১৯৭১ সালের ১৫ ই অক্টোবর ২০/২৫ জন পাক মিলিটারী রাত প্রায় ১১ টায় আমাদের বাড়িতে চলে যায়। আমাদের বাড়ী ঘেরাও করে আমাকে নাম ধরে ডাকলে আমি ঘর হতে বেরিয়ে আসি। সঙ্গে সঙ্গে দুজন পাকসেনা আমার দুহাত ধরে ফেলে এবং গামছা দিয়ে পিঠমুড়া করে দুহাত বেঁধে ফেলে দেয়। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় এবং একজন চাকর ঘরের মধ্যে শুয়ে ছিলো তাকেও ধরে ফেলে এবং আমার নিকটে নিয়ে আসে। একজন সুবেদার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে। তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার? তোমার গ্রামে কয়জন মুক্তিবাহিনী আছে? তুমি মুক্তিবাহিনীকে আমাদের খবরাখবর পৌছে দাও? তাদের সবগুলো কথার জবাব আমি অস্বীকার করি। তারপর আমাকে হুমায়ূন কবির নামে একজন পাঞ্জাবী ফোন অপারেটার ৪/৫ টা ঘুষি মেরে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তারপর আমাকে মোটা একটা কাঠের লাঠি দিয়ে সমস্ত শরীরে আঘাত করে আর জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে সত্যি করে বলো তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার নয়। তারপর আরও ৮/৯ জন মিলিটারী আমার নিকটে চলে আসে এবং তারা প্রত্যেকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করে বুট দিয়ে লাথির পর লাথি মারতে থাকে। তাদের মধ্যে একজন ছোট ১২/১৪ বছরের বিহারী ছেলে ছিল। সে আমাকে ২/৩ হাত দূর থেকে জাম্প করে এসে আমার বুকে আঘাত করে। তারপর আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। প্রায় একঘণ্টা পর আবার জ্ঞান ফিরে পেলে আমাকে স্কুলের দোতালায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে গিয়ে একটা আকড়ার সাথে দুহাত ঝুলিয়ে বেতের লাঠি দিয়ে শরীরে বেদম প্রহার করার দরুন সমস্ত শরীর ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। প্রায় ১৫/২০ মিনিট আমাকে মারার পর আমি যে কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি তা আমি বলতে পারি না। তারপর জ্ঞান ফিরে পেলে আমি দেখতে পাই আমি একটা ঘরের মধ্যে পড়ে আছি।
তারপর ৭ দিন আমাকে বিভিন্ন উপায়ে প্রহার করার পর আমি হাঁটতে চলতেও একস্থান হতে অন্যস্থারে সরে যেতে না পারার জন্য আমাকে প্রহার করা বাদ দেয়। আমি আধা মরা অবস্থায় ঘরের একটা কোণে পড়ে থাকি। আমাকে ধরার দুদিন পর আমার চাকরটাকে ছেড়ে দেয়।
তারপর মেজর ২৬শে অক্টোবর আমাকে ডাকে। ৪/৫ জন মিলিটারী ধরাধরি করে আমাকে মেজরের সামনে এসে হাজির করে। মেজর আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে থাকে তুমি সত্য করে বলো মুক্তিবাহিনী তোমাদের বাড়ীতে আসে কিনা? তোমার ভাই মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার কি না? তোমাদের গ্রামে কতজন ছেলে মুক্তিবাহিনী হয়েছে? সবগুলো প্রশ্নের উত্তর আমি অস্বীকার করি। তারপর মেজর একজন সুবেদার ডাকে। উক্ত সুবেদার মেজরের নিকট আসলে মেজর তাদের আদেশ করে এই লোক কোন দোষী নয়। একে গাড়িয়ে করে তার বাড়ীতে রেখে এসো। তারপর আমাকে গাড়িতে করে আমার বাড়ী পৌছে দিয়ে আসে। অর্থাৎ ২৬ শে অক্টোবর আমি ছাড়া পাই। তারপর আমি বাড়ী গিয়ে তিনমাস স্থানীয় চৌগাছ বাজারের একজন ডাক্তারের নিকট চিকিৎসায় ভাল হয়ে উঠি। এখন আমি চলে ফিরে খেতে পারি। কিন্তু কাজকর্ম করে খাবার মত কোন সামর্থ্য আমার নেই। এখনও মেঘ বৃষ্টি হলে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বেদনা করে, আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি।
চৌগাছা সরকারী ডাক বাংলোর পিছরে ২০/২৫ টা কবরে প্রায় ৭০/৮০ জনকে প্রত্যেক দিন প্রায় ৮/১০ জন করে লোককে ব্যায়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে আধা মরা করে ২/৩ জনকে একই ছালার মধ্যে ভরে ছালার মুখ বেঁধে উক্ত কপোতাক্ষ নদীতে ফেলে দিয়েছে। উক্ত নদীর উপর একটা ব্রীজ আছে, সেখানেও নিয়ে গিয়ে ব্যায়োনেট চার্জ করে নদীতে ফেলে দিয়েছে। অনেককে উক্ত নদীর উপর যে ব্রীজ পার হয়ে নদীর পশ্চিম পাড়ে প্রায় ৩০/৪০ টা করে ৮০/৯০ জন লোককে মেরে পুঁতে রেখেছে। যে সমস্ত লোক পাকসেনারা চৌগাছায় মেরেছে এবং তাদের ক্যাম্পের আশাপাশে পুতে রেখেছে এর মধ্যে অধিকাংশই শরণার্থী। কারণ তারা কাশিমপুর মাশিলা হিজলী বর্ডার দিয়ে ভারতে যাবার সময় পাকসেনারা তাদেরকে ধরে এবং চৌগাছায় তাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসে। তারপর নৃশংসভাবে হত্যা করে পুঁতে রাখে। এইবাবে দীর্ঘ নয় মানে চৌগাছাতে পাকসেনারা ১০০/১৫০ জন লোককে হত্যা করে। তাদের মধ্যে মেয়ে ও পুরুষ উভয়ই ছিল। মেয়েদেরকে ২/৩ দিন রেখে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার করার পর ব্যায়োনেট চার্জ করে নদীতে ফেলে দিত। আমি যে এগার দিন ছিলাম ঐ কয়দিনে প্রায় ২০/২৫ জন লোককে ডাক বাংলোর পিছরে রাত আটটার পর প্রতিদিন ৪/৫ জন করে হত্যা করে পুঁতে রাখে।
স্বাক্ষর/-
মোঃ মোহসিন উল্লাহ
গ্রাম-চৌগাছা
থানা-ঝিকরগাছা, জেলা-যশোর
১০/০৫/৭৩