ডেইলি টেলিগ্রাফ লন্ডন, মার্চ ৩০, ১৯৭১
ট্যাঙ্কের দ্বারা বিদ্রোহ দমন
৭০০০ মানুষ নিহত: বাড়ি-ঘর ভস্মীভূত
সাইমন ড্রিং, ব্যাঙ্কক থেকে
যিনি যুদ্ধের সময় ঢাকায় ছিলেন
সৃষ্টিকর্তার নামে আর অখন্ড পাকিস্তান রক্ষার অজুহাতে ঢাকা আজ একটি বিধ্বস্ত এবং ভীত নগরী। গণহত্যা চালানোর উদ্দেশ্যে ঠান্ডা মাথায় পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৪ ঘন্টা গোলাবর্ষণ চালিয়ে গিয়েছে এবং এর ফলে ঢাকা নগরীর ৭ হাজার মানুষ নিহত, বিশাল বিস্তৃত এলাকা মাটির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার লড়াইকে নির্মমভাবে থামিয়ে দেওয়া হয়েছে।
যদিও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দাবি করছেন যে পরিস্থিতি এখন শান্ত তবু রাস্তাঘাটে দেখা যাচ্ছে গ্রামমুখী হাজার হাজার মানুষ। শহরের রাস্তাঘাট এখন ফাঁকা, দেশের অন্যান্য স্থানে হত্যাযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে।
এব্যাপারে সন্দেহ নেই যে ট্যাংকের বলে বলীয়ান সৈন্যদল শহর এবং অন্যান্য বৃহৎ লোকালয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ নেই বললেই চলে।
তুচ্ছ কারণে গুলি করে মানুষ হত্যা করা হচ্ছে, বাড়িঘর নির্বিচারে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
সৈন্যদের দেখে মনে হচ্ছে যে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৩ মিলিয়ন মানুষের উপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় তারা বদ্ধ পরিকর।
ঠিক কতো নিরীহ মানুষকে এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে সে হিসাব করা খুবই কঠিন। তবে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোর এবং ঢাকার হিসাব যোগ করলে এ সংখ্যা ১৫ হাজারের কম হবেনা।
হতা-হতের সংখ্যা সঠিক ভাবে পরিমাপ করা না গেলেও সামরিক অভিযানের ভয়াবহতা সহজেই উপলব্ধি করা যাচ্ছে । ছাত্রদের নিজের বিছানায় হত্যা করা হয়েছে , নিজের ছোট্ট দোকানটিতে কসাইয়ের লাশ পড়ে আছে , নারী ও শিশুদের ঘরের ভিতর জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী পাকিস্তানিদের একসঙ্গে জড়ো করে গুলি করে মারা হয়েছে, বাড়িঘর, বাজার, দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে আর পাকিস্তানি পতাকা উড়ছে সব ভবনের শীর্ষে।
সরকারি সৈন্যদের দিকে হতাহতের সংখ্যা স্পষ্ট নয়। তবে অন্তত একজন অফিসার নিহত এবং ২ জন সৈন্য আহত হয়েছে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে পাকবাহিনী বাঙালির অভ্যুত্থান সাফল্যের সাথেই দমন করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানী সৈন্যদের হাতে বন্দী অবস্হায় দেখা গিয়েছে এবং আওয়ামী লীগের প্রায় সব নেতাকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাঁজোয়া বাহিনীর হামলা
শীর্ষস্থানীয় সব রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্য অনেককেই হত্যা করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনের সমর্থক দুটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকার অফিস ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।
তবে ২৫ মার্চ রাতে বের হওয়া ট্যাংক বহরের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা।
ঢাকা আক্রমণে তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য ব্যবহৃত হয় – একটি সাঁজোয়া, একটি গোলান্দাজ আর একটি পদাতিক। রাত ১০টার কিছু পরে তারা ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে।
১১টার দিকে গুলিবর্ষন শুরু হয় এবং পাক বাহিণীর প্রথম হামলার শিকার হয় উল্টানো গাড়ি, গাছের গুড়ি, আসবাব পত্র, কনক্রিট পাইপ দিয়ে দ্রুত ব্যারিকেড দেওয়ার চেষ্টায় এগিয়ে আসা মানুষগুলো।
কেউ একজন ফোনে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দেন যে, শহরে কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এবং তিনি যেন বাড়ি ছেড়ে আত্মগোপন করেন। তবে তিনি তা করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, আমি যদি আত্মগোপন করি তবে তারা আমার সন্ধানে নেমে সারা ঢাকা শহর ধ্বংস করে দেবে।
২০০ ছাত্র নিহত
ছাত্রদেরকেও সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পাকসেনাদের হামলার পরও বেঁচে যাওয়া ছাত্রদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, তারা ভেবেছিল তাদের কেবল গ্রেপ্তার করা হবে। এ রকম হত্যাকান্ডের কথা কারো কল্পনায়ও আসেনি ।
মাঝ রাতের ঠিক পরপরই আমেরিকার দেওয়া স্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত এম-২৪ ট্যাংক বহর এক কলামে সাজিয়ে সেনা দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় প্রবেশ করে। সৈন্যরা ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেটাকে ঘাঁটি বানিয়ে ছাত্রাবাসগুলিতে গোলাবর্ষণ করতে থাকে।
সরকারবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি বলে পরিচিত ইকবাল হলে গোলা নিক্ষেপ আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিতে ২০০ ছাত্র নিহত হয়। এ ধরনের অতর্কিতে হামলায় নিরস্ত্র ছাত্ররা সম্পূর্ণ আপ্রস্তুত অবস্হায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
দুদিন পরও দেখা যায় পোড়া রুমের মধ্যে পড়ে থাকা লাশ, বারান্দায় আর মাঠে লাশ। তবে সবচেয়ে বেশি লাশ দেখা গেছে হলের পাশের লেকে। চিত্রকলার এক ছাত্রের লাশ উপুড় হয়ে পড়েছিল তার ক্যানভাসের ওপর।
কোয়ার্টারে বসবাসকারী ৭ জন শিক্ষক নিহত হন। কোয়ার্টারের বাইরে লুকিয়ে থাকার চেষ্টারত ১২ সদস্যের একটি পরিবারকে গুলি করে মারা হয়। হত্যাজজ্ঞের পর পাক বাহিনী অনেক মৃতদেহ সরিয়ে ফেলতে সমর্থ হয়। সেকারণেই ইকবাল হলের মেঝেতে পড়ে থাকা ৩০ টি লাশ দেখে পুরো ঘটনার ভয়াবহতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
অন্য একটি হলে ছাত্রদের মেরে দ্রুত কবর খুঁড়ে মাটিচাপা দিয়ে তারপর ট্যাংক দিয়ে মাটি সমান করে দেওয়া হয়।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বসবাসকারী অন্য সাধারণ লোকজনকেও রেহাই দেওয়া হয় নি। রেললাইনের পাশে শান্তি হাউজের ২০০ গজ এলাকার সমস্ত ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
পাক বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে থাকা একটি মার্কেটও পুড়িয়ে দেয়। দোকানের ভেতর ঘুমিয়ে থাকা লোকজন মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ হারায়। কাঁধ পর্যন্ত টেনে দেওয়া কম্বলের তলায় মনে হচ্ছিল তারা যেন ঘুমিয়েই আছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে বাজুকা ছোড়া হয় এবং এলাকার একটি মসজিদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর আক্রমণ
পাক বাহিণীর ট্যাঙ্কবহরের এক অংশ যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণরত, তখন আরেক অংশ শহরের অন্য প্রান্তে অবস্হিত পূর্ব পাকিস্তান পুলিশের সদর দপ্তর রাজারবাগ আক্রমণ করে।
ট্যাংক প্রথমে গোলাবর্ষণ করে এবং পরে সৈন্যরা ঢুকে ঘুমন্ত পুলিশের ব্যারাক মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। এই হামলায় ঠিক কতজন নিহত হয়েছিল তার সঠিক হিসাব যদিও জানা যায় নি তবে ধারণা করা হয়, ঐ সময়ে সেখানে অবস্থানকারী ১১০০ পুলিশের মধ্যে অল্প কজনই রেহাই পেয়েছিল।
এই অবস্থার মধ্যে সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাসভবন ঘিরে ফেলে। রাত ১টার ঠিক আগে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করে জানা যায় যে , তিনি অনেক আগেই এ ধরনের হামলার আশংকা করছিলেন এবং কয়েকজন কাজের লোক ও দেহরক্ষী বাদে বাড়ির অন্য সদস্যদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছিলেন।
শেখ মুজিবের এক প্রতিবেশী পরে জানান যে, রাত ১টা ১০ মিনিটে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্রাক বোঝাই সৈন্যরা গুলি করতে করতে শেখ মুজিবের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে।
বাড়ির সামনে এসে একজন অফিসার রাস্তা থেকেই ইংরেজিতে চেঁচিয়ে বলেন, ” শেখ, আপনি বাইরে আসুন। “
ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে শেখ মুজিব বলেন, “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। এতো গোলাগুলির দরকার ছিল না, আমাকে টেলিফোন করে দিলে আমি নিজেই হাজির হতাম।”
অফিসারটি তখন বাড়ির বাগানে ঢুকে বললেন, “আপনাকে গ্রেফতার করা হলো।”
তিনজন কাজের লোক, একজন সহকারী আর দেহরক্ষীসহ শেখ মুজিবকে নিয়ে গেল তারা।
দলিল-পত্র সরিয়ে নেয়া
শেখ মুজিবকে যখন সেনা সদরদপ্তরের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন আরেক দল সৈন্য বাড়ির ভিতর ঢুকে। তারা বাড়িতে রক্ষিত দলিলপত্র নিয়ে যায়, সবকিছু ভেঙে-চুরে তান্ডবলীলা চালায়, বাগানের সদর দরজায় তালা লাগিয়ে দেয় এবং বাংলাদেশের লাল, সবুজ, হলুদ পতাকা গুলি করে নামিয়ে শেখ মুজিবের বাড়ি ত্যাগ করে।
রাত ২টা নাগাদ ঢাকা একটি জ্বলন্ত নগরীতে পরিণত হয়। সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকা দখল করে নেয় এবং লুকিয়ে থাকা ছাত্রদের গুলি করে মারতে ও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার বদলে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যদিও কোনো কোনো এলাকা থেকে মাঝে মাঝে ভারী অস্ত্রের গোলাবর্ষণের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, তবুও এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, যুদ্ধের তীব্রতা কমে এসেছে। ইতিমধ্যে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের উল্টোদিকে অবস্থিত খালি পড়ে থাকা ‘পিপলস’ পত্রিকার অফিসে এক প্লাটুন সৈন্য ঢুকে সেটিকে জ্বালিয়ে দেয় এবং সে অফিসের একমাত্র নৈশ প্রহরীকে গুলি করে হত্যা করে।
ভোরের ঠিক আগে গোলাগুলি প্রায় থেমে যায়।বেলা যত বাড়তে থাকে, মৃত নগরী অদ্ভুত নিস্তব্ধতা তত প্রকট হতে থাকে। থেমে থেমে কাকের ডাক আর সামরিক গাড়ির চলাচলের শব্দ ছাড়া শহরে আর যেন কিছুই ছিল না। তবে সবচেয়ে খারাপটা তখনও বাকি ছিল।
দুপুর নাগাদ বিনা নোটিশেই কয়েক কলাম সৈন্য ঢাকার পুরোনো অংশে অতর্কিত হামলা চালায়। পুরোনো ঢাকার রাস্তাঘাট অতন্ত সংকীর্ণ এবং সেখানে ১ মিলিয়নেরও বেশী লোক বসবাস করে। পরবর্তী ১১ ঘন্টা ধরে পাকসেনারা যেসব এলাকা শেখ মুজিব সমর্থকদের শক্ত ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত, সেসব জায়গায় পরিকল্পিত ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
ইংলিশ রোড, নয়া বাজার, ফ্রেঞ্চ রোড, সিটি বাজার এলাকায় হাজার হাজার লোকের বাসস্থান পুড়িয়ে দেওয়া হয় ।
ফ্রেঞ্চ রোড-নয়া বাজার এলাকায় এক বৃদ্ধের ভাষ্যে জানা যায় যে, পাক সেনারা হঠাৎ যেন গলির মাথায় উদয় হতো আর ঐ গলির সবকিছু পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিত।
সৈন্যরা দুইভাগে ভাগ হয়ে আসত। প্রথমে থাকতো অস্ত্রধারী সৈন্যরা। তাদের অনুসরণ করতো পেট্রোলের ক্যান হাতে আরেক দল, যারা নির্বিচারে বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে দিতো। যারা পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করতো তাদের গুলি করে মারা হত। আর যারা ভিতরেই থাকতো তারা জীবন্ত দগ্ধ হত। সেদিন বেলা ২টার মধ্যে ঐ এলাকার ৭০০ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে হত্যা করা হয়।
একই ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয় অন্য আরো তিনটি এলাকায়, যেগুলোর প্রত্যেকটির আয়তন কম-বেশী আধা বর্গ মাইল।
সৈন্যরা একটি এলাকা থেকে চলে যাওয়ার সময়ে যতটুকু পারতো , লাশগুলো ট্রাকে তুলে নিয়ে পরবর্তী টার্গেট এলাকার দিকে রওয়ানা দিত। পুরোনো ঢাকার পুলিশ স্টেশনগুলোতেও তারা নির্বিচারে হামলা চালায়।
শনিবার সকালে পুরোনো ঢাকার একটি বাজারের ধ্বংসস্তূপে এক পুলিশ আফিসার কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। তিনি বলেন, “আমি আমার কনস্টেবলদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। আমার অধীনে ২৪০ জন ছিল, এ পর্যন্ত ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি-যাদের সবাই মৃত।”
পাক সেনাদের এই অভিযানে সবচেয়ে বড় হত্যাকান্ডটি ঘটানো হয় পুরোনো ঢাকার হিন্দু এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দাদের ঘর থেকে বের করে এনে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মারা হয়।
হত্যা করার পর পুরো এলাকাও জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছার-খার করে দেয়া হয়।
২৬ মার্চ রাত ১১টা পর্যন্ত সৈন্যরা পুরোনো ঢাকায় বাঙালী ইনফর্মারদের সহায়তা নিয়ে অভিযান চালিয়ে যায় ।
সৈন্যরা ফ্লেয়ার ছুড়লে বাঙালি ইনফর্মাররা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের বাড়ি দেখিয়ে দিত। তারপর সৈন্যরা ট্যাংকের গোলায়, রিকয়েললেস রাইফেলের গুলিতে অথবা পেট্রোল জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে ঐসব বাড়ি ধ্বংস করে দিত।
টঙ্গী এবং নারায়ণগঞ্জ ছিল শেখ মুজিবের সমর্থক বামপন্থীদের ঘাঁটি। সেই এলাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টেকে মোতায়েন করা হয়। শহর এলাকায় রোববার সকাল পর্যন্ত গোলাগুলি অব্যাহত থাকে। তবে বড় ধরনের অভিযানগুলো ২৬ তারিখ রাতে, আক্রমণ শুরু হবার ঠিক ২৪ ঘন্টার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
সৈন্যদের শেষ টার্গেটগুলোর অন্যতম ছিল দেশের প্রধানতম বাংলা দৈনিক ইত্তেফাকের অফিস। হামলা শুরু হওয়ার পরপরই সেখানে প্রায় ৪০০ সৈন্য অবস্থান নেয়।
২৬ মার্চ বিকেল ৪টা নাগাদ চারটি ট্যাংক এসে দাঁড়ায় ইত্তেফাক ভবন সংলগ্ন এলাকায়। আর সাড়ে ৪টায় ঐ ভবনটি পরিণত হয় একটি জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডে। শনিবার সকালে ঐ ভবনে পুড়ে কয়লা হয়ে যাওয়া মৃতদেহ ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
যতো দ্রুত সৈন্যরা শহরের রাস্তায় নেমেছিল, ঠিক সেই রকম দ্রুততার সাথেই তারা তাদের ব্যারাকে ফিরে যায়। শনিবার সকালে রেডিওতে ঘোযণা দেয়া হয় যে সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কার্ফ্যু তুলে নেওয়া হবে।
রেডিওর ঘোষণায় বার বার সামরিক আইনের ধারাগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা হয়, সংবাদপত্রের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়, সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগ দিতে বলা হয় এবং ব্যক্তিগত অস্ত্র জমা দেয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাজার হাজার মানুষের পলায়ন
যাদুমন্ত্রের মত নগরীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে এলেও মানুষের মধ্যে আতঙ্ক আরো ঘনীভূত হয়। এখানে-সেখানে কুন্ডুলীভূত কালো ধোঁয়া এবং সৈন্য দলের উপস্হিতি সত্বেও বেলা দশটা নাগাদ রাস্তাগুলো ভরে ওঠে পলায়নপর মানুষের ভিড়ে।
কেউ গাড়িতে, কেউ রিকশায় কেউবা হেঁটে। সবার সঙ্গে মালপত্রের বহর, ঢাকার মানুষ পালাচ্ছে হাজারে হাজারে। আর কখনো কখনো শোনা যাচ্ছিল করুণ আর্তনাদ-” আমি বৃদ্ধ মানুষ, দয়া করে আমাকে সঙ্গে নিয়ে যান।” “আল্লাহর ওয়াস্তে আমার বাচ্চাটিকে আপনাদের সাথে নিয়ে যান।”। এই ধরণের আহাজারীতে ঢাকার বাতাস ভারী হয়ে উঠে। এর পাশ দিয়েই অন্য দিকে তাকিয়ে পলায়নপর মানুষ হেঁটে যাচ্ছিল।
নীরবে মাথানত করে পলায়নরত মানুষ ধ্বংসস্তুপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। পাকবাহিনীর তান্ডবলীলার প্রমাণ পদে পদেই দেখা যাচ্ছিল। দেখা যাচ্ছিল কি নিপুণ পরিকল্পনায় সৈন্যরা মানুষ হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।
একটা বাজারের পাশে হঠাৎ গুলির শব্দ হল। মুহূর্তের মধ্যেই ২০০০ মানুষ দৌড়াতে শুরু করল। কিন্তু এটি ছিল শুধুমাত্র অস্ত্র জমা দিতে চাওয়া কোন এক মানুষের বন্দুকের শব্দ।
সরকারী অফিসগুলো ফাঁকা। বেশীরভাগ কর্মচারীই পালিয়ে যাচ্ছিল গ্রামের দিকে।
আর যারা শহরেই রয়ে গেছে তারা ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে সেসব ধ্বংসস্তূপের মাঝে, এক সময়ে যা ছিল তাদের বাসস্থান। তারা খুঁজে দেখছিল ধ্বংসস্তুপের ছাইয়ের মাঝ থেকে কোন কিছু উদ্ধার করা যায় কিনা।
যেসব গাড়িগুলো ছুটছিল, সেগুলো ছিল হয় গ্রামমুখী পলায়নপর মানুষে বোঝাই অথবা রেডক্রসের পতাকা লাগিয়ে মৃতদেহ অথবা আহতদের বহনকারী গাড়ি।
আর মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছিল সৈন্যদের গাড়ি, জনতার দিকে বন্দুক তাক করে নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে ছিল তারা।
শুক্রবার রাতে যখন তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয় তখন তারা চিৎকার করে বলছইল নারায়ে তাকবির-একটি পার্সিয়ান শব্দ যার অর্থ আমরা যুদ্ধে জিতে গিয়েছি।
শনিবারে তাদের স্লোগান দিচ্ছিল পাকিস্তান জিন্দাবাদ- যার অর্থ পাকিস্তান দীর্ঘজীবি হোক।
বেশিরভাগ মানুষই পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করছিল। পেট্রোল ছাড়া পাকিস্তানি পতাকাই ছিল বাজারে সর্বাধিক বিক্রিত পণ্য।পালিয়ে যাওয়ার সময় নিজেদের বাড়িঘর সম্পদ রক্ষার জন্য মানুষ দরজায় তালা দিচ্ছিল আর ছাদে পাকিস্তানি পতাকা ওড়াছ্ছিল।
চারটা নাগাদ রাস্তা আবার ফাঁকা হয়ে পড়ল। রাস্তায় রাস্তায় সৈন্যরা অবস্থান নিলো। আর সারা শহরে নেমে এলো সুনসান নীরবতা।
কিন্তু প্রায় সাথে সাথেই গুলির শব্দ আবার নীরবতা ভেঙে দিল। রেডিওতে ঘোষণা দেওয়া হলো কেউ ঘরের বাইরে এলেই গুলি করা হবে। কার্ফ্যু বলবত হবার ঠিক দুই মিনিট পরে একটি ছোট্ট ছেলে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের কাছ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছিল। তাকে আটক করা হয়, একজন অফিসার তাকে জোরে জোরে চড় মারেন এবং তাকে জিপে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ঢাকা ক্লাবের নাইট গার্ড ক্লাব ভবনের গেট লাগাতে এসে সৈন্যদের গুলিতে মারা যায়।
রেসকোর্সের মাঝখানে মন্দিরের আশপাশের বাসিন্দা একদল হিন্দুকে গুলি করে মারা হয়। তাদের অপরাধ ছিল এই যে তারা খোলা জায়গায় ঘোরাফেরা করছিল।
সৈন্যদের অবরোধের মুখে পালাতে না পেরে অনেক মানুষকেই ঢাকা ফিরে আসতে হয়। তাদের একজনের মুখ থেকে শোনা যায় যে পালানোর চেষ্টারত কত মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
রাস্তায় রাস্তায় দেয়া সৈন্যদের ব্যারিকেডের অন্যপাশ ছিল পুরোপুরি ফাঁকা। একমাত্র সেনাবাহিনী ছাড়া কারো পক্ষেই বলা সম্ভব ছিলনা যে আসলে কি ঘটছে।
সড়ক পথের ভিড় এড়াতে গ্রামের দিকে যাওয়ার জন্য অনেকেই বেছে নিয়েছিল নদীপথ। নৌকার জন্য নদীর তীরে অপেক্ষা করতে করতেই আবার শুরু হয়ে গিয়েছিল কার্ফ্যু। পরদিন সকালে সেখানে দেখা যায় ছোপ ছোপ রক্তের দাগ।
বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ
ঢাকা অথবা পূর্ব পাকিস্তানের অন্য কোথাও সংগঠিত কোনো প্রতিরোধ খবর পাওয়া যায় নি। পশ্চিম পাকিস্তানি কোন অফিসারও তাদের অভিযানের পথে কোন ধরণের প্রতিরোধের কথা উল্লেখ করেন নি। একজন পাঞ্জাবি লেফটেন্যান্টের ভাষায়, “এই মানুষগুলো চাইলেও আমাদের ওপর পাল্টা আঘাত করতে পারবে না।” অন্য আরেক অফিসার জানান যে পরিস্হিতি এখন অনেক ভালো।
“কেউই একটি শব্দ উচ্চারণ করতে বা ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতে পারবে না। আসলে আমরা তাদের হত্যা করব। তাদের অনেক কথা বলার সুযোগ দেয়া হয়েছে। তারা বিশ্বাসঘাতক, আমরা তা নই। আমরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য আল্লাহর নামে লড়াই করছি।”
পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের পরিকল্পনা এবং পরিচালনায় এই অভিযান বাংলার মানুষের সর্বশেষ প্রতিরোধের ক্ষমতা পর্যন্ত গুঁড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল।
শুধুমাত্র ভারতীয় সরকারের প্রোপাগান্ডা এবং ঢাকার বাইরের কোনো এক গোপন স্থান থেকে পরিচালিত বামপন্থীদের বাংলাদেশ রেডিও ছাড়া কোথাও চলমান যুদ্ধের কোনো খবর পাওয়ার উপায় ছিল না।
পূর্ব পাকিস্তানীদের স্বপ্ন ছিল একটি গণতান্ত্রিক দেশে সমঅধিকারের সাথে বসবাস করা। এই স্বপ্নভঙ্গের ভয়াবহ ক্ষত সময়ের ব্যবধানে তা শুকিয়ে গেলেও গত সপ্তাহে চালানো নির্মম হত্যাযজ্ঞ এবং ধ্বংসযজ্ঞের যে স্মৃতি তা প্রজন্মান্তরেও ভোলা সম্ভব হবে না।
শেখ মুজিবের আন্দোলনের ধ্বংসস্তূপ থেকে যদি কিছু বেরিয়ে আসে তা হলো এই যে, সেনাবাহিনীকে কখনোই ছোট করে দেখা যাবে না। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যতই জনগণকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার কথা বলুক না কেন, তিনিই কখনোই কোনো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবেন না – সেই নির্বাচন বৈধভাবেই জেতা হোক আর না হোক।