চুয়াত্তরের ঈদের ঘটনা (গ্রন্থসূত্র – জাসদের উত্থান -পতন)
:::::::::::::::::::::::::::
স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে তাদের প্রধানতম শত্রু ছিলেন কুষ্টিয়া জেলার খােকসা-কুমারখালী অঞ্চলের সংসদ সদস্য গােলাম কিবরিয়া। তার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের জমি দখল এবং নানা ধরনের অনাচারের অভিযােগ ছিল। কুষ্টিয়া জেলা মুজিব বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার এবং গণবাহিনীর নেতা মারফত আলীর প্রস্তাব অনুযায়ী গােলাম কিবরিয়াকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই প্রস্তাব অনুমােদনের জন্য ঢাকায় জাসদের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রধান নেতা নূরে আলম জিকুর কাছে পাঠানাে হয়। নূরে আলম জিকুর সঙ্গে জাসদের কর্মী শাহাবুব আলম চিরকুট আদান-প্রদান করেন। ঢাকায় গণবাহিনীর হাইকমান্ডের সঙ্গে আলাপ করে জিকুকে ‘হ্যা’ অথবা ‘না’—এই সিদ্ধান্ত দিতে বলা হয়। সিদ্ধান্ত আসে ‘হ্যা’। | একদিন রাতে গণবাহিনীর ৭৩ জন সদস্য কুষ্টিয়ার মিরপুর থানার ছাতারপাড়া গ্রামে মরা নদীর পারে সমবেত হন। অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে রক্ষীবাহিনীর ওপর কীভাবে আক্রমণ করা হবে, তার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করাই ছিল এ সমাবেশের উদ্দেশ্য। হঠাৎ তারা বুঝতে পারেন, রক্ষীবাহিনী তাদের ঘেরাও করে ফেলেছে। শুরু হয় ‘যুদ্ধ’। গােলাগুলি চলে আড়াই ঘন্টা। গণবাহিনীর মূল নেতা শামসুল হাদীসহ সাতজন নিহত হন। নিহত অন্য ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন মুসা, উম্মত, খলিল, জিলানী, কুদুস ও ছােট মন্টু। তারা সবাই ছিলেন একাত্তরের মুক্তিযােদ্ধা। আহত হন ছয়জন। রক্ষীবাহিনীর। ১৭ জন নিহত হন। গােলাগুলিতে তিনজন নিরীহ কৃষক মারা যান। তারা মাথায় করে পাট নিয়ে যাচ্ছিলেন। | গণবাহিনী গােলাম কিবরিয়ার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার চেষ্টা চালিয়ে যায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল, দিনের বেলায় প্রকাশ্যে তাকে হত্যা করা হবে। অবশেষে চুয়াত্তরের ২৫ ডিসেম্বর সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়। সেদিন ছিল কোরবানির ঈদ। এই অপারেশনে গণবাহিনীর মােট ৪৩ জন অংশ নেন।
এর আগে। কুমারখালী ও খােকসা থানার পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করার পরিকল্পনা করা হয়। হান্নান, আলাউদ্দিন, অধীর, মজনু ও গনি কুমারখালী থানায় গিয়ে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে বলেন, ‘সারেন্ডার করবেন, না আমরা থানা দখল করব?’ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বললেন, ‘আমাদের জানে মারবেন না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কিছু বলব না। প্রয়ােজনে একটি-দুটি ফাকা আওয়াজ করব।’ কুমারখালী থানার ওসি নজরুল ইসলাম এভাবেই পুলিশের ২২ জন সদস্যসহ আত্মসমর্পণ করেন। একই পদ্ধতি নেওয়া হলাে খােকসা থানার ক্ষেত্রেও। সেখানে আবুল দারােগাসহ ১৮ জন পুলিশ সদস্য আত্মসমর্পণ করেন। কুমারখালী থানার সামনে ঈদগাহ। থানার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয় রাত একটায়। ২৫ ডিসেম্বর বুধবার সকালে ঈদের জামাত। লােকে লােকারণ্য, হাজার দশেক মানুষ। জামাত শুরু হবে, সবাই দাড়িয়ে গেছেন। সবার সামনে দিয়ে কয়েকজন হেঁটে গেলেন। তাঁদের পরনে শার্ট-লুঙ্গি, গায়ে চাদর। সামনের কাতারে দাঁড়ানাে গােলাম কিবরিয়ার বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে একজন গুলি করলেন। ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। তাঁর দেহরক্ষী আজম খান ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যান। মানুষ যে যেদিকে পারে ছুটে পালায়। ঈদের জামাত আর হয়নি। পুরাে অপারেশনটি কয়েক মিনিটের মধ্যে শেষ হয়। দলটি গড়াই নদ পার হয়ে সােনাদিয়া বাজারে চলে যায়। সেখান থেকে একেকজন একেক জায়গায় গােলাম কিবরিয়া শেখ মুজিবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। শেখ মুজিব তাকে ‘মিয়াভাই’ বলে সম্বােধন করতেন। এই ঘটনায় তিনি খুবই মর্মাহত হন। পরে পুলিশ-রক্ষীবাহিনী এক হাজারের বেশি লােককে গ্রেপ্তার করে। ২৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয় । কালু নামের একজনকে রাজসাক্ষী করা হয়। পরে বিভিন্ন এনকাউন্টারে’ গণবাহিনীর আনসার, জিলানী ও কুদ্দুস নিহত হন। হামলা এড়াতে শাহাবুব আলম একবার ২৪ ঘণ্টা পানিতে ডুবে ছিলেন।
#সংগ্রামের_নোটবুক