বাংলার বাণী
ঢাকা : ২১শে জানুয়ারী, সোমবার, ১৯৭৪, ৭ই মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতি অভিনন্দিত
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আগত বিদেশী প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এবং সর্বক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতাদানের আশ্বাস দিয়েছেন। গত শনিবার বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনের প্রভাতী বৈঠকে বিশ্বের যে বারোটি দেশের প্রতিনিধিরা বক্তৃতা দিয়েছেন সে দেশগুলোর মধ্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, মিশর, ইরাক, পোল্যান্ড, হাঙ্গেরী, রুমানিয়া, জাপান, পূর্ব জামানী, যুগোশ্লাভিয়া, বুলগেরিয়া ও মালয়েশিয়া। প্রতিটি দেশের প্রতিনিধিই বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক বন্ধুত্বের দৃঢ় প্রত্যয়ের বলিষ্ঠ ঘোষণা উচ্চকিত করেছেন। এবং পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে বাংলাদেশের সাথে তাঁদের বন্ধুত্ব জোরদার হয়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন। বৈদেশিক প্রতিনিধিরা এ আশাও প্রকাশ করেছেন যে, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনে দ্রুত অগ্রগামী হতে সক্ষম হবে। ভারতীয় প্রতিনিধি বলেছেন, ঔপনিবেশিক অর্থনৈতিক বেড়াজাল থেকে মুক্তির জন্য বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে লড়েছেন এবং এখনো লড়াকু মনোভাব ত্যাগ করেননি, দেখে তিনি মুগ্ধ। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশ এখনো জাতিসংঘের সদস্য নয়, তবুও ইতিমধ্যেই বহু আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়েছে বাংলাদেশ। সোভিয়েত প্রতিনিধি বলেন, এশীয় পরিবারবর্গের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের বর্তমান ভূমিকা অব্যাহত থাকলে অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশ এই মহাদেশে শান্তি ও প্রগতির ক্ষেত্রে নতুন পথ উন্মোচন করতে সক্ষম হবে। জিডিআর প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশকে জাতিসংঘভুক্তির প্রশ্নে তাঁর দেশ পূর্ণ সমর্থন দেবে এবং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন। যুগোশ্লাভিয়ার প্রতিনিধি বলেছেন, আলজিয়ার্সে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগদান আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পরিচয় পরিব্যাপ্ত করেছে। জাপানের প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠবে এবং একটি সমৃদ্ধিশালী দেশে পরিণত হবে। মিশরীয় প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন অবশ্যই অর্জন করবে। হাঙ্গেরীয় প্রতিনিধি বলেছেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষকে অমিত প্রেরণা যোগাবে।
বৈদেশিক প্রতিনিধিদের ভাষ্য থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে আর একবার প্রমাণিত হলো যে, বাংলাদেশের স্বাধীন, জোটনিরপেক্ষ ও শান্তিকামী পররাষ্ট্রনীতি আজ বিশ্বের দেশে দেশে অভিনন্দন লাভ করছে। বিদেশীরা বাংলাদেশের সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য ও সার্বিক অগ্রগতিই মনেপ্রাণে কামনা করেন। বিশ্বশান্তি, প্রগতি, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাংলাদেশের ভূমিকা সমগ্র বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বের প্রতিটি নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য অঙ্গীকারাবদ্ধ। বাংলাদেশ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী সংগ্রামে এক অগ্রসেনা। শান্তির সৈনিক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বাধীনে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে সমাজতান্ত্রিকতার পথে এগিয়ে যেতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ নীতিতে অবিচল। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের নীতিতে বাংলাদেশ বিশ্বাসী। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি তাই বিশ্বের প্রতিটি দেশেই প্রশংসার্জন করে চলেছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের এই সম্মান তার বলিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতির জন্যেই। বৈদেশিক প্রতিনিধিরা সেই সত্যটিই আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পঁচিশটি আন্তর্জাতিক সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। কিন্তু এখনো বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়নি। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের নিপীড়িত ও মুক্তি সংগ্রামরত দেশগুলোর সম্পর্ক খুবই সুখপ্রদ। আরব জাহানের কাছেও বাংলাদেশের সমাদর রয়েছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্য সংকটে বাংলাদেশ নির্যাতিত আরব ভাইদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল। ইন্দোচীনেও বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে নিকট আত্মীয়তা ঘোষণা করেছে। আলজিয়ার্স সম্মেলনে বাংলাদেশ যে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা করেছে, তাতেও বিশ্বসভায় বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ ভুক্তির ব্যাপারটিতেও সাফল্য লাভের সম্ভাবনা সূচিত হয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে আগত বিশ্বের বারোটি বৈদেশিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বক্তব্য থেকে বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের সমমর্মিতাই প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশের জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জয় যে অবশ্যম্ভাবী, তাও আমরা সহজেই অনুমান করতে সক্ষম। বৈদেশিক প্রতিনিধিরা বঙ্গবন্ধুর যোগ্যতম নেতৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে আমাদের পররাষ্ট্রনীতিরই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন।
মিশর-ইসরাইল সৈন্যাপসারণ চুক্তি
অবশেষে মিশর-ইসরাইল সৈন্যাপসারণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। কায়রো-সুয়েজ সড়কের ১০১ কিলোমিটার পয়েন্টের এক সামরিক তাঁবুতে অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন মিশরীয় সেনাবাহিনীর চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ আবদুল গনি গামাসি এবং ইসরাইলী সেনাবাহিনীর চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ ডেভিড এলাজার। কায়রোর সংবাদপত্রগুলোতে প্রকাশিত বিবরণ অনুযায়ী জানা গেছে যে, চুক্তি মোতাবেক ইসরাইলী সৈন্য সুয়েজ খাল থেকে ৩৩ কিলোমিটার পূর্বে সরে যাবে। মিশরকে কোনো রকম সুবিধা দিতে হবে না। ইসরাইলী ক্ষেপণাস্ত্র, সাঁজোয়া বহর এবং কামান মিটলা ও গিড্ডি গিরিপথের পেছনে সরিয়ে নেয়া হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। জানা গেছে। মধ্যপ্রাচ্য বিরোধের সামগ্রিক নিষ্পত্তির আগে মিশর সুয়েজ খাল খুলবে না, তবে খাল পরিষ্কার ও প্রশস্ত করার কাজে মিশর হাত দেবে।
গত অক্টোবর মাসে মধ্যপ্রাচ্যে যে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছিল, তার তিনমাস পরেই মধ্যপ্রাচ্য বিরোধের মীমাংসার জন্যে শান্তির স্বপক্ষে বাস্তব পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। সুদীর্ঘ পঁচিশ বছরব্যাপী মধ্যপ্রাচ্য বিরোধ মীমাংসাকল্পে এবারই সর্বপ্রথম উভয়পক্ষের প্রতিনিধি একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর দান করেন। এই চুক্তি স্বাক্ষরের ব্যাপারে মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারকে কম ছুটোছুটি করতে হয়নি। ডঃ কিসিঞ্জারের সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় মিশর-ইসরাইল সৈন্যাপসারণ চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হওয়াতে মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার একটা আলামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইসরাইলের সহকারী প্রধানমন্ত্রী এ্যালোন বলেছেন, সুয়েজ খাল ফ্রন্টের সৈন্য অপসারণের জন্যে ইসরাইল ও মিশর নতুন স্বাক্ষরিত চুক্তিতে একটি গোপনীয় ধারা সন্নিবেশিত করেছে। চুক্তিটির একটি অংশ লিখিত এবং অপর একটি অংশ মৌখিক বলেই তিনি তথ্য প্রকাশ করেছেন। চুক্তি অনুযায়ী ইসরাইলী দখলকৃত আরব ভূমি থেকে সৈন্য সরিয়ে নেবে এবং উভয়পক্ষ অস্ত্রশস্ত্র হ্রাস করবে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদত একদল পত্রিকা সম্পাদকের কাছে বলেছেন যে, সিরিয়া এবং প্যালেস্টাইনীদের বাদ দিয়ে মিশর-ইসরাইলের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক আলোচনায় অংশ গ্রহণ করবে না। ওদিকে ইসরাইলের উপ-প্রতিমন্ত্রী মিঃ এ্যালোন বলেছেন যে, মিশর-ইসরাইল চুক্তিটি ইসরাইলের পার্লামেন্টে অনুমোদন না করা পর্যন্ত তা বৈধ বলে গণ্য হবে না। জাতিসংঘের মহাসচিব ডঃ কুর্ট ওয়াল্ড হেইমও সুয়েজ খাল এলাকা থেকে সৈন্য অপসারণ সংক্রান্ত চুক্তিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি অভিমত দিয়েছেন যে, এ চুক্তি মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানে নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের স্বপক্ষে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
কিন্তু মিশর-ইসরাইল সৈন্যাপসারণ চুক্তিতে প্যালেস্টাইনী আরব উদ্বাস্তুদের ন্যায়সঙ্গত পুনর্বাসন ব্যবস্থার কোনো দফা রফা করা হয়নি। তা’ছাড়া, চুক্তির একটি অংশ মৌখিক বিধায় অনেকের মনেই একটা সন্দেহ জেগে রয়েছে। ডঃ হেনরী কিসিঞ্জারের সহযোগিতায় প্রণীত এই মিশর-ইসরাইল সৈন্যাপসারণ চুক্তিতে যদি প্যালেস্টাইনীদের স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জন্যে মুক্তিফ্রন্টের নেতা ইয়াসির আরাফাতের বক্তব্যকে সম্মান দেয়া হতো, তাহলে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে এই চুক্তি শান্তি প্রতিষ্ঠায় একটা বিরাট পদক্ষেপ হিসেবে আরো উজ্জ্বলতর হতে পারতো।
ইসরাইলের পার্লামেন্টেও এই চুক্তিটি অনুমোদিত হয়ে যাবে। কিন্তু তবুও কথা থাকে যে, সৈন্য অপসারণ করলেও সমস্যার কিন্তু মুলোৎপাটিত হবে না। সৈন্য অপসারণ এবং পৃথকীকরণের মধ্যে অবশ্য যুদ্ধের উস্কানি ও উত্তেজনা প্রশমিত হবে এবং হঠাৎ করে কোনো পক্ষই যুদ্ধ শুরু করতে পারবে না। এদিক থেকে বিচার করলে, মিশর-ইসরাইল চুক্তিটির গুরুত্ব রয়েছে বৈকি! কোনো সমস্যাই রাতারাতি সমাধান করা সম্ভব নয়। আমরা আশা করি, মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার সমুদয় মীমাংসার একটা শান্তিপূর্ণ পটভূমি তৈরী হবেই। এই পটভূমিতে প্যালেস্টাইনীদের স্বার্থও বিবেচনা করে দেখা হবে। নইলে সমস্যা থেকে যাবে। কাজেই রোগ সারানোর জন্যে গোড়ায় কোনো গলদ না রাখাই শ্রেয়তর। ইসরাইলের মুরুব্বী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ কথা জানে। এখন ইসরাইলের একগুঁয়েমীর অবসান হলেই মঙ্গল।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক