You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলার বাণী
ঢাকা : ২৬শে নভেম্বর, সোমবার, ১৯৭৩, ১০ই অগ্রহায়ণ, ১৩৮০ বঙ্গাব্দ

খাদ্য সংগ্রহ অভিযানকে সফল করার আহ্বান

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে গত পরশু নাটোরস্থ উত্তরা গণভবনে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দেড়ঘন্টা স্থায়ী এই বৈঠকে দেশের আইন-শৃঙ্খলা, খাদ্য সংগ্রহ অভিযান, দুর্নীতি ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা শেষে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যে কোনো মূল্যে সমাজবিরোধী, চোরাকারবারী ও দুর্নীতিবাজদের দেশ থেকে নির্মূল করে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুস্থ ও শান্ত করার কথা দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করা হয়েছে এবং আরো অধিক সংখ্যক পুলিশ, বিডিআর, রক্ষীবাহিনী এবং সেনাবাহিনী নিয়োগ করে এই অভিযানকে আরো ব্যাপকতর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। খাদ্য সংগ্রহ অভিযান সফল করার প্রেক্ষিতে এই অভিযানকে অগ্রাধিকার দিয়ে বলা হয়েছে, খাদ্যশস্যের সর্বনিম্ন সংগ্রহ মূল্য যাতে উৎপাদনকারী চাষীদের হাতে পৌঁছে তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। এ প্রসঙ্গে সংগৃহীত শস্য যথাযথভাবে গুদামজাত করার কথা উল্লেখ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে যে, কোনো শৈথিল্যতা কিম্বা পূর্ব-সাবধানতার অভাবে সংগৃহীত শস্য বিনষ্ট হলে গুদামজাতকরণের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা এবং কর্মচারীদেরকেই দায়ী করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। সম্মেলনে উল্লেখিত সিদ্ধান্তসমূহ যথার্থভাবে কার্যকরী করার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারী কর্মচারীদের দায়িত্ব সম্পর্কে পুনরায় সচেতন করে দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আপনারা সকলেই দেশের সমগ্র জনগণের সেবকরূপে জাতীয় সরকারের অধীনে কাজ করছেন—কোনো ঔপনিবেশিক শাসকের সেবা করছেন না। সুতরাং জাতীয় সরকারের কর্মী ও সেবক হিসেবে আত্মত্যাগ ও দৃঢ় একনিষ্ঠতার সঙ্গে কাজ করে জাতির সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, আপনারা নিজেরা দায়িত্বশীল এবং সৎ না হলে আপনাদের অধঃস্তনদের কাছ থেকে কিভাবে সততা ও ত্যাগ কামনা করবেন? বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো কার্যকরী করার জন্যে সরকারের সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করার জন্যে আপামর জনগণের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নানা দিক থেকে দেশের উত্তরাঞ্চলের গণভবনে অনুষ্ঠিত এই উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। দেশবাসী বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবরাখবরের মাধ্যমে লক্ষ্য করেছেন যে, বেশ কিছুদিন থেকে উত্তরাঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কি মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। প্রায় প্রত্যেক দিনই তথাকথিত একশ্রেণীর চরমপন্থী সমাজবিরোধী অত্যন্ত কর্মতৎপর হয়ে উঠেছে। ফলে প্রায় প্রত্যেহই উত্তরাঞ্চলের কোনো না কোনো থানা আক্রমণ, ব্যাংক লুট, রাজনৈতিক এমন কি নিরীহ ব্যক্তি খুন ইত্যাদির মাধ্যমে জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আরেক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী চোরাকারবারী উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত এলাকা দিয়ে দেশের বিশেষ করে খাদ্যশস্য, পাট এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যাপক চোরাকারবার করে চলেছে।
সরকার ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং ইতিমধ্যে তা শুরুও হয়ে গেছে। মেহনতি মানুষের কল্যাণার্থেই সরকার খাদ্য সংগ্রহ অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যেহেতু সীমান্ত এলাকার খাদ্যশস্য প্রায়ই চোরাকারবারীদের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়, সেজন্যে সীমান্তের ১০ মাইল এলাকার মধ্যে থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ধান সংগ্রহ করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ধানগুলো কেবল সংগ্রহ করলেই চলবে না, উৎপাদনকারী চাষীরা যাতে সরকার ঘোষিত মূল্য পায় এবং সংগৃহীত ধান সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের অভাবে যদি বিনষ্ট হয় তাহলে ধান সংগ্রহ অভিযানের মূল উদ্দেশ্যই বিফল হয়ে পড়বে। আমরা ইতিপূর্বে বহুবার আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতির জন্যে এবং চোরাকারবারীদের দৃঢ় হস্তে দমনের জন্যে সরকারকে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছি। আমরা এও বলেছি, এ ব্যাপারে সরকার কঠোর হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করবে। সরকার ও জনগণের যৌথ প্রচেষ্টায় দেশের কল্যাণ আসবে এ বিষয়ে আমরা নিশ্চিত।

সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়

ধান চালের দেশ বাংলাদেশের অন্যতম ফসল বোরো ধান। আমন-ইরির পর সারাদেশের আনাচে কানাচে এখন এই ফসল চাষেরই বিপুল প্রাণ প্রস্তুতি চলছে। কৃষকের উৎপল চোখের কোণে এখন রঙীন স্বপ্নের আঁচড়—মানুষের হৃদয়ে হৃদয়ে এক বিপুল প্রত্যাশা।
আমাদের বিগত কৃষি অভিজ্ঞতা আমরা এক বিস্ফারিত পুলকিত চোখে দেখেছি সামান্য একটু আধুনিক বৈজ্ঞানিক উপায়ে বা পাওয়ার পাম্পের ব্যবহারে চাষাবাদ করলে আমাদের শ্রমের ফসল সাধারণ অবস্থার চাষাবাদের চেয়ে অনেক বেশী লোভনীয়, আকর্ষণীয় ও বিপুল হতে পারে। সুতরাং, আমাদের বর্তমান চাষাবাদে যদি উপযুক্তভাবে পাওয়ার পাম্পের মতো আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যায়, তবে আমাদের শ্রমের ফসল আমাদের স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও নিশ্চয়ই এক বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে দেশকে সুখ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
সুখের বিষয়, আমাদের সরকারী কৃষি বিভাগ চাষাবাদে পাওয়ার পাম্পের এ কার্যকারিতা সম্পর্কে সজাগ দৃষ্টি দিয়েছেন এবং মোট ৪০ হাজার পাওয়ার পাম্প আমদানী পরিকল্পনার প্রায় ৩৫ হাজার ইতিমধ্যেই এসে গেছে এবং তা দেশের বিভিন্ন ক্ষেতে খামারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এখনো পাঁচ হাজার আসবার বাকী আছে কিম্বা আসার প্রতীক্ষায় প্রহর গুণছে।
তবে, আমরা মনে করি, এই ৪০ হাজার পাওয়ার পাম্পও আমাদের সর্বাত্মক প্রয়োজনের জন্যে পর্যাপ্ত নয়। কারণ, প্রায়ই দেখা গেছে যে, পাম্প হ্যান্ডলিং-এ একটা না একটা ক্রুটি বিচ্যুতির জন্যে অনেক পাম্পকে অকেজো হিসেবে বসে থাকতে হয় এবং যান্ত্রিক চাষাবাদ ব্যাহত হয়ে পরবর্তী ফলনের উপরও স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
এজন্যেই প্রয়োজনের বাইরেও বেশ কিছু পাম্প মওজুত রাখা দরকার। যাতে কোনো একটি পাম্প অকেজো হয়ে পড়লে মওজুত পাম্প থেকে পূর্বতন পাম্পের স্থলাভিষিক্ত সম্ভব হয়।
এ প্রসঙ্গে আমরা সরকারের একটি সাম্প্রতিক ঘোষণাকে আগ্রহের সঙ্গে স্মরণ করতে চাই। ঘোষণায় বলা হয়েছে যে, শীঘ্রই সরকারী উদ্যোগে দেশে স্থানীয়ভাবে পাওয়ার পাম্প প্রস্তুত করা সম্ভব হবে এবং তখন আর বিদেশ থেকে পাম্প আমদানী প্রয়োজন পড়বেনা।
ঘোষণাটি নিঃসন্দেহেই আশাব্যঞ্জক এবং উদ্যোগ সর্ব অর্থেই প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয়। তবুও আমরা সে বিতর্কে যেতে চাইনা।
আমাদের দেশের বিভিন্ন ক্ষেত খামারের জন্যে প্রয়োজনীয় পাওয়ার পাম্প বিদেশ থেকেই আমদানী করা হোক বা তা’ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সম্ভব হোক সে বিষয়ে আমরা আপাততঃ উৎসাহী নই।
আমাদের মূল বক্তব্য এই যে, আমাদের কৃষিকাজের জন্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ পাওয়ার পাম্পের প্রয়োজন। তা বিদেশ থেকে এনে আমাদের সরবরাহ করা হোক বা স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করে সরবরাহ করা হোক তাতে আমাদের খুব একটা মাথাব্যথা নেই।
আমাদের মাথাব্যথা পর্যাপ্ত ও সময়োচিত পাওয়ার পাম্পের ব্যবস্থাকরণের জন্যে। কারণ, আমরা আমাদের বিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি যে, অপর্যাপ্ত ও সীমিত পরিমাণ পাওয়ার পাম্প থাকার দরুণ প্রায়ই অসাধু ও কর্মবিমুখ চাষীরা বা অফিসের কর্মচারীরা একটা না একটা ঘাপলা দেখিয়ে কৃষি কাজ দিনের পর দিন বন্ধ রেখেছে, অথবা কিছু অসৎ পন্থার পরিবর্তে পাম্প সরবরাহ করেছে। অজুহাত হিসেবে তারা নানা উসিলা দেখিয়েছে। যেমন-তেল নেই, খুচরা যন্ত্রাংশ নেই, এটা নেই, ওটা নেই, আরো কতো কি।
কিন্তু আমরা এ বছর আর সে সব ঘাপলা শুনতে রাজী নই। পর্যাপ্ত পরিমাণ পাম্প ও তার প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশের ব্যবস্থা করলে অসাধুরা আর ঘাপলা করতে পারবেনা বলে আমাদের বিশ্বাস।
এ প্রসঙ্গে আমরা স্বভাবতঃই আশা করি যে, প্রকৃত কৃষকের হাতে বা প্রকৃত আগ্রহী কৃষকের হাতে যাতে এসব পাম্প সময়মতো পৌঁছায় সেজন্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও নিশ্চয় যাবতীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করবেন এবং পূর্ণ যোগ্যতার পরিচয় দেবেন।
সবচেয়ে বড় কথা, বোরো চাষের উপযুক্ত সময় প্রায় সমাগত, সুতরাং, যা’ কিছুই করতে হবে তা’ তাৎক্ষণিকভাবে না করলে এবং সময়ের পূর্বে সমস্ত ব্যবস্থাদি না সম্পন্ন হলে সব আন্তরিকতা ও সব ব্যবস্থাদিই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কথায় বলে সময়ের এক ফোঁড়। অসময়ের দশ ফোঁড়। এ কথাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের স্মরণ রাখা উচিত।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!