#ছাত্রলীগের_কাউন্সিলের_ব্যাপারে_বঙ্গবন্ধু
ঢাকায় এসে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন যাতে তাড়াতাড়ি হয় তার ব্যবস্থা করলাম। এর পূর্বে আর কাউন্সিল সভা হয় নাই। নির্বাচন হওয়া দরকার, আর আমিও বিদায় নিতে চাই। ঢাকার তাজমহল সিনেমা হলে কনফারেন্স হল আমার সভাপতিত্বে। আমি আমার বক্তৃতায় বললাম, ‘আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্টানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্টানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নাই। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই। তবে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ যে নেতৃত্ব দিয়েছে, পূর্ব বাংলার লোক কোনোদিন তা ভুলতে পারবে না। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য যে ত্যাগ স্বীকার আপনারা করেছেন এদেশের মানুষ চিরজীবন তা ভুলতে পারবে না। আপনারাই এদেশে বিরোধীদল সৃষ্টি করেছেন। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না’। এটাই ছিল বক্তৃতার সারাংশ। একটা লিখিত ভাষণ আমি দিয়েছিলাম, আমার কাছে তার কপি নাই। নির্বাচন হয়েছিল, দবিরুল ইসলাম তখন জেলে ছিল। তাকে সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। দবিরুল সম্বন্ধে কারও আপত্তি ছিল না, তবে খালেক নেওয়াজ খান সম্বন্ধে অনেকের আপত্তি১২৭ছিল। কারণ সে কথা একটু বেশি বলত। শেষ পর্যন্ত আমি সকলকে বুঝিয়ে রাজি করলাম। আমার বিদায়ের সময়ের অনুরোধ কেউই ফেলল না। আমি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছি, আমার মনোনীত প্রার্থী খালেক নেওয়াজ প্রতিষ্টানের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি করেছিল। সে চেষ্টা করত সত্য, কিন্ত কোন সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা তার ছিল না। আর অন্যের কথা শুনত, নিজে ভাল কি মন্দ বিবেচনা করত না, বা করার ক্ষমতা ছিল না। একমাত্র ঢাকা সিটি ছাত্রলীগের সম্পাদক আবদুল ওয়াদুদের জন্য প্রতিষ্টানের সমূহ ক্ষতি হতে পারে নাই। পরে ওয়াদুদ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সম্পাদক হয়েছিল। যদিও আমি সদস্য ছিলাম না, তবু ছাত্রনেতারা আমার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেছেন। প্রয়োজন মত বুদ্ধি পরামর্শ দিতে কার্পণ্য করি নাই। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্টাতা হিসাবে শ্রদ্ধা করেছে।শামসুল হক সাহেব অনেক পরিশ্রম করে একটা ড্রাফট ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্রের খসড়া করেছেন। আমাদের নিয়ে তিনি অনেক আলোচনা করেছিলেন। আমরা একমত হয়ে ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র নিয়ে আলোচনা শুরু করলাম। কয়েকদিন পর্যন্ত সভা হল। দুই একবার শামসুল হক সাহেবের সাথে ভাসানী সাহেবের একটু গরম গরম আলোচনা হয়েছিল। একদিন শামসুল হক সাহেব ক্ষেপে গিয়ে মওলানা সাহেবকে বলে বসলেন, ‘এ সমস্ত আপনি বুঝবেন না। কারণ, এ সমস্ত জানতে হলে অনেক শিক্ষার প্রয়োজন, তা আপনার নাই’। মওলানা সাহেব ক্ষেপে মিটিং স্থান ত্যাগ করলেন। আমি শামসুল হক সাহেবকে বুঝিয়ে বললে তিনি বুঝতে পারলেন, কথাটা সত্য হলেও বলা উচিত হয় নাই। ফলে হক সাহেব নিজে গিয়ে মওলানা সাহেবকে অনুরোধ করে নিয়ে আসলেন। শামসুল হক সাহেবের রাগ বেশি সময় থাকত না।মওলানা ভাসানী সাহেবকে ভার দেওয়া হয়েছিল ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের নমিনেশন দিতে। তিনি যে সমস্ত লোককে নমিনেশন দিয়েছিলেন তা আমার মোটেই পছন্দ ছিল না। তাঁকে আমি বললাম, ‘আপনি এ সমস্ত লোক কোথায় পেলেন, আর ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করলেন; এরা তো সুযোগ পেলেই চলে যাবে’। মওলানা সাহেব বললেন, ‘আমি কি করব? কাউকেই তো ভাল করে জানিও না, চিনিও না। তোমার ছাত্ররা যাদের নাম দিয়েছে, তাদেরই আমি সদস্য করেছি’। আমি বললাম, ‘দেখবেন বিপদের সময় এরা কি করে’। ওয়ার্কিং কমিটি ড্রাফট ম্যানিফেস্টো গ্রহণ করল এবং কাউন্সিল সভা ডেকে একে অনুমোদন করা হবে ঠিক হল। ড্রাফট ম্যানিফেস্টো ছাপিয়ে দেওয়া হবে, কারও কোন প্রস্তাব থাকলে তাও পেশ করা হবে। জনমত যাচাই করার জন্য আমরা ড্রাফট রাখলাম। তাতে পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দিবার প্রস্তাব করা হল। কেবলমাত্র দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করতে হবে এ কথাও বলা হল। আরও অনেক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রোগ্রাম নেওয়া হয়েছিল।আমরা প্রতিষ্টানের কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও আমি ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় প্রথম সভা করতে যাই।
#অসমাপ্ত_আত্মজীবনী #সংগ্রামের_নোটবুক #ভাসানী #ছাত্রলীগের_কাউন্সিলে_বঙ্গবন্ধু
ছবি – ১৯৭০ সালের। ফাইল ফটো।