You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.07 | বাংলাদেশের সংগ্রাম চলছে চলবে- ননীগােপাল দাস | দর্পণ - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশের সংগ্রাম চলছে চলবে
ননীগােপাল দাস

মুক্তি ফৌজের পরামর্শ ও সহায়তায় আমার প্রিয় জন্মভূমি ছেড়ে এ পার বাংলায় আমি এসেছি। হিলিতে ওপার থেকে তাড়া খাওয়া মানুষের সঙ্গে দু’দিন শরণার্থী শিবিরেও কাটিয়েছি। দীর্ঘ ষােল বছর পর আমি এ দেশে এলাম।
এখানে আসার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আমি মুক্তিবাহিনীর একটি শিক্ষাশিবিরের মেডিকেল অফিসার ও পরামর্শদাতা ছিলাম। স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা ও আমার ব্যক্তিগত মুসলিম বন্ধুরা যখন নিশ্চিতভাবে বুঝলেন যে, বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল সংস্কৃতিসেবী ও হিন্দু হিসেবে পাক জঙ্গি বাহিনীর হাতে সপরিবারে আমার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পুরােপুরি আশঙ্কা রয়েছে, তখনই তারা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে বিদেশে কাজ করার জন্য।
পূর্ব দিগন্তে আজ থেকে নতুন সূর্য প্রদীপ্ত। আমি সেই সবুজ, হরিত ও লালের দেশ বাংলাদেশের নাগরিক। আমরা এক অসম মরণ যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছি- এ একটা যুদ্ধ। যুদ্ধই বা বলি কেন এ হচ্ছে বাঙালি নিধনযজ্ঞ বাঙালি জাতির শিক্ষা, সভ্যতা ও সংস্কৃতি মুছে ফেলবার মরণপণ লড়াই। নির্মম জঙ্গিশাহীর প্রয়ােজন শুধু বাংলার মাটিটুকুর আর সবকিছুই তারা ধুয়ে মুছে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায়। নইলে তারা এই সেদিন (একুশে এপ্রিল) আমার নিজের জেলা বগুড়ার পাঁচবিবিতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে এসে হাটের দিনে মেশিনগান বসিয়ে হাজার হাজার নিরস্ত্র ও বেসামরিক জনগণকে বিনা প্ররােচনায় হত্যা করবে কেন?
আমরা জানি এটা আমাদের মুক্তি সংগ্রাম। বিশ্ব যদি আমাদের পাশে এসে নাও দাঁড়ায় তবুও এ যুদ্ধ আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। জানি এ যুদ্ধ হবে দীর্ঘস্থায়ী ও রক্তক্ষয়ী। সংকল্পে অটল বীর মুক্তিযােদ্ধারা এই সংগ্রামকে সাফল্যের মঞ্জিলে পৌছে দেবেই। বাংলাদেশ এক নতুন যুগের সূচনা করল। আমরা সেই নতুন যুগের অগ্রপথিক। বাংলাদেশে যা ঘটছে জাতিসংঘের সংজ্ঞায় তা রীতিমতাে গণহত্যা। এতে সভ্যজগতের বিবেক শিহরিত হওয়া উচিত ছিল। তবুও সেই পাষাণ দেবতাকে আমরা টলাতে পারিনি। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে উভয়পক্ষ মিলে ছয়-সাত হাজারের বেশি নিহত হয়নি। তাতেই জাতিসংঘ চঞ্চল হয়ে উঠেছিল, নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডেকে যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছিল। তারপর তাসখন্দ চুক্তি। বর্তমান যুদ্ধে ছয়-সাত লক্ষ লােক নিহত হয়েছে, সম্পত্তির ক্ষয়ক্ষতি গত চার সপ্তাহে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকা মূল্যের। তবুও জাতিসংঘ নিশ্ৰুপ। রাষ্ট্রসংঘের বৈঠকখানা শুধু বৃহৎ শক্তিবর্গের রাজনীতির দাবাখেলা ও কূটনীতির কুটিল লড়াইয়ে মত্ত। সেখানে মানবতার প্রশ্ন নেই মানবাধিকার সেখানে তুচ্ছ। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যতদিন এটা পাক-ভারত যুদ্ধে রূপান্তরিত না হয়, ততদিন জাতিসংঘ আসরে নামবে না। উ থান্ট কি একটা যুদ্ধই চান? তাই আজ আর জাতিসংঘের নিষ্ঠুর বিবেকের কাছে আবেদন-নিবেদন নয়, আজ তার বিরুদ্ধে ধিক্কার ও বিক্ষোভ প্রদর্শনের দিন। জাতিসংঘ হয়তাে গণহত্যা বন্ধ করতে পারে। কিন্তু তাতে স্বাধীন বাংলাদেশ বাস্তবায়িত হবে না। আপােস-আলােচনা এ অবস্থায় অর্থহীন। আমরা দ্বিতীয় তাসখন্দ চাই না। আমাদের লড়তে হবে। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমরা চাই অস্ত্রশস্ত্র। চালাবার জন্য উপযুক্ত ট্রেনিং এবং রণকৌশল শিক্ষা। শুধু শরণার্থীদের সেবা, মেডিকেল রিলিফ ক্যাম্প ও বেস হসপিটাল স্থাপন করাটাই যথেষ্ট নয়। বিভিন্ন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি কোটি কোটি টাকা তুলছেন। তারা কি সেই অর্থ দিয়ে আমাদের অস্ত্রসজ্জায় সজ্জিত করতে পারেন না? এমনকি কয়েকটা ট্রান্সমিটারও কিনে দিতে পারেন না? কবি শিল্পীরা কি দেশাত্মবোেধক কবিতা রচনা করে এপার-ওপার বাংলার একাত্মতা ঘােষণা করেই ক্ষান্ত থাকবেন? রাজনৈতিক দলগুলাে কি আমাদের হাতিয়ার যােগান দিতে পারেন না?
সংকল্পে অটল মুক্তিযােদ্ধারা কখনই আত্মসমর্পণ করবে না। আমরা বিশ্বাস করি সামরিক একনায়কতু চিরস্থায়ী হতে পারে না। আমরা জানি উপনিবেশবাদের দিন শেষ হয়ে গেছে। গৃহশত্রুদের খতম করে আমাদের এগােতে হবে। ইয়াহিয়া খানের এডভেনচারিজম-এর সমুচিত জবাব আমরা দেবই।

সূত্র: দর্পণ
০৭.০৫.১৯৭১