You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ১৮ই জানুয়ারী, শুক্রবার, ১৯৭৪, ৪ঠা মাঘ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

দেশ গড়ার সংগ্রামে যুবসমাজ

বাংলাদেশ আওয়ামী যুব লীগের প্রথম জাতীয় কংগ্রেসের তারিখ সমাসন্ন প্রায়। আগের কর্মসূচী অনুসারে এ সম্মেলন আগামী ১লা, ২রা ও ৩রা ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হবার কথা ছিল। কিন্তু এক পরিবর্তিত-সিদ্ধান্ত অনুসারে এ সম্মেলন এখন আগামী ৪ঠা, ৫ই ও ৬ই ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত হবে।
এ জন্যে সংগঠনের এক প্রতিনিধিদল গত পরশু গণভবনে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে। উদ্দেশ্য ছিল জাতির জনকের শুভাশীষ গ্রহণ করা।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আজকে দেশের এই নাজুক মুহূর্তে সবচেয়ে বেশী যা’ প্রয়োজন তা’ হচ্ছে বিভিন্ন গণ-সংগঠনসমূহের ক্যাডারদের মধ্যে মৌলিক সততা ও দেশ গঠন চেতনার এক আন্তরিক কর্তব্যবোধ সৃষ্টি করে প্রকৃত অর্থে ‘সৎ-নেতৃত্ব’ প্রদান করা। তাই তিনি যুবকদের অত্যন্ত সততার সঙ্গে দেশ সেবায় এগিয়ে আসতে আহ্বান জানান।
বাংলার বিগত মুক্তি-সংগ্রামে যুবলীগ কর্মীদের আত্মত্যাগ ও ভূমিকার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধু বলেন, সোনার বাংলাদেশকে সত্যিকারভাবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই ব্যক্তিস্বার্থ ভুলে জাতীয় স্বার্থে কাজ করতে হবে। তিনি আরো বলেন, দেশের গরীব জনসাধারণ তাদের নানান অসুবিধার স্থায়ী নিরসনের জন্যে যুবসমাজের কাছ থেকে সৎ ও আন্তরিক নেতৃত্বের প্রতীক্ষায় বসে আছে। এ জন্য তিনি দেশের বৃহত্তর স্বার্থে সুশৃঙ্খল যু্ব সংগঠনের প্রয়োজনীয়তার উপরও গুরুত্ব আরোপ করেন।
তিনি বলেন, আমাদের রাষ্ট্র গৃহীত চারটি আদর্শের প্রকৃত বাস্তবায়নের জন্যে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ ও কৃষক লীগ সহ অন্যান্য সবাইকেই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মিলিতভাবে প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তিনি আশ্বাস দেন, মুক্তিযুদ্ধজনিত ব্যাপক ধ্বংস ও উচ্ছৃংখলতা সত্ত্বেও তাঁর সরকার ও দল দেশে একটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করতে সব সময়ে নিবেদিত থাকবেন। তিনি নবজাত রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য নস্যাতে সচেষ্ট শত্রুদের সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্যে যুবলীগ কর্মীদের সতর্ক করে দেন।
তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, কাউকেই কষ্টার্জিত স্বাধীনতা বিঘ্নিত করতে দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, শুধুমাত্র দেশবাসীর দারিদ্র ঘুচানোর ঐকান্তিক ইচ্ছার তাগিদেই তিনি এই প্রধানমন্ত্রীত্ব নিয়েছেন এবং গণশত্রুদের অশুভ চক্রান্ত ও পাঁয়তারা সত্ত্বেও তিনি দ্বিধাহীনভাবে কাজ করে যাবেন।
দেশের ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধুর সময়োচিত উপদেশ যে অত্যন্ত মূল্যবান ও তাৎপর্যপূর্ণ এতে কোনো সন্দেহ নেই। বর্তমান সরকার গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে বদ্ধপরিকর। আর এ উত্তরণে দেশের যুবসমাজ এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন। দেশের সর্বত্র দুর্নীতি, মুনাফাখোরী, মওজুতদারী, চোরাচালানী ও অন্যান্য সমাজবিরোধী তৎপরতা বন্ধ এবং আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারকে একান্তভাবে যুবসমাজই সাহায্য করতে সক্ষম। আমরা আশা করবো, যুবলীগ কর্মী সহ দেশের যুবসমাজ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তাঁর স্বপ্ন সোনার বাংলাকে বাস্তবায়িত করতে এগিয়ে আসবেন।

দুর্নীতি দমনের কার্যকরী ব্যবস্থা চাই

দুর্নীতিতে আমাদের সমাজ জীবন ছেয়ে গেছে। দুর্নীতি আমাদের সমাজদেহে এতো ব্যাপক এবং এমন রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে যে, দুর্নীতির করাল গ্রাস থেকে মুক্তির জন্যে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা অনিবার্য হয়ে উঠেছে। দুর্নীতির দুষ্টক্ষত থেকে মুক্তি না পেলে আমাদের জাতীয় জীবনের নৈতিক মেরুদন্ড অচিরেই ভেঙে যাবে। আমরা দিন দিন নৈতিক অধঃপাতের পথে এগিয়ে যেতে বাধ্য হবো।
দুর্নীতি দমনের জন্যে জাতীয় সংসদে বিল গৃহীত হয়েছে। দুর্নীতি দমন সংশোধনী বিলের সমালোচনার জবাবে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুর বলেছেন, প্রতিটি নাগরিক সচেতন না হলে দুর্নীতি দূর হবেনা। জনাব ঠাকুর তাই দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা এবং বিদ্বেষ সৃষ্টির আহ্বান জানিয়েছেন। জনাব ঠাকুর তথ্য প্রকাশ করে বলেছেন, স্বাধীনতার পর দশ হাজার দু’শ নয়টি দুর্নীতির মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় দু’ হাজার মামলার সরাসরি তদন্ত চলছে এবং দু’ হাজার চারশ’ ঊনসত্তরটি মামলার চার্জশীট দাখিল করা হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী অবশ্য স্বীকার করেছেন বিচারক এবং অন্যান্য কর্মচারীর অপ্রতুলতার জন্যে মামলা পরিচালনার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে।
এ কথা সত্য যে, সমাজের সর্বস্তরে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির সর্বগ্রাসী থাবা বিস্তার লাভ করেছে। সাধারণ মানুষ দুর্নীতি সম্পর্কে সজাগ রয়েছেন। কিন্তু নাগরিক সচেতনতাই দুর্নীতি নির্মূলের একমাত্র পথ নয়। আমরা জানি, দুর্নীতি দমনের জন্যে একটি পুলিশ বিভাগ রয়েছে। এই দুর্নীতি দমন পুলিশ বিভাগের মধ্যেও যে দুর্নীতি নেই, এমন কথা আমরা জোর গলায় উচ্চারণ করতে পারবো না। সরকারী প্রশাসনিক বিভাগ থেকে সবার আগে দুর্নীতির মূলোৎপাটিত করতে হবে। প্রশাসনিক বিভাগের আমূল পুনর্বিন্যাস যদি করা হয় তাহলেই কেবল দুর্নীতির বিরুদ্ধে যথার্থ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে। সরকারকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করার জন্যে জনসাধারণকেও এগিয়ে আসতে হবে। জনসাধারণ দুর্নীতির বিরুদ্ধেই রয়েছে। এখন প্রয়োজন শুধু দুর্নীতি দমনের জন্যে আইনানুগ ব্যবস্থাবলম্বনের। বৃটিশ আমলেও দুর্নীতি ছিল। পাকিস্তানী আমলে তো দুর্নীতির ছড়াছড়ি আমরা দেখেছি। এখনো এই স্বাধীন বাংলার বুকেও দুর্নীতির কালোছায়ায় আমাদের সমাজ জীবনকে এক পংকিলতার আবর্তে হাবুডুবু খেতে দেখছি। সে জন্যই বলছি দুর্নীতি উৎখাত করতে হলে পুরনো আইন সংশোধন অত্যাবশ্যক। দুর্নীতির মামলার এতো যে ছড়াছড়ি, এতে দুর্নীতিবাজরা কি উপযুক্ত শাস্তি পাচ্ছে?
দুর্নীতিদমন বিভাগের দুর্বলতার জন্যই আজ দুর্নীতিবাজরা সমগ্র দেশব্যাপী আসর জাঁকিয়ে বসেছে এবং পুরনো আইনের ফাঁক দিয়ে দুর্নীতি করেও অব্যাহতি পেয়ে যাচ্ছে। দুর্নীতি দমনের জন্য তাই আইনকে নতুন ছাঁচে গড়তে হবে, যাতে দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা কোনোক্রমেই সাধুবেশে সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে সদর্প পদক্ষেপ চালাতে না পারে। আমরা চাই, দুর্নীতির সর্বগ্রাসী থাবা থেকে মুক্তি পেতে। দুর্নীতিপরায়ণতা দেশকে আজ এক অতল অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে উদ্যত। এমতাবস্থায়, প্রকট দুর্নীতির কবল থেকে দেশ এবং জাতিকে মুক্ত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থাই যথাযোগ্য বলে আমরা মনে করি।

খুন হচ্ছে কিন্তু খুনীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছেনা

আবার রাজধানীতে খুন! মহাখালী ফোরকানিয়া মাদ্রাসার জনৈক ছাত্রকে কে বা কারা হত্যা করে পালিয়ে গেছে। তার বয়স মাত্র ২০ বছর এবং গত বছর সে হজ্জব্রত পালন করেছে। একজন ধর্মপ্রাণ ছাত্র বলে সে সবারই কাছে পরিচিত ছিল। অথচ কোন্ অশুভ চক্রান্তের শিকার হয়ে যে তাকে প্রাণ হারাতে হলো সে কথার জবাব দেবার আজ কেউ নেই। অন্ততঃ অন্যান্য ঘটনাদৃষ্টে তাই মনে হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যায়, আজিমপুর হত্যাকান্ড সহ এ পর্যন্ত রাজধানীতে প্রায় ডজন খানেক খুন সংঘটিত হয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা গেছে খুনের পরে আর কিছু করার যেন থাকেনা। বহু রকম লম্প ঝম্প প্রদান করার পরও একখানা চার্জশীট দাখিল করা হয় না। মুনীরা হক হত্যাকান্ডে বা গ্রীন রোড কিংবা বাসাবোতে যে মর্মান্তিক ঘটনাগুলো সম্প্রতি রাজধানীর বুকেই ঘটে গেলো—তার কোনোটিরই কোনো কুল কিনারা করা সম্ভব হয়নি আজ পর্যন্ত।
শুধু কি তাই? আজ ইটের পাঁজায় শিশুর গলা কাটা বা হাত পা কাটা লাশ, কাল ম্যানহোলে গলিত স্ফীত মৃতা যুবতীর লাশ, পরশু রমনার পাশে বস্তাবন্দী মানুষের টুকরো করা দলা পাকানো মৃতদেহ এবং এমনি আরও।
স্বভাবতঃই এ জাতীয় ঘটনায় রাজধানীর নাগরিক জীবনে ভীতি ও সন্ত্রসের ছায়া নেমে এসেছে। পরিষ্কার ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে এবং কারা করছে এর পেছনে রাজনৈতিক কারণ না ব্যক্তিগত কারণ আছে কিছুই জানা যায় না। তবে কারণ যাই হোক—ঘটনা যা ঘটছে তা নিছক তখনই শুধু নয়—বিভীষিকাময় খুন।
অথচ এ যাবত একটি খুনেরও যথাযথ তদন্ত বা রহসোদ্ধার পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগ করতে পারছে না। আমাদের জানার মধ্যে এমন বিবৃতি ও বক্তৃতা দিয়ে যে খুন, রাহাজানি, ছিনতাই এবং ইত্যাকার দুষ্কর্মগুলো বন্ধ করা যাবেনা—এ কথা তো বলারও অপেক্ষা রাখে না। এবং সেই সঙ্গে এও সত্যি যে, পুলিশ বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট মহল যদি কাজে তৎপর না হয় তাহলে আইনের বুলি কপচিয়েও কিছু হবেনা। কারণ আইন ও বিচার দু’টোই একত্রে প্রয়োগ করতে না পারলে দুষ্কৃতিকারী ভয় পাবে কেন? আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যে পুলিশের উপর ন্যস্ত সেই পুলিশই যদি খুন-খারাবী আর রাহাজানি বন্ধ করতে সক্ষম না হয় তাহলে জনসাধারণের মনে নিরাপত্তাবোধ আসবে কিভাবে। কিভাবে আস্থা রাখা হবে পুলিশের উপর। এ প্রশ্নের আলোকে সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। একটার পর একটা খুন হবে—রহস্য নাটকের মতো রহস্যের মাত্রা বাড়বে আর পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে এ তো হতে পারে না। হওয়া উচিতও নয়।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!