শিরোনামঃ পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপক সভার কার্য বিবরণীর একটা অংশ
সুত্রঃ প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভা
তারিখঃ ১৫ই মার্চ ১৯৪৮
জনাব ধীরেন্দ্র নাথ দত্তঃ স্যার, সংসদ-র বাইরে খুব গোলমাল চলছে, ছেলেদের উপর কোন অত্যাচার হচ্ছে কিনা আমরা তা জানতে চাই।
ড. প্রতাপ গুহ রয়ঃ সভাপতি সাহেব, যদিও আমাদের মুলতবির প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারি নাই তাহলেও ঐ মুলতবি সম্বন্ধে আমাদের আইনসভা-এর নেতা কোন বিবৃতি দেবেন কি?
মাননীয় জনাব খাজা নাজিমুদ্দিনঃ স্যার, আমি যে কারণে বিলম্ব করেছি তা হল আমি সংগ্রাম পরিষদের সাথে সাক্ষাৎ করছিলাম। আমাদের মধ্যে একটি চুক্তি সাক্ষরিত হয়েছে এবং আমি এই লোকগুলোকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। আমাদের মধ্যে একটি বোঝাপড়া ছিল যে তারা সংসদ ও সচিবালয়ের নিকট আসবে না; কিন্তু আমি প্রমাণসহ পেলাম যে তার সংসদ কক্ষের খুব কাছে এসেছে এবং আন্দোলন করছে। চুক্তি অনুসারে আমি সকল পুলিশ তুলে নিয়েছি এবং তারা তাদেরকে সংসদ ও সচিবালয় ভবনের সামনে ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানিনা কী ঘটছে এবং আমি মনে করি কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা ঘটবে না। আমাদের অবস্থান হল এই, জনাব, যদি তারা সংসদ সংলগ্ন রাস্তায় না আসে তাহলে তাদেরকে উৎপীড়ন করা হবে বলে আমি মনে করি না।
ড. প্রতাপ চন্দ্র গুহ রয়ঃ স্যার, ১১ তারিখের ঘটনা সম্বন্ধে কোন বিবৃতি দিবেন কিনা?
মাননীয় জনাব খাজা নাজিমুদ্দিনঃ এ সম্বন্ধে আলোচনা সংসদীয় দলের সভায় হয়ে গিয়েছে এবং তার বিবৃতি করা হয়েছে, সে সম্বন্ধে তার অধিক আলোচনা ভাল মনে করি না।
জনাব প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ীঃ মাননীয় সভাপতি সাহেব, আইনসভার বাইরে যে কি হচ্ছে এবং ছাত্র ডেমোন্সট্রেটর-দের উপর কোন অত্যচার হচ্ছে কিনা সেটা একবার দেখে এলে ভাল হোত।
মাননীয় জনাব খাজা নাজিমুদ্দিনঃ আপনার অনুমতি অনুসারে, স্যার, কি ঘটেছে সে সম্পর্কে একটি বিবৃতি প্রদান করতে চাই (প্রতিবন্ধকতা) । দয়া করে আমার কথা শুনুন। দয়া করে আমার যা বলার আছে তা শুনুন (প্রতিবন্ধকতা)।
জনাব স্পিকারঃ আমি সদস্যদের অনুরোধ করছি হাউজের কার্যপ্রণালী অনুসরণ করার জন্য। মাননীয় সংসদ নেতা এই বিষয়ে একটি বিবৃতি দিবেন এবং আপনাদের নিকট আমার অনুরোধ তার কথা শুনুন।
জনাব মনোরঞ্জন ধরঃ স্যার, আমি নিজে দেখে এলাম এবং প্রধান মন্ত্রীর নিজে গিয়ে দেখা উচিত যে বাইরে কি হচ্ছে। সত্যই যদি এখানে ছাত্রদের উপর পুলিশের কোন অত্যাচার হয় তাহলে সেটা বড় দুঃখের বিষয় হবে।
মাননীয় জনাব খাজা নাজিমুদ্দিনঃ স্যার, সকাল হতে আমি সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনা সভায় ছিলাম যেটাতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব আছে যারা এই আন্দোলন শুরু করেছে। আমাদের আলোচনার ফল স্বরুপ আমরা কিছু নির্দিষ্ট চুক্তিতে পৌঁছেছি এবং তাদেরকে জেলে যাওয়ার ও সেখানে কারা আছে তা দেখার অনুমতি প্রদান করা হয়েছে। তারা ফিরে এসেছে এবং চুক্তিতে সই করেছে। যারা জেলে আছে তাদের সকলকে মুক্ত করে দেওয়ার আদেশ আমি দিয়েছি। তারা চেয়েছিল আমি যেন সকল পুলিশ তুলে নেই। বিধানসভা ও সচিবালয় বাদে অন্য জায়গার পুলিশ তুলে নেওয়ার আদেশ আমি দিয়েছি। আমি তাদের নিশ্চয়তা দিয়েছি এবং আদেশও করেছি যেন সকল পুলিশ তুলে নেওয়া হয়। তাদের উচিত নয় সংসদের সামনে আসা। তারা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে কিন্তু সংসদের সামনে যেন না আসে। তারা রমনা অথবা অন্য কোন জায়গায় যেতে পারে। আমি জানি না কি ঘটেছে, তারা কেন এখানে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে? এই হল চুক্তির একটি কপি। সচিবালয় ও বিধানসভা বাদে অন্য জায়গা থেকে পুলিশ সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি সংগ্রাম পরিষদ বর্জিত হয়েছে, অথবা কি হয়েছে আমি তা জানি না। (হইচই)
আপনি যদি চান তবে চুক্তির কপিটি পড়তে পারি।
“সংযুক্ত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর নিম্নোক্ত বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছেঃ
১. ২৯শে ফেব্রুয়ারি ১৯৪৮ থেকে বাংলা ভাষা ইস্যুতে যাদেরকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাদেরকে অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া হবে।
২. মাননীয় প্রধান মন্ত্রী পুলিশ কর্তৃক আনা বাড়াবাড়ির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্ত করবেন, এবং এক মাসের মধ্যে বিবৃতি প্রদান করবেন।
৩. এপ্রিল, ১৯৪৮ এর প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলার বিধানসভার অদাপ্তরিক বিষয়ের জন্য একদিন বরাদ্দ থাকবে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পাক সংসদ ও কেন্দ্রীয় সরকারী পরীক্ষায় উর্দুর সমমর্যাদা প্রদান করার জন্য বিশেষ প্রস্তাব আনা হবে।
আজকের দলীয় সম্মেলনে এই বিষয়গুলো আলোচনা করা হবে।
৪. ইংরেজি ভাষা পরিবর্তন করার সাথে সাথেই বাংলাকে এই প্রদেশের দাপ্তরিক ভাষা বানানোর প্রস্তাব করে এপ্রিলে বিধানসভায় দাপ্তরিক ঘোষণা উত্থাপিত হবে, এবং নির্দেশনা প্রদানের মাধ্যম হবে বাংলা কিন্তু স্কুল ও কলেজে সংখ্যা গরিষ্ঠ ছাত্রদের ভাষা প্রাধান্য পাবে।
৫. এই আন্দোলনে যারা অংশগ্রহন করেছে তাদের কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হবে না।
৬. পত্রিকা সমূহের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।
৭. ভাষা সংক্রান্ত কারণে পূর্ব বাংলার যেসব স্থানে ২৯শে ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪৪ ধারা জারি হয়েছে সেসব স্থান থেকে তা তুলে নেওয়া হবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর। আমি তৃপ্ত যে এই আন্দোলন রাষ্ট্রের শত্রুদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি।
ড. এ. এম. মল্লিকঃ মাননীয় সভাপতি সাহেব, আমাদের বিধানসভা নেতা যে বললেন সব জায়গা হতে পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছে কিন্তু আমি দেখে এলাম পুলিশ তুলে নিয়ে মিলিটারি বসান হয়েছে।
জনাব আবু তাইয়্যাব মাজহারুল হকঃ স্যার, আপনি নিজে গিয়ে দেখুন।
মাননীয় জনাব খাজা নাজিমুদ্দিনঃ এখানে মিলিটারি প্রথম থেকে বসান ছিল, এখানে মিলিটারি শুরু থেকেই বসান ছিল এবং অন্যান্য জায়গা থেকে পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছে। তারা পুরো রমনা জুড়ে, কিন্তু ঐসব জায়গা থেকে পুলিশ তুলে নেওয়া হয়েছে এবং কোন গ্রেফতার করা হয়নি, কাউকে বাধা গ্রস্ত করা হয়নি। চুক্তি ছিল এই যে তারা বিধানসভার সামনে আসবে না ও সচিবালয়ে যাবে না, কিন্তু তারা যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারে। (কক্ষে বড় ধরণের হইচই)
জনাব মফিজুদ্দীন আহমেদঃ স্যার, ১১ তারিখে যে সমস্ত ছাত্রদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছি কি?
জনাব আব্দুল মমিনঃ একজনে বললে ভাল হয়।
জনাব সামসুদ্দীন আহমেদঃ স্যার, আমি যখন আসি তখন বহু জায়গায় পুলিশ দেখেছি। কি চুক্তি হয়েছে তা আমি জানি না। যাই হউক তিনি যে চুক্তিটি পড়লেন ওটা বহু গণ্ডগোলের ব্যাপার, তিনি যদি ব্যাপারটা নিজে গ্যে একবার দেখে আসেন তা হলে ভাল হয়।
জনাব মুহাম্মদ আলিঃ স্যার, এ সময়ের মধ্যে অবশ্যই নতুন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মনে হচ্ছে যে প্রদর্শনকারীরা এখানে আসতে চায় কারণ এটাই একমাত্র ফোরাম যেখানে জন প্রতিনিধিরা তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে থাকে। অতএব ব্যাপারটি আইনসভার একটি বৈঠকে নেয়া উচিত। আমি সুপারিশ করি না যে প্রধান মন্ত্রীকে ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত থাকা উচিত এবং তাদের ক্ষোভ সমূহ কি তা দেখা উচিত। এটা অপেক্ষাকৃত ভাল হয় যে আপনি, স্যার, আপনার প্রতিনিধিদের উচিত যে প্রদর্শনকারীরা কি চায় এবং তাদের ক্ষোভগুলো কি কি তা খুজে বের করা, যাতে করে তারা বুঝতে পারে যে অবস্থাটা কি, এবং তাদের অভিযোগের কতটা প্রতিকার করা সম্ভব।
জনাব মসিহুদ্দীন আহমেদঃ সভাপতি সাহেব, আমি এই আইনসভাকে একটা সংবাদ দিচ্ছি, আপনারা জানেন যে একটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল কিন্তু এখনই শুনতে পেলাম যে জনাব গফুর ইউনিভার্সিটি প্রাঙ্গণে ঢুকে সেখানে মহিলা ছাত্রীদের উপর টিয়ার গ্যাস ছেড়েছে, তারফলে যে চুক্তি করা হয়েছিল তা নষ্ট হয়ে গিয়েছে এবং তার জন্যে বাহিরে বিক্ষোভ হচ্ছে, আমি আশা করি আইনসভার নেতা বাহিরে গেলে সব বুঝতে পারবেন। মি. গফুর এই অবস্থা তৈরি করেছে।
* * * * * *
বেগম আনোয়ারা খাতুনঃ স্যার, আমার একটা বক্তব্য আছে।
জনাব এ. কে. ফজলুল হকঃ পয়েন্ট অফ অর্ডার হিসেবে, স্যার, আমি সুপারিশ করছি যে আইনসভার নেতার উচিত বাহিরে যাওয়া এবং বাইরে কি হচ্ছে তা দেখা। এটা যতক্ষণ পর্যন্ত করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত আইনসভার কার্যক্রম চলমান থাকতে দেব না আমরা। আমাদের অনুভূতি এভাবে নিষ্পিষ্ট হতে পারে না। এইটা ছেলেখেলা নয়। আইনসভার নেতার উচিত এখনই বাইরে যাওয়া। তার অবশ্যই যাওয়া উচিত, অবশ্যই যাওয়া উচিত, অবশ্যই যাওয়া উচিত।
আনোয়ারা খাতুনঃ স্যার, আমার একটা বক্তব্য আছে।
মি. স্পিকারঃ জনাব ফজলুল হক, আম খুব দুঃখের সাথে বলছি যে আপনি যা বলেছেন তা কোন পয়েন্ট অফ অর্ডার নয়। পুরনো সাংসদ হিসেবে আপনার জানা উচিত কোনটা পয়েন্ট অফ অর্ডার আর কোনটা পয়েন্ট অফ অর্ডার নয়। ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ের উপর নেতা বিবৃতি দিয়েছেন। এরপর এই বিষয়ে কোন পদক্ষেপ নেওয়ার কথা আমি তাকে বলতে পারি না। সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে পূর্ণ সচেতন। যদি আপনি তা মনে করেন তবে আইনসভার বাইরে তাকে এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলতে পারেন।
জনাব ধীরেন্দ্র নাথ দত্তঃ মি. স্পিকার, স্যার, বেগম আনোয়ারা খাতুন কিছু বলতে চাচ্ছেন।
মিসেস আনোয়ারা খাতুনঃ স্যার, গত ১১ই মার্চ তারিখে যা হয়েছে , তা হয়েছে। আজ পুলিশ মেয়েদের গায়ে হাত দিয়েছে, গলা টিপে মেরেছে, তার প্রতিকার চাই। ঐ সমস্ত চোরামি এখানে চলবে না। আমরা চাই প্রধান মন্ত্রী সেখানে গিয়ে আসুন।
* * * * *
জনাব সামসুদ্দীন আহমেদঃ স্যার, মেয়েদের গায়ে পুলিশ হাত তুলেছে। আমরা এর প্রতিকার চাই। এই মুহূর্তে সকলের পদত্যাগ করা উচিত।
মি. স্পিকারঃ আইনসভা বিকাল ৪.৫৫ পর্যন্ত মুলতবি থাকবে।
* * * * *
বিরতির পর
জনাব মুহাম্মদ আলীঃ স্যার, আমি একটা সুপারিশ করেছিলাম যে আপনার উচিত ব্যাপারটি আপনার নিজের হাতে নেওয়া যেহেতু বিধানসভার সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন চলছে। স্যার, এটা সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিদের আইনসভা এবং যখন কিছু মানুষ আমাদের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করছে, আমরা জানতে চাই তাদের অভিযোগ গুলো কি কি এবং কিভাবে তার প্রতিকার করা যায়। আপনার দপ্তরে আইনসভার কিছু সদস্য ও বিক্ষোভকারীদের কিছু প্রতিনিধি নিয়ে একটি পরামর্শ সভার আয়োজন করে ব্যাপারটি নিজের হাতে নেওয়ার জন্য আপনিই সর্বোত্তম লোক। এবং তখন আমরা তাদের অভিযোগ কি কি এবং সেগুলোর প্রতিকার আইনসভার এখতিয়ারে পড়ে কিনা তা জানতে চাওয়ার অবস্থানে যেতে পারব। আমি, স্যার, জানতে চাই আমার সুপারিশ অনুযায়ী কী প্রস্তাব করেন।
জনাব মুহাম্মদ রুকুনুদ্দীনঃ জনাব স্পিকার, স্যার, ছেলেরা আমাদের প্রাণ; ছেলেদের শান্তি আমাদের শান্তি; তাদের অশান্তি আমাদের অশান্তি; গত ২/৩ দিন যাবৎ যা চলছে তা নিতান্তই অপ্রীতিকর। একটা সমঝোতা হওয়ায় আমরা আনন্দিত ও নিশ্চিন্ত হয়েছিলাম। কিন্তু সে সমঝোতা ভঙ্গ হয়েছে। আমাদের দেখা দরকার কি জন্য কাদের উস্কানিতে এমন একটা সুন্দর সমঝোতা ভঙ্গ হল, একটা তদন্ত হওয়া উচিত এবং যারা এর জন্য দায়ী তাহাদের উপযুক্ত বিচার হওয়া উচিত।
* * * * *