বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৩ই জানুয়ারী, রবিবার, ১৯৭৪, ২৮শে পৌষ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
অবৈতনিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রসঙ্গে
আগামী ১৯৮২ সালের মধ্যেই অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। আগামী ১৯৭৫ সাল থেকে প্রথম শ্রেণীর শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করা শুরু হবে এবং প্রতি বছরই একটি শ্রেণীকে এই পর্যায়ে উন্নীত করা হবে। ফলে আগামী ১৯৮২ সালের মধ্যেই অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন করা সম্ভব হবে। জাতীয় শিক্ষা কমিশন অচিরেই যে রিপোর্ট সরকার সমীপে পেশ করবেন তাতে এই সুপারিশ করা হবে বলে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে। গত বছরের জুন মাসে শিক্ষা কমিশন যে অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেছিলেন তাতে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষাকে বিকেন্দ্রীকরণের সুপারিশ করা হয়েছিল। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে দশ হাজার নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠা করার উপরও জোর দেয়া হবে। কারণ, অতিরিক্ত ছাত্রের চাপে যাতে শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা দেখা না দেয়। এছাড়া ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে রাষ্ট্রীয় চার মৌলাদর্শকে আয়ত্ত করতে পারে, সে জন্যেও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আন্তর্জাতিক এবং মানবতাবাদের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্বুদ্ধ করার জন্যেও নতুন ব্যবস্থা গৃহীত হবে। শিক্ষাকে শান্তি-প্রগতি ও মৈত্রীর খাতে প্রবাহিত করাও হবে নতুন শিক্ষা ব্যবস্থার অন্যতম উদ্দেশ্য।
দেশের বুক থেকে নিরক্ষরতার অভিশাপ দূর হোক, শিক্ষার দ্বার সকলের জন্যে উন্মুক্ত হোক, এটা আমরা অবশ্যই চাই। রাষ্ট্রসংঘের সহযোগিতায় গঠিত বিশেষ কমিটি বিশ্বব্যাপী নিরক্ষরতা দূরীকরণের অভিযান চালিয়েছেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে এই অভিযান পরিচালিত হলেও নিরক্ষরতার অভিশাপকে ঝেটিয়ে বিদায় করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। নিরক্ষরতার অভিশাপের সঙ্গে দারিদ্র্যের অভিশাপও আমাদের পক্ষে রাতারাতি কাটিয়ে উঠা সম্ভব নয়। বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে হলে তাই গরীব জনসাধারণের আর্থিক সামর্থ্য থাকাটাও একান্ত দরকার। তাই অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা সার্থকভাবে প্রবর্তিত হোক, নিরক্ষরতার অভিশাপ ধুয়ে মুছে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাক, এটা আমাদের কামনা। কিন্তু শিক্ষার হার উন্নত করার জন্যে এতোদিন কোনো সুসংহত পরিকল্পনা প্রণীত করা সম্ভব হয়নি। জাতীয় শিক্ষা কমিশন অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করবেন, ভালো কথা। কিন্তু এতে দেশের কৃষক এবং শ্রমিকদের সন্তান-সন্ততিদের শিক্ষা গ্রহণের সমস্যার সুরাহা হবে কি না, তা আমরা নিশ্চিত করে বলতে পারি না। কারণ অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করলেই যে গরীব জনসাধারণের সমস্যা মিটে যাবে এমন মনে করার যৌক্তিকতা নেই যারা কৃষক, মাঠে হাল চাষ করে, তারা তাদের সন্তানকেও বংশানুক্রমে ঐ কাজেই ব্যবহার করে। শ্রমিকের ছেলেও শ্রমকেই জীবন ধারণের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। কাজেই বেতন মওকুফ করা হলেও কৃষক ও শ্রমিকের ছেলেদের পক্ষে শিক্ষা লাভ করাটা একেবারে সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। একজন গরীব কৃষকের পক্ষে ছেলের পাঠ্যবই কেনা এবং পোশাকও বোঝা হয়েই দেখা দেবে। শুধু বেতন মওকুফের ফলে যে কৃষক ও শ্রমিকের ছেলেরা শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসবে এমন মনে করার কারণ নেই। নিরক্ষরতা দূরীকরণে তাই দারিদ্রের বোঝাও একটা সমস্যা বৈ কি! দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় তাই এমনি একটা নীতি প্রণয়ন করা উচিত যাতে শিক্ষার দ্বার সকলের জন্য উন্মুক্ত এবং অবারিত হয়।
প্রহসন বোধ হয় একেই বলে!
প্রহসন বোধ হয় একেই বলে। পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রণালয় অবশেষে এক প্রেসনোট জারী করেছেন। প্রেসনোটে জনগণকে পরিত্যক্ত বাড়ীর বেআইনী দখল না নেয়ার জন্য হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, যারা অর্থের বিনিময়ে প্রবঞ্চকদের নিকট থেকে পরিত্যক্ত বাড়ীঘরের দখলীস্বত্ব ক্রয় করবেন এবং যারা পরিত্যক্ত বাড়ীঘর অবৈধভাবে হস্তান্তর করবেন, তাদের উভয় পক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পরিত্যক্ত বাড়ীঘরের বেআইনী দখলকারীদের উচ্ছেদ করা তো হবেই, উপরন্তু সরকার তাদের কাছ থেকে অতীতের সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণও আদায় করবেন।
পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রণালয়ের এই প্রেসনোটের ভাষ্য থেকে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, এখনো সরকারের আয়ত্তাধীন পরিত্যক্ত বাড়ীঘর অনেকেই ‘বেআইনীভাবে দখল’ করে আছেন। অথচ সরকার পরিত্যক্ত বাড়ীগর ছেড়ে দেয়ার জন্য বহু পূর্ব থেকেই নানা রকম চেষ্টা-চরিত্র করে আসছেন। গতকাল স্থানীয় একটি দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় পরিত্যক্ত বাড়ীঘরের সংখ্যা ৭ হাজার। এদিকে হিসাবের ৭ হাজার বাড়ীর মধ্যে সরকারের দখলে রয়েছে মাত্র ৩ হাজারের মতো বাড়ী। সরকারী সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এক মোহাম্মদপুর-মিরপুর এলাকায়ই নাকি ২ হাজারের মতো বাড়ী সরকারের বেদখলে রয়েছে। পুলিশ, মিলিটারী কিংবা কার্ফু কোনো কিছুতেই পরিত্যক্ত বাড়ীঘর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। কেন এতোদিন পরিত্যক্ত বাড়ীঘর উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি তা আমরা জানি না। তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, যারা পরিত্যক্ত বাড়ীঘর এখনো দখল করে আছেন কিংবা দখলীস্বত্ব অবৈধভাবে হস্তান্তর করার চেষ্টা করছেন, তাদের ‘খুঁটির জোর’ আছে। এই খুঁটির জোর এতো প্রবল যে, তারা সরকার নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ তো দিচ্ছেনই না বরং পরিত্যক্ত বাড়ীঘর থেকে কেটে পড়ার আগে নতুন ব্যক্তিকে ঐসব বাড়ীর দখল দিয়ে যাচ্ছেন। এ জন্যেই পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রণালয়কে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে প্রেসনোট জারী করতে হয়েছে। এবং পরিত্যক্ত বাড়ীর দখলকারীদের ‘প্রবঞ্চক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে হয়েছে। অর্থাৎ পরিত্যক্ত বাড়ীঘর কেলেংকারীটি যে চরম আকার ধারণ করেছে, আমাদের সামনে সেই চিত্রটিই আলোকিত হয়ে উঠেছে। পরিত্যক্ত বাড়ীঘর উদ্ধারের ব্যর্থতার জন্যেই যে এই চরম দুঃখজনক অবস্থার উদ্রেক হয়েছে, তাতে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই। তবুও মন্দের ভালো বলতে হবে যে, পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রণালয়ের শেষাবধি নিদ্রা ভঙ্গ হয়েছে, জনসাধারণকে সচেতন করে দেয়ার জন্যে প্রেসনোটের আশ্রয় তারা নিয়েছেন। যথাসময়ে যদি পরিত্যক্ত বাড়ীঘর উদ্ধারের যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হতো, তাহলে আজ এই করুণাবস্থার উদ্রেক হতো না। তাই বলা চলে, প্রেসনোট জারী করে পূর্ত ও গৃহনির্মাণ মন্ত্রণালয় এক প্রহসনেরই পরিচয় দিয়েছেন। বারংবার আমরা প্রসহনের পরিচয় পেতে ইচ্ছুক নই। আমরা চাই, পরিত্যক্ত বাড়ীঘর অবিলম্বে উদ্ধার করে পরিত্যক্ত বাড়ীঘর নিয়ে উদ্ভূত সমস্ত কেলেংকারীর অবসান করা হোক। প্রহসন যেন পর্বতপ্রমাণ না হয়।
ষোল হাজার মামলা ঝুলছে
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির সঙ্গে বিচার কার্য ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। তাই দেশে যখন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট কার্যকরী ভূমিকা নিতে প্রয়াস পাচ্ছেন, তখন বিচার বিভাগ সম্বন্ধেও সচেতন ও সক্রিয় হতে হবে বৈকি! অন্যথায় একতরফা চেষ্টায় কাজ আশানুরূপভাবে অগ্রসর হবে না এ কথা প্রায় বলেই দেওয়া যায়।
গতকাল পত্রিকান্তরে প্রকাশিত হয়েছে যে একমাত্র ঢাকা সদরেই ১৬ হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে এবং অমীমাংসিত মামলার সংখ্যা ক্রমশঃই বাড়ছে। কারণ স্বরূপ বলা হয়েছে প্রথমতঃ পদোন্নতি, বদলি ও মৃত্যুজনিত কারণে বিগত দশ মাসের মধ্যে ঢাকা সদরে ম্যাজিস্ট্রেটের সংখ্যা ২৫ থেকে ১২তে নেমে এসেছে। ঐ শূন্যস্থানগুলো পূরণ করাও হয়নি এবং কার্যরত বাকী ম্যাজিস্ট্রেটদের উপর কাজের দায়িত্ব পড়েছে অত্যাধিক।
দ্বিতীয়তঃ কম লোক থাকার জন্য বাড়তি কাজ ছাড়াও তাদেরকে নানাবিধ লাইসেন্স পারমিট ইত্যাদি ইস্যু করা ও তদারক করার কাজে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। ফলে কোর্টে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস প্রায় সময় কর্ত শূন্য অবস্থায় থাকে। এবং এর জন্যে গ্রাম থেকে মামলা উপলক্ষে আগত লোকেরাই অর্থ অপচয় সহ নানারূপ ভোগান্তি পুইয়ে থাকেন।
এই ঘটনা শুধু যে ঢাকার সদর কোর্টেই ঘটছে এবং ঘটেছে তা নয়। সমগ্র বাংলাদেশে লোয়ার কোর্ট থেকে শুরু করে মহকুমা ও সদর কোর্টে এমনি আরো বহু হাজার মামলা বিচারাধীনে ঝুলে রয়েছে। কিছুদিন আগে এ নিয়ে পত্রিকান্তরে খবর প্রকাশিত হয়েছিল এবং দু’একটি পত্রিকায় উপসম্পাদকীয় নিবন্ধে খবরটির বিস্তারিত ব্যাখ্যাও করা হয়েছিল। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!
আমাদের দেশের ম্যাজিস্ট্রেট যাদেরকে এজলাসে বসে বিচার করতে হয় তাদেরকেই প্রশাসনের নানাবিধ দায়িত্ব সহ আনুষঙ্গিক লাইসেন্স, পারমিট, ন্যায্যমূল্যের দোকান সংশ্লিষ্ট কার্যাদি ও অন্যান্য বিচার সম্পর্কিত নয় এমন বহুবিধ কাজে সময় ব্যয় করতেই হয়। সেক্ষেত্রে বিচারের কাজও বিঘ্নিত হতে বাধ্য।
এছাড়াও আমাদের দেশে পুলিশী সূত্রের সহযোগিতার অভাবে বেশীর ভাগ বিচারের কাজ বিলম্বিত হয়। যথাসময়ে প্রতিবেদন, চার্জশীট ইত্যাদি দাখিল না করায় এবং অসৎ প্রভাবে পড়ে পরিবেশন করায় বিচারের মধ্যে গলদও ঢুকে পড়ে। সেটা উদ্ধার করতে যথেষ্ট সময় ব্যয়িত হয় এবং পরিশেষে বিলম্বিত বিচার ধামাচাপা পড়ে যায়, তা অনেকক্ষেত্রে জন-অসন্তোষের ইন্ধন জোগায়।
অতএব বলা যায়, বিচার বিভাগের প্রতি উদাসীন হলে চলবে না। শুধু ঢাকা সদরেই নয়, ম্যাজিস্ট্রেটের পদ যেখানেই শূন্য আছে, তা অবিলম্বে পূরণ করতে হবে। বাড়তি দায় দায়িত্ব কমিয়ে যারা বিচারের সঙ্গে জড়িত আছেন, তাঁদেরকে সেই কাজে অভিনিবিষ্ট হবার জন্যে সময়, সুযোগ ও পরিবেশ দিতে হবে। কারণ ইংরেজীতে একটা কথা আছে ‘জাস্টিস ডিলেড জাস্টিস ডিনায়েড’। তাই বিচার বিভাগে যেন অন্ততঃ বিচারে বিলম্ব ঘটিয়ে অবিচারের দৃষ্টান্ত রাখার ঐতিহ্য স্থাপিত না হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি এই আমাদের আবেদন।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক