You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রতারণার মধ্যে সৃষ্ট যে দেশ

১৯৪০ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম প্রদেশের নেতা হওয়ার কারণে জিন্নাহসহ কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ শেরে বাংলাকে দিয়েই লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তারপর এমন অযৌক্তিক ও অপমানজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয় যার ফলে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক বাধ্য হন নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগ থেকে পদত্যাগ করতে। অনুরূপভাবে পাকিস্তানের জাতির পিতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন দেখলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের লাহাের প্রস্তাবে দুটি স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রর প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তখন মতলব আঁটলেন এই দুই স্বাধীন ও সার্বভৌম মুসলিম রাষ্ট্রকে একীভূত করে ‘একটি পাকিস্তান’ করতে হবে।

তাই প্রয়ােজন পড়ল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে। তখন বঙ্গীয় পরিষদে তার নেতৃত্বে ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনেই মুসলিম লীগ বিজয়ী হয়। সােহরাওয়ার্দী মুখ্যমন্ত্রী হন। সে জন্য তাকে দিয়েই জিন্নাহ শিল্পী কনসেশনে ‘এক পাকিস্তানের; প্রস্তাব পাশ করান। এ সময় ভারতে অন্তবর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছিল। ঐ সরকারে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কিংবা হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদী কেউই ঠাই পাননি। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতবাসী তথা বিশ্বকে দেখাতে চাইলেন পাকিস্তান মুসলিম রাষ্ট্র হলেও সেখানে সব ধর্মের লােক নিরাপদে বসবাস করতে পারবে সম-অধিকার নিয়ে। সেজন্য যােগেন্দ্রনাথ মন্ডলকে গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার সুযােগ দেয়া হয়। এসবই ছিল পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের চতুরতা ও ভাওতাবাজি। পাকিস্তানী নেতারা বলতেন, বিশ্বে পাকিস্তান হবে ইসলামিক রাষ্ট্রের মডেল। পাকিস্তানের জাতির পিতা সম্পর্কে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক বলেছেন, ‘মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ নামাজ, রােজা ও ধর্মের ধার ধারতেন না। জীবনের শেষ ৩ বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, ইচ্ছাশক্তি, হুইস্কি, সিগারেট এবং কখনাে কখনাে শূকরের মাংসও তিনি ভক্ষণ করতেন। এমনই ছিল নবসৃষ্ট রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের ভন্ডামি ।

করাচী, ৪ মার্চ ১৯৪৯

সামনে কবর খোঁড়া হচ্ছে। যাকে কবরস্থ করা হবে তিনি দাঁড়িয়ে আছেন কবরের সামনে কবরে শায়িত করার পূর্বে জীবন্ত মানুষটি কথা বলতে দাড়িয়ে গেলেন। উপস্থিত সবাই বিমূঢ়। বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। দেখছেন মানুষটির শান্ত, সমাহিত চেহারা। কোনাে হতাশা নেই। ক্রোধ নেই  সৌম্যকান্তি। গণপরিষদের স্পিকার তাকিয়ে আছেন তিনি বিস্মিত। যেন বিমূঢ়! তাকে বিনীত সম্বােধন করে সেই ব্যক্তিটি বলেন, “স্যার, এই জীবনে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার সময় কেউ উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেয়ার এবং শেষকৃত্যে অংশ নেয়ার সুযােগ পায় না। আমার জীবনে এ এক অপূর্ব সুযােগ এসেছে যেখানে আমি এই পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সেই শেষকৃত্যে অংশগ্রহণ করছি। একটু পরেই যাকে এই পার্লামেন্টে কবরস্থ করা হবে। এরকম দাড়িয়ে কিছু বলার সৌভাগ্য আজও কারাে হয়নি। সম্ভবত এই পার্লামেন্টে এটাই আমার শেষ কথা হবে। মাননীয় স্পিকার মহােদয়, আজ যে আইন সংশোধন হতে যাচ্ছে সাধারণ মানুষ সহজেই তার তাৎপর্য অনুধাবন করতে পারবে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার যে সংশােধনটি করতে যাচ্ছে তার মাধ্যমে প্রমাণ হয় তাদের শিক্ষা ও ইতিহাস-জ্ঞানের কত বড় অভাব রয়েছে এবং এটা করা হচ্ছে একজন মাত্র ব্যক্তিকে সামনে রেখে। তাঁকে যেভাবেই হােক এই পার্লামেন্ট থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য। আয়ােজন দেখে মনে হচ্ছে এই ব্যক্তিটিকে জ্যান্ত সমাহিত করার জন্য। গণপরিষদের সদস্য হিসেবে বিনীতভাবে আমি তা উপলব্ধি করছি, একজন ব্যক্তিকে পার্লামেন্ট থেকে অপসারিত করার যে আইনটি পেশ করা হয়েছে তা অর্থহীন। কেননা এখনাে ভারত বিভাগের পরে বহু নেতাই তাদের স্থায়ী অবস্থান নির্ধারণ করেননি। তবুও আইন হচ্ছে যে, গণপরিষদ সদস্যের পাকিস্তানে স্থায়ী নিবাস থাকবে না তিনি গণপরিষদ সদস্য থাকবেন না বা যার ঘর নেই, বাড়ি নেই, আবাস নেই। কিন্তু সেই ব্যক্তিই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব এনেছিল, পার্লামেন্টারি পার্টির দিল্পীর কাউন্সিলে পাকিস্তান নামক একটিমাত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে।

সেদিন মুসলিম লীগ বঙ্গীয় পরিষদে ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৩টি আসনে বিজয়ী হয়। এই বিজয়ের পেছনে যে মানুষটি অগ্রণী ও কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন তিনি হলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। ১৯৪৬ সালের ২২ এপ্রিল এই মানুষটি প্রাদেশিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেদিন তার নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা ও দক্ষতা সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। তার নেতৃত্বের দক্ষতায় বিমুগ্ধ নিখিল পাকিস্তানের সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাকে দিয়ে দিল্লীতে যে প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় তার মাধ্যমে ভারত খণ্ডিত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিধানিক ভিত্তি তৈরি হয়।  সেই ব্যক্তি যিনি পাকিস্তান প্রস্তাব মুসলিম লীগ পার্লামেন্টের পার্টিতে উপস্থাপন করেন তাকেই আজ এ পামেন্টে অন্যায়ভাবে শিরচ্ছেদ করা হচ্ছে। পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বলেন, এখন পর্যন্ত এদেশে স্থায়ী নাগরিকত্বের বিধান তৈরি হয়নি। এখন পর্যন্ত জাতীয়তার আইন পাস হয়নি। এখন পর্যন্ত কে কোন্ রাষ্ট্রে ভারত বা পাকিস্তানে থাকবে বা যাবে তা নির্ধারিত হয়নি। অনেকে হয়তাে পাকিস্তানে এসে থাকবেন ব্যবসা বাণিজ্য বা শরণার্থী হয়ে, যারা চমৎকার রুটি ও মাছ মাংস পাওয়ার লােভে বলা হয়ে থাকে পাকিস্তান মুসলমানদের জন্য মাতৃভূমি। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার কারণে বলা হয় সাম্প্রদায়িক সমস্যা সমাধান হয়েছে। তাহলে এই উপমহাদেশের যে কোন মুসলমানই পাকিস্তানে স্থায়ী অধিবাসী হতে পারেন। পাকিস্তানের প্রতি যার আনুগত্য আছে তিনি এদেশের নাগরিক হতে পারেন।

এ বিষয়ে আমি দুটো উদাহরণ তুলে ধরি, আমার অত্যন্ত প্রিয় বন্ধু ভারত ইউনিয়নের প্রতি এখন পর্যন্ত আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। অন্যদিকে তিনি আবার পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টও। আমি যদি ভুল না করি জনাব ইসহাক সাইত যিনি ভারত ইউনিয়নে পার্লামেন্ট সদস্য। তিনি আবার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হয়ে বিদেশে আছেন। প্রথম থেকেই আইনের নামে বেআইনি। কোন একক ব্যক্তির জন্য আইন তৈরি করা হয় না। কিংবা তাকে তিরস্কার বা পুরস্কার করার জন্য আইন তৈরি অর্থহীন। হােসেন শহীদ সােহরওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের যৌথ নেতৃত্বে বাংলাকে অবিভক্ত রাখার প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর ফলে মুসলিম লীগ সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ক্ষিপ্ত হন। ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এই ষড়যন্ত্রে যােগ দেন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। তিনি পূর্ববঙ্গের কোটায় গণপরিষদ সদস্য হয়েছিলেন। লাহাের পার্লামেন্টারি পার্টিতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বাগ্মিতায় জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দৃষ্টে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ মন্তব্য করেছিলেন, সােহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে যথাযােগ্য ব্যক্তি। একসময় উত্তর প্রদেশ থেকে আগত প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান সােহরাওয়ার্দীর পেছনে লাগেন। অন্যদিকে লিয়াকত আলী খান কায়েদে আযমকে পূর্বের মতাে সম্মান করতেন না। কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলী। জিন্নাহর মৃত্যুর পর কবর জিয়ারত পর্যন্ত করতে যাননি। এই ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৭ সালে ৫ আগস্ট পূর্ব বঙ্গ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক জিন্নাহর সমর্থনে খাজা নাজিমুদ্দীন ৭৫-৩৯ ভােটে সােহরাওয়ার্দীকে পরাজিত করে পার্লামেন্টারি পার্টির দলনেতা হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি হলেন পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী।

হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সাহেব গণপরিষদে বলেন, স্বেচ্ছাচারিতা একনায়কতন্ত্র মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। ইসলামের নাম ব্যবহৃত হবে কিন্তু ইসলামের মর্মবাণী প্রতিষ্ঠিত হবে না। এ ধরনের রাষ্ট্র ব্যবস্থার মূলভিত্তি সুদৃঢ় হতে পারে না। একদিন শিকড়মূল উপড়ে পড়বে। আমার দোষ হলাে বাংলার যে দাঙ্গা চলছিল তা প্রতিরােধ করা। হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব স্থাপন করা। শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। এটা যদি আমার অপরাধ হয় তাহলে আমি বলব এই গণপরিষদে থাকার কোন ইচ্ছে আমার নেই। এর জন্য আইন করার প্রয়ােজন ছিল না এক ব্যক্তিকে জবাই করার জন্য । সম্মানিত পীরজাদা আব্দুস সাত্তার এমন একটি জটিল বিষয়ে বলেছেন, গণপরিষদ একটি সার্বভৌম সংস্থা সে যা ইচ্ছা তাই করতে পারে । কিন্তু মাননীয় স্পিকার, আমি বলতে চাই আইনের বাইরে তা যেতে পারে না যা তাকে বেঁধে রেখেছে। প্রেসিডেন্ট ইচ্ছামতাে আইনের বাইরে কিছু করতে পারে না একথা আমি গণপরিষদ সদস্যদের মনে করিয়ে দিতে চাই।’ ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হলেও ভারতীয় রাজনীতিতে দলটি তেমন প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি।

এমনকি ১৯১৩ সালে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ লীগে যােগদান করলেও এই পার্টি নিয়ে তার তেমন কোন আগ্রহ ছিল না তখন তিনি কংগ্রেসের নেতা এবং উভয় দলের ভেতরে সমঝােতার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি ১৯২৮ সালে এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে কৃষক প্রজা পার্টি গঠিত হয়। পার্টির লক্ষ্য ছিল ছােট বড় জমিদার ভূস্বামী সংঘের বিরুদ্ধে। কৃষক প্রজাদের পক্ষে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে না পারে সেজন্য মুসলিম লীগ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে প্রধানমন্ত্রীর পদ প্রদানে সম্মত হন। নির্বাচন উপলক্ষে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তখন ঢাকায় এলেও তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছিল খুবই কম সংখ্যক লােক। সেই তুলনায় শেরেবাংলার জনপ্রিয়তা ছিল উত্তঙ্গ।  মুসলিম লীগের সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ববঙ্গের জনপ্রিয় জননেতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে বিশেষভাবে অনুরোধ জানান যে, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হককে যেভাবে হােক মুসলিম লীগে যােগদান করাতে হবে। ১৯৩৭ সালে অক্টোবরে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক যুক্ত বাংলার মুসলিম লীগের সভাপতি পদে যােগদান করেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সেক্রেটারি হন।  এর পূর্বে যে ঘটনা তা যেমন ঐতিহাসিক তেমনি পূর্বাপর তাৎপর্যপূর্ণ। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪০ সালে লাহােরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সাধারণ কাউন্সিল সভা আহ্বান করেন। লাহাের সম্মেলনে ভারতীয় মুসলমানদের মুক্তির  প্রশ্নে আলিগড় আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম প্রমুখের তাত্ত্বিক বিরােধ দেখা দেয়  আলিগড় আন্দোলন প্রভাবিত নেতারা বিশেষভাবে মুসলিম-সংখ্যালঘু প্রদেশগুলাের মুসলমানদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ধর্মীয় নিরাপত্তা নিয়ে আলােড়ন তুলেছিলেন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বা শেরে বাংলা ফজলুল হক আলিগড়ে লেখাপড়া করেননি বা তাদের নেতৃত্বের পেছনে ব্রিটিশ রাজ্যের আনুকূল্য ছিল না।

তারা বলেছিলেন, সর্বভারতীয় সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্যে হিন্দুরা শাসনকার্য পরিচালনায় প্রাধান্য লাভ করবে। সেজন্য প্রয়ােজন মুসলমানদের স্বাধীন স্ব-শাসিত অঞ্চল। স্ব-শাসন না পেলে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক মুক্তি সম্ভব নয়। মুসলিম লীগ সভাপতির আহ্বানে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক ২২ মার্চ লাহাের সম্মেলনে উপস্থিত হন এবং মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর বিশেষ অনুরােধে লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তার বাগিতায় মুগ্ধ হয়ে উক্ত সম্মেলনে আগত কাউন্সিলবৃন্দ তাকে ‘শেরে বাংলা’ উপাধিতে ভূষিত করেন। লাহাের প্রস্তাব উত্থাপনের বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, “Of course and I am better than Mr. Jinnah!” তিনি হাজার হাজার জনতার মাঝে মিন্টু পার্কে ভাষণে বলেন, “১৯০৬ সালে যে বেঙ্গল থেকে মুসলিম লীগের পতাকা উড্ডীন হয়েছিল আমি সেই পতাকা নিয়ে আমাদের নিজস্ব আবাসভূমি প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেয়ার সুযােগ পেয়েছি।”  লাহাের রেজুলেশনের মর্মকথা ছিল, ভারতবর্ষ বিভক্ত করে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এলাকাগুলােতে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করা হবে। উপযুক্ত সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের অন্তর্ভুক্ত ইউনিট বা প্রদেশগুলাে স্বায়ত্তশাসিত হবে।

জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী

বাঙালির নেতৃত্ব শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী যােগ্যতা ও জনসমর্থনের বিচারে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের সমতুল্য দক্ষ দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পূর্বে ও পরে দু’জনকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করা হয় অথচ ১৯৪০ সালে ২৩ মার্চ লাহােরে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের ২৭তম বার্ষিক সভায় শেরে বাংলা ফজলুল হক উত্থাপিত লাহাের প্রস্তাব যা পরবর্তীকালে পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে অভিহিত হয়েছিল। যা কাউন্সিলদের সামনে উত্থাপিত হয় গৃহীত হয়েছিল যা ছিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মৌলিক নীতি। সেখানে বলা হয়েছিল, মুসলমানদের দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা। বঙ্গপ্রদেশের অবিসংবাদিত নেতাকে দিয়ে লাহাের প্রস্তাবের মাধ্যমে উত্তর-পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দুটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠিত হবে। কাউন্সিল মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব গ্রহণের পর মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় গােষ্ঠী দেখলেন দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে তাদের স্বার্থ বিঘ্নিত হবে এবং তাদের নেতৃত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে ধাবিত হবে। ক্যাবিনেট মিশনের বিরােধিতার সুযােগে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খান ১৯৪১ সালে ৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শেরে বাংলা ফজলুল হক ভাইসরয়ের অধীনে ডিফেন্স কাউন্সিলের পদ থেকে পদত্যাগ না করার অজুহাতে পার্টির শৃঙ্খলাবিরােধী কাজে যুক্ত হিসেবে তাকে পত্র লেখেন।

শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক উক্ত অভিযােগের বিপক্ষে আটটি যুক্তি উত্থাপন করে বলেন, আমাকে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে হচ্ছে যে, এখনই দলের মধ্যে যে অবস্থা তৈরি করা হচ্ছে তা ভবিষ্যতে একনায়কতন্ত্রের জন্ম দেবে যা পরবর্তীকালে বিবেককে তাড়িত করে বিদ্রোহের দিকে নিয়ে যাবে। বঙ্গপ্রদেশের ওয়ার্কিং কমিটিকে না জানিয়ে এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রেক্ষিতে শেরে বাংলা ফজলুল হক সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের সদস্য পদ হতে পদত্যাগ করেন। প্রকৃতপক্ষে বাংলার জনগণ জানতেন ফজলুল হক একমাত্র ব্যক্তি যিনি বাংলার দুরবস্থা থেকে তাদের নিকৃতি দিতে পারেন এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম কেননা যেখানে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ড. খান সাহেব এবং তার ভাই কংগ্রেসের কাছে পরাজিত হয়। পাঞ্জাবে হিন্দু-শিখ-মুসলিম সম্প্রদায়ের একাংশ মিলে গঠিত ইউনিয়নিস্ট পার্টি মুসলিম লীগকে পরাজিত করে। ১৯৩৭ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক মুসলিম লীগের সঙ্গে সরকার গঠন করেন। কিন্তু মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর প্রচেষ্টা ছিল প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষের ও নেতৃত্বের প্রভাব ক্ষুন্ন করে মুসলিম লীগকে কেন্দ্রীয়ভাবে শক্তিশালী করা। সেজন্য শেরে বাংলা ফজলুল হকের সঙ্গে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সংঘর্ষ তৈরি হয় । লিয়াকত আলী খান ও মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাকে ভাইসরয়ের নির্বাহী কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করতে বললে ফজলুল হক তা মানতে অস্বীকার করেন যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। ফজলুল হক এ সম্পর্কে এক বিবৃতিতে বলেন, জিন্নাহ স্টাইলের ডিক্টেটরশিপ তিনি মানবেন না।’ শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক জিন্নাহর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদে ১৯৪১ সালে ১০ সেপ্টেম্বর মুসলিম লীগ হতে পদত্যাগ করেন।

পাকিস্তানের ধুরন্ধর নেতৃত্বের সামনে বাংলার আর এক বিশাল ব্যক্তিত্ব যিনি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের বঙ্গপ্রদেশে বিপুলভাবে বিজয়ী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেছিলেন তাকে দিয়ে অখণ্ড পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যে কাজটি ‘অসমাপ্ত ছিল সেটি পূর্ণাঙ্গ করার জন্য মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব প্রদান করেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে। তিনি যেহেতু সমগ্র পাকিস্তানের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন তাঁকে দিয়েই সেই কর্মটি’ সম্পন্ন করার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে যায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল পাকিস্তানের রাজধানী হবে কলকাতা। পাকিস্তানের রাজধানী স্থাপিত হলে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম, মওলানা ভাসানীর মান মর্যাদা ও প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাবে। এই সমস্ত কারণে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিম উদ্দিন, নূরুল আমিন, মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ মুসলিম লীগ নেতা বাংলা প্রদেশকে বিভক্ত করতে এবং কলকাতার উপর থেকে কংগ্রেসের দাবি প্রত্যাহার করতে জোরালাে ভূমিকা নেয়নি। বরং তারা খুশিই হয়েছিলেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান কলকাতার বিনিময়ে লাহােরকে পশ্চিম পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য বৃটিশ শাসক ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের সাথে দর কষাকষি শুরু করেন। অন্যদিকে সােহরাওয়ার্দী, শরৎ বােস, হাশিমুদ্দীন প্রমুখ যুক্ত বাংলার পক্ষে জনমত গঠন করেন। কারণ যুক্ত বাংলায় মুসলমানরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।

শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী

শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী

তারপরও শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীসহ হিন্দু মহাসভা ও উগ্রবাদী হিন্দুরা যুক্তবাংলাকে বিভক্ত করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব এ সম্পর্কে ১৯৪৭ সালে ২৭ এপ্রিল একটি বিবৃতি দিয়ে বলেন, হিন্দু এবং মুসলমান যুগ যুগ ধরে এ এলাকায় শান্তি ও সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম ১৯৪৭ সালের ২৯ এপ্রিল এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, আমি তাদের কাছে আবেদন জানাই বাংলা ভাগ করানাের “I beg to them not to destroy Bengal,” এ সঙ্গে সুভাষ বসুর ভাই শরৎ বসু ও আবুল হাশেম ১৯৪৭ সালের ২০ মে উভয়ে একত্রে এক যৌথ চুক্তিতে স্বাধীন যুক্তবাংলার পক্ষে একটি রূপরেখা তুলে ধরেন।

প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশিম

সেখানে সরকারি প্রতিনিধিত্ব ভােট প্রদানের অনুপাত এবং মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন একজন মুসলমান ও হিন্দু। গণপরিষদ গঠিত হবে ৩০ সদস্যের, তার মধ্যে ১৬ জন মুসলমান ও ১৪ জন হিন্দু প্রতিনিধি থাকবে। মহাত্মা গান্ধী ৮ জুন ১৯৪৭ সালে এক পত্রে বলেন, মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ যদি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় যুক্তবাংলার পক্ষে লিখিত অনুমােদন দেয় তাহলে আমার পক্ষ থেকে কোন আপত্তি থাকবে না। কিন্তু উগ্র হিন্দুবাদীর পক্ষে বল্লভ ভাই প্যাটেল এ প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। অবশেষে বাংলা প্রদেশ বিভক্ত হয় এবং কলকাতা পূর্ব বাংলার হাতছাড়া হয়ে যায়। কিন্তু কলকাতার বিনিময়ে লাহাের পশ্চিম পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ১৯৪৬ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লীর অ্যাংলাে-এ্যারাবিক কলেজে নির্বাচিত পার্লামেন্টারি পার্টিতে দিল্লীতে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে দিয়ে রেজুলেশন উত্থাপন করেন। প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্বাঞ্চল এবং পশ্চিমাঞ্চলকে নিয়ে একটিমাত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে।

বল্লভ ভাই প্যাটেল

বল্লভ ভাই প্যাটেল

 

মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ সর্বভারতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে বাঙালি মুসলমানগণ লাহাের প্রস্তাবের পক্ষে যে নিরঙ্কুশ সমর্থন ও রায় প্রদান করেছিল এটা ছিল সেই গণরায়ের প্রতি এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা। এই সংশােধনীর বিরােধিতা করেছিলেন যুক্তবাংলার মুসলিম লীগের সদস্য ও কাউন্সিলরা। শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন একজন কাউন্সিলার। তিনি তার নেতার এই অপরিণামদর্শী প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। আবুল হাশিম সম্মেলনের সভাপতি জিন্নাহর সামনে দাঁড়িয়ে জোরালােভাবে বলেন, এই প্রস্তাব আমরা মানি না। পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে জিন্নাহর নির্দেশে তাকে চ্যাঙদোলা করে কাউন্সিল প্যান্ডেলের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়। সােহরাওয়ার্দী সাহেব ভেবেছিলেন যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পাবেন। কেননা লিয়াকত আলী খান ছিলেন পাকিস্তান ভূখণ্ডের বাইরের লােক, তার বাড়ি উত্তর প্রদেশে যিনি নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য ছিলেন না। বাংলার কোটা হতে তাকে নির্বাচিত করা হয়। সেজন্য তিনি হৃষ্টচিত্তে এই সংশােধনী সমর্থন জানাতে দ্বিধা করেননি।

মুসলিম ছাত্রলীগের দেশপ্রেমিক ও প্রগতিশীল অংশের জনাব নূরউদ্দিন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল ওয়াসেক, শামসুর রহমান, জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ আজিজ, শামসুল হক, আনােয়ার হােসেন, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ নেতা ও কর্মীরা মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হন। কারণ লাহাের প্রস্তাবের মধ্যে বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীনতা ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের যে গ্যারান্টি ছিল তা অবলুপ্ত হয়। বলতে গেলে তখন থেকেই বাঙালি জাতির উপর পশ্চিম পাকিস্তান নেতৃত্ব চেপে বসার সুযােগ লাভ করে। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কর্তৃক উত্থাপিত লাহাের প্রস্তাব যা ছিল কাউন্সিল কর্তৃক অনুমােদিত সেই প্রস্তাব পার্লামেন্টারি পার্টির দ্বারা সংশােধন করা কোনক্রমেই সাংবিধানিক, গঠনতান্ত্রিক ও নীতিগতভাবে বৈধ হতে পারে না। এই অবৈধ পথেই দিল্লী প্রস্তাব মােতাবেক ভারত খণ্ডিত হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জিন্নাহ-লিয়াকত আলী খানের ষড়যন্ত্র শুরু হয় কীভাবে দক্ষ, জনপ্রিয়, অভিজ্ঞ ও মেধাবী জননন্দিত নেতৃত্ব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে যুক্তবাংলার মুখ্যমন্ত্রী হতে সরিয়ে দেয়া যায়। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় এই যে, পাঞ্জাব প্রদেশ বিভক্ত হওয়া সত্ত্বেও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী খিজির হায়াত খানকে পরিবর্তন করে কোন নতুন মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়নি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শুরু হতেই পূর্ববঙ্গের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে বাঙালি জাতিকে শাসন শােষণ ও দমন করার নীতি গ্রহণ ও প্রয়ােগ করা হয়। ১৯৪৭ সালে মুসলিম লীগের সভাপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা আসাম ভ্রমণে আসেন। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সে সময় আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন।

জিন্নাহ ও লিয়াকত

জিন্নাহ ও লিয়াকত

তিনি জিন্নাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে আসামের মুসলমানদের দুঃখ-দুর্দশার মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরেন। ঐ সময় ইস্পাহানি জিন্নাহর সঙ্গে ছিলেন। তিনি লিখেছেন, মওলানার আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে এবং তার মর্মস্পর্শী বক্তব্যে তার চোখে অশ্রু দেখা দিয়েছিল। সন্ধ্যার সময় জিন্নাহ ইস্পাহানিকে বলেন যে, ভাসানীর মতাে লােক নেতৃত্বের যােগ্য নয়। তিনি আরাে বলেন, “সেন্টিমেন্টাল, ননসেন্স, ইমােশন রাজনীতিতে কাজ করবে না। অশ্রু দ্বারা দুশমনদের পরাজিত করা যাবে না, এর জন্য প্রয়ােজন কঠোর কর্মনিষ্ঠা, সাহস ও প্রত্যয়। জিন্নাহ বলেন, মওলানা ভাসানী ভালাে বক্তা হতে পারেন, শ্রোতাদের আবেগাপ্লুত করতে পারেন কিন্তু তিনি ভালাে নেতা হতে পারবেন না। এই সংকটকালে প্রয়ােজন ঠাণ্ডা মাথার লােক যার চোখ থাকবে শুষ্ক, যে স্পষ্ট সবকিছু দেখতে পারবেন এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। জিন্নাহ মওলানা ভাসানী সম্পর্কে কুৎসিৎ মন্তব্য করেন। কিন্তু মওলানা ভাসানী সম্পর্কে জিন্নাহর এই মন্তব্য ব্যর্থ প্রমাণিত হয় যখন সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে কিনা সেই গণভােটে ভাসানীর শক্ত ও সাহসী ভূমিকার জন্য যা সম্ভব হয়েছিল। এভাবে যিনি ‘লাহাের প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন সেই ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী যিনি অখণ্ড ‘পাকিস্তানের প্রস্তাব’ দিল্লীর পার্লামেন্টারি পার্টিতে সর্বসম্মত সমর্থন গ্রহণে সমর্থন হন এবং মজলুম জননেতা পাকিস্তান সৃষ্টিতে যার অসামান্য অবদান রয়েছে বাংলার এই তিন জনপ্রিয় জননেতাকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী, দলীয় শাসকচক্র অত্যন্ত কৌশলে দল ও সরকার থেকে বিতাড়িত করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির এই অন্যতম নায়কদের একমাত্র অপরাধ ছিল তারা বাংলা ও বাঙালির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। পাকিস্তানে প্রথম থেকে যে প্রতারণা-সেই প্রতারণার মধ্যে তার ভাঙনের বীজ রােপিত হয়েছিল।

(L-R) Khwaja Khairuddin, Muhammad Ali Jinnah and M A H Ispahani.

(L-R) Khwaja Khairuddin, Muhammad Ali Jinnah and M A H Ispahani.

আর একজনের নাম অবশ্য উল্লেখ করার ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা রয়েছে। যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। যিনি পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ যাকে অত্যধিক বিশ্বাস করতেন। একই সাথে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য হিন্দু তফশিলী সম্প্রদায়ের নেতা হিসেবে ভারত বিভাগের অন্তর্বর্তীকালীন ও পরবর্তীকালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আইন ও শ্রমমন্ত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। কায়েদে আযম মােহাম্মদ আলীর মৃত্যুর পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে ভারতের সঙ্গে গােপন তথ্য পাচারের অভিযােগে তাকে হুমকি দেন।

যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল

যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডল

অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ১৯৫০ সালে তাকে কলকাতায় পালিয়ে যেতে হয়। কলকাতা থেকে তিনি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান বরাবর এক দীর্ঘ পত্র লেখেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, সুপরিকল্পিতভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে প্রদেশ থেকে বিতাড়িত করার নীতি এবং হিন্দু বুদ্ধিজীবীদের হাত থেকে রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে তারা যেন প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সেই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। অথচ মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৬ সালে পহেলা নভেম্বর ভারতে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয়েছিল সেই মন্ত্রিসভায় তিনি মন্ত্রী ছিলেন। এমনকি তিনি একথা বিশ্বাস করতেন, উপরতলার হিন্দু সম্প্রদায়ের কারণে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে যথার্থ ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল বলেই তিনি মুসলিম লীগকে সমর্থন দিয়েছিলেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা থাকবে না। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হবে না। কিন্তু ১৯৫০ সালে দাঙ্গা বেধে যায়। পূর্ববঙ্গে শতকরা ৭৫ ভাগ জমিদার হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত। কিন্তু তিনি জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তারপরও পাকিস্তানকে ইসলামীকরণ করার লক্ষ্যে যখন সার্বিক দিক দিয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করা হলাে তখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়াল যে, পাকিস্তানের জন্য তিনি উঁচুতলার হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকেননি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে কাজ করেছেন। সেই পাকিস্তান ছেড়ে জীবন নিয়ে তাকে ভারতে পালিয়ে যেতে হয়।”

১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ কর্তৃক লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার পর ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা লীগের মূলমন্ত্র ও একমাত্র কর্মসূচিতে পরিণত হয়। ১৯৪৬ সালের আগে মুসলিম লীগ হাইকমান্ড কর্তৃক পাকিস্তান পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট রূপরেখা প্রণীত না হওয়ার কারণে ১৯৪০ সাল থেকেই বাংলার নেতৃস্থানীয় মুসলিম লীগ নেতারা পাকিস্তান পরিকল্পনাকে ভারতের দুটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলে দুটি স্বতন্ত্র, স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষিতে দেখে আসছিলেন। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তত্ত্বটির পশ্চাতে প্রধানত তিন ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান ছিল। প্রথমত, আবুল হাশিমের মতাে কেউ কেউ এবং পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সােসাইটির প্রবক্তারা বিশ্বাস করতেন, বাঙালি মুসলমানরা শুধু হিন্দুদের থেকে ভিন্ন নয়, বরং অন্যান্য প্রদেশের মুসলমানদের থেকেও ভিন্ন, অতএব তারা একটি স্বতন্ত্র জাতিসত্তার অধিকারী। সেজন্য ন্নি রাষ্ট্র তাদের কাছে প্রথম দাবি। দ্বিতীয়ত, কারও কারও (যেমন আহসান মনজিল খাজা গ্রুপ) মনে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃত্বের প্রতি প্রীতি বা অন্ধ আনুগত্য প্রবল ছিল। তৃতীয়ত, লাহাের প্রস্তাবের স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ’ কথাটি সােহরাওয়ার্দীর মতাে অনেকের মনে বাংলায় পৃথক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেতনা জাগ্রত করেছিল। বস্তুত পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ গঠন ও পাকিস্তান আন্দোলনের গােটা সময়ব্যাপী বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে ভিন্ন জাতিসত্তার দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান ছিল। বিশিষ্ট বাঙালি নেতা ও লাহাের প্রস্তাবের প্রস্তাবক শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের মূলে ছিল পারস্পরিক স্বার্থ ও আনুগত্যের সংঘাত।

তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করতেন যে, অবাঙালি মুসলমান নেতারা বাংলার মুসলমানদের বিশেষ সমস্যার প্রতি কখনও প্রয়ােজনীয় গুরুত্ব আরােপ করতেন না। বহু বিষয় ও ঘটনা শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবুল হাশিম ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মতাে নেতাদের মনে এ ধারণাই সৃষ্টি করে যে, জিন্নাহর প্রস্তাবিত পাকিস্তান বাংলার জনগণের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না। তারা উপলব্ধি করেছিলেন, একটি অখও পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে বাঙালি মুসলমানদের উপর চলবে পশ্চিম পাকিস্তানের আধিপত্য। এসব বাঙালি নেতৃত্বের কাছে জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের অর্থ ছিল তির। তাদের বিবেচনায় এটা অখণ্ড পাকিস্তানের আদর্শিক ভিত্তি পর্যায়ের কোন বিশ্বাসবােধ ছিল না, বরং এটা ছিল ভারতের সাধারণ মুসলমানদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ হিন্দু বা সংক্ষেপে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের একটি কৌশলগত দিক। এর প্রমাণস্বরূপ পাকিস্তান গণপরিষদ ১৯৪৭ সালে ১১ আগস্ট করাচীর অধিবেশনে একজন তফশিলী সম্প্রদায়ের নেতা যােগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে সভাপতি নিযুক্ত করে গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রমাণ করতে চাইলেন পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের দেশ হবে না, হবে সব সমপ্রদায়ের দেশ।  কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসলামিক স্লোগান’ বা ‘প্যান ইসলামিজম’ এই কথিত তত্ত্ব পাকিস্তানি নেতৃত্বের দর্শন বা তাত্ত্বিক বুনিয়াদ নয় বরং পাকিস্তান সৃষ্টির জন্য এটি ছিল একটি স্লোগান মাত্র।

H S Suhrawardy with his political 'son' Sheikh Mujibur Rehman in 1949

H S Suhrawardy with his political ‘son’ Sheikh Mujibur Rehman in 1949

পাকিস্তান সম্পর্কে জিন্নাহর ধারণা থেকে তাদের এ ধারণা সম্পূর্ণ ভিন্নতর ছিল। শেরে বাংলা ফজলুল হকের বিপরীতে আবুল হাশিম ও হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর উপযুক্ত সময় ও সুযােগ সৃষ্টি হওয়ার আগে এ সম্পর্কিত তাদের স্বতন্ত্র চিন্তা-ভাবনা নিয়ে অগ্রসর হওয়ার পরিবর্তে ঐ সময় পর্যন্ত মুসলিম লীগের আন্দোলনের মূলধারার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত রাখাকেই শ্রেয় মনে করেন। কেননা এর বিপরীত পন্থা অবলম্বন করলে এ পর্যায়ে ভারতের মুসলমানদের মধ্যে যে অনৈক্যের সৃষ্টি হবে তা খােদ পাকিস্তান পরিকল্পনার মূলে কুঠারাঘাত হানতে পারে বলে তারা একে আত্মঘাতী বিবেচনা করতেন।  স্বাধীন ইস্টার্ন পাকিস্তান বা এক ধরনের বৃহত্তর বাংলা’ রাষ্ট্র গঠনের ধারণা সম্বন্ধে ঘনিষ্ঠভাবে ওয়াকিবহাল যেকোন ব্যক্তির কাছে ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক গৃহীত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগের পেছনে তার অভীষ্ট লক্ষ্য কী ছিল তা সাধারণ জনগণের কাছে ছিল ‘অস্পষ্ট’। সােহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে ভারতের পূর্বাঞ্চলের স্বাধীনতার লক্ষ্য সামনে রেখে দাবিকৃত পাকিস্তান রাষ্ট্রের ধারণার সঙ্গে তাদের যুক্তবাংলার তত্ত্ব যে সাংঘর্ষিক নয় বরং সঙ্গতিপূর্ণ তা উঠতি মধ্যবিত্তের মধ্যে কিছুটা আলােড়ন সৃষ্টি করলেও পাকিস্তান সৃষ্টিতে তখন ধর্মের বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক প্রভাব প্রবলভাবে সক্রিয় ছিল। কার্যত দিল্লী সম্মেলনের পর থেকে অখণ্ড স্বাধীন বাংলার জন্য আন্দোলন শুরু করার ঘােষণদানকালে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সুস্পষ্ট ভাষায় বলেন: “আমি বাংলাকে বরাবর একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ভেবে আসছি, ভারতের কোন ইউনিয়নের অংশ হিসেবে নয়।

হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কর্তৃক উত্থাপিত অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের প্রতি জিন্নাহর দৃষ্টিভঙ্গি কী ছিল এ সম্বন্ধে দেশের শিক্ষিত সমাজ, রাজনৈতিক ভাষ্যকার এবং নেতৃবর্গের মধ্যে ভিন্নমত থাকলেও সম্প্রতি এ প্রস্তাব সম্পর্কে জিন্নাহর প্রকৃত অবস্থানটি অজানা নেই।  ১৯৪৭ সালের ২৬ এপ্রিল এক সাক্ষাৎকারে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ভাইসরয়কে জানান যে, পর্যাপ্ত সময় পেলে তিনি বাংলার অখণ্ডতা বজায় রাখতে সক্ষম হবেন এবং এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত। তিনি এ মর্মে জিন্নাহর সম্মতি আদায় করতে সক্ষম হবেন যে, যদি বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ রাখা হয় তাহলে এর পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আবশ্যকতা নেই। তিনি আরও বলেন, বাংলার কমনওয়েলথের সদস্য হিসেবে থাকার সর্বপ্রকার ইচ্ছা রয়েছে। একই দিন মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভাইসরয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এলে ভাইসরয় তাকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রস্তাব সম্বন্ধে অবহিত করেন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের বাইরে রেখে এর অখণ্ডতা বজায় রাখা সম্পর্কে তার মতামত সরাসরি জানতে চান। কোনরকম দ্বিধা ছাড়াই জিন্নাহ জবাব দেন: আমার আনন্দিত হওয়ার কথা। কিন্তু কলকাতা ছাড়া বাংলার মূল্য কোথায়? তারা বরং অবিভক্ত ও স্বাধীন থাক, আমি নিশ্চিত যে তারা আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলবে। কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত থাকা সম্পর্কে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী যে ইচ্ছা প্রকাশ করেন তার প্রতি জিন্নাহর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “অবশ্যই আমিও যেমনটি আপনাকে ইঙ্গিত দিয়েছি যে পাকিস্তান কমনওয়েলথের অন্তর্ভুক্ত থাকতে চাইবে।” মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং লিয়াকত আলী খান পরে বিভিন্ন সময়ে বাংলার অখণ্ডতা ও স্বাধীনতার প্রশ্নে একই অভিমত ভাইসরয় এবং তার স্টাফদের কাছে ব্যক্ত করেন। তারা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, বাংলার মুসলমান জনসাধারণের মাঝে এ প্রস্তাব আপাতত গ্রহণযােগ্য হবে না।

তারা এখন অখণ্ড পাকিস্তানের স্বপ্নে বিভাের। আর সেই স্বপ্নের গােড়াপত্তন করেছিল বাংলার তিন জনপ্রিয় নেতা। তাদের পরিশ্রম ও দক্ষতা দ্বারা । জিন্নাহ-লিয়াকত তাদের দ্বারা কাজ করিয়ে নেওয়ার পর দল থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেন। বিপরীতে সেই স্বপ্নকে দীর্ঘায়িত করার জন্য খাজা নাজিমুদ্দিন প্রমুখের মতাে নেতা সক্রিয় রয়েছেন। অন্যদিকে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন অখণ্ড বাংলা হবে প্রকৃত অর্থেই একটি শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ দেশ। মুসলমানদের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের উভয় গ্রুপকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন। এ পর্যায়ে ‘খাজা গ্রুপ বা অখণ্ড পাকিস্তানপন্থীরা এ ধারণা পােষণ করতে থাকে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে বন্ধনহীন অবস্থায় বাংলার মুসলমানরা ঐক্যবদ্ধ হিন্দুস্থানের শক্তি মােকাবেলা করতে সমর্থ হবে না। এবং কালক্রমে বাংলা ভারতের একটি অংশে পরিণত হবে বলে তারা আশঙ্কা করেন। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান সর্বদা চেয়েছেন কলকাতার পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানে লাহাের যেন অন্তর্ভুক্ত থাকে। তখনকার ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে শেরে বাংলা ফজলুল হক, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিম ছিলেন জনপ্রিয় ও শীর্ষস্থানীয় বাঙালি নেতা।

বাঙালির জাতি-রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে তাদের আগ্রহ ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা তাঁদের চিন্তাকে যৌক্তিক পরিণতিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য দূরদর্শিতা ও দৃঢ় মনােবলের পরিচয় দিতে ব্যর্থ হন। এ ব্যর্থতার নানা কারণ থাকতে পারে, তবে তাদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের সংঘাত ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব প্রবল থাকায় তারা ঐতিহাসিক পর্যায়ে বাঙালির জাতি রাষ্ট্র গঠনে প্রয়ােজনীয় ও ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হননি। নিখিল ভারত মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব ও বাঙালি নেতাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় সম্পর্ককে পাকিস্তানি নেতারা পরিকল্পিত একীভূত পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজে লাগিয়েছে।” পাকিস্তান কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ কিংবা পাকিস্তান সরকার বাঙালি নেতৃত্বকে প্রতারণার আবর্তে ঠেলে দিয়েছে। ক্ষমতার লােভ ও পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে তারা সার্থকভাবে কাজে লাগিয়ে বৃহত্তর জনশক্তিকে দাঙ্গা, ধর্মীয় উন্মাদনায়, সার্থকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছে। শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হকের আদর্শগত কোন দৃঢ় অবস্থান ছিল না। ডাল-ভাতের স্লোগান দিয়ে সাধারণ-কৃষক-প্রজাদের কাছে বিশেষ করে মহাজনী সুদ প্রথা বাতিল করার প্রতিশ্রুতি শেরে বাংলা ফজলুল হককে জনপ্রিয় করলেও স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অবদান ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয় হয়ে থাকবে। যদিও তার স্বপ্নরাজ্য ছিল বৃহত্তর বাংলা। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বংশগত আভিজাত্য, তার সমগ্রোত্রীয় বলয় ভেদ করে প্রথম থেকেই তিনি উচ্চ মহলে প্রভাব বিস্তার করলেও প্রথম দিকে জনগণের কাছে জনপ্রিয়তা ১৯৪৬ সালের পূর্বে তেমনটি ছিল না। এই দুই নেতৃত্বের দূরদৃষ্টির অভিজ্ঞতা ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র স্থাপনের পক্ষে ঐক্যসূত্রে গ্রথিত ছিল না। এই দ্বন্দ্বের বিভিন্ন রূপ পর্যবেক্ষণ করব আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল পর্যন্ত। প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের হাতে তারা জিম্মি হয়ে পড়েন। বাংলার জনগণ ধর্মান্ধতার কবলে বন্দি। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রীয় কাঠামাে, শাসন ব্যবস্থা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ও দখল, প্রাসাদ ষড়যন্ত্র, কেন্দ্রীভূত শাসন ও কর্তৃত্ব সর্বদাই জনগণকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা করেছে। 

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধ সত্যের মুখোমুখি – অধ্যাপক আবু সাইয়িদ

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!