You dont have javascript enabled! Please enable it!

পাকিস্তানে বরফ গলছে

পশ্চিম পাকিস্তানে বরফ গলতে শুরু করেছে মনে হয়। জাতীয় পরিষদ বর্জনের হুমকি দেবার পর সুর খানিকটা নরম। করাচীতে ভুট্টোর পিপলস পার্টির সংসদীয় সম্মেলন থেকে ঘােষণা করা। সর্বসম্মতিক্রমে সংবিধান রচনার আশ্বাস পেলে পিপলস পার্টি ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে প্রস্তত। সেক্ষেত্রে পিপলস পার্টি সংবিধানের প্রশ্নে আওয়ামী লীগের সঙ্গে এক চুক্তিতে আবদ্ধ হবে ও পূর্ণ সহযােগিতা করবে। তাছাড়া সম্মেলন থেকে বলা হয়েছে, পিপলস্ পার্টি যথাসম্ভব অসামরিকসরকার গঠনের জন্য উদগ্রীব।
এ থেকে বােঝা যায় পাকিস্তানের নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ বর্জন সম্পর্কে ভুট্টোর দলে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। তার কারণ ও আছে। কোনাে পার্টি যদি জাতীয় পরিষদ বর্জন করে তবে সামরিক শাসনকর্তার পূর্বঘােষিত ফতােয়া অনুযায়ী ধরে নেওয়া হবে সেই পার্টি নির্বাচনে যােগ দেয়নি আর তার অবশ্যম্ভাবী পরিণতি সামরিক শাসনকেই বহাল রাখা। পূর্ব-পাকিস্তানকে যারা শােষণ ও দোহন করে পশ্চিম-পাকিস্তানের সেই শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী গােষ্ঠী এবং তাদের সলাপরামর্শদাতা সাম্রাজ্যবাদীরা ভূট্টোকে সামনে রেখে পাকিস্তানকে সেই অবস্থায় ঠেলে দেবার জন্যই চাল চেলেছিল। কিন্তু পশ্চিম-পাকিস্তানেরও সাধারণ মানুষ যে নির্বিবাদে তার শিকার হতে চাইবে না ভুট্টোর দলের একাংশও হয়তাে তা বুঝতে পেরেছেন। কাশ্মীর সমস্যাকে সামনে রেখে ভারত থেকে আক্রমণের জুজুর ভয় দেখিয়ে বা পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অধিবাসীদের সঙ্গে প্যান-ঐস্লামিক ঐক্য স্থাপন করে পাকিস্তানের ঐক্যের নামে অগণতান্ত্রিক শাসন কায়েম রাখার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। ভুটো যে ঐস্লামিক সমাজতন্ত্রের ফানুস সৃষ্টি করেছিলেন তা ফুটো হয়ে চুপসে গেছে। শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের যে ভাবমূতি গড়ে তুলেছে তাকে আর অস্বীকার করা সম্ভব হচ্ছে না।
গােটা পাকিস্তানের প্রায় সাত কোটি অর্থাৎ শতকরা ৫৬ জনের সমর্থন রয়েছে আওয়ামী লীগের পেছনে। ভুট্টোর পিপলস পার্টি যে অঞ্চলের সমর্থন পেয়েছে তার লােকসংখ্যা পাঁচ কোটির অধিক নয়। জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩ টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ যে কেবল আসনের দিক দিয়েই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে এমন নয়, জনসংখ্যারও অধিকাংশের আস্থাভাজন হয়েছে। সংখ্যালঘু অংশের সমর্থনে ভুট্টোর পিপলস পার্টি পেয়েছে ৮৫টি আসন। সুতরাং এ অবস্থায় আওয়ামী লীগকে সংবিধান রচনায় কোনাে দল বাধা দিলে গণতন্ত্রহস্তা রূপেই সে চিহ্নিত হবে। এসব কথা বিবেচনা করেই হয়তাে মৌলানা মৌদুদীর সাত সদস্যক দল জামিয়াৎ-উল-ইসলাম জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জাতীয় আওয়ামী লীগ নেতা খান আবদুল ওয়ালী খান ও পাকিস্তান ডেমােক্র্যাটিক পার্টির সভাপতি মি. নুরুল আমানত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে কেউ ১৫ দিন অনুপস্থিত থাকলে তার সদস্যপদ খারিজ হবে এরূপ বিধান থাকায় পাকিস্তান মুসলিম লীগের একাংশের মধ্যেও দোমনা ভাব দেখা দিয়েছে। এই অংশের নায়ক খান আবদুল কাইয়ুম খান আওয়ামী লীগের “একগুয়েমিতে” বিরুক্তি প্রকাশ করলেও ফেডারেল সরকারের অধিকার সম্বন্ধে কিন্তু আওয়ামী লীগের দাবির সঙ্গে অনেকখানি একমত। তিনিও চান ফেডারেল সরকারের হাতে প্রতিরক্ষা পররাষ্ট্র ও মুদ্রা নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাক। অতএব লীগের এই অংশও যে শেষ পর্যন্ত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবে না এমন কথা বলা যায় না।
আওয়ামী লীগ একদিকে ভাসানীর উগ্র সংকীর্ণতাবাদ এবং অন্য দিকে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ও সাম্প্রদায়িকতাবাদের কোনঠাসা করে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের যে বুনিয়াদ রচনা করেছেন তারই উপর রচিত হবে পাকিস্তানের ভাবী সমৃদ্ধির সৌধ। প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্রীড়নক ভুট্টোর সমস্ত চক্রান্ত ব্যর্থ হতে বাধ্য।

সূত্র: কালান্তর, ২৪.২.১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!