You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৯শে ডিসেম্বর, বুধবার, ৩রা পৌষ, ১৩৮০

জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততায় ভাস্বর এ জাতীয় দিবস

একটি জাতির জীবনে স্বাধীনতার মূল্য যে অপরিসীম এবং স্বাধীনতার তাৎপর্য যে কত গভীর তা আমরা ষোলই ডিসেম্বর জাতীয় দিবসের স্বতঃস্ফূর্ত অনুষ্ঠানে ও আনন্দ উদ্বেলতায় মর্মে মর্মে অনুভব করেছি। পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার অক্টোপাস থেকে মুক্তির জন্যে আমরা অমিত বিক্রমে সশস্ত্র সংগ্রামে আত্মনিবেদন করেছিলাম। হানাদার পাক বাহিনীকে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমির মাটি থেকে চিরতরে উৎখাতের জন্য বাংলার ঘরে ঘরে গড়ে তুলেছিলাম দুর্ভেদ্য দুর্গ, হাতে তুলে নিয়েছিলাম হাতিয়ার, কোরাস কন্ঠে উচ্চারণ করেছিলাম বন্ধন মুক্তির জয়গান। একাত্তরের সুদীর্ঘ ন’টি মাস আমরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে মরণাস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিলাম। অবশেষে একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর পাক-হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলো। আমরা একাত্তরের ষোলই ডিসেম্বর মুক্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে নতুন প্রত্যয়ে বাঁচার বলিষ্ঠ উদ্যমে হয়েছিলাম বলীয়ান। ষোলই ডিসেম্বর এলেই তাই স্বাধীনতাহীনতার গ্লানি আমাদের রক্তাক্ত করে, বেদনার্ত করে এবং আমরা স্বাধীনতা প্রাপ্তির অনাবিল আনন্দে অংশীদার না হয়ে পারিনা। ষোলই ডিসেম্বর এবার দেশের আপামর জনসাধারণ বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জাতীয় দিবস হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে প্রতিপালন করেছেন। জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণচাঞ্চল্যে ষোলই ডিসেম্বর উৎসবানুষ্ঠানের জোয়ারে মহিয়ান দিপ্তীতে ভাস্বর হয়ে উঠেছে। রাজপথে আমাদের বীর সৈনিক ভাইদের পদবি ক্ষপে, পত্র-পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায়, বিভিন্ন দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দৃপ্ত মিছিলে, নানা রংয়ের পোষ্টারে ফেষ্টুনে এবং শিশু কিশোরদের উচ্ছল সমাবেশে ষোলই ডিসেম্বর দূর্বার প্রাণাবেগে হয়েছে অভিসিক্ত। ষোলই ডিসেম্বর জাতীয় দিবসে সমগ্র জাতি যে প্রাণ তরঙ্গে উদ্বেলিত হয়েছে, তার মূলে রয়েছে জনগণের আন্তরিকতা এবং পরাধীনতার প্রতি চরম ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ।
আমরা জাতীয় মুক্তির তৃতীয় বর্ষে যাত্রা শুরু করেছি। গৌরবময় বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা জাতীয় মুক্তির দুটি বৎসর অতিক্রান্ত করেছি বটে, কিন্তু আমরা এখনো সম্পূর্ণ সমস্যামুক্ত নই। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম শেষ করলেও ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও বেকারত্বের সংগ্রাম আমাদের শুরু হয়েছে মাত্র। ষোলই ডিসেম্বর জাতীয় দিবসকে কেন্দ্র করে জনমনে প্রথমাবস্থায় নানা বিভ্রান্তির জন্ম হলেও শেষাবধি দেশের সন্ত্রাসবাদী চক্রের কারসাজি ফলপ্রসূ হয়নি। নৈরাজ্যের রাজনীতি জনগণকে দিকভ্রান্ত যে করতে পারেনি, জাতীয় দিবসের স্বতস্ফূর্ত উদ্বেলতার মাধ্যমেই জনগণ তার প্রমাণ দিয়েছেন।
জাতীয় দিবসের আনন্দে অংশীদার হওয়ার জন্যে, আলোকসজ্জা অবলোকনের জন্যে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগের জন্যে তাই আমরা গভীর রাত অবধি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে ঘরের বাইরে বিচরণরত দেখেছি। কোন কোন তথাকথিত বিপ্লবী রাজনৈতিক প্রতষ্ঠানের কর্মীরা দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় দিবসের পবিত্রতাকে ম্লান করার জন্য নানা রকম নাশকতামূলক বিচ্ছিন প্রয়াস চালানোর চেষ্টা করলেও তাদের ভয়ে জনগণ অন্ততঃ ভীত হয়নি, বরং দৃঢ় সাহসিকতার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী চক্রের মুখে ছাই ছিটিয়ে দিয়েছে। স্বাধীনতা যে আমাদের পরম কাংখিত, দেশবাসী এবারের জাতীয় দিবসে সেই পরিচয়টিকেই উন্মোচন করেছেন। দেশে নানাবিধ অভাব-অভিযোগ, পর্বত প্রমাণ সমস্যা-সংকট বিরাজিত থাকা সত্ত্বেও জনসাধারণ যে প্রাণ চাঞ্চল্যের পরিচয় দিয়েছেন তা জাতীয় দিবসকে আরো মহিমামন্ডিত করেছে, তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। রক্তমূল্যের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীনতার আলোক স্পর্শে উজ্জীবিত হয়েছি, সেই স্বাধীনতার সুফল থেকে আমাদের কোন দুষ্ট চক্রই দূরে সরিয়ে দিতে পারবেনা। জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখে এ কথাটি আমরা নির্দ্বিধায় উচ্চারণ করতে পারি।

পাট যেন আর লোপাট না হয়

পাটের ব্যাপারে, সরকারি উদ্যোগে পাট ক্রয়ের ব্যাপারে অথবা পাটের চোরাচালানের ব্যাপারে হরদমই অনেক কথা বলা হচ্ছে, অনেক অনেক কিছু লেখালেখি হচ্ছে। কেউবা বলছেন পাট চাষ চাষীর গলার ফাঁসে পরিণত হচ্ছে। কারো কারো মতে আবার পাট চাষ নাকি নীল চাষে পরিণত করা হচ্ছে। ইত্যাকার কথাবার্তা সব সময়ই শোনা যাচ্ছে। এবং দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব কথারই উত্তপত্তি বাংলাদেশের প্রধান অর্থকরী ফসল, বাংলাদেশের প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী সোনালী আঁশ পাটের দুরবস্থা তথা পাটের মূল্য নির্ধারণ ও উৎপাদক পর্যায়ে পাটের ন্যায্য মূল্য এবং জাতীয়করণের পর পাট ব্যবসা সঠিকভাবে পরিচালনা ও পাটের চোরাচালান রোধকল্পে গৃহীত ব্যবস্থাপনার ত্রুটিজনিত অবস্থারই প্রেক্ষিতে।
পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করার পর সরকার উৎপাদক পর্যায় পাটের সর্বনিম্ন মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করেছেন। সরকারি পাটক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে গায়ে-গঞ্জে-মফস্বলে। পাট কেনার ব্যাপারে হয়তো বা সরকারের আন্তরিকতার কোন অভাব ছিলনা- কিন্তু তবুও বেশ অচলাবস্থা, পাট উৎপাদকদের হয়রানির শেষ হয়নি। অনেক ক্ষেত্রেই যাদের ওপর পাট চাষীদের কাছ থেকে পাট ক্রয় করে সরকারি গুদামে তোলার দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল তাদের দায়িত্বহীনতা এবং সাথে সাথে ‘টুপাইস’ আয়ের মওকা লোভের শিকারে পরিণত হওয়াটাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই হয়রানি ও অচলাবস্থা সৃষ্টির মূল কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই সংবাদপত্রের পাতায় ‘অর্থ না থাকায়’ অমুক কেন্দ্রে যে পরিমাণ পাটকেনার কথা ছিল, তার থেকে শতকরা মাত্র দশভাগ পাট কেনা হয়েছে এমন সব খবর পাওয়া যাচ্ছে। এবং যেহেতু কোন মহল থেকে এ জাতীয় কোনো খবরেরই প্রতিবাদ শোনা যাচ্ছেনা- কাজেই এসব খবরকে অনায়াসেই সত্য বলে ধরে নেয়া যেতে পারে।
অন্যদিকে পাটের চোরাচালান আজ একটা সর্ববাদী সত্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন হাজার হাজার না হোক শত শত মণ পাট যে চোরাপথে সীমান্তের ওপারে চলে গিয়ে এপার আর ওপারের এক শ্রেণীর অসাধু ও চোরাকারবারির মুনাফার পাহাড় গড়ে তুলেছে তাতে কেবল পাটচাষী বা জাতীয়করণকৃত পাট ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না, তার একটা মারাত্মক ও অশুভ চাপ পড়ছে এপার ওপার উভয় দেশের অর্থনীতিতেই। এতে একদিকে এপারের মুদ্রামূল্য হ্রাস হচ্ছে, অন্যদিকে ওপারের মুদ্রাস্ফীতির লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আলাদা পাট দফতর স্থাপন করেছেন। বাংলার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের প্রধান উপকরণ পাটকে রাহুমুক্ত করার জন্য আলাদা মন্ত্রী নিয়োগ ও মন্ত্রণালয়ের স্থাপন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় আজ সারা দেশবাসীর সাথে আমরাও আশা করবো পাটকে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সকল চক্রান্তের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য সার্বিক ও সঠিক কর্মসূচি নেয়া হবে। জাতীয় শত্রুদের হাত থেকে পাট ব্যবসা ও পাটকে চোরাচালানের কবলে থেকে রক্ষা করার সাথে সাথে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সিনথেটিকের হুমকির হাত থেকেও রক্ষা করার প্রয়াসী হতে হবে। এক কথায় পাট যেন আর লোপাট না হয় সে দিকে অবশ্যই লক্ষ্য রাখতে হবে।

ডি-এন-ডি প্রকল্পের সংস্কার প্রসঙ্গে

গত পরশু ঢাকার একটি স্থানীয় দৈনিক প্রকাশ যে, সামান্য বিশ ত্রিশ হাজার টাকার অভাবে প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ডি-এন-ডি প্রকল্প নামে এক বৃহৎ সেচ প্রকল্পের প্রায় সম্পূর্ণটাই নাকি ভেস্তে যেতে বসেছে। ঢাকা শহরকে বন্যার অভিশাপ থেকে রক্ষা করার জন্য এবং সেই সঙ্গে প্রায় ১২ হাজার একর জমিতে ধানের ফলন ঘটানোর জন্য প্রকল্পটি ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরা এলাকায় দেশ স্বাধীন হবার আগেই নেয়া হয়েছিল এবং এজন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছিল।
খবরে প্রকাশ, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবার ফলে ওইসব এলাকার চাষীকূল স্বাভাবিকভাবে বছরে প্রায় দু’বার বা তিনবার ধানের ফলন ঘটাতে সক্ষম। কিন্তু হালে সংলগ্ন উপখালগুলির অবস্থা এত খারাপ হয়ে গেছে যে, অন্তর্গত জমির মালিকরা এখন নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়েছেন। প্রকাশ, অবিলম্বে এসব খালগুলির পুনঃখনন ও মেরামত করা না হলে ওইসব এলাকায় এ বছর কোন বোরো চাষ আদৌ সম্ভব হবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন হবার কারণ আছে।
প্রকল্পটির প্রধান কার্যক্রম যখন চালু থাকে, তখন এ উপখালগুলো নাকি বন্ধ থাকে। বিশেষ করে প্রকল্পের ডি এল ৩ নাকি সব চেয়ে বেশি খারাপ হয়ে পড়েছে। অবিলম্বেই এর পুনঃখনন ও মেরামত করা প্রয়োজন। আরো জানা গেছে যে, ওইসব এলাকার কৃষককুল এ বিষয়ে ঢাকা সেচ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি নাকি জানিয়েছেন যে, এ মেরামতের জন্য উপযুক্ত তহবিল মজুদ নেই। অথচ ডি-এন-ডি প্রকল্পের এসব খাল-উপখালগুলির পুনঃখনন ও মেরামতের জন্য নাকি মাত্র ত্রিশ হাজার টাকার প্রয়োজন।
আমরা স্বভাবতঃই এমন খবরে বিশেষ উদ্বিগ্ন বোধ করছি এবং সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও এদিকে একটি প্রয়োজনীয় আশু দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এমন সামান্য অর্থের জন্য ডি-এন-ডির মত এমন একটি বৃহৎ ও জনকল্যাণমূলক প্রকল্প কোন অর্থেই ব্যাহত থাকা যুক্তিযুক্ত নয়। তা’ছাড়া বন্যার অভিশাপ থেকে ঢাকাবাসীর মুক্তির কথা বাদ দিলেও সুপ্রশস্ত ১২ হাজার একর জমির বছরে দু-তিনবার ধানের ফলন কোন চারটি খানে কথা নয়।
আমাদের দেশে যেখানে সবুজ বিপ্লবের জন্য সরকার ও জনসাধারণ ঐকান্তিকভাবে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছেন এবং উদ্যোগও চালিয়ে যাচ্ছেন সেখানে এতো সামান্য অর্থের জন্য কেন এ প্রকল্পের রক্ষনাবেক্ষনের প্রতি এত অনীহা দেখানো হচ্ছে, তারও উপযুক্ত বিভাগীয় তদন্তের প্রয়োজন। এক্ষেত্রে লালফিতার তেলেসমাতি কতটুকু হাত দিয়েছে তাও বেশ নিরপেক্ষভাবে তুলে নেয়া প্রয়োজন এবং অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি বিধানের মাধ্যমে সুবিচার সুনিশ্চিত করা প্রয়োজন।
এমন কি গত বছরও নাকি এমন অনীহার জন্য ও সময় মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা না নেবার জন্য ঐ সব এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে বিপুল ফসলের ক্ষতি সাধিত হয়েছে এবং এ নিয়ে জনসাধারণও দারুন বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। তাই আমরা আশা করি, এ বছর যাতে গত বছরের অভিশাপের পুনরাবৃত্তি না হয় সেজন্য কর্তৃপক্ষকে অবিলম্বেই এদিকে দৃষ্টি দিয়ে যাবতীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবেন।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!