বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গত পঁচিশ বছর কী সংগ্রাম আমাদের করতে হয়েছে এবং এই স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এখনও কত রকম চক্রান্তের মােকাবিলা করে চলেছি, তার একটা রেকর্ড আমি রেখে যেতে চাই। বললাম ; তাড়াহুড়াের কি আছে? আপনি দেশে নতুন শাসন পদ্ধতি প্রবর্তন করছেন। এসব ঝামেলা চুকিয়ে ধীরেসুস্থে আবার লেখার ডিকটেশন দেবেন। আমি ততদিনে দেশে ফিরে আসবাে। মুজিব বললেন : সময় পাব না। তােমাকে বলছি, যেকোন মুহুর্তে আমাকে হত্যা করা হতে পারে। দেশে একদিন তুমি ঠিকই ফিরবে, কিন্তু ফেরার আগেই হয়তাে শুনবে তােমার মুজিব ভাই আর নেই। একটা বুলেট আমাকে চেজ করে ফিরছে। কখন বুকে বিধবে আমি নিজেও জানি না। কথাটা কোন রাজনীতিকের ছলনা, না তার মনের প্রকৃত শংকা, সেদিন আমি তা বুঝতে পারিনি। বরং মনে হয়েছিল, এটা তার রাজনীতিবিদসুলভ ছলনা। মনের প্রকৃত কথা নয়।
এই সাক্ষাতের বাইশদিন পরে-১৫ আগস্ট সকালে যখন লণ্ডনে বসে শুনলাম। মুজিব নেই, সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত, তখন তার সে কথাই বার বার আমার মনে পড়েছে, একটা বুলেট আমাকে চেজ করছে। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে একটা কথাই ভেবেছি, দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পাব না। মুজিব আকস্মিকভাবে নিহত হয়েছেন। কিন্তু এমন শােচনীয় পৱিণতি তার ঘটতে পারে এ শংকা তার মনে বেশ কিছু কাল ধরেই কাজ করছিলাে। কেন এ ধরনের শংকা পােষণ করছেন, তা তিনি আভাসে-ইংগিতে অনেক বার প্রকাশ করেছেন। ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক এম, আর, আখতার লণ্ডনে বাংলাদেশের প্রেস কাউন্সিলার নিযুক্ত হন। লণ্ডন যাত্রার আগে শেখ সাহেবের কাছে বিদায় চাইতে গেলে তিনি বলে ওঠেন, দেশে ফিরে এসে আমার কবরে দুমুঠো ফুল ছিটিয়ে দিস’।
মুজিবের মৃত্যুর কিছুদিন আগে বাংলাদেশের পাকিস্তানী আমলের অন্যতম মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান বয়স হওয়ার দরুণ নানা রােগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে আসেন। মুজিবের সংগে দেখা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বুড়াে হয়েছি। নানা রােগ নিয়ে বিদেশে চিকিৎসার জন্যে চলেছি। আমার জন্য দোয়া করবেন। শেখ সাহেব হেসে বললেন : আপনার জন্য দোয়া অবশ্যই করছি। কিন্তু আমার জন্যও আপনি করবেন। দেশে ফিরে হয়তাে আমার জানাজাতেও যােগ দেয়ার সুযােগ পাবেন না।’
১৯৭৩ সালের শেষদিকে প্রথম লক্ষ্য করি, বঙ্গবন্ধু তার অস্বাভাবিক মৃত্যুর কথা ভাবছেন এবং বলছেন। মৃত্যুভয় তার ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য যে কাজ তিনি করতে চান, আততায়ীর গুলি হয়তাে শেষ পর্যন্ত তাকে তা শেষ করতে দেবে না, এমন একটা শংকা তিনি পােষণ করতে শুরু করেছিলেন। ‘৭৩ সালের আগস্ট মাসে তিনি আমাকে ডেকে পাঠান। প্রেসিডেন্ট হাউসে গিয়ে পৌছতেই তিনি আমাকে একান্তে ডেকে নিয়ে বললেন : আত্নজীবনী লেখার কাজ শুরু করতে চাই। আমার ভাষা নেই। আমি বলে যাব, তুমি লিখবে, এমন একটা করা কি সম্ভব? বললাম ; তা সম্ভব। আপনি যা বলবেন , তা আমি টেপ রেকর্ডে ধরে রাখব এবং নিজেও সংগে সংগে লিখে রাখবাে। তবে আপনার যা ব্যস্ততা, তাতে আপনি কি সময় করতে পারবেন? শেখ সাহেব বলেন : আমাকে সময় করতেই হবে। নইলে আর সময় পাব ন। ওরা আমাকে সময় দেবে না। কেবল সুযােগ খুঁজছে, কখন হত্যা করবে। এই প্রথম তার মুখে একটা চক্রান্তের ইংগিত পেলাম। জিজ্ঞাসা করলাম : আপনি কি সত্যি সত্যি ভাবছেন, কেউ আপনাকে হত্যা করতে চায়? মুজিব বললেন : তুমি সাংবাদিক, তােমাকে একথা মুখ ফুটে বলতে হবে কেন? তুমি কি বুঝতে পার না,কারা আমাকে হত্যা করতে চায় এবং কেন চায়। এরপর সেদিন আর কথা এগােয়নি।
Reference: ইতিহাসের রক্তপলাশ-পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর – আবদুল গাফফার চৌধুরী