কিন্তু সে বরাদ্দের পরিমাণ কি তা’ উল্লেখ করা হয়নি। ফলে, এ ‘পর্যাপ্ত বরাদ্দ’ বা মাত্রাতিরিক্ত কি না তাও জানা যায়না।
আর, এভাবে খুঁটে নেটে বিশ্লেষণ করলে হয়তো আরো দুর্বলতাও ধরা পড়বে।
সুতরাং, আমাদের নিশ্চিত ধারণা যে, সরকার বিঘোষিত এ আমদানী নীতি সম্পূর্ণ পরিষ্কার বা সর্বপ্রয়োজন সাপেক্ষ হয়নি। এর উপর আরো নজর দেওয়া উচিত ছিল এবং একে আরো ব্যাপক, সু-বিশ্লেষিত এবং প্রয়োজন-সাপেক্ষ ও পরিষ্কার করা উচিত ছিল।
অবশ্য, এর কিছু কিছু বৈশিষ্ট ও গুণাগুণকে অলক্ষ্য করলে তা নিতান্তই অন্যায় হবে।
এর গুণ ও বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ :
(১) গত বছরের তুলনায় প্রায় সব ক্ষেত্রেই বরাদ্দ বেশী।
(২) দেশীয় ভাবে ঔষধ তৈরীর উপর গুরুত্ব বেশী দেওয়া হয়েছে।
(৩) তৈরী বস্ত্রের চেয়ে তুলা ও সূতা আমদানীর উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
(৪) মোটরযানে স্থানীয় এজেন্টদের সুযোগ বৃদ্ধি করা হয়েছে।
(৫) বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য, ভোগ্যপণ্য ও কাঁচামালের বিশ্বব্যাপী মূল্য স্ফীতি সত্ত্বেও সেগুলো আমদানীর নিশ্চিত ব্যবস্থা হয়েছে।
(৬) ঔষধ শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহের জন্যে ঔষধ শিল্পকেই সরাসরি লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে।
(৭) সাধারণভাবে যেসব দ্রব্য আমাদের দেশের চাহিদা মেটানোর জন্যে যথেষ্ট পর্যাপ্ত তা’ এ নীতিতে আমদানী করা হবে না। তবে, কোনো প্রয়োজনীয় দ্রব্যেরও ঘাটতি হতে দেওয়া হবে না।
(৮) সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বস্তুর সংগ্রহের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, ইত্যাদি।
যাহোক, সব মিলিয়ে সরকার বিঘোষিত এ নীতি মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হলেও সম্পূর্ণ স্পষ্ট হয়নি। সরকার আমাদের বক্তব্যের দিকে একটি শুভ দৃষ্টি রেখে বর্তমান নীতির প্রয়োজনীয় সংশোধন সাধনে উৎসাহী হবেন বলে আমরা আশা রাখি।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক