পাকিস্তান ৭ কোটি মানুষের সাথে জুয়ার যুদ্ধে হেরে গেছে
সানডে টাইমস
১২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
“সানডে টাইমসের বাংলাদেশের রক্তাক্ত জন্মের সংবাদ থেকে নেয়া”
প্রথম দিন
ঘটনার প্রথম থেকেই শুরু করি। তিন খন্ড নাটকের শুরুটা হয়েছিল ১৯৪৭ সালের বিয়োগান্তক দেশ বিভাজনের মাধম্যে। প্রথম ভাগের পর্দা উঠেছিল ২৫ মার্চে, যখন পাকিস্তানের সেনাবাহিনী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও মানুষকে দমন করতে চেয়েছিল। দ্বিতীয় ভাগ শুরু হয় ২২ নভেম্বর, যখন ভারতীয় সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতাকামী গেরিলা, মুক্তিবাহিনীর সাহায্যের জন্য সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছিল এবং এককাতারে এসে যুদ্ধ শুরু করেছিলো।
নাটকের তৃতীয় দৃশ্যের অবতারনা হয় যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সব ফ্রন্ট থেকেই যুদ্ধ শুরু হয়। ভারত পাকিস্তানের সাড়ে আটষট্টি কোটি লোক কারাকোরামের পাদদেশ থেকে গ্রেট ইন্ডিয়ান মরুভূমি, সিন্ধু সেচের কৃষিজমি থেকে পদ্মার জলমগ্ন দ্বীপপুঞ্জে পর্যন্ত যুদ্ধ যুদ্ধ রবে জেগে ওঠে।
গত কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা জরুরী অবস্থার ভিতরে মুরে শায়লি রাওয়ালপিন্ডি থেকে রিপোর্ট করেছে। সেনাবাহিনীর ভিতরে বহু উপর পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় আগ্রাসনের ব্যাপারে জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে চাপ দিয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানে নিযুক্ত কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমিন আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী বলেছিলেন যে, তিনি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদেরকে ঠেকিয়ে রাখতে পারবেন। সেই সময়ের মধ্যে বর্ষা মৌসুম শুরু হবে সাথে নদীর পানি ফুলে ফেপে উঠবে। যা তাদের সৈন্যদেরকে কিছুটা হলেও মুক্তিবাহিনীর আক্রমন থেকে সুরক্ষিত রাখবে। সে সময় নিয়াজী আরো বলেছিলেন যে, রাজনৈতিক ভাবে কিছু স্ট্রেটেজি নেয়া হবে যাতে করে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গ্রামাঞ্চলে তাদের সমর্থন ও জনপ্রিয়তা হারানো শুরু করবে। সেখানে কি কৌশল ঠিক করা হয়েছিল আশা করি তা আমরা কিছুদিনের মধ্যেই দেখতে পাবো। তাদের এই কৌশলে কিছু ব্যাপার আছে যা হতে পারে কফিনের শেষ পেরেক ঠোকার মতোঃ তবে যুদ্ধের শেষে বোঝা গেলো যে তাদের কৌশল একটা ভুল ধারনার উপর ভিত্তি করে করা যা আসলে এখন প্রমাণিত হয়েছে।
জেনারেল নিয়াজী তার সেনাবাহিনীকে অতিরিক্ত সৈন্য ও গোলাবারুদের সরবরাহ ছাড়াই আগামী ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু তার দেয়া আদেশটা ছিল অনুমানের উপর ভিত্তি করে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একটা পন্থা। তার ধারনাটা ছিল ভারতীয় বাহিনী সীমান্ত বরাবর মর্টার হামলা ও মুক্তিফৌজ গেরিলাদের সাহায্য করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
কিন্তু পাকিস্তানের প্রতি পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে ভারতীয় চাপ বৃদ্ধি পেতেই থাকে এবং এক পর্যায়ে ২২ নভেম্বর থেকে ভারত প্রকাশ্যে যুদ্ধে যোগ দেয়। এই ঘটনার পর স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী সেনার পক্ষে গুলি চালু রেখে ভারতীয় সেনা ও গেরিলাদের ঠেকিয়ে রাখাটা গোলাবারুদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই ছিল না। বুধবার ১ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী ইয়াহিয়া খানকে রিপোর্ট করেন যেভাবে গোলাবারুদ ব্যবহার হচ্ছে তাতে স্টক এক সপ্তাহের বেশী স্থায়ী হবে না।
* হেনরি ব্রান্ডন; নিকোলাস ক্যারল; গডফ্রে হজসন দ্বারা সম্পাদিত
একই দিনে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনাদের কাছে একটা লিখিত আদেশ গিয়ে পৌছায় যে, যেভাবেই হোক গোলাবারুদের অপচয় রোধ করতে হবে এবং প্রতিটা গুলির সদ্বব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এটা এমনই এক আদেশ ছিল যাতে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত সেনাদের মনোবল ধরে রাখা যায়। যা আসলে ছিল পাকিস্তানী জেনারেল কতৃক একপ্রকারের আত্নসমার্পনের বহিঃ প্রকাশ।
দ্বিতীয় দিন: পাকিস্তানের ব্যর্থতা দ্রুত ঘনিয়ে আসছিলো
দ্বিতীয় দিনঃ
কলকাতার একটা সংক্ষিপ্ত সফর শেষে মিসেস গান্ধী কলকাতা থেকে দিল্লি ফিরে আসেন এবং শনিবার মধ্যরাতের কিছু সময় পর তিনি সংবাদটা পান। তিনি রেডিওব্রডকাস্টের মাধ্যমে বলেন, ভারত একটি মারাত্বক যুদ্ধের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। পরের দিন সংসদেও একই কথা বলেছিলেন তিনি।ভারতের রাজনীতিবিদরা সংসদে বসে টেবিল চাপড়ে এবং পূর্ন উদ্যমের সাথেই তড়িঘড়ি করে প্রতিরক্ষা বিল পাস করে, যাতে মিসেস গান্ধীর হাতে জরুরি ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।
তৃতীয় দিনঃ পশ্চাৎধাবন করো অথবা মুক্তিবাহিনীর হাতে মরো
রোববার ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটা ছোট কৌশল পরিবর্তন, পূর্ব ফ্রন্টে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্ত দুর্গ দখল করতে সাহায্য করেছিল। ঐ দিন ঢাকাতেই দুটো সাঁড়াশি আক্রমন চালানো হয়েছিল।
যত দ্রুত সম্ভব প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাকে দখল করা ছিল ভারতীয়দের অন্যতম উদ্দেশ্য। এবং তারা গোটা পূর্ব পাকিস্তান কে সামরিক ভাবে দুটো অংশে ভাগ করতে চাইছিল। যার দুটো পাশেই থাকবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিচ্ছিন্ন কিন্তু আত্বরক্ষায় মগ্ন সেনাদের দল। এই পরিকল্পনাটা মুক্তিফৌজ বা ভারতীয় সেনাদের পিছু হটতে কিংবা সহজেই ঢাকাকে দখল করতে সাহায্য করত। যুদ্ধের শেষের দিকে গোটা পরিকল্পনাটাই পূর্ব পাকিস্তানের সর্বনিন্ম ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে হটাতে সাহায্য করেছিলো। ভারতীয়রা আশা করেছিলো, এই কম ক্ষয়ক্ষতি অথচ বিজয় স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে তার অর্থনৈতিক পুর্নগঠনে সাহায্য করবে।
কুমিল্লার লাকসাম রেল জংশনের চল্লিশ মাইল দক্ষীনে একটা ভারতীয় সেনাবাহিনীর দল সীমান্ত পার হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে ঢুকে পড়ে। ঢাকা থেকে দাউদকান্দি পর্যন্ত সোজাসুজি একটা রাস্তা আছে এবং নদী পথে পূর্ব ঢাকা থেকে যার দূরত্ব মাত্র ২২ মাইল। এসব এলাকায় ভারতীয় বিমান সেনার অভিযানে হানাদার দখল মুক্ত হয়। এই এলাকা গুলোতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দ্বারা কোন কৌশলী বিমান আক্রমন হয় নি। ভারতীয় বিমান বাহিনী দাবি করেছিল যে তারা পূর্ব পাকিস্তানে থাকা চারটি বাদে সব গ্রাউন্ড স্টেশন ধ্বংস করে দিয়েছে। এবং যে গুলো অক্ষত আছে সেগুলো ঢাকাতেই রয়েছে। যে একটা অক্ষত রানওয়ে আছে সেটাও ঢাকা বিমান বন্দরেই রয়েছে।
যশোরে ভারতীয় আর্মি ইউনিট প্রবেশের পর, ৫০০০ থেকে ৭০০০ পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধ এড়ানোর জন্য তাদেরকে বাইপাস করে ঢাকা অভিমুখে চলে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়। পূর্ববাংলার পূর্ব সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কিছু অংশ আগরতলা থেকে আশুগঞ্জ অভিমুখে প্রবেশ করে যার পথমধ্যেই ঢাকা অভিমুখী একটা প্রধান সেতু ছিল।
চট্টগ্রাম ছিল করাচি থেকে পূর্ব পাকিস্তানে আসা সকল সরবরাহের পূর্ব টার্মিনাল যা ভারতীয় বিমানবাহী রণতরী বিক্রান্ত তে থাকা সেনাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছিলো। এবং চট্টগ্রামের সাথে ঢাকা ও প্রদেশের উত্তর অংশে যোগাযোগের জন্য রাস্তা ও রেললাইন যা প্রচন্ড ভাবে পাকিস্তানী সেনাদের ক্ষয়ক্ষতির হুমকিতে ছিল সেগুলোও ফেনী অভিমুখে থাকা ভারতীয় সেনাদের কিছু ইউনিট সুরক্ষা দিয়েছিলো। কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যবর্তী স্থানের বসানো হয়েছিলো একটা কমিউনিকেশন স্টেশন।
চতুর্থ দিনঃ ট্যাংক গুলোর প্রবেশ এবং কিছু শকুন
৬ ডিসেম্বর সোমবার, ভারত দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর “বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের” স্বীকৃতি দিয়েছিল। মিসেস গান্ধী ভারতের লোকসভাতে এমপিদেরকে জানান যে, “পাকিস্তান বাংলাদেশের জনগণকে তাদের অধীনে ফিরিয়ে নিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যার্থ হয়েছে। এখন পাকিস্তান ভারতের সাথে একটা চাপানো যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে, স্বাভাবিক দ্বিধাতে ভুগে আমরা যদি এখন কিছু না করি তাহলে আমাদের পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে হস্তক্ষেপের কোন মানেই থাকবে না। পাকিস্তান স্বাধীনতার সূচনা লগ্নেই ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় শত্রুতার জেরে ভারতের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক বন্ধ করে দিয়েছিল। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানে, ভারতীয় সেনাদের দ্বারা ফেনী পতনের পর থেকে চট্টগ্রামের সাথে ঢাকার যোগাযোগের সকল রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে। ভারতীয়রা এখন আশুগঞ্জ ও দাউদকান্দির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে মেঘনা নদী পার হয়েই তারা ঢাকাতে হামলা করতে পারবে বলে আশা করছে।
ষষ্ঠ দিনঃ পাকিস্তানীদের মনোবল তাদের জুতোতে এসে ঠেকেছে
বুধবার ভারতীয় বিমান করাচিতে প্রচন্ড বোমাবর্ষণ করেছে এবং একই সাথে রাশিয়ার তৈরী ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজ গুলোও সমুদ্র থেকেও করাচীতে বোমাবর্ষন করেছে। যা তিনটি মালবাহী জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্থ করেছে তাদের ভিতর একটা ব্রিটিশ জাহাজও ছিল। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানই এখনো ভারতীয়দের যুদ্ধ জয়ের বিশ্বাসের জায়গা হয়ে রয়েছে। একটা ছোটখাটো ভুল বোঝাবুঝির কারনে আমাদের সাংবাদিক ফিলিপ জ্যাকোবসন ও তার ফটোগ্রাফার কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে রয়েছে। পেনি টুইডির সাথে অন্য তিনজন সাংবাদিক যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সবচেয়ে বড় সাফল্য দেখার জন্য সেনাবাহিনীর অনুমতি ছাড়া আবার সীমান্ত পার হতে গিয়ে যশোরের কাছে ধরা পড়েছে। যশোর জায়গাটা পাকিস্তানি ১৬ তম ডিভিশনের সদর দপ্তর ছিল, এবং পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র পশ্চিম সীমান্তের সবচেয়ে শক্তিশালী দূর্গ বলে পরিচিত ছিল। জ্যাকবসন বোঝার চেষ্টা করেছিল যে কেন সেখানকার পাক-সেনাদের প্রতিরোধ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। যশোরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ শক্তি ভেঙ্গে পড়াটা পুরো পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের সবচেয়ে বড় একটা ধাধা ছিলো। পুরো সপ্তাহ ধরেই , ভারতীয় সেনাবাহিনীর সূত্র এবং অন্যান্য বিশেষজ্ঞ পর্যবেক্ষকরা পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন যে, যশোর সেনানিবাসের বিশাল সামরিক এলাকা ও পার্শবর্তী যশোর শহরের আশেপাশের এলাকা গুলো দখল করতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। গত সপ্তাহের শুরুতেই ভারতীয় গোয়েন্দারা রিপোর্ট করে যে, যশোর সেনানিবাস রক্ষায় একটি সম্পূর্ণ পদাতিক ব্রিগেড নিয়োজিত আছে যাতে ভারী কামান, ৪০ টা ট্যাংক, গোলক ধাধার মতো মাইন ফিল্ড, কনক্রিটের বাংকার, ট্যাংক ধ্বংসকারী কামান সমেত প্রায় ৫০০০ সেনা ও আফিসার রয়েছে। সমস্ত পূর্বাভাষই ছিল পাকিস্তানিদের পক্ষে এবং বলা হচ্ছিল তারা দাঁড়িয়ে থাকবে এবং প্রচন্ড যুদ্ধ হবে। শুধু ৯ম ডিভিশনের এক দৃঢ় প্রতিজ্ঞ কমান্ডিং অফিসার কর্নেল পি এস দেশপান্ডে বলেছিলেন যে, তারা পালিয়ে যাবে। কিন্তু ২৪ ঘন্টারও কম সময়ের ভিতরে ভারতীয় ট্যাঙ্ক ও পদাতিক বাহিনী অনেকটা সুবিধা করে নিয়েছিলো অথচ তারা ভেবেছিলো, এত কিছু দখল করতে তাদের ১ সপ্তাহের চেয়ে বেশি সময় ধরে তীব্র লড়াই চালাতে হবে। আক্ষরিক অর্থে, একটি গুলি ছোড়া ব্যাতিত যশোরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন সামরিক স্থাপনা হিসাবে যশোর বিমানবন্দর দখল করা হয়েছে। এই খবর পাওয়ার পর কর্নেল দেশপান্ডে উল্লাসিতভাবে বলে উঠেছিলেন, “এখন এক দফা হয়ে যাক”। এই বিস্ময়কর পতনের অনেক গুলো কারনের মধ্যে অন্যতম কারনটা হলো বাংলাদেশে থাকা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মারাত্বক শৃঙ্খলার অভাব। গত সপ্তাহ জুড়ে,পাকিস্তানী সেনা ইউনিট বিনা প্রতিরোধেই বিভিন্ন জায়গায় আত্নসমার্পন করেছে। কমলাপুরে, ৩১ বেলুচ রেজিমেন্ট যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সবচেয়ে ভালো যোদ্ধা বলে পরিচিত তাদের ১৬০ জন, গুলি ছোড়া ছাড়াই আত্নসমার্পন করেছে। কুমিল্লার কাছে, ২৫ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স, যারাও ভালো যোদ্ধা বলে পরিচিত ছিল তাদের কমান্ডিং অফিসার ১০০ জন সৈন্য সহ ভারতীয় প্লাটুনের কাছে আত্নসমার্পন করেছে। রেলওয়ে যুদ্ধের কৌশলগত আখাউড়া শহর, যা ঢাকা প্রতিরক্ষায় একটি অত্যাবশ্যক স্থাপনা বলে বিবেচিত ছিল। যেখানে অতিরিক্ত সেনা, অস্ত্রশস্ত্র ও ভারী কামান মোতায়েন করে রাখা হয়েছিল, তা ভারতীয় সেনা ও গেরিলারা নামে মাত্র যুদ্ধ করেই দখল করে নিয়েছিলো।
এটা আসলে কেন হয়েছিল সেটা বলা মুশকিল কিন্তু কর্নেল দেশপান্ডের করা প্রাণবন্ত উক্তির মধ্য দিয়ে তা সবচেয়ে ভালো ভাবে প্রকাশ করা যায়। তিনি বলে ছিলেন, পাকি সৈন্যদের মনোবল এখন তাদের বুটের নীচে গিয়ে ঠেকেছে। “ গত পনেরো দিন আগে থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর উর্ধতন কর্মকর্তারা তাদের স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে ঢাকা থেকে দূরে চলে গেছিলেন। অসমর্থিত সূত্র থেকে একটি গুজব শোনা যাচ্ছিলো যে, সেনা ও তাদের পরিবারকে পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ ফ্লাইট যোগে নিয়ে যাওয়া হবে যাতে তারা নিরাপদে দেশে ফিরে যেতে পারে।
পাকিস্তানী দেনারা ইতিমধ্যে এই ফ্লাইট সম্পর্কে প্রচুর দুশ্চিন্তা করছিল। ভারতীয়দের বোমারু বিমান গুলো পাকিস্তানী অবস্থান চিহ্নিত করে বোমা ফেলেই চলেছিল আর লাউডস্পিকার, লিফলেট, এবং রেডিও সম্প্রচারের মাধ্যমে একটি সহজ কিন্তু অনমনীয় বার্তা বলেই চলেছিল। বার্তাটি ছিল:
“মুক্তিবাহিনী (বাংলাদেশ গেরিলা) ধরার পূর্বে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করো।”
কিছু ভয়ঙ্কর ঘটনা ইতোমধ্যে ঘটে গিয়েছিল এবং তা ঘটেই চলেছিলো। ভারতীয় সেনারা পূর্ব পাকিস্তানে আসার আগেই মুক্তিবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে কিছু পাকিস্তানী সৈন্যের লাশ এদিক সেদিক পড়ে থাকতে দেখা গেছিলো অথবা নদীতে ভাসমান অবস্থায় পাওয়া গেছিলো।
গত সপ্তাহের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর দৃশ্যমান অগ্রগতি ছিল যে তারা শুধুমাত্র পাকিস্তানী সেনাদের শৃঙ্খলাভঙ্গ করে দিয়েছিলো। কয়েক জায়গায়, তারা সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিল। ভারতীয় সেনারা পার্বত্য অঞ্চল গুলোতে প্রচন্ড নিশ্চুপ ছিল যেখানে পাকিস্তানি বাহিনীর খুবই নগন্য এবং সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন একটি প্রতিরোধ যুদ্ধের আশঙ্কা করা হয়েছিলো।
যশোর কাছাকাছি, সেখানে দুদিক থেকে (ভারতীয় এবং মুক্তি বাহিনী) একটি প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যশোরের নিয়ন্ত্রন নেবার জন্য কর্নেল দেশপান্ডের অতি উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও তারা শহর ও সেনানিবাস উপর হঠকারীভাবে হামলা করে বসে।
এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানীরা ভারতীয় অগ্রগতি সম্পর্কে অত্যান্ত খারাপভাবে মূল্যায়ন করেছিলো। যশোর শহর ও সেনানিবাস আক্রমনের জন্য অপারেশন রুমের ম্যাপে ভারতীয় অবস্থানের চার্টটা যারা দেখেছিলো তাদের বক্তব্য ছিলো, তারা আরেকদিনের জন্য একটি পূর্ণমাত্রার আক্রমণ প্রত্যাশা করে নি। যা হবে তা আজই চুকিয়ে ফেলতে হবে।
বুধবার ৪ঃ২০ মিনিটে যখন দ্রুতগতিতে জায়গা খালি করা শুরু হলো, তখন ভারতীয়রা ছিল ৬০০০ গজ দূরে। পাকিস্তানিরা এত তড়িঘড়ি করে সেদিন ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যায় যে, ঐ দিনের কমান্ড ও অন্যান্য কাগজপত্র ও জেরক্স মেশিনের মধ্যে পাওয়া গেছিল। সেখানকার অফিসার্স মেসে অর্ধ প্রস্তুত খাবারও ছিল।
অধিকাংশ পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে গেছে বলে মনে হয়েছিল। যদিও কেবল খুলনায় সড়ক বরাবর সন্দেহজনক নিরাপত্তা বলয় তখন ও চালু ছিল এবং তারা সেখান থেকে চলে যাবার সময় সাথে করে তাদের আর্টিলারী গুলো ও নিয়ে গেছিলো। এই আর্টিলারী গুলো সম্ভবত সেনানিবাসের কয়েল মাইল পিছনে ছিল এবং সেগুলো রক্ষা করা তাদের জন্য সবচেয়ে সহজ ছিল। আমি ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে শুধুমাত্র একটা পাকিস্তানি ট্যাংকের ধবংসাবশেষ নিজেই দেখেছি যা তখনও পুড়ছিল। পাকিস্তানিরা চলে যাবার সময় তাদের প্রায় ৬০০০ টন গোলাবারুদ এবং সাধারণ সরবরাহ পিছনে ফেলে গেছিলো যা পালানোর সময় তাদেরকে মারাত্বক আত্নদ্বন্দে ভোগাবে বলে মনে করি।
আমরা যশোর পৌঁছানোর পর সবচেয়ে উদ্ভট যে জিনিসটা দেখেছিলাম তা হলো সেনানিবাসের গেইট। কলকাতা থেকে ৮৫ মাইল এবং ৫ ঘন্টার একটা নিরবিচ্ছিন্ন ভ্রমন শেষে আমরা সেখানে পৌছেছিলাম একটা ক্ষীণ হলুদ ট্যাক্সিতে করে। আমরা পেট্রাপোলের সীমান্ত পোস্টে পৌছানোর পরেই দেখেছিলাম উৎফুল্ল জনতা সেখানে ভীড় জমিয়েছে। সেখান থেকে যশোর 25 মাইল দূরে। পুরো রাস্তা জুড়ে ছিল জনতার হর্ষধ্বনি সঙ্গে গ্রামবাসীর হাতে ছিল রেখাযুক্ত নতুন লাল, সাদা, স্বর্ণ ও সবুজ খচিত বাংলাদেশের পতাকা। তাদের গলায় জোরে জোরে ধবনিত হচ্ছিল সেই পরিচিত “জয়বাংলা” শ্লোগান। বাংলাদেশ যে এখন বিজয়ী, সেটাই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছিল গ্রামবাসীর জোর গলায়।
সুন্দর ও নেশা ধরানো সবুজ বেষ্টিত গ্রামাঞ্চলের মধ্য দিয়ে গাড়ী চলার সময় মনে হচ্ছিল ধান গাছ মন্ডিত গাঢ় সবুজ একটি দাবার ছক।বাদামী পানি এবং উজ্জ্বল গাছপালা সবই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছিল পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পশ্চাদপসরণ করেছে। আরো লক্ষ্য করলাম একেকটি গোপন বাংকার যেন যুদ্ধ করা ছাড়াই পরিত্যক্ত অবস্তায় পড়ে আছে এবং বাংকার গুলোতে প্রায়ই তাদের ফেলে যাওয়া অস্ত্রসস্ত্র খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো।
আশ্চর্যজনক ভাবে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারদের চোখে দৃষ্টিগোচর হয় যে, অপসৃত পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশের অধিকাংশ এলাকার অত্যাবশ্যকীয় পিচের রাস্তা এবং রাস্তার মাঝে গর্তও করে রেখেছিলো। এমনকি চলার পথের সেতু গুলোও ধবংস করে রেখে গেছে। নাভারনের বেতনা নদীর ওপর একটি সেতু ও পাকিস্তানীরা ধবংস করে রেখে যায়। পরে ভারতীয়রা এসে একটা বাইপাস রাস্তা তৈরীর মাধ্যমে সারাদেশের সাথে যোগাযোগ পুনঃস্থাপনে সক্ষম হয়। সেনাবাহিনীর কয়েকটি লরিতে ইট ও মাটির গুড়া এনে খারাপ রাস্তা গুলোকে সংস্কার করার জন্য দিনরাত কাজ করতে থাকে এবং অবশেষে রাস্তা আবার চালু করা হয়।
ঝিকরগাছাতেও একই ব্যাপার চোখে পড়ে। আমরা একটি নতুন প্রথম উদ্বেগজনক কিছু প্রমাণ পাই। এটা ছিল বাংলাদেশ নামক দেশ হওয়ার আগেই যে হত্যা ও গনহত্যা হয়েছে তার নমুনা ছিল এবং যা ছিল মারাত্বক অস্বাভাবিক। একটা রেল ট্রাকের উপরে তিনটি অল্পবয়সী পুরুষের লাশ বোঝাই করা ছিলো। যাদের প্রত্যেকের গায়েই ছিলো কাদামাখা স্কার্টের মত লুঙ্গি। তাদের চোখ ছিল বাঁধা, হাত ও পা পেছন দিক দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধা ছিলো।তাদের গলা কেটে জবাই করা হয়েছে এবং রক্ত বাদামী মাটিতে পড়ে জবজব করছিলো।
গ্রামবাসী জানায়, মৃত ব্যক্তিরা ছিলো পাকিস্তানীদের সহযোগী ও বিশ্বাসঘাতক যারা পাকিস্তানি সেনাদের ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও হত্যার সাহায্য করেছিলো। তবে, কেউ মুক্তিবাহিনীই যে তাদেরকে হত্যা করেছে সে কথাটা কাউকে বলতে শুনিনি। গত কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, ক্রমাগত গুজব শোনা যাচ্ছিলো যে, মুক্তিবাহিনী তাদের নিজেদের বিবেচনার উপর বাংলাদেশের সাথে যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাদের উপর এক ভয়ানক প্রতিশোধ নিচ্ছে। অন্ধকার গুজব শোনা যাচ্ছে ক্যাঙ্গারু টাইপের আদালতে বিচারের পর দোষী ব্যাক্তিদেরকে সাথে সাথেই মৃত্যুদন্ড দেয়া হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক জায়গা মত, ঝিকরগাছাতে এই ধরনের প্রতিশোধের যথেষ্ঠ কারন আছে। কারন কেউ কেউ বলছে গত সপ্তাহে যখন পাকিস্তানীরা পালিয়ে যাচ্ছিলো, সেই সময় তারা ১০০ জন গ্রামবাসীর উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল।
৭ম দিনঃ যশোরের রণাঙ্গন থেকে
খুলনা সড়ক, একটি প্রধান নদীবন্দর এবং পূর্ববাংলার সবচেয়ে বড় শহর যশোর ও যশোর সেনানিবাসের নিয়ন্ত্রন নেওয়ার পর ভারতীয় সৈন্যরা যুদ্ধচালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর ছিলো। সে সময় ফিলিপ জ্যাকবসন তাঁদের সঙ্গে ছিলেন:
যশোরের “দুর্ভেদ্য” অবস্থান থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভীষিকাময় পশ্চাদপসরণ চিহ্ন শহর জুড়েই বোঝা যাচ্ছিল। আলকাতরা-মেশান নুড়িরাস্তা বিক্ষত হয়েছিল এবং মেশিনগান বুলেট এবং রকেট দ্বারা আশেপাশের দেয়াল ক্ষতবিক্ষত হয়েছিলো। এক ডজন পোড়ানো-জিপ এবং লরি পরিখা মধ্যে পড়ে ছিলো। পাকিস্তানি নিয়মিত সেনাদের অদ্ভুত ও নিথর দেহ গুলো জানান দিচ্ছিল তাদের অন্তর্বেদনার ভঙ্গি। কিছু মৃতদেহ পুড়ে গেছিলো এবং কালো হয়ে গেছিলো; অন্যদের দেহগুলোতেও ছিল ভয়ানক ক্ষত। মাছি গুলো লাশকে ঢেকে ফেলেছিলো।
যুদ্ধ শুরু হওয়া পর্যন্ত এই ৮ নং সেক্টরের তারাই ছিল প্রথম মৃত পাকিস্তানি সৈন্য যাদেরকে আমরা এই অবস্থায় দেখলাম। তারা মূলত ভারতীয় ট্যাঙ্ক এবং জেট দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যশোর সেনানিবাসের আশেপাশে মরে পড়েছিলো। তারা তাদের গাড়ি ছেড়ে এবং পরিখার দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে দৌড়ে পালিয়েছিল। মৃতদেহের চারপাশে স্থানীয়দের প্রচন্ড ভিড় দেখেছিলাম এবং তারা ডান হাত উচু করে একটাই শ্লোগান দিচ্ছিল ‘জয় বাংলা!”।
রাস্তার নিচে আরো একটি মাইল পথ যেখানে রুপদিয়ার কিছু অংশ বিদ্যমান, পাকিস্তানি সৈন্য দের বিলম্বিত পদক্ষেপের দৃশ্য হিসেবে যথেষ্ট অপ্রত্যাশিত ছিল, পেছনে ২000 মানুষ ছিল যাদের মধ্যে যশোরের পদায়িত অফিসারেদের প্রায় ১০০০ স্ত্রী-পরিবার ছিল। ছিটানো কুঁড়েঘরগুলি এখনও জ্বলছে এবং তিনটি বাস যা ব্যারিকেডের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে – সেগুলো বুলেট দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঝাঁঝরা করে দেয়া হয়েছে।
আমরা মাদ্রাসি রেজিমেন্টের একটি ব্যাটেলিয়ন-এর সামনে ভেতর দিয়ে এগিয়ে যাই, ছোটো, লোকগুলো হাসিমুখে আমাদের দিকে হাত নাড়া দিচ্ছিল -আমাদের ফটোগ্রাফার পেনি টুইডি এবং আমি ভারতের ৬৩ তম ক্যাসলির রাশিয়ান নির্মিত টি৫৫ ট্যাঙ্কের করে একটি স্বল্প যাত্রা শুরু করেছিলাম। পাকিস্তানি পজিশনের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য সরু রাস্তা দিয়ে ১০৫ মিলিমিটারের বড় বন্দুক নিয়ে ভারতীয় দের সামনের পয়েন্টে পৌঁছলাম। ১৪৫৫ জনের একটি সম্পূর্ণ স্কোয়াড্রন খুলনা সড়কের পরবর্তী পুশ ডাউনে মাদ্রাসির সমর্থনে একত্রিত হল।
ট্যাঙ্কের ভিতরে আরামে থাকলেও পিছনে ক্রমাগত পাকিস্তানীদের শেলিং এ শব্দে আমি নার্ভাস হচ্ছিলাম। আমাদের আশেপাশেই ১০৫ মি মি বন্দুকের থেকে আক্রমণ আসছিল। আমরা দেখলাম ভারতীয় বাহিনী খুব সাবধানে পাকিস্তানীদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছিল। সামনে সম্ভবত ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পাকিস্তানী ইনফ্যান্ট্রি ছিল। তারা মেশন গান ওঁ মর্টার থেকে গুলি করছিল। শত গজ দূর থেকেও হাল্কা অস্ত্রের গুলির আওয়াজ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল।
শেলিং করে পাকিস্তানিদের সরাতে ব্যর্থ হলে স্থানীয় কমান্ডার লে নরেনজিয়ার-একজন মর্যাদাবান, অযাচিত মাদ্রাজি-এয়ার সাপোর্টের জন্য কল করার সিদ্ধান্ত নিলেন। রেডিওতে দ্রুততার সাথে জানানো হল – ম্যাপ চেক করা হল।
সবাই আশা নিয়ে ঊর্ধ্বমুখী তাকাল। কিছুক্ষণ কিছু ঘটেনি। তারপর, খুব হঠাৎ, ভারতীয় বিমান বাহিনীর দুই রাশিয়ান এস ইউ ৭ নীল আকাশে দেখা গেল। কয়েক মিনিট তারা চক্কর দিল। যেভাবে শিকারের জন্য চিল ঘুরতে থাকে।
তারপর, একটি ট্যাংক থেকে নীল ধোঁয়া সম্পন্ন শেলিং করা হল – তারা খাড়া ডাইভ দিল – সোজা – একদম গাছের মাথার লেভেলে। আমি ৩০ ক্যালিবারের মেশিন গান থেকে আলোক ছটা দেখতে পেলাম। জেট থেকে পাকিস্তানী অবস্থানে গুলিবর্ষন করা হচ্ছিল।
যখন বিমানগুলো কলকাতার দিকে চলে যাচ্ছিল তখন পাকিস্তানী অবস্থান থেকে কোন গুলির আওয়াজ আসছিলনা। আবার ট্যাঙ্ক আগাতে লাগল। উজ্জ্বল হলুদ শর্শে খেতের ভেতর দিয়ে সেগুলো এগিয়ে চলল। পেছনে মাদ্রাজি ইনফ্যান্ট্রি। কর্নেল নারেগিয়ান তার কমান্ড জিপ থেকে জানালেন খুলনা শেষ।
দিন ৮: ০১১ রাজধানীর কাছাকাছি
শুক্রবার পাকিস্তানের আশা শেষ হতে লাগল। পূর্বদিক থেকে ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকার দিকে আগাতে লাগল। সেখানে বাঙালিরা অপেক্ষা করছিল। আর সেখানে বিহারী ও পাঞ্জাবি মুসলিমরা ভয়ে ছিল। পশ্চিমে পাকিস্তানীদের কাশ্মীরের কাজ আপাতত বন্ধ আছে। এখন পাকিস্তান এর শক্তভাবে সামরিক প্রতিষ্ঠান গুড়িয়ে দেবার সময়। জাতিসংঘের গভর্নর পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা মেজর-জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছ থেকে একটি আপিল গ্রহণ করেন। তিনি কিছু শর্তাবলী দিয়ে যুদ্ধের সমাপ্তির জন্য সাহায্য চান যা পাকিস্তানের হেরে যাবার স্পষ্ট প্রমাণ।
ফরমান আলী জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পাকিস্তানি সেনা ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানোর অনুরোধ জানালে তাদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান। পাশাপাশি তিনি পূর্ব পাকিস্তানে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
তবে নিরাপত্তা পরিষদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে একটি বার্তা এসে পৌঁছানোর কথা বলে ফরমান আলী এর আপিল কথা তেমন গুরুত্বের সাথে দেখে নাই। এবং ঢাকায় গুজব ওঠে যে ফর্মান আলীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, এলএল-জেনারেল এএ কে নিয়াজি – জিওসি ইস্টার্ন কমান্ড, দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন – তিনি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে সবার সামনে এসে সে গুজব ভেঙ্গে দেন। “আমি এখানে আছি – আল্লাহর ইচ্ছানুসারে আমার সৈন্যবাহিনী কমান্ড করছি”, তিনি বলেন। “এবং আমি কখনও তাদের কাছে সমর্পিত হবনা।”
ঢাকার কমান্ডিং জেনারেল ফরমান আলীকে জেনারেল স্যাম মানেকশো তার ব্যক্তিগত রেডিও বার্তায় আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ দেন: “প্রতিরোধ করলে অযথা অনেক সাধারণ সৈনিকের মৃত্যু হবে।” – তিনি জানান।
ম্যানেকশো অতিরঞ্জিত কিছু করেননি। ভারতীয় সৈন্যরা পশ্চিম থেকে ঢাকায় ঢুকেছে ও উত্তর থেকে এসে মেঘনা নদীর তীরে তাদের প্রথম অবস্থান তৈরি করে। সৈন্যদের আশুগঞ্জে হেলিকপ্টার দিয়ে নদী পার করে আনা হচ্ছে। এটি ঢাকা থেকে মাত্র ৪০ মাইল উত্তর-পূর্ব দিকে যেখান থেকে সরাসরি রাস্তা দিয়ে শহরে প্রবেশ করা যায়।
সকালে ও বিকেলে ঢাকায় বোমা বর্ষণ করা হয়-এই সপ্তাহে বেশিরভাগ দিন এমন ছিল। শহরটির বাসিন্দারা বোমা হামলায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছিল। বিমানবন্দরের কাছে তারা ২৫০ পাউন্ডের একটি বোমা পায় যেটা আমেরিকার তৈরি।
পশ্চিমাঞ্চলে কাশ্মীরের পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ বাড়িয়ে তুলেছে। পাকিস্তানীদের সাহসী আক্রমণে যেখানে আর্টিলারি ও অস্ত্রসজ্জিত ব্যাটিয়ন ছিল – তারা অগভীর মুনাওয়ার তাভি নদীতে পূর্ব দিক থেকে ভারতীয় বাহিনীকে আক্রমণ করে।
ভারত স্বীকার করে যে, এতে তাদের ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা চেম্বের এলাকায় হামলা চালায়। একই সময়ে ভারত সম্ভবত জাতিসঙ্গের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে পাড়ে যখন বাংলাদেশ সরকার স্থাপিত হবে।
দিন ৯: এক্ট ৩ শেষ
গতকাল, এটি স্পষ্ট ছিল যে এক্ট-৩ শেষ। পাকিস্তানি সৈন্যরা দলে দলে আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে।
ভারতীয় বাহিনী শেষ বড় জলের বাধা অতিক্রম করেছে, ইতিমধ্যে ঢাকার চারপাশে আংটির মত ঘিরে ফেলেছে।
পশ্চিমে ভারতীয়রা যুদ্ধক্ষেত্র লাইন বরাবর দ্রুত আগাচ্ছে, যদিও পাকিস্তানিরা তাদের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে।
তবে এটি সমানভাবে স্পষ্ট ছিল যে এক্ট -৩ সবকিছুর শেষ নয়।
একটি এক্ট ৪ হতে হবে।
দিল্লিতে, নিকোলাস ক্যারল দেখেছিলেন যে, বাংলায় ভারতীয় সাফল্যগুলির পরে, ভবিষ্যত পরিকল্পনাটি খুব সহজ এবং দৃশ্যত অনিবার্য। ভারতীয় কর্মকর্তাদের মনের মধ্যে একই চিন্তা ভাবনা আছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের শেষ পর্যন্ত মারা যেতে হবে। এমনকি যদি ঢাকায় টাইম টেবিল মেনে চলা হয় তবুও তাদের কোন পথ থাকবে না।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায়, শেখ মুজিবের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদ যশোরে শনিবার বিকেলে যথাক্রমে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন।
পাকিস্তানি বন্দীদেরকে দ্রুত বাড়ি পাঠানো হবে, যদিও কোনো দয়ায় নয় (“কেন আমরা ওইসব বেজন্মাদের খাওয়াব?” একজন সিনিয়র ভারতীয় কর্মকর্তা ক্যারোলকে জিজ্ঞেস করেছিলেন।) ভারত তখন তার সৈন্য প্রত্যাহার করবে।
ভারতীয়রা অনুমান করে চিন কিছুটা ঝামেলা সৃষ্টি করতে চেষ্টা করবে। তারা পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তার চেষ্টা করবে। এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটা গিলতে অস্বীকৃতি জানাবে এবং ইসরায়েলের মত অবস্থায় থাকতে চেষ্টা করবে।
দীর্ঘমেয়াদে, পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র বাহিনী যে চরম দুর্ভোগে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের তা বহুদিন বয়ে বেড়াতে হবে।
কিন্তু ৯ দিনের সামরিক সংঘর্ষ শেষ হয়েছে। তবুও পাকিস্তানি বাহিনী এখনও মজুদ সৈন্য আছে তার কমান্ডার আত্ম
বিশ্বাসী ছিল।
ভারতীয় স্ট্র্যাটেজিস্টরা অনুমান করে নিয়েছিল, এবং পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন যে, এক্ট-৪ হতে পাড়ে একটি যবন মৃত্যু আইন। কিন্তু এই সময়ে এক্ট- ৩ এ নামতে হচ্ছে। শনিবারের একটি সংক্ষিপ্ত সময়ের পর, “একটি খুব খারাপভাবে শোনা রেডিও ট্রান্সমিটার নিজেকে রেডিও পাকিস্তান হিসেবে ঘোষণা করে,এখনও বিবিসির মনিটর ঢাকা থেকে তুলে নিতে পারে – রেডিও ঢাকা শেষ পর্যন্ত ম্লান হয়ে যাচ্ছে। বাংলায় পাঞ্জাবি শাসনের শব্দ কোন, “জয়বাংলা!”র আওয়াজে চাপা পরে গেছে।