বাংলা বাণী
ঢাকাঃ ১৩ই জুলাই, শনিবার, ২৮শে আষাঢ়, ১৩৮১
পাট সমস্যা যথাযথ সমাধান হোক
দেশের একমাত্র বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নির্ভরযোগ্য ফসল পাট। পাট নিয়ে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি অনেক কথা বলা হয়েছে। মন্ত্রীরাও বলেছেন আমরাও বলেছি। অতীতে দেশ যখন পাকিস্তানি শোষকশ্রেণীর উপনিবেশ ছিল তখনও এই পাটের ব্যাপারে বাংলাদেশের জনগণের একটি বিশেষ বক্তব্য ছিল। এবং সে বিষয়ে তাদের কিছু দাবি-দাওয়া ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতারা তুলে ধরতেন। স্বাধীনতার পর সরকার পাট সম্পর্কে একটি বিশেষ নীতি গ্রহণ করেছেন। পাটের ব্যবসা ও পাটকল জাতীয়করণ করা হয়েছে জনগণের কল্যাণের কথা ভেবেই। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, দেশের ঐতিহ্যবাহী পাট আজ নানা বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে কৃষকরা পাট উৎপাদনে উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে। সর্বোপরি বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের নিশ্চিত ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
গত পরশুদিন আমাদের অর্থমন্ত্রী বাজেট সমাপনী ভাষণ দান করতে গিয়ে পাট সংক্রান্ত কিছু কথা বলেছেন। তার মতে, আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের পাট আজ তুমুল প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। আগে ব্রাজিল পাট নিতো এখন তারা নেয় না, কারণ তারা পাটের বিকল্প আবিষ্কার করেছেন। থাইল্যান্ড পাট নিতো, তারা নিজেরাই পাট রপ্তানি করে। ফিলিপাইন আমাদের পাট কিনতো এখন তারা থাইল্যান্ড থেকে কেনে। ভারতের মোট ১১৫টি পাটকল আগে আমাদের পাটের উপর নির্ভরশীল ছিল এখন তারা নিজেরাই পাট উৎপাদন করছে এবং অধিক পাট উৎপাদনের জন্য তারা তাদের কৃষকদের বস্তুগত সাহায্য বৃদ্ধি করে উৎসাহিত করছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারত আজ আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। অর্থমন্ত্রীর এ অভিমত থেকে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের পাটের বাজার হতাশাব্যঞ্জক বলে ধরে নেওয়া যায়। ঠিক একই দিনে আমাদের প্রতিমন্ত্রীর নারায়ণগঞ্জের ‘শুভ পাট ক্রয়’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করতে গিয়ে বেশ জোরের সঙ্গে ঘোষণা করেছেন যে, বাংলাদেশ পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বাজার প্রায় হারিয়েছিল, সৌভাগ্য ও গর্বের কথা যে দেশ আবার তার পুরনো বাজার কব্জা করেছে। এখন বাংলাদেশের পাট ও পাটজাত দ্রব্য ভারতের চেয়ে বেশি দামে রপ্তানি হচ্ছে। একই দিনে প্রকাশিত পাট সম্পর্কিত আশা-হতাশার সংবাদ পাঠ করে দেশের জনগণ নিজেদের ভবিতব্য চিন্তা করবে। পাটের আসল খবর কি–এটা আর জনগণের জানবার বাসনা।
পাটের মূল্য নির্ধারণ ও কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার বিষয়টি বর্তমানে নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। অতীতে বাংলাদেশের কৃষকদের হয়ে আজকের ক্ষমতাসীন দলই পাটের এই ন্যায্য মূল্য আদায়ের সংগ্রাম করেছে। অতীতেও তারা যেমন ন্যায্যমূল্য পায়নি–বর্তমানেও তারা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে এমন কথা জোর করে বলা যাবে না। সরকার প্রথমে প্রতি মণ পাট এর মূল্য ৫০ টাকা ধার্য করেছিলেন, পরে এ বছরের প্রথম দিকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা ধার্য করেছেন। যখন দাম বাড়ানো হয়েছিল তখন দেশের কৃষকদের ঘরে পাট ছিলনা। বাড়তি মূল্য পেয়েছে বা পাচ্ছে পাটের মজুতদাররা। দেশে যে সকল সরকারি ক্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে–তারাও যে যথার্থ নির্ধারিত মূল্যে পাট কিনবে এমন আশা করা যায় না। সরকারি ক্রয়ের মধ্যেও নানা প্রকার ঘাপলা রয়ে গেছে। দেশে এবার পাট উৎপাদন নিদারুণভাবে হ্রাস পাবে। তার প্রধান কারণ হলো উৎপাদন খরচের তুলনায় দেয় সরকারি মূল্য অত্যন্ত কম। এক হিসেবে বলা হয়েছে যে, এক মণ পাট উৎপাদনে খরচ হলো ৭৫ টাকা অথচ দেয় সরকারি মূল্য ৬০ টাকা। অবশ্য ৬০ টাকাই কৃষকরা পাচ্ছে এমন নিয়ম আজও প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি। গত পরশুদিন আমাদের পাটমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জে বলেছেন, পাট চাষীদের জন্য নির্ধারিত মূল্য প্রতি ৬০ টাকার অর্জনে সরকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মন্ত্রী সাহেবের এ উক্তিতেই বোঝা যাবে যে, আজও নির্ধারিত ষাট টাকা মণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেননি, অতএব সেটা অর্জনের জন্য সরকার কৃত সংকল্প। আগামী অর্থবছরে পাটের উৎপাদন হ্রাস পাবে এটা আজ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে। জাতীয় অর্থনীতিতে আগামী বছরেই উৎপাদন হ্রাস নিদারুণ আঘাত হানবে। সাবেক পাটমন্ত্রী গত ৫ই জুলাই একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে, কৃষকদেরকে অধিক পরিমাণে পাট চাষে উৎসাহিত করার জন্য যথেষ্ট পরিমাণে ভর্তুকি (সাবসিডি) দেওয়ার ব্যাপারে সরকার বিবেচনা করছেন। বস্তুতপক্ষে পাট চাষীদের উৎসাহ প্রদান করার জন্য আজ বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। নইলে পাটের উৎপাদন দিন দিন গোটা জাতীয় অর্থনীতি মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। বঙ্গবন্ধু নিজের হাতে পাট মন্ত্রণালয় রেখে নিশ্চিতভাবে জাতিকে আশ্বস্ত করেছেন বলে আমরা মনে করি। পাঠের বিষয়টির একটি সুষ্ঠু বিধান হোক–এটাই আমাদের কামনা।
কাকস্য পরিবেদনা!
সংবেদন অনুভূতির স্পর্শকাতরতা ভীষণ কমে গেলেও দুর্ঘটনার সংবাদ একটা আশ্চর্যান্বিত কম্পন লাগে বৈকি এখনও। আবার মিরপুরের দুইটি মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ যুগপৎ ব্যথিত, বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ হতে হয়। গত ১০ জুলাই রাত পৌনে বারোটায় একটি চলন্ত বি,আর,টি,সি বাস এবং একটির সুপিরিয়র কোচ সার্ভিস এর মধ্যে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বি,আর,টি,সি বাস খালি থাকলেও কোচটি যাত্রীবোঝাই ছিল। সংঘর্ষে ২৭ জন আহত হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করার পর একজন মৃত্যুবরণ করেন। ৭জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
পরদিন অর্থাৎ ১১ জুলাই সকাল সাড়ে ১১টায় মিরপুরের ১১ নম্বর বাস স্ট্যান্ডের কাছে আরও একটি দুর্ঘটনা ঘটে। বি,আর,টি,সি’র চলন্ত বাস একটি ৬/৭ বছরের শিশুকে চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলেই শিশুটি মারা যায়। প্রথম দুর্ঘটনার জন্য বি,আর,টি,সি’র কন্ডাকটারকে গ্রেফতার করা হয় কিন্তু পরের দুর্ঘটনায় পলাতক বি,আর,টি,সি বাসের সন্ধান পেলেও কারুকে গ্রেফতার করা হয়নি বলে থানা সূত্রের খবরে প্রকাশ।
দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছে। এইতো গত ২৩ জুন ঢাকা আরিচা সড়কে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। মাত্র দু’তিনদিনের মধ্যে পরপর চারটি বাস দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়। ফলে ৪ জন নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই ৭ই জুনে ঢাকা ডেমরা রোডে মাতুয়াইলে ও একটি মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনা ঘটে এবং তাতে ৪০ জন আহত ও ২০ জন নিহত হয়। এবং এমনিভাবেই প্রায় প্রতিদিনই দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে। অসহায় মানুষগুলো মরছে, আহত হচ্ছে, পঙ্গু হচ্ছে এবং আবারো দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে অন্যরা। যেন এ কিছুই নয়।
রাজধানীর বাইরে এবং নগরের অভ্যন্তরে উপর্যুপরি সড়ক দুর্ঘটনার উপর বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হয়েছে। দুর্ঘটনার কারণগুলি বিশ্লেষণ ও তা থেকে পরিত্রান পাওয়া সম্পর্কে সম্পাদকীয় ও উপ সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখা হয়েছে। ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকাতেও সড়ক দুর্ঘটনার উপর সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা!
দুর্ঘটনা ঘটায় প্রধানতঃ ড্রাইভার। রাস্তা খারাপ, সড়ক নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ পুলিশ নেই এবং অন্য গাড়ি অসাবধান এসবগুলিই দুর্ঘটনার সহায়ক শর্ত সন্দেহ নেই কিন্তু গাড়ির চালক সতর্ক শয়তান হলে নিজেকে বাঁচাবার অবকাশ টুকু যে সৃষ্টি করা যায় একথা অভিজ্ঞ চালকেরাই বলে থাকেন। কারন গাড়ির চাকা স্লিপ করলে চালক ই সর্বাগ্রে তা বুঝতে পারেন। আর সে কথা বোঝা সত্ত্বেও গাড়ির গতি নিয়ন্ত্রণ না করলে দুর্ঘটনা হতে বাধ্য। অনেক সময় চালকেরা গাড়ির পাশ কাটিয়ে যাবার সময়ও গতি বেগ একটুও হ্রাস করেন না। ফলে সংঘর্ষ হলে দুটো গাড়িই ছিটকে পড়ে দূরে। অথচ এসব ক্ষেত্রে সাবধান হওয়া চালকদের অবশ্য কর্তব্য। এবং এখানে চালকের নৈপুণ্য।
আবার দেখা যায় লাল বাতি জ্বলে ওঠা সত্ত্বেও ক্রসিংয়ের সামনে দুপাশ থেকে গাড়ি সাঁ সাঁ করে চলছে। এক্ষেত্রে কড়া শাস্তি ও জরিমানা দেয়ার বন্দোবস্ত রাখা উচিত। এছাড়াও লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালকদের অনেকেরই ন্যূনতম শিক্ষা নেই। গাড়ির যন্ত্রাংশের নাম ও কার্যকারিতা সম্পর্কে এরা ওয়াকিবহাল ও নয়। গাড়ি গিয়ারে রেখে ক্লাচে পায়ের চাপ দিয়েই তারা গাড়ির গতিরোধ করে। এভাবে থাকার দরুন গতিপ্রাপ্ত গাড়ি চালকের একটু অসতর্কতার সুযোগেই ছুটতে আরম্ভ করে। খেয়া পারাপারের ঢালু রাস্তায় এ কারণে প্রায়ই ছোটখাট দুর্ঘটনা বাঁধিয়ে বসে। তাই ড্রাইভিং শিক্ষার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ শিক্ষার বিধিবন্ধন অবশ্যই রাখতে হবে।
রাজধানীর বাস ও কোচ চালকদের বেলায়ও একথা প্রযোজ্য। অনেক সময় এত অল্প বয়স্ক চালকদের হাতে গাড়ি থাকে এবং এমন বেপরোয়াভাবে তারা জনবহুল রাস্তায় গাড়ি চালায় যে যাত্রীদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তদুপরি প্রায় গাড়ির স্পিডো মিটার খারাপ থাকায় প্রকৃতপক্ষে গাড়ি কত গতিতে চলছে তা কারুর বোঝার উপায় থাকে না। মনে রাখতে হবে যে গাড়ি একটা যন্ত্র। এর প্রতিটি যন্ত্রাংশকে তাই ঠিক রাখতে হয়। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য একটা অন্যতম প্রধান উপায় বটে।
পরিশেষে এই বেপরোয়া দুর্ঘটনার জন্য সংশ্লিষ্ট মহল সচেতন হোক এটাই আমাদের দাবি। নিরীহ যাত্রীসাধারণের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার অধিকার তাদের নেই। এবং বাসগুলি ধ্বংস করারও কোনো এখতিয়ার তাদের নেই। জান ও মালের ধ্বংসকে রোধ করতেই হবে। আমরা চাই আমাদের যাত্রা হবে নিরাপদ। ও কিছু নয় -বাতাস বলে দুর্ঘটনাগুলোকে এড়িয়ে গেলে চলবে না।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক