২০ শে মে ধরা পড়ার পর আমাকে ফিল্ড ইন্টেলিজেন্সের কাছে অর্পণ করা হয়। সেখানে হাবিলদার মেজর মাসুদ প্রথম লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে। পরে শরীরের সমস্ত জামা কাপড় খুলে চিৎ করে ফেলে পায়ের তলাতে লাঠি দিয়ে বেদম প্রহার শুরু করে। সারাদিন অভুক্ত অবস্থাতেই এই প্রহার চলে। এরপর আমাকে এফ, আই এর নিকটে একটি সেলের মধ্যে পুরে রাখলো। তখন আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। সেখানে তখন প্রায় ৩৪ জন বন্দী অবস্থায় ছিলেন। ২০ টা থালাতে এই ৬৪ জন বন্দীকে খেতে হতো। পরিষ্কার না করেই উক্ত থালাতে খেতে হতো।
সারাদিন একবার খাদ্য দিতো। নামাজের সময় অজু করার জন্য ২ মিনিট করে সময় দিতো। যদি বেশি সময় লাগতো তা হলে তার উপর মারপিট শুরু হয়ে যেত। মাঝে মাঝে বন্দীদের দিয়ে গাড়ির চাকা পরিষ্কার করাতো।
খাদ্যের দরুণ প্রায় বন্দীদের পেটের অসুখ হয়। তার ফলে তারা প্রায় ঘরের মধ্যে পায়খানা করে ফেলতো। তখন তাদের প্রহার করা হতো বেদমভাবে।
একদিন চার পাঁচজন যুবককে ধরে নিয়ে আসে। তাদের পা এমনভাবে বাঁধা ছিল যে খাড়া হয়ে তারা চলতে পারতো না। তাদের বিড়ালের মত হাঁটু ও হাত দিয়ে হেঁটে যেতে হতো। পিছনে পাকসেনারা লাঠি দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যেতো। মনে হতো যেন গরুর পাল তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
বন্দীদের হত্যা করার সময় মেজর ওমর খুরশীদ নিজে আসতো এবং যাদের হত্যা করা হবে তাদের নামের লিস্ট করে নিয়ে যেতো। পরে তাদের হত্যা করা হতো।
কয়েকজন মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের উপর দিকে পা বেঁধে তাদের লাঠি দিয়ে প্রহার করতো।
একদিন সাধু প্রকৃতির একজন লোককে ধরে নিয়ে আসে। তাকে গুপ্তচর সন্দেহ করতো। দশ বার হাত দূর হতে দৌড়ে এসে উক্ত সাধু প্রকৃতির লোকের বুকে বুট সমেত লাথি মারতো আর বলতো তুমি ভারতীয় বাহিনীর গুপ্তচর। বুটের আঘাতে পড়ে গেলে তার পায়ে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করতো। পরে তাকে তুলে আবার বুকে বাঁট দিয়ে আঘাত করতো।
এইভাবে প্রায় আড়াই মাস ধরে অত্যাচার করে। প্রায় ৬০ জনকে এই ঘর হতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করে।
৩১শে জুলাই ১৪ জনকে বন্দীশালা হতে ক্যান্টনমেন্টের প্রাইমারী স্কুলে নিয়ে যায়। সেখানে ৩ রা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই স্কুলে বন্দী করে রাখে।
কয়েকজন মুক্তিফৌজকে ধরে নিয়ে এসে একদিন বেদম প্রহার করে। প্রত্যেকদিন মুক্তিফৌজ নামে কয়েকজন যুবককে দিনের বেলায় বাইরে বের করে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে সন্ধ্যার দিকে ঘরে নিয়ে আসতো। এই ভাবে তাদের সারা শরীর ফুলে ও পরে পচে গিয়ে পোকা হয়ে গিয়েছিলো। তাদের জিজ্ঞাসা করতো ভারতের কোথায় কোথায় ট্রেনিং চলছে। তারা এত অত্যাচারের মুখেও গোপন তথ্য প্রকাশ করতো না। এক মাস পরে তাদের একদিন রাতে নিয়ে যায়। পরে তাদের আর কোন দিন দেখা যায়নি। সন্ধ্যার দিকে যখন বন্দীদের গুনতো তখন চামচ দিয়ে প্রত্যেকের বুকে একটা করে ভীষণ জোরে আঘাত করতো। মনে হতো যেন বুকের হাড় যেন বুঝি ভেঙ্গে গেল। এইখানে বন্দী অবস্থায় একটা ২০০ গজ ট্রেঞ্চে সবার সামনেই প্রত্যেককে পাশাপাশি বসে পায়খানা করতে হতো।
৪ঠা সেপ্টেম্বর তারিখে স্কুল হতে যশোর সেন্ট্রাল জেলে নিয়ে যায়। সেখানে কতৃপক্ষ বাঙ্গালী থাকায় জেল খানাতে কোন মারপিট হয়নি।
আমাদের সাথে একজন পাঠান ছিলেন বন্দী। কারণ সেই পাঠান এক গ্রামে আগুন লাগাতে অস্বীকার করায় মেজরের সাথে গোলমাল হয় এবং মেজরকে একটা চড় লাগায়। ফলে তার নয় মাস জেল হয়েছিলো।
স্বাক্ষর/-
সৈয়দ আলী ইমাম
এস, ডি, ও, এম, ই, এস; (আর্মি)
যশোর ক্যান্টনমেন্ট, যশোর
২৪/০৩/১৯৭৩