দ্যা সানডে টেলিগ্রাফ, ১৬ এপ্রিল, ১৯৭১
শেখের সমর্থকরা সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে ব্যার্থ হয়েছিল
সাইমন ড্রিং
পুর্ব পাকিস্তানে অগ্রসরমান পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালিদের কার্যকর এবং দীর্ঘ মেয়াদি প্রতিরোধ প্রক্রিয়া যে শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে যাবে, এ নিয়ে খুব একটা সন্দেহ নেই। যদিও তথাকথিত “বাংলাদশ মুক্তিবাহিনী” অনেক সফলতার খবর শোনা যাচ্ছে, তবে এরকম কিছুর অস্তিত্ব আদৌ আছে কি না সন্দেহ।
যেসব স্থান থেকে প্রতিরোধের খবর পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো মূলত যেসব স্থানে এখনও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সমন্বিতভাবে অগ্রসর হয়নি, অথবা যেসব স্থানে স্থানীয় পুলিশ বাহিনী অথবা ইস্ট বেঙ্গল রাইফেলসের কিছু সেনা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
কিন্তু পুরো দেশব্যাপি একটি সমন্বিত প্রতিরোধ পরিকল্পনা, যা কি না একটি দৃঢ় সামরিক আক্রমনের সম্মুখে কিছু হলেও দাঁড়াতে পারে, চোখে পরছে না।
শেখ মুজিবের সমর্থকরা যদিও গতমাসের এই সেনা অভিযান শুরুর আগে তারা কিভাবে যুদ্ধ করবেন সেসব নিয়ে অনেক কথাই বলেছিলেন, কিন্তু তারা আসলে প্রায় কিছুরই প্রস্তুতি নেননি। তারা অনেক সরব ও আক্রমণাত্মক মিছিল করেছে বটে, কিন্তু তাদের কোন সাংগঠনিক প্রস্তুতি ছিল না, তাদের কোন ট্রেনিং ছিল না, ছিল না কোন অস্ত্র, এবং পাক সেনারা ঢাকায় যেটা প্রমান করেছে, তাদের যুদ্ধ সামাল দেবার কোনই প্রস্তুতি ছিল না।
পাকিস্তানি সেনা বাহিনী যখন যথেষ্ট পরিমান সৈন্য আর অস্ত্রপাতি এনে ফেলবে, তখন তারা এই বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ প্রচেষ্টাগুলোকে ঢাকাকে তারা যেভাবে দমন করেছে, একইভাবে দমন করে ফেলবে।
গেরিলাদের স্বর্গ
যদিও মনে হচ্ছে না যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জন্য গ্রাম অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রন করা খুব জরুরী। তারা সম্ভবত জনবহুল এলাকাতে ঘাঁটি গেঁড়ে বসে থাকার চেয়ে বেশি কিছু করবে না।
এদেশের গ্রামাঞ্চল হচ্ছে নিচু ধানক্ষেত, কলাগাছের জঙ্গল, পাটক্ষেত, চা বাগান, নদী আর জঙ্গলে ভরা এক গোলকধাঁধা এবং গেরিলা যুদ্ধের জন্য আদর্শ। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীও সেটা জানে।
কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত বাঙ্গালীদের মধ্যে থেকে কোন নেতার উদ্ভব হয়, অথবা যেটা আরো গুরুত্বপুর্ন, কেউ তাদেরকে অস্ত্রের সরবরাহ না দেয়, ততক্ষন পর্যন্ত বাঙ্গালীরা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
মার্চের উত্তাল প্রথম তিন সপ্তাহে, যখন মনে হচ্চিল বাঙ্গালীদের স্বাধীনতা অর্জন কেবল সময়ের ব্যাপার মাত্র, শেখ মুজিব ও তাঁর দল গ্রামে গ্রামে যোদ্ধা সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন বটে। পুর্ব পাকিস্তানীদের স্বপ্ন এমন নাটকীয় ও রক্তাক্তভাবে ভেঙ্গে চৌচির হবার মাত্র কয়েকদিন আগেই আমি ঢাকার বাইরে এরকম কয়েকটি জায়গায় গিয়েছিলাম।
এরকম একটি গ্রামে, যেখানে প্রায় ১,০০,০০০ এর বেশি লোক থাকে, প্রায় ৩০০ জনকে বেছে নেয়া হয়েছিল। একজন ধুসর দাঁড়িওয়ালা প্রাক্তন ব্রিটিশ ভারত সেনাবাহিনীর এনসিও এর নেতৃত্বে তারা গ্রামের চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে অতি উৎসাহের সাথে আলোচনা করতো তারা কি করবে সেসব নিয়ে।
কিন্তু এটা পরিস্কার বুঝা যাচ্ছিল যে তারা আসলে তাদের চোখা করা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে আর যুদ্ধ বিদ্যা শেখার চেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে প্যারেড করার ইচ্ছা দিয়ে খুব বেশি কিছু করতে পারবে না।
“আমরা রাস্তাঘাট আর ব্রিজ কেটে(ভেঙ্গে) দেব, আর শত্রুর কাছ থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেব” একজন বলেছিলেন। তবে মনে হয় না ঢাকায় তার সমগোত্রীয়রা যা করতে পেরেছেন তাঁর চেয়ে বেশি কিছু করার ক্ষমতা তার আছে।
স্বপ্নের জগৎ
রাজধানীতে ছাত্ররাও, যাদেরকে সেনারা আওয়ামী লীগের চরম সমর্থক হিসাবে মনে করে, এরকমই একটা স্বপ্নের জগতে বাস করছিল। তারাও সারাক্ষন আমৃত্যু যুদ্ধ করে যাবার ইচ্ছার কথা বলত।
কিন্তু তাদের কাছে ১৯৩০-৪৫ সালের যুদ্ধের সময়ের অল্পকিছু কিছু পুরনো রাইফেল, একই বয়সী কিছু পিস্তল, আর হাতে বানানো কিছু বোমা ছাড়া আর কিছুই ছিল না, এবং মার্চের ২৫ তারিখে যখন সেনাবাহিনী নামলো, তখন এগুলোর ব্যবহার দেখা যায়নি।
গোলাগুলি যখন শুরু হল, তখন সব ধরনের ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ, চিল্লাপাল্লা, এবং পাকিস্তানি সরকারের সামরিক শক্তির প্রকাশ্য অবাধ্যতা সবই দ্রুত বন্ধ হয়ে গেল। এবং এই একই নমুনা দেখা যাচ্ছে সারা দেশেও।
যখন আমি শহরের বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে গিয়ে মানুষজনকে প্রতিরোধ যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা জিজ্ঞেস করেছি, বেশিরভাগই কাঁধ ঝাকিয়ে অন্য দিকে চলে গিয়েছে।
এরাই ছিল সেই ছাত্ররা, সেই বুদ্ধিজীবীরা, ব্যবসায়ীরা, যারা মাত্র কয়েকদিন আগেই তাদের বাসাবাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছিলেন, যারা মাত্র আগেরদিন বিকালেই সরকার বিরোধী মিছিলে অংশগ্রহন করেছিলেন।
এখন যেখানে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ গনহত্যার শিকার হয়েছে, স্বাভাবিক ভাবেই তাদের এখন “অস্ত্রের মুখে আমরা কিই বা করতে পারি” বলা ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
এখন সম্ভবত যাদের পক্ষে কিছুটা হলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব তারা হচ্ছে গোপন বামপন্থী দল ও সমাজতান্ত্রীক দলগুলো। এখন পর্যন্ত তাদের নেতাদের গ্রেফতারের কোন খবর পাওয়া যায়নি।
এদের মধ্যে তিনটা প্রধান দল আছে যারা হয়ত সামরিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কিছু হলেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। এরা সবাই পিকিংপন্থী।
আমি এদের অনেকের সাথেই ঢাকায় মার্চের প্রথম দিকে গোপনে দেখা করেছি। তারা স্বীকার করেছে যে তাদের দল এখনও ছোট, আর তাদের হাতে অস্ত্র আছে সীমিত পরিমান।
তাদের একমাত্র সরবরাহ আসে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নকশাল বিপ্লবিদের কাছ থেকে, আর হয়ত কিছু আসে বার্মিজ বিদ্রোহিদের কাছ থেকে। তারা কাজ করে মূলত ঢাকা ও চট্টগ্রামের শিল্প এলাকাগুলোতে, এবং উত্তরাঞ্চলের গ্রামের দিকেও তাদের অল্প উপস্থিতি আছে। তাদের সহায়তা আসে প্রধানত ট্রেড ইউনিয়নগুলো থেকে।
এদের নেতারা সাধারণত হচ্ছে ২৫ থেকে ৬০ বছর বয়সী মধ্যবিত্ত শ্রেণির কেউ যারা স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে গেছে। তারা নিজ নিজ আদর্শে নিবেদিতপ্রান, কিন্তু আদর্শগত পার্থক্যের কারনে তারা বেশিরভাগ সময়েই নিজেদের মধ্যেই ঝগড়াঝাঁটিতে ব্যস্ত থাকে।
পুর্ব পাকিস্তানে মার্চ মাসের গোলযোগের সুযোগে তারা দুই শহরেই মিছিল বের করেছিল, এবং সেই মিছিল থেকে “রক্তাক্ত বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন” করার ডাক দিয়ে লিফলেট বিলি করেছিল।
প্রতিরোধের বীজ
“আমরা যোদ্ধা নই” আমাকে এমনটাই বলেছিলেন একজন বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবী ঢাকায় সেনাবাহিনী নামার পরদিনই। “আমরা কথাই একটু বেশি বলি”।
“কিন্তু প্রেসিডেন্ট এখন আর আমাদের জন্য কোন উপায় রাখলেন না। এমনও যদি হয় যে তারা আগামী ১০ বছর আমাদের শাসন করতে পারলো, তবুও তারা টের পাবে তারা যতটুকু হজম করতে পারবে, তারচেয়ে বেশি খেয়ে ফেলেছে। আসল প্রতিরোধের বীজ রোপণ করা হয়ে গেছে, এবং শেষ পর্যন্ত আমরা প্রত্যাঘাত করবই”।
হয়ত এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমানিত হবে। কিন্তু সেটার জন্য লম্বা সময় লাগবে বলে মনে হচ্ছে। আর যদি সেটা হয়ও, সেটা খুব সম্ভবত পাইপ খেয়ে অভ্যস্ত মধ্যমপন্থী শেখ মুজিবুর রহমানের মত কারো হাতে না হয়ে হবে কমিউনিস্টদের হাতে।