মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নগ্নরূপ
আমেরিকার সদর দপ্তর থেকে সুস্পষ্টভাবে ঘােষণা করা হয়েছে যে কোন রাজনৈতিক কারণের অজুহাতে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করা হবে না। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থার সদস্যরাও মার্কিন সরকারের সঙ্গে একই মত পােষণ করেন। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতি যাই হােক না কেন, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ,
পশ্চিম জার্মানী, বৃটেন, জাপান ইত্যাদি দেশ পাকিস্তানকে যথারীতি আর্থিক সাহায্যদানে বিরত থাকবে না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার অনুগামীরা দ্বৈত নীতি গ্রহণ করেছে। এরা বাঙলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের জন্য সাহায্য প্রেরণ করে ভারত সরকারকে তুষ্ট করতে চায়, অন্যদিকে পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে সর্বপ্রকার আর্থিক সাহায্য দিয়ে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ধ্বংস করতে বদ্ধপরিকর। এটাই হল বিশ্বব্যাপী উপনিবেশবাদের পতনের যুগে সাম্রাজ্যবাদের নতুন কৌশল। মার্কিন সাম্রাব্যবাদীরা সরাসরি বাঙলাদেশ দখল করবে না কিন্তু তাদেরই দালাল ও সাহায্যপুষ্ট ইয়াহিয়া খানকে দিয়ে জোর জবরদস্তি করে মারণাস্ত্রের সাহায্যে বাঙলাদেশকে পাকিস্তানের মধ্যে পদানত করে রাখতে চায়। এই কারণেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিয়ে চলেছে এবং সরাসরি ঘােষণা করেছে যে কোন রাজনৈতিক কারণের অজুহাতে সেই সাহায্য বন্ধ করা হবে না।
মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের এই কৌশল নতুন নয়। ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার পতন এবং সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রের উত্থানের পর রাজনৈতিক ভৌগলিক মানচিত্রের পরিবর্তনের পরেই বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ তথা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের কৌশল পরিবর্তন করেছে। নতুন উপনিবেশ সৃষ্টি করার সামর্থ্য হারিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশ ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নানা কৌশলে আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করাই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব রণকৌশল। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় এমন কোন সদ্য স্বাধীন দেশ নেই যাদের বিরুদ্ধে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়নি।
ভিয়েতনামে সরাসরি মার্কিন আগ্রাসন ও গণহত্যা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিশ্ব-রণকৌশলের অংশ। মার্কিন স্বার্থেই এবং তাদের সাহায্যপুষ্ট হয়ে ইস্রাইল স্বাধীন আরব প্রজাতন্ত্রকে উচ্ছেদ করার জন্য যুদ্ধ ঘােষণা করেছিল। লক্ষ্য হল আরব প্রজাতন্ত্রী সরকারের পরিবর্তে দালাল সরকার প্রতিষ্ঠা করে আরব জগতের তৈল সম্পদ করায়ত্ত করা। চিলি, বলিভিয়া এবং পেরুতেও মার্কিন একচেটিয়া পুঁজিপতিদের ষড়যন্ত্র সুবিদিত। চিলিতে প্রগতিশীল সরকার যাতে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন না হতে পারে তার জন্য মার্কিনীদের অন্তর্ঘাতমূলক কাজ সংগঠিত করার ক্ষেত্রে কোন প্রকার ত্রুটি ছিল না।
বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমূলে উৎপাটিত করার জন্য জাহাজ বােঝাই মারণাস্ত্র প্রেরণ এবং সর্বপ্রকার আর্থিক সাহায্য দান কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সর্বত্রই জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রধান শত্রু মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামেরও অন্যতম প্রধান শত্রুতে পরিণত হয়েছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সম্পর্কে মােহ পােষণ করে বা তাদের মিষ্ট কথায় তুষ্ট হয়ে জাতীয় মুক্তির জন্য সংগ্রাম করা যায় না। আবার এ কথাও সত্য যে কোন দেশ, ছােট হােক আর বড়ই হােক, আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও বিশ্বগণমতের সমর্থন ব্যতীত কেবল নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম আন্তর্জাতিকতাবাদের বিশিষ্ট অংশ হিসেবেই সাফল্য অর্জন করতে পারে। জাতীয় মুক্তিসগ্রামে ইতিহাসই এই সত্য প্রমাণ করেছে।
পাকিস্তানকে মার্কিন সামরিক ও আর্থিক সাহায্য কেবল বাঙলা দেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে সীমিত নয়, ভারতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনের অংশ হিসেবে গণতন্ত্রের বিকাশের বিরুদ্ধেও সম্প্রসারিত। পাকিস্তানকে সামরিক ও আর্থিক সাহায্য দানের নিগুঢ় অর্থই হল ভারতে গণতন্ত্রের প্রতি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের চ্যালেঞ্জ। এর অর্থ হচ্ছে, মার্কিন অস্ত্রে ইয়াহিয়া খানকে সুসজ্জিত করে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম ও ভারতের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ঘাঁটি স্থাপন করা। গত লােকসভা নির্বাচনে মার্কিন প্রেমীদের পরাজয়ের ফলে ভারত সরকারের উপর চাপসৃষ্টি করার জন্য মার্কিন সরকার এই দ্বৈত-কৌশল অবলম্বন করেছে।
এই দ্বৈত কৌশল সম্পর্কে যদি ভারত সরকারের কোন মােহ বা সন্দেহ থাকে তা হলে কেবল বাঙলাদেশের সর্বনাশ হবে না ভারতের ভবিষ্যতও বিপন্ন হবে।
সূত্র: কালান্তর, ৩০.৬.১৯৭১